আমি মোটামোটি অপদার্থ টাইপের ছেলে। একটা দিন নিজ হাতে বাজার করিনি। কোনদিন রান্না ঘরে চুলো ধরাই নাই। এমনকি এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতে আমার বিরাট অনীহা। এহেন অকর্মন্য ছেলেকে যে ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়নি, এজন্য আমার মাকে মমতাময়ী বললে বহুত কম বলা হয়। মাঝে মধ্যে অবশ্য চরম বিরক্ত হয়ে বলে, ‘তুই আমাকে কবে মুক্তি দিবি বল?’ এসব কথায় বিশেষ পাত্তা দেই না। সকালে জেগে ওঠা থেকে ঘুমাতে যাওয়া অবধি আম্মুকে জ্বালাই। এবং আমি এমন শয়তানের শয়তান যে মাকে ক্ষেপায়ে মজা পাই।
নিজ হাতে খেতে আমার বড় কষ্ট লাগে। ফাইভ ক্লাস পর্যন্ত খাওয়াদাওয়ার মত ফালতু কাজে হাত লাগাইনি, আম্মু আছে না! হাইস্কুলে ওঠার পর আম্মু নানা টালবাহানা শুরু করল। তখন আমার ছোট ভাইটা হয়েছে। আহা! দশ বছর একলা একলা কত সুখেই না ছিলাম। কি আর করা! কপালের দুর্ভোগ। আম্মুর সাথে অলিখিত চুক্তি হল। একবেলা আম্মু খাওয়ায় দিবে, আরেকবেলা নিজ হাতে খাবো। তিনবার খেলে আম্মু দুবার, আমি একবার। চারবার খেলে দুই দুই সমতা। তারপর দিনকাল ভাল যায়। ক্লাশ নাইনে উঠে আম্মুর মনে হল, ছেলে দামড়া হয়ে গেছে। তাকে আর লাই দেয়া ঠিক না। অনেক চেষ্টা নিলাম, অনশন করলাম, তবু লাভ হলো না। পরীক্ষা আশীর্বাদ হয়ে আসে আমার জন্য। পড়তে পড়তে আমি দিশেহারা, খাবো কখন? মা জননী ও বুঝতে পারে, খাওয়ার চেয়ে পড়া বড়। এই দুর্বলতার সুযোগ কয়েকবার বুয়েটে টার্ম ফাইনালের সময় ও নিয়েছি। আর হাল্কা অসুখ-বিসুখ হলে তো কোনকথা নাই। আম্মু উল্টো আমাকে খাওয়ানোর জন্য জ্বালায়।
খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ক্যাচাল এখানে শেষ না, বরং শুরু। খাই অনেক কম কিন্তু ঝামেলা করি শতগুণ। আম্মু প্রতিদিন সকালে আমাকে জিজ্ঞেস করে রান্নার মেনু ঠিক করে। এতকিছুর পরে আমার স্বাস্থ্যের কোন উন্নতি হয় না। একদম ছোটবেলা থেকে তালপাতার সেপাই। এই নিয়ে আমার যতটা না মাথাব্যথা তার থেকে আমার মায়ের অনেক বেশী কষ্ট। তার জীবনের একটা স্বপ্ন, আমাকে মোটাতাজা দেখে যাওয়া! সারাজীবন শুনেছি, সব সন্তান মায়ের চোখে সমান। কিন্তু আমি ১১০% শিউর আম্মু তার ছোট ছেলের থেকে আমাকে বেশী ভালোবাসে।
নিতান্ত বাধ্য না হলে আমি এলার্ম ব্যবহার করি না, দরকার হয় না। সেই স্কুলবেলা থেকে এখনকার অফিসবেলা পর্যন্ত প্রতিদিন ভোরবেলা আম্মু ডাকতে ডাকতে অস্থির করে দেয় আর আমি বলি, দশ মিনিট পরে ডাক দিও। তারপর আবার ডাকলে বলি, পাঁচ মিনিট। এভাবে ঘুমাতেই থাকি।
আম্মুর আরেকটি স্বপ্ন, ছেলে বড় হয়ে বিদেশ যাবে। পিএইচডি ডিগ্রীধারী হয়ে বাড়ি-গাড়ি অনেক কিছু করবে। আপাতত আমার মধ্যে এই স্বপ্নপূরণের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দিব্যি মায়ের কোলে আরামে আছি। অচীনদেশে খামাখা কষ্ট করতে কে যায়? আবার ভাবি, একবার গিয়ে দেখা যাক আমাকে ছেড়ে থাকতে আম্মুর কেমন লাগে! এর কারন আছে। বুয়েট লাইফে যে কয়েকরাত মাত্র হলে থেকেছি আম্মুর ফোন আসছে, “কি করতে থাকবি! চলে আয় বাসায়।” মাকে ছেড়ে প্রথম অনেক দূরে যাই অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষে। বন্ধুদের সাথে সেন্টমার্টিন্স ট্যুর। আম্মুর অনুমতি পেতে খবর হয়ে গিয়েছিল। গতবছর সিলেট যাবার সবকিছু ঠিকঠাক হলো। হঠাৎ করে আম্মু একটু অসুস্থ। আমি কুলাঙ্গার পুত্র ব্যাগ গুছিয়ে সত্যি চলে গেলাম। তারপর একটা বিভীষিকাময় ট্যুর। আম্মুর অসুস্থতা বাড়তে থাকে আর আমি টেনশনে ছটফট করি। শেষমেষ বন্ধুদের রেখে একদিন আগে চলে আসলাম। আমাকে দেখে আম্মু ক্লান্ত হেসে বলে, “মনে করছিলাম তোরে আর দেখতে পাবো না।”
এই আমার আম্মুসোনা, আমার সবথেকে আপনজন। আমার জীবনের যা কিছু অর্জন, সব মাকে ঘিরে – সব। জীবনের প্রথম চাকরীর প্রথম মাসের টাকা যখন আম্মুর হাতে তুলে দেই আনন্দে আমার চোখে পানি চলে আসছিল। যাক, আমি একদম অকর্মা না। টুকটাক আর যেসব কর্ম করেছি, যেমন গুটিকয়েক ছাত্রী পড়িয়েছি সেগুলোর কাহিনী আম্মুর সাথে শেয়ার করি। প্রেম-ভালোবাসা এসব তরল বিষয় আমার জীবনে আসেনি। যদি আসে, মাকে জানাবো সবার আগে। কারন, আমার মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা। সবশেষে মাকে বলি, “মাগো, তুমি আমার আগে যেও নাগো মরে। আমি তোমাকে ছাড়া একটা দিন ও বাঁচতে চাই না।”
মন্তব্য
অনেক ভালো লাগল। আমি লিখতে পারলে বোধহয় এভাবেই লিখতাম।
এই আকাম্টা আমিও করি। নিজে মধ্যবয়সী হয়ে গিয়েছি, কিন্তু মাকে জ্বালাতে এখনও মজা পাই। তবে মা এখন আর আগের মত ক্ষ্যাপে না, হেসে দেয়।
আমাদের সবার মা দীর্ঘজীবী আর রোগমুক্ত হোক। আমাদের সবার মায়ের স্বপ্ন পূরণ হোক।
-লাবণ্য-
ধন্যবাদ লাবণ্য
মায়ের হাসি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ হাসি
-----------------------------------------
ব্যস্ততা আমাকে দেয় না অবসর ...
-----------------------------------------
এই গল্প ভরা রাতে, কিছু স্বপ্ন মাখা নীল নীল হাতে
বেপরোয়া কিছু উচ্ছাস নিয়ে, তোমার অপেক্ষায় ...
আমেন।
কৌস্তুভ
খুব সুন্দর একটা লেখা,পড়ে ভালো লাগলো।
[বিষণ্ণ বাউন্ডুলে]
-----------------------------------------------------------------------------------
...সময়ের ধাওয়া করা ফেরারীর হাত থিকা যেহেতু রক্ষা পামুনা, তাইলে চলো ধাওয়া কইরা উল্টা তারেই দৌড়ের উপরে রাখি...
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
আমি ও খাওয়া দাওয়া নিয়ে খুব জ্বালাতন করেছি এক সময় মাকে । এটা খাব না ওটা খাব না .........আপনার সুন্দর করে গোছানো লেখাটি পড়ে মনে পরে গেল সেই সব পুরনো কথা । আজ মায়ের কাছ থেকে দুরে এসে বুঝতে পারি মা হচ্ছে সাধারণের মাঝেও অতি অসাধারণ একজন রমনী ।
পৃথিবীর সব মায়েরাই বুঝি এমন হয় ।
সাবরিনা সুলতানা
কৌস্তুভ, বিষণ্ণ বাউন্ডুলে, দুষ্ট বালিকা ধন্যবাদ লেখা পড়ার জন্য।
-----------------------------------------
ব্যস্ততা আমাকে দেয় না অবসর ...
-----------------------------------------
এই গল্প ভরা রাতে, কিছু স্বপ্ন মাখা নীল নীল হাতে
বেপরোয়া কিছু উচ্ছাস নিয়ে, তোমার অপেক্ষায় ...
পড়তে খুব ভাল লেগেছে! একবার তো ভাবছিলাম, আমার আত্মজীবনী কে এভাবে বলে দিচ্ছে??
আর কিছুই চাই না জীবনে!
==========================
একটাই কমতি ছিল তাজমহলে,
......তোমার ছবিটি লাগিয়ে দিলাম!
==========================
একটাই কমতি ছিল তাজমহলে,
......তোমার ছবিটি লাগিয়ে দিলাম!
আপনে আর আমি দেখা যায় একইরকম ভালো মায়ের একইরকম পাপিষ্ট পোলা...
তয় পার্থক্য একটা আছে, আপনে চাক্রি পাইসেন- আমি জেবনেও পামু না...
_________________________________________
সেরিওজা
ভালো লাগলো
এইটাই দুনিয়ার নিয়ম। অপদার্থরাই ভাগ্যবান হয়। ধরেন যেমন আপনে, যেমন আমি।
দৃশা
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
দারুণ লাগল, মাথায় ঘিলু থাকলে দেশেই থাকেন, মায়ের কাছাকাছি, দূরে আসলে আমার মত সুখে থাকলে ভূতে কিলায় মার্কা সিরিজ লিখতে হইবেক। আহা! এমন কইরা যদি লিখতে পারতাম!
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
নতুন মন্তব্য করুন