আমার বাসার ২০০৭ সালের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি বাইরের দিকে। রাস্তার স্ট্রীট ল্যাম্পের অস্পস্ট আলোতে ঝাপসা ২০০৮ সাল ক্রমশ: স্পস্ট হয়ে উঠছে। ঘড়ির কাঁটা ধরেই আসছে নতুন বছরের ঝাঁপি। মেনে নিই আর অস্বীকার করি, ঘড়ির কাঁটাকে কি আর অস্বীকার করা যায়? সময়ের বাস্তবতার কাছে জীবনের বাস্তবতা বড্ডো অসহায়। এমনিতে আমরা নিজেরা বড়ই নিয়তিনির্ভর মানুষ। তার সাথে জড়ো হয়েছে আমাদের বিশ্বাস। ভাগ্যের চাকা বদলাতে আমরা বিশ্বাস আর নিয়তির কাছে সমর্পণ করে স্বস্তি খুঁজে বেড়াই। তাই, ২০০৮ সাল অন্যদের জন্য আবেদন আনলেও আমার কাছে মনে হয় পুরনো পোশাক ছেড়ে নতুন বছরের মোড়কে বাঁধা রঙিণ পোশাক পড়ে নিচ্ছি। এধরণের এক নিরুত্তাপ নিরুত্তেজিত ভাবনাকে অন্তরঙ্গ করেই সচলের সব ব্লগারদের এক চিমটে নববর্ষের শুভেচ্ছা।
জীবনটা বড্ডো অদ্ভুত। আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনধারায় অভ্যস্ত অনেকের বড়ো হওয়া হয়েছে মানিয়ে নেওয়ার রেওয়াজ রপ্ত করার মধ্যে। ভদ্রতার মুখোশ মুখের মধ্যে সেঁটে ভদ্র সভ্য হবার ভব্যতা প্রমানের প্রাণান্তকর চেস্টায় লিপ্ত থাকি। তাই, যখন ভীষণ অন্যায় দেখি, অনাচার দেখি, আর ভন্ডামী দেখি তখন হা হুতাশ করা ছাড়া কোন উপায় খুঁজে পাই না। মনে মনে ঘৃণা পুষি। বিষোদগার করি। নীরবে প্রতিবাদ করি। গা বাঁচিয়ে মিন মিন স্বরে বলি "বড্ডো অন্যায়" হয়েছে। নীরব প্রতিবাদ সরব হয়ে ঘরের চৌকাঠ অতিক্রম করার সাহস খুঁজে পায় না। প্রতিবাদী হওয়ার চেয়ে আপোষবাদী তোষামোদী মনটা নিজের মধ্যে স্বস্তি আর তৃপ্তি খুঁজে বেড়ায়। দেশটা উল্টো পথে হাঁটছে, তাতে কি? আমরা ভাল আছি। আমি খুঁজে বেড়াই আমার আর আমার পরিবারের নিরাপত্তা আর উন্নতি। আমার ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার মধ্যে সমস্টিগত উতক্রান্তির কোন ভাবনার ঠাঁই নেই। এভাবে দেশবিচ্ছিন্ন এক একটা মনন দূরে ঠেলে দিচ্ছে এই দেশের উত্তরণের সকল সম্ভাবনাকে।
তাই হতাশায় ঘেরা ২০০৭ সালের লেন্সে যখন আগামী বছরটা দেখি তখন তাতে আশার প্রদীপ জ্বলে না। আনন্দ আর উতসবের ছবিটা একবারও মনে ভাসে না। গত বছর এই সময়ে অনেকটা সংকট পেরিয়ে আমরা কিছুটা আশার আলো দেখছিলাম। তারপর একে একে আমাদের প্রত্যাশাগুলো নির্মম বাস্তবতার আঘাতে চুরমার হয়ে গেল। আমরা ক্রমেই বুঝতে থাকলাম আমাদের রাস্ট্রযন্ত্র কি চমতকারভাবে আগ্রাসী আর স্বৈরশক্তির ঔদ্ধত্যের কাছে পরাভূত হয়েছে। ময়ূরপুচ্ছ ধারণ করলেই কি নেকড়ের দলের আচরণ বদলায়? সুশীল সমাজের পেখমে এদের নখর আর ক'দিন আড়াল করে রাখা যায়? তা ক্রমশই স্পস্ট হয়ে উঠছে। কস্টে বুকটা ভারী হয়ে উঠে। মনটা প্রতিবাদী হয়। যোদ্ধা হয় না। গা বাঁচিয়ে ঘৃণা পুষি। কলমের আঁচড়ে বদলে দিতে চাই চারদিক। নির্মাণ করতে চাই এক নতুন সমাজ আর মননের ভিত্তি। স্বপ্নে বসতবাড়ী গড়ি। ভাবি নিজের জীবনকালেই দেখে যাব শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। এধরণের আশাকে অবলম্বন করে কীবোর্ডের উপর আঙ্গুল সচল হতে থাকে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে।
গত এক বছর এদেশের সামরিক সরকার সিভিল পোশাকে ক্রমেই জেঁকে বসেছে দেশটার বুকের উপর। দমবন্ধ একটা পরিবেশে আমরা ভাবছি বদলাবে স্বদেশ। ফিরবে গণতন্ত্র। সামরিক বাহিনী ফিরবে ব্যারাকে। সবই বৃথা আশা। এদেশে সামরিক বাহিনী কখনও ব্যারাকে ফেরার জন্য বেরিয়ে আসে না। ছলে বলে রাস্ট্রযন্ত্রটাকে তারা কবজায় নিয়ে আসে। নিপীড়ন আর পেষণের কৌশল বদলেছে। মিথ্যে মামলার শিকার হয়ে অসহায়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জেলের গরাদে মুক্তির প্রহর গুণছেন। একজন তরুণ কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানকে জেলে পুরে সামরিক যন্ত্র ধর্মান্ধ শক্তির মাথায় ক্রমাগত হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারে নিস্ক্রিয় রাস্ট্রযন্ত্র সামরিক গোয়েন্দাদের সাহায্যে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ধোঁয়া তুলে আর পুষে গণতন্ত্রের দাবী থেকে গণদাবীকে দূরে সরিয়ে রাখার অপপ্রয়াস অব্যাহত রেখেছে।
একটি অনির্বাচিত তত্বাবধায়ক সামরিক সরকার এই রাস্ট্রকে যে ব্যর্থ করে চলছে তা দিনের আলোর মতো ক্রমেই স্পস্ট হয়ে উঠছে। রাস্ট্রযন্ত্র হারাচ্ছে স্বচ্ছতা। প্রভুদের পদলেহন প্রকট হয়ে উঠছে। রাস্ট্রবিরোধী চুক্তি করে দেশের অমূল্য প্রত্নসম্পদ বিনস্ট করেছে। রাস্ট্র ব্যক্তি আর গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থে। বিচার ব্যবস্থাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। সুবিচারের আশা অদূর ভবিষ্যতে সুদূরপরাহত। সুশীল সমাজকে কিনছে। রাজনৈতিক নিয়োগ দিচ্ছে। তোষামোদের দল তৈরীর জন্য করেছে এনবিআর সম্মেলন। আর কতো? তিরিশ লাখ শহীদ হয়েছে কিছু হঠকারী রাস্ট্রদ্রোহীর কাছে দেশকে পণবন্দী করে রাখার জন্য? এই সরকারের নৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রকট হয়ে উঠছে। তাদের একমাত্র সাফল্য হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক বেশ্যাবৃত্তিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে। হঠাত করেই সুশীলসমাজ একটি স্বৈরাচারী সরকারের বন্দনায় আত্মনিবেদিত হয়ে উঠেছে।
সেদিন আমার এক বন্ধু ই-মেইলে জানাল, মানবাধিকার বিষয়ে সোচ্চার একটি ব্লগগোষ্ঠীর একজন পুরোধা আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক মদদপুস্ট এনবিআর কনফারেন্সে যোগ দিতে দেশে গেছে। শক্তির পুজা নতুন নয়। তাই বলে বিবেক আর যুক্তির মাথা খেয়ে? যারা এনবিআর কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলেন, তারা কি একবারও জিগ্যেস করেছেন সিডর দুর্গত বাংলাদেশে এধরণের আয়েশী উদ্যোগের হোতা কারা? কি তাদের স্বার্থ? যারা নির্বিচারে মানবাধিকার হনন করছে তাদের পাশে এক কাতার দাঁড়াতে আমাদের সুশীল সমাজ একটুও লজ্জাবোধ করল না? স্বৈরাচারী শক্তির মাথা কেনার বাজারবুদ্ধি সবসময়ই প্রখর হয়। তারা জানে কাকে টোপ দিলে বড়শীতে ধরা দেবে। মূল্যবোধবিবর্জিত কিছু মানুষ একখন্ড ক্ষমতার মাংস মুখে পুরে স্বৈরশক্তির প্রশংসার কীর্তন গাইবে। স্বৈরাচার নিপাত যাবে না। নুর হোসেনের কবরের উপরেই আবারও উঠে দাঁড়াবে স্বৈরাচারের বিষবৃক্ষ। গণতন্ত্রের কবরখোদকরা আবারও ২০০৮ সালে প্রবলভাবে শক্তিমান হয়ে উঠবে। তারই নমুনা আমরা দেখতে শুরু করছি।
আমার লেখায় গভীর হতাশা ফুটে উঠার জন্য আমি দু:খিত। নতুন বছরে আপনাদের হতাশ করার ইচ্ছে আমার ছিল না। আশা করি, আপনারা একখন্ড প্রত্যাশার চিত্র তুলে ধরে আমাদেরকে উপহার দেবেন। এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগাবেন। পথ দেখাবেন। আমার এক শিক্ষক আমাকে হতাশাবাদী হওয়ার পাঠ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন আশাগুলো সবসময় নেতিবাচক রাখবে। পাব না জানি পথ ধরে যদি পেয়ে যাই তাহলে পাওয়ার আনন্দ অনেক বেশী হবে, তেমনি না পাওয়ার কস্টটাও অনেক সামান্য হবে। এধরণের নেতিবাচক লেন্সে একটু আশার আলো আলোকিত করুক আমাদের ২০০৮-এর পথচলা। শুভ নববর্ষ।
মন্তব্য
সুশান্ত,
আপনাকেও শুভ নববর্ষ।
অন্ধকারের উতস হতে উতসারিত আলো
সহমত। অনিচ্ছাসত্ত্বেও শুধুই সহমত।
শুভ নববর্ষ।
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
আড্ডাবাজকে নতুন বছরে নিয়মিত সচলে চাই।
আড্ডাবাজকে সচলে সচল হওয়ার তাড়া দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ @ শিমুল।
সবাইকে শুভ নববর্ষ।
অন্ধকারের উতস হতে উতসারিত আলো
নতুন মন্তব্য করুন