বইমেলায় ঢুকার আর বেরুবার আমরা আমাদের মত করে কিছু স্টাইল বানিয়ে নিয়েছিলাম। স্টলের পর্দা নামিয়ে শুদ্ধস্বরের সামনে থেকে বেশ বড়সড় একটা দল ধীর পায়ে বেরুবার পথ ধরে হেঁটে যেত। এদেরকে দেখলেই মনে হতো; মেলা থেকে বেরুবার কোন ইচ্ছা এদের নেই। কিন্তু বাধ্য হয়ে এরা ফিরে যাচ্ছে। এই দলটা হাঁটতে হাঁটতে টিএসসির মোড়ে বা ছবির হাটে বা শাহবাগ মোড়ে যাত্রা বিরতি করতো কয়েকবার। চিংড়ির মাথা, মাশরুম ভাজা, চা-সিগারেট তারপর যে যার মতো একেকজন একেকদিকের বাস-রিকশা ধরতো। এইটাই ছিল আমাদের স্টাইল। ফেব্রুয়ারি মাসের স্টাইল।
পনেরোর ২৬ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর ছিল শুদ্ধস্বরের সব বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। এই উন্মোচন অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষন ছিল অভিজিৎ রায় ও মীজান রহমানের ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইটি। এই বই প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল আগের বৎসর অর্থাৎ চৌদ্দতে। কিন্তু বিশাল টেকস্টকে কনভার্ট করা, ছবিগুলো জায়গামত বসানো এবং প্রফেশনাল প্রুফরিডারকে দিয়ে প্রুফ দেখানোর ঝক্কিতে বের করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। এদিকে মেলা আসার আগেই মীজান ভাই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। অভিজিৎ এর আশংকা ছিল এবারো বই প্রকাশ হয় কি না! ইনবক্সে আমাদের কথা হতো। আমি আশ্বস্থ করার জন্য বাক্য নির্মাণ করতাম আর অভিজিৎ বলতেন; মিয়া ডুবাইবেন না তো! বলেন আপনার জন্য কি আনুম? আমি স্মাইল ইমোর সাইন জুড়ে দিয়ে বলতাম; এরাম রাম রাম রাম! কী যে বলেন! অভিজিৎ বলতেন; বুঝছি! অবশেষে অভিজিৎ যেদিন দেশে আসেন সেদিনই বইটি মেলায় আসে।
বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের ক্ষেত্রে আমরা সবসময়ই প্রচলিত নিয়মরীতিকে উপেক্ষা করেছি। নিজেরাই নিজেদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে নাড়ু-বাতাসা খাওয়া আমাদের শুরুর বছর থেকে চর্চা করা অভ্যাস। এবারো এরকমটি প্ল্যান করা হলো। সবার সাথে আলাপ করে সময় ঠিক করা হলো ২৬তারিখ সন্ধ্যার পর। একটু দেরিতেই সবাই আসলেন। বইয়ের আলোচনা, সমালোচনা, অনুভুতি প্রকাশ আর নাড়ু-মোয়া-বাতাসা খাওয়ার মাধ্যমে শেষ হয়েছিল অনুষ্ঠান। অভিজিৎ ছিলেন শেষ বক্তা। মুক্তচিন্তার যুক্তিবাদি, বিজ্ঞানমনষ্ক বই প্রকাশের ব্যাপারে জোড় দিয়েছিলেন তিনি। বন্যা আহমেদ বই লিখতে রাজি হয়েছিলেন লীলেনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায়। আমি বলেছিলাম আগামীবার থেকে শুদ্ধস্বর এধরনের বই প্রকাশের মধ্যেই নিবেদিত থাকবে।
সেই সন্ধ্যায় অভিজিৎ এর পরনে ছিল লাল পাণ্জাবি, বন্যার কমলা ফতুয়া। অনুষ্ঠান শেষে হাত ধরাধরি করে তারা চলে গিয়েছিল। আমি শুনেছিলাম আমাদের অনুষ্ঠানের আগে একটা বিজ্ঞান লেখকদের বৈঠকে তারা যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরেরদিন খবর পেলাম সেই বৈঠক আমাদের অনুষ্ঠানের পরে হয়েছিল।
স্টলের পর্দা নামিয়ে ধীর পায়ে ফেরার সময় সেদিন ছিলাম রুনা,তারেক,লীলেন আর আমি। টিএসসির সবকিছু স্বাভাবিকই ছিল। মানুষজন হল্লা করছিল, পুলিশরা আড্ডা দিচ্ছিল, বেলুনওলা বেলুন বিক্রি করছিল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভুট্টা পোড়ার ধোয়ায় চোখ জ্বলছিল। আমরা সাধারণত টিএসসিতেই চাবিড়ি খাই। কিন্তু সেদিন জানিনা কেন টিএসসিতে ভাল লাগছিল না। সোহরাওয়ার্দী গেটের একটু পর একজন মহিলাকে দেখলাম চিৎকার করছেন। পাশে একটা মোটর সাইকেল পরে আছে। আশেপাশের দুএকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে? কেউ কিছু বলতে পারলো না। আমরা ভাবলাম এটা হয়ত ছাত্রলীগের নৈমত্তিক ঘটনার কোনকিছু। ছবির হাটে ঢুকে গুড়চায়ে যেই চুমুক দিয়েছি, মোবাইলটা বেজে উঠলো। গনজাগরণ মঞ্চের এক নেতা; টুটুলভাই, অভিজিৎ রায়ের কোন খবর জানেন? আমরা জাদুঘরের সামনে আছি। আমরা চা ফেলে ছুটে আসি জাদুঘরের সামনে। সেখানে বেশ কয়েকজনের জটলা। কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না। এক সাংবাদিকের মাধ্যমে খবর পাওয়া গেলো দুর্ঘটনার খবর সত্য। আমি, রুনা আর তারেক সামনের এক খালি রিকশায় লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। ঢাকা মেডিকেলের জরুরী বিভাগের সামনে ততক্ষনে অনেক ভীড় জমে গেছে। বারান্দায় ট্রলিতে বসা রক্তাক্ত বন্যা। হাত বাড়িয়ে আমাকে ডেকে বললেন, একটা এয়ার এ্যাম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করেন অভিকে বাঁচান। বন্যাকে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলো। রুনা গেলো বন্যার ট্রলি ধরে। আমি ইমার্জেন্সি ওটির দিকে ছুট দিলাম। দেখি বাকী সামনে দাঁড়ানো। ও বললো, টুটুলভাই আশা নাই। আমি ভেতরে ঢুকলাম। ডাক্তার বললো ওয়েট করেন। একটু পর আমাকে বললো টিকিট কাটা হয় নাই। টিকিট নিয়ে আসেন। আমি বাইরে বেরিয়ে ১০টাকার টিকিট কাটলাম। আবার ভেতরে ঢুকে ডাক্তারের হাতে টিকিট দিলাম। ডাক্তার তখন আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কে হন? এই প্রশ্নের উত্তরে কি বলতে হবে আমার মাথায় তখন আসছিল না কিছু। হঠাৎ আটকে যাওয়া দম ছেড়ে দিয়ে বললাম বন্ধু, বন্ধু হই। ডাক্তার আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, সরি। আমার মনে হলো আমার সবগুলো মাসল শক্ত হয়ে গেছে। ডাক্তারের হাত ধরে আমি ওটি রুমে গেলাম। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, শরীরের রক্ত পরিষ্কার করা হয়েছে। নিথর অভিজিৎ রায়ের বুকে একটা হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।
এই সময়েই হাসপাতালের আশেপাশে এক নাগাড়ে অনেকগুলো ককটেল ফোটার শব্দ শুনা গেলো। বন্যাকে স্কয়ারে ট্রান্সফার করা হলো। ২৬ থেকে ২৮ফেব্রৃয়ারি পর্যন্ত অভিজিৎ ছিল হিমঘরে। ১মার্চ সিদ্ধেস্বরী আর ক্যাম্পাস ঘুরে মানুষের ভালবাসায় আর শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়ে মৃত অভিজিৎ জীবিত মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়ে গেলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। আমরা অশ্রু আবেগে তাকে রেখে আসলাম মর্গে।
বাংলাদেশকে কুপমুন্ডকতার অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাতে বায়ান্ন আর একাত্তরকে হৃদয়ে এবং মগজে ধারন করা অভিজিৎ এর চিন্তা, লেখা, কর্ম এবং আত্মত্যাগ যুগ যুগ ধরে বাতিঘরের ভুমিকা পালন করবে। অভিজিৎরা হারলে হারবে বাংলাদেশ, অভিজিৎরা জিতলে জিতবে বাংলাদেশ।
মন্তব্য
আপনাকে লিখতে দেখে খুব ভালো লাগছে টুটুল ভাই। আপনাদের মত সাহসী মানুষ আছে দেখেই এখনও আমার মত ভীতু মানুষেরা স্বপ্ন দেখে।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
আবার লিখছেন দেখে ভালো লাগছে টুটুলভাই
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
হ। অনুভূতিহীন রক্ত
স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলেন, পরিবর্তন চেয়েছিলেন , অন্ধকারকে আলোর ভুবন বানাতে এগিয়ে এসেছিলেন' হয়তো এমন উন্নত মানসিকতার ফলাফল এই ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি। তিনি হয়তো পরাজিত নয়। তবে নিঃসন্দেহে পরাজিত আমাদের মনুষ্যত্ব।
ঠাকুর ঝি
লেখা চলুক টুটুল ভাই। আর কী আছে আমাদের কলম ছাড়া।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
সোহেল ইমাম
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন