টানা এক সপ্তাহ, কি তার চেয়ে একটু বেশী? একনাগাড়ে নাইট ডিউটি করে গেলে তুমি। সকালবেলা বাড়ী ফিরতে, গোসল করে, খেয়ে, দূপুরের একটু পরেই আবার ছুট। তোমার কাছে সেটা কোনো কষ্টই না! তুমি কাছে থাকলে নানুর একটুখানি সুবিধা হয়, এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বা অর্থময় কাজ সেই সময়ে আর কিছুই কী হতে পারতো?
তারপর? তারপর একদিন আর ধরে রাখতে পারলে না তাকে, ছেড়ে দিতেই হলো, হাসপাতালে তখন তুমি একা। সেদিনও তোমার কাছে থাকতে পারি নি আমি, পরীক্ষা ছিলো আমার। বাবাও পারলো না আমাকে ছেড়ে যেতে, তাই তুমি একাই রইলে সেদিন। অনেক, অনেক, অনেক মানুষের ভিড়ে একা।
অথচ কী আশ্চর্য্য রকম শান্ত ছিলে তুমি! হাজার হাজার মানুষ বাড়ি ভর্তি। কী শান্ত ভাবে সবার সাথে কথা বলে যাচ্ছ তুমি, সমস্ত কাজের আয়োজন করে যাচ্ছ, সবাইকে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছ। আমাদের সেই চির-চরিত "কখন হলো-কেমন করে হলো"-র উত্তর দিয়ে যাচ্ছ তুমি কী প্রচন্ড ধৈর্য্য ধরে। কে যেন বল্লো, হাসপাতাল থেকে ফেরার ঠিক পরপরই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে তুমি, কিন্তু সামলে নিয়েছিলে খুব কম সময়েই। এক ফোঁটা কাঁদতে দেখি নি তোমাকে, কাঁদার ফুরসত কোথায় তোমার? তোমার তখন কত, কত কাজ! ঝাপিয়ে তোমার কোলে পড়ে হু হু করে কাঁদছি যখন তখন মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলে, মনে আছে? তোমার শক্তি ধার করেই আমার জন্ম, সেদিনও তোমার আদরে কী প্রচন্ড বল পেয়েছিলাম!
সেই সময়টায়, ঠিক সেই সময়টায় আমি বুঝতে পেরেছিলাম ঠিক কেমন ছিলে তুমি মুক্তিযুদ্ধের সময়টায়, আগরতলা ক্যাম্পে। তোমার ক্যাম্পের সাথীদের কাছে (তোমার নিজের মুখে কখনো নয় কিন্তু) তোমার প্রচন্ড মনোবলের গল্প কত শুনেছি! শেল পড়ার সময় ক্যাম্পের মানুষেরা যখন ভয়ে, আতংকে দিশাহারা, তখন কেমন অসীম সাহসে-শক্তিতে তুমি, মাত্র একুশ বছরের তুমি, সবাইকে অভয় দিতে, সবাইকে নিরাপদ জায়গায় জড় করার কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়তে! সেই তো তুমি! বিপদে, দঃখে, অসময়ে তুমি কেমন করে যেন হয়ে ওঠো শান্ত, অথচ দৃঢ় এক অকুতোভয় অতিমানবী। তোমাকে তখন আমার দুর্গা দুর্গা লাগে।
দশটা বছর কেটে গেছে। আজকে আমি বড় হয়েছি, কথায় কথায় কতো শাসন করি তোমাকে। কোথায় কোন কথাটা বলা উচিৎ হয়নি তোমার, কোথায় যাওয়া উচিৎ হয়নি, কোন শাড়ীটা পড়লে তোমাকে খারাপ দেখায় এরকম হাজারো মতামতে জর্জরিত করি তোমাকে। হেন কাজ অথবা চিন্তা নেই তোমার যেখানে আমার ট্রেস্পাস্- হ্যাঁ, ট্রেস্পাস্ই তো! - নেই। এতই বড় হয়েছি, এতই আমি পণ্ডিত হয়েছি আজকাল! আজকে তো তাই আমারই তোমাকে শক্তি দেয়ার কথা!
না, আমি জানি, আমার শক্তি বা সাহস, কোনোটারই প্রয়োজন নেই তোমার! তুমি সেই মেয়ে, যে একাত্তরে একুশ বছর বয়সে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সীমান্ত পার হতে সাহায্য করতে কাপড়ের ভাঁজে ছুড়ি লুকিয়ে, যাতে ধরা পড়ে গেলে গোপন তথ্য ফাঁসের আগেই শেষ করে দিতে পারো নিজেকে।
কিন্তু আমার যে বড় ইচ্ছা করছে আজকের দিনটাতে তোমার পাশে থাকতে! আজকে সন্ধ্যায় যখন কোনো শিল্পী গাইবেন "জীবন যখন শুকায়ে যায়", তখন সবার অগোচরে আমি জানি কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়বে তোমার গাল বেয়ে। শুধু সেই মুহুর্তটাতে তোমার সাহস-শক্তির ঢালটাকে নামিয়ে রেখো। ঠিক সেই মুহুর্তটাতে আমাকে তোমার পাশে ভেবে নিয়ে একটুখানি প্রাণ খুলে কেঁদো মা, আমি তোমার ঢাল হয়ে, আমি নানু হয়ে ঘিরে রাখবো তোমাকে।
মন্তব্য
"---------একটুখানি প্রাণ খুলে কেঁদো মা, আমি তোমার ঢাল হয়ে, আমি নানু হয়ে ঘিরে রাখবো তোমাকে।"__________এই সকালে চমৎকার একটা পোষ্ট পড়তে সহযোগিতা করায় অনেক ধন্যবাদ অহি। আপনার মায়ের হিত কামনায়!!!
এস হোসাইন
----------------------------------
"মোর মনো মাঝে মায়ের মুখ।"
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
সন্তান হিসেবে কত কর্তব্যই যে পালন করতে পারি না, কালকে রাতে শুধু এই কথাটাই বারবার মনে হচ্ছিলো। আপনার ভালো লাগলো জেনে ভালো লাগলো।
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
আবেগ ঘন লেখা।
আপনার মা তো ভীষণ সাহসী নারী! অনেক শ্রদ্ধা রইলো তাঁর প্রতি।
ভালো থাকুন আপনারা।
অনেক অনেক ধন্যবাদ, মৃত্তিকা, মা সত্যিই বড় সাহসী।
ভালো থাকুন আপনিও।
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
আপনার নানু এবং মা, দুজনকেই শ্রদ্ধা করি আমি, আমাদের পরিবারের সবাই।
একদিন হয়তো আপনার ভেতর আরেক সুফিয়া কামাল কে দেখতে পাবে আমার সন্তানেরা।
.........................................
I think what I think because that's how I am. You think what you think because that's how you are.
...........................
Every Picture Tells a Story
মুস্তাফিজ ভাই, আপনার মন্তব্য পড়ে চুপচাপ বসে থাকলাম খানিকক্ষণ। নানু আমাদের যতটা ছিলেন, ঠিক ততোটাই বুঝি ছিলেন পুরো বাংলাদেশের, এই কথাটা বুঝতে পেরেছিলাম যখন সম্পূর্ণ অপরিচিত নারী-পুরুষের ঢল নেমেছিলো আমাদের বাড়িতে, শহীদ মিনারে, সেই দশ বছর আগে।
ভাই, আমি একেবারেই সাধারণ, আটপৌরে, ভীরু (আমার সিগনেচারটা দেখুন!)। নিজেরই দিনবদলের স্বপ্ন দেখার সাহস বা শক্তি কোনোটাই নেই, নানুর মতো পথপ্রদর্শক হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না! তবু এত বড় আশীর্বাদ দিলেন, কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেলাম।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
খুব মায়াময় লেখা। আরো কিছু লিখবেন কি কখনো আপনার মাকে নিয়ে অন্য কোন পোস্টে ? বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা ? জানতে ইচ্ছা করছে।
অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য, মন্তব্যের জন্য বইখাতা।
মুক্তিযুদ্ধের কথা লিখতে গেলে এত গল্প একসাথে মাথায় এসে ঘিরে ধরে যে কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখবো বুঝে পাই না! ছোটোবেলায় ঠাকুরমার ঝুলি অথবা উপেন্দ্রকিশোরের গল্প যেমন শুনেছি, তার পাশাপাশি একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের, মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প শুনে বড় হয়েছি। শহীদ আলতাফ মাহমুদ, রুমী, ড: গুহঠাকুরতা, খালেদ মোশার্রফ - এরা তো বটেই, এরকম আরো কত কত মানুষের গল্প যে শুনতাম! তাঁদের যেন চোখের সামনে দেখতে পেতাম, আর ভীষণ রোমাঞ্চে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যেত!
মায়ের গল্প মূলত শুনেছি মা'র আগরতলা ক্যাম্পের হাসপাতালের সাথীদের কাছে, অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে, বা তাঁদের বই পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্ত পার হতে সাহায্য করা, তাঁদের পরিবারের কাছ থেকে খবর-চিঠি, ইত্যাদি পারাপারের গল্পগুলি সত্যিই গায়ে কাঁটা দেবার মতো।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
খুব অল্পকয়জন মানুষকে আমি অনেকটা অন্ধভাবেই শ্রদ্ধা করি, আপনি যাদের কথা বলেছেন, তারা সেই অল্পকয়জনের দুইজন। তাদের আলোয় আপনি আলোকিত, নিভে পড়ে থাকার নিয়তি আপনার না।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
অসংখ্য ধন্যবাদ পড়া এবং মন্তব্যের জন্য ওডিন।
ভাইরে, আলো অথবা প্রতিভা যদি জেনেটিক হতো তাহলে তো প্রতি প্রজন্মে একজন করে আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল পেতাম আমরা! যোগ্য উত্তরসূরি হতে যেমন রক্তের সম্পর্কের প্রয়োজন পড়ে না (বেগম রোকেয়ার সাথে নানুর সরাসরি রক্তের সম্পর্ক ছিলো না), ঠিক তেমনি, শরীরে আলোকিতের রক্ত থাকলেও আমার মতো সাধারণ, ভীরু মানুষ হওয়া যায়, যারা নিভেই পড়ে থাকে।
আর নিয়তির কথা বলছেন? মা-বাবা থেকে দূরে থাকাটাই আজকাল সবচে' নিশ্চিত নিয়তি মনে হয়।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
অফলাইনে বসে থাকি বেশিরভাগ সময়। তাই অনেককেই জানানো হয় না অনুভবের কথা।
কিছু লেখা আছে মনের খুব গভীরে রেখাপাত করে। আপনি এমন দুটি লেখা লিখলেন কমপক্ষে। (অথবা এই দুটোই আমি পড়লাম বুঝি)
অভিবাদন আপনাকে।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
একটা কথা আপনাকে বলা উচিৎ। সচলায়তনে যখন লেখা শুরু করি, তখন মোটামোটি পণ করেছিলাম যে কখনোই নিজের ব্যাক্তিগত কথাগুলি লিখব না, পলিটিকাল কোনো মন্তব্য করব না, শুধুই বাংলা লেখার চর্চাটুকু ধরে রাখার জন্য সচলায়তনে আসা-যাওয়া করব। তারপর একদিন হঠাৎ করে আবেগের বশে লিখে ফেল্লাম খুব ব্যাক্তিগত কিছু কথা একটি পোস্টে। ক'জন মানুষের নাম বিশেষ করে নিতেই হয়েছিলো সে পোস্টে, কারণ ভীষনভাবে দাগ কেটেছিলো তাদের কথা মনে। আপনি তাদের একজন।
সেই আপনার আমার লেখা ভালো লেগেছে, সেটা যে আমার জন্য বিশেষ আনন্দের একটা ব্যাপার, সেটা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না, তাই না?
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
নতুন মন্তব্য করুন