নিশির দুঃখগাঁথা

হাসিব জামান এর ছবি
লিখেছেন হাসিব জামান [অতিথি] (তারিখ: রবি, ০৮/০৩/২০০৯ - ৪:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ধরা যাক, মেয়েটির নাম নিশি। সে নানাবাড়ি থাকত মায়ের সাথে। তার মা স্কুলের শিক্ষিকা আর বাবার দোকান ছিল একটু দূরের শহরে। বাবা মাঝেমধ্যে আসত, মামারাই তার সব। মফস্বল এলাকা হলেও কিভাবে কিভাবে যেন নিশিকে নাঁচের নেশায় পেল। মামাদের আগ্রহ আর নিজের চেষ্টা সব মিলে সে ভাল নাঁচতে শিখল। স্কুলের মেডেল তো পেতই, এলাকায় কালচারাল ফাংশন হলেও ডাক আসে। নিশির বয়স যখন বার তখন তার জীবনে দুটি আনন্দের ঘটনা ঘটে। এক, সে পঞ্চম শ্রেনীর বৃত্তি পরীক্ষায় পুরো জেলার ভিতর ট্যালেন্টপুলে তৃতীয় স্থান অধিকার করে। দুই, তার একমাত্র ভাই নাঈমের জন্ম হয়। দিনগুলো খুব সুন্দর কাটছিল।

মেয়েদের মনে হয় ছোট্ট বেলাটা খুব সুখের কাটে। যত বড় হয় চারপাশটা তাদের জন্য তত কঠিন হতে থাকে। নিশি যেন একটু বেশী তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল। শরীরটা খুব বাড়ন্ত ছিল। পড়ে ক্লাশ সিক্সে কিন্তু দেখলে মনে হয় এইট বা নাইনের ছাত্রী। ছোট্ট মফস্বল শহর, তার উপর এত এত গুন মেয়ের!! সবাই প্রায় একনামে চিনত। তাতে বোধহয় কোন সমস্যাও ছিল না। কিন্তু আল্লাহ যাকে দেয় তাকে মনে হয় সব কিছু উজাড় করে দেয়। নিশি দেখতে মারাত্মক রকমের সুন্দরী। আর সব সমস্যাটা সেখানেই। এত সুন্দর একটা মেয়ে নাচানাচি করবে আর এলাকার সুপুত্রদের সুনজরে পরবেনা তা কিভাবে হয়?

সুতরাং যা হবার তাই হল। নিশির নাচের উপর খড়গ নেমে আসল। মা-বাবা কড়াভাবে নিষেধ জারি করলেন। কিন্তু নাচ ততদিনে নেশায় চেপে বসেছে, মামারাও সাথে ছিল। ফলে লুকিয়ে লুকিয়ে নাচ একটু আধটু চলতে থাকল। পড়াশুনা অল্পতেই ভাল হয়, মেয়ের মেধা আছে। একটা কিছু নিয়ে তো তার থাকতে হবে। নিশির এক মামা বিতর্ক করতেন, তার হাত ধরেই নিশি বিতর্ক প্রতিযোগীতায় নাম লেখাল। ধীরে ধীরে সেখানেও সে ভাল করল।

ক্লাস সেভেন এর বার্ষিক পরীক্ষার পর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে অনেকদিন পর নাচল নিশি। এলাকার নামকরা গুন্ডা রিকি এরপর থেকেই ওর পিছনে লাগে। ঐ বয়স টা বোধহয় সব মেয়েদের জন্যই ডেঞ্জেরাস। একটা ফাড়াঁ আসবেই। নিশি নিজেও হাল্কা প্রশ্রয় দিয়েছিল কিনা কে জানে? পরের বছরটা নিশির পরিবারের জন্য রীতিমত আতঙ্কের ছিল। যখন তখন তুলে নেয়ার হুমকি, বিয়ের প্রস্তাব। নিশির মা দুচোখে অন্ধকার দেখেন। কত স্বপ্ন তার এই মেয়েকে নিয়ে। মেয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে ইংলিশে অনার্স পড়বে, আরো কত কি! লোকের কথায় কান দিয়ে মা মেয়েকে খুব মারেন আর ঘরে আটকে রাখেন। অথচ নিশির দোষ টা ছিল কি? অতিমাত্রায় সুন্দরী এটাই তো তার দোষ। কিন্তু নিশি ছিল খুব জেদী। বিনাদোষে আটকে রাখা সে মেনে নিল না, বাসা থেকে বের হল আর জীবনের সবথেকে বড় ভুল টা করল সেখানেই।

তিন দিন পর নিশিকে পাওয়া গেল সেন্সলেস অবস্থায়। সেদিন ই তারা ঢাকা চলে আসে। নিশির এক খালার বাসাতে ওঠে তারা। পরদিন খবর আসে নিশির বাবার দোকান সহ মার্কেট এর চার-পাঁচ টা দোকান কারা যেন পুড়িয়ে দিয়েছে। বাড়ি ফিরে যাবার পথ তাদের চিরদিনের মত বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও মেয়েকে যে ফিরে পেয়েছে এতেই তারা খুশী। সবকিছু আবার শূন্য থেকে শুরু হয়। নিশি অগ্রনী গার্লস স্কুলে ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়। মা আবার স্বপ্ন দেখে মেয়েকে নিয়ে, মেয়ে বিসিএস দেবে, কত বড় চাকরী করবে! কিন্তু কপালে তো থাকতে হবে।

তখন দিলওয়ালে দুলহানিয়া, কুচ কুচ হোতা হায় এর যুগ। একদিন বাড়িওয়ালী এসে নিশির মাকে বলে, আপনার মেয়েটা তো খুব সুন্দর – দেখতে একদম কাজলের মত। ওকে আমার ছেলের জন্য নিব। আত্মীয়-স্বজনরা বলে, এই মেয়ে যেখানে যাবে সেখানেই মানুষের চোখ পরবে। একে বিয়ে দিয়ে দেয়াই ভাল। তাছাড়া ছেলের ফ্যামিলি ভাল। ঢাকা শহরে ছয়তলা বাড়ি আছে, ছেলে পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করে। অতি উত্তম প্রস্তাব! মায়ের কিন্তু প্রবল অনীহা। সে নিজে সেই যুগের বিএড করা টীচার, মেয়েকে নিয়ে তার আরো কতশত স্বপ্ন। তবু সবাই ধরে বেধে নিশিকে পর করে দিল।

পড়ালেখা না হয় নাইবা হল। বিয়ের পর এই কিশোরী মেয়েটা কিছুটা সুখ তো পেতে পারত। কিন্তু কপালে যে সুখ লেখা নেই। বাঘের খাঁচা থেকে সিংহের খাঁচায় এসে পরে নিশি। বিয়ের রাতেই বুঝতে পারে তার স্বামী সোহেল নেশাগ্রস্ত। আর ধীরে ধীরে এটাও জানতে পারে তাকে আনা হয়েছে সোহেলের নেশা ছাড়াতে! অনিন্দ্য সুন্দর বউ যদি ছেলেকে ফেন্সিডিলের বোতল ছাড়াতে পারে এই আশায়! এটা যে কতবড় ভুল আর ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত তা শুধু ঐ অসহায় বউটি হারে হারে বুঝতে পারে, আর কেউ না। বুকের কষ্ট বুকে চেপে মরে, মা-বাবা কাউকে কিছু জানায় না নিশি। হয়ত অভিমান, হয়ত জেদ। আর কত ভোগাবে তাদের? তার জন্য বাড়িছাড়া হয়েছে, নিঃস্ব হয়েছে। এখন মেয়ে বিয়ে দিয়ে একটু ভারমুক্ত হয়েছে বেচারীরা। আবার তাদের ঘাড়ে চেপে বসা কেন? নিশি ভাবে তার জীবন তো গেছেই, এখন ছোট ভাইটার জীবন অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেয়া যাবে না।

নিশি চেষ্টা করে, প্রানপন চেষ্টা করে সোহেল কে নেশা থেকে মুক্ত করতে। শুভাকাঙ্খীদের সুপরামর্শে নিশি এই অল্প বয়সে মা হয়, পৃথিবীর আলো দেখাতে নিয়ে আসে আরেকটি অভাগী মেয়ে শিশুকে। এটা আরকটা মারাত্মক ভুল। নেশাখোর মানুষের কাছে স্ত্রী মা হল কি মারা গেল তাতে কিছুই আসে যায় না। জাগতিক কোন মায়া-মমতা-সৌন্দর্য তাদের স্পর্শ করে না, তারা বাস করে একটা ঘোরের মধ্যে – সেখানে আছে শুধু পাশকিবকতা আর নির্মমতা। দিন যায় আর রাত আসে। নিশির উপর নির্যাতন আর অত্যাচার বাড়তেই থাকে। কাহাঁতক আর সহ্য করা যায়। একসময় নিশির মামা-খালারা জানতে পারে, মাকে জানানো হয় আরো অনেক পরে। কিন্তু তাদের আর কিবা করার আছে? একটু স্বান্তনা, মাথায় হাত রাখা, চোখের জলে ভাসানো – ব্যস এইটুকুনই।

সাতটা বছর কেটে গেছে। নিশি বুঝতে পারে এই নরক থেকে মুক্তি পেতে হলে নিজেকেই কিছু একটা করতে হবে। নিশির মেয়ে একটু একটু করে বড় হয়। আর নিশি লুকিয়ে লুকিয়ে এসএসসি শেষ করে, একটা ইণ্টেরিয়র ডিজাইনের কোর্সে ভর্তি হয়। একসময় বাবা-মার কাছে চলে আসে। ডিভোর্সের প্রস্তুতি চলে। কিন্তু শ্বশুর বাড়ীর লোকজন তাদের বউমাকে ফিরিয়ে নিতে চায়। কিছুতেই ডিভোর্স হতে দেবে না। নিশির বাবার বয়স হয়েছে। মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে এক ভোরবেলায় বাসের চাকায় পিস্ট হয়ে সব দায়-দায়িত্ব মুক্ত হন। নিশির ভাই নাঈম মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ে। সামনে একটা উত্তাল সমুদ্র। এই সমুদ্র নিশিকে পাড়ি দিতে হবে সম্পূর্ন একা একা।

বাস্তব মনে হয় সিনেমার থেকেও নির্মম। সিনেমা হলে নিশির সাথে হয়ত কোন নায়কের দেখা হত, তারপর একটা সুন্দর সমাপ্তি থাকত। কিন্তু বাস্তব বলেই নিশির সাথে যাদের দেখা হয়েছে তারা সবাই খলনায়ক, আর এই কাহিনীর কোন সমাপ্তিও নেই।


মন্তব্য

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

নির্মম কিছু সত্যি....মন খারাপ
আর কিছু কিছু মানুষকে দেখি, এরা সারাটা জীবন শুধু কষ্টই পেয়ে যায়।
জীবনটা মিশেলে হওয়া উচিত...

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

হাসিব জামান এর ছবি

হুম, কিছু কিছু মানুষের জীবনটাই শুধু কষ্ট পাওয়ার। আর কষ্ট গুলো আমাদের মত কিছু মানুষেরই দেয়া।
জীবনটা মিশেলে হলে দারুন হত।

-----------------------------------------
ভালবাসা তুমি - প্রেয়সীর ঠোঁটে প্রগাঢ় চুম্বন;
ভয়হীন তবু, দেখলে দেখুক না লোকজন।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

খুবই খারাপ লাগল। কিছু কিছু মানুষকে জীবনে কেন যে শুধু কষ্টই পেতে হয়! এর জবাব হয়ত কোনওদিনই পাওয়া যাবে না...

হাসিব জামান এর ছবি

এর জবাব হয়ত সৃষ্টিকর্তার কাছে ও নেই।
-----------------------------------------
ভালবাসা তুমি - প্রেয়সীর ঠোঁটে প্রগাঢ় চুম্বন;
ভয়হীন তবু, দেখলে দেখুক না লোকজন।

হাসিব জামান এর ছবি

দুঃখ-কষ্টের লেখা মানুষজন মনে হয় কম পড়ে। এইজন্যে কমেন্ট নাই। আফসুস মন খারাপ

লেখা কিরকম হইল তা সম্পর্কে দু-এক লাইন না বললে ক্যামনে কী মন খারাপ(

-----------------------------------------
ভালবাসা তুমি - প্রেয়সীর ঠোঁটে প্রগাঢ় চুম্বন;
ভয়হীন তবু, দেখলে দেখুক না লোকজন।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আপনার লেখা যে কতোটা সার্থক হয়েছে তার প্রমাণ তো দেখতেই পাচ্ছেন। দুঃখ কষ্টের লেখা জনগণ পড়লেও ভয়ে মন্তব্য করে না। আর কারোটা জোর দিয়ে না বলতে পারলেও এখানে আমি নাম দস্তখত করে গেলাম।

লেখাটা এতোটাই জীবন্ত মনে হয়েছে যে ভেতরে এর স্পর্শ অনুভব করেছি। আমরা গল্প পড়তে ভালোবাসি, গল্পের ভেতরে দুঃখ, কষ্ট, বেদনা দেখতে পছন্দ করি। বাস্তব জীবনের সাথে যেনো এগুলো অচ্ছুৎ! আমরা সহজে নিতে পারিনা, নিতে চাইনা। দৈনন্দিন ক্লেশকে বাইপাস করে আমরা একটু অক্সিজেন পেতে চাই সব জায়গায়। একটু রিচার্জ করে নিতে চাই নিজেকে, সামনের দুঃখ কষ্টগুলোকে ফেস করতে হলে স্পৃহার দরকার হবে তো!

এই লেখাটা গল্প হিসেবে পড়তে শুরু করে যখন নিচে এসে দেখলাম, এটা গল্প না, রুঢ় বাস্তব- তখন আর সাহসে কুলায়নি কিছু বলার এখানে। এটা হয়তো আমার সীমাবদ্ধতা এক। কিন্তু লেখকের লেখনী শক্তির প্রশংসা না করে থাকাটাও অন্যায়। তাই লিখতে হলো আবঝাব।

লেখা জারী রাখুন বস। চলুক
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

হাসিব জামান এর ছবি

ধূগোদা, আপনার অসম্ভব সুন্দর কমেন্টের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার বেশ জুনিয়র, তুমি করে বলতে পারেন। সচলের সাথে আমার পরিচয় স্বল্প দিনের। নামহীন অতিথি হিসেবে কমেন্ট করাটা কষ্টকর ছিল, তাই অনেক লেখা ভাল লাগ্লেও লেখকের সাথে পরিচিত হতে পারি নাই। আজ থেকে আপনার ভক্ত হয়ে গেলাম, ভাল-মন্দ যা হোক আমার লেখায় বলে যাবেন।

গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নির্মম বাস্তবতাকে গল্প বানাতে ব্যর্থ হলাম।
-----------------------------------------
ভালবাসা তুমি - প্রেয়সীর ঠোঁটে প্রগাঢ় চুম্বন;
ভয়হীন তবু, দেখলে দেখুক না লোকজন।

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

নিশির জীবনটা আরেকটু কম নির্মম হলে ধরনীর কোথাও কী অঘটন ঘটে যেতো? বুঝি না।

হাসিব জামান এর ছবি

ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য। ভাল থাকবেন। হাসি
-----------------------------------------
ভালবাসা তুমি - প্রেয়সীর ঠোঁটে প্রগাঢ় চুম্বন;
ভয়হীন তবু, দেখলে দেখুক না লোকজন।

অতিথি লেখক এর ছবি

নিশির জন্য মন খারাপ।।দুনিয়াতে কিছু মানুষ বোধহ্য় শুধুই কষ্ট পেতেই আসে।।

[বিষন্ন বাউন্ডুলে]

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।