আকরাম আল মাসরী এক ভাগ্যহত প্যালেস্টাইনিয় যুবক। প্যালেস্টাইনের অন্য সবার মতো অবরোধের মধ্যেই তার জন্ম, সহিংসতা দেখে দেখেই তার বড় হওয়া। তারপরও তার স্বপ্ন ছিলো কোন দিন হয়ত সুদিন আসবে। প্রতিপক্ষ অসম শক্তির হলে তা লড়াই থাকে না; জন্মভূমি বাঁচানোর চেয়ে নিজের বেঁচে থাকাটাই মুখ্য মনে হয়। তার সমবয়ীসদের কেউ কেউ ধরে নেয় সশস্ত্র সংগ্রাম একমাত্র উপায়, কেউ মনে করে আপোষ করেই বাঁচতে হবে। আকরামের মনে ঠিক কী ছিল তা জানা যায়নি। শুধু জানা গেছে তার চারপাশের মানুষদের মধ্যেই অনেকে তাকে সন্দেহ করা শুরু করে। আকরাম শত্রুপক্ষের চর।
ইতিহাস বলে, রোমান কি অটোমান, প্রায় সব শাসনামলেই ইহুদিরা বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। নিজভূম ছেড়ে তাই তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পাড়ি জমায়। এক সময় জায়োনিস্ট আন্দোলন গড়ে উঠে, টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে জমি-জমা কেনে তারা- বিশেষ করে প্যালেস্টাইন অঞ্চলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান শাসনের অবসান ঘটলে মধ্যপ্রাচ্যের শাসনভার গ্রহণ করে ব্রিটিশরা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইহুদিরা তখন প্যালেস্টাইনে অভিবাসন শুরু করে। ফলস্বরূপ, সে অঞ্চলে আরব মুসলিম ও ইহুদিদের মধ্যে বিরোধও বাড়ে। এসব বিরোধে ব্রিটিশদের ভূমিকা ছিল উভয় পক্ষকে খুশী রাখার। কিন্তু খুশী ছিল না আরব দেশগুলো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে হিটলারের গণহত্যায় প্রায় ৬মিলিয়ন ইহুদি প্রাণ হারায়। যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশদের অবস্থা তখন শোচনীয়। সুযোগ বুঝে ইহুদিদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবী তাই আরও সমর্থন পায়। শেষমেশ বৃটিশরা ইউএনের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে স্বতন্ত্র ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করে। এ ব্যবস্থায় ইজরায়েলের জন্য ছিল ৫১%, আর প্যালেস্টাইনের জন্য ৪৯% ভূমি। ইহুদিরা এ প্রস্তাব মেনে নিলেও পার্শ্ববর্তী আরব রাষ্ট্র, মিশর, জর্ডান ও সিরিয়া তা মেনে নেয় না। প্যালেস্টাইনের ইতিহাসে এটা ছিল সবচেয়ে বড় ভুল, আজও যার মাশুল দিচ্ছে সাধারণ প্যালাস্টাইনিয়রা।
প্যালেস্টাইন নামে আলাদা রাষ্ট্র হোক, আসলে তা ঐ আরব দেশগুলো চায়নি। তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো নিজেদের সম্প্রসারণ। পরের বছর ইজরায়েল যখন নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে, ঐ আরব দেশগুলো তখন কৌশলে প্যালেস্টাইনি জমি নিজেদের দখলে নেয়। ১৯৬৭ এরা আবার ইজরায়েলের সাথে হাস্যকর এক যুদ্ধে যায়, এবং ৬দিন স্থায়ী সে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দখলকৃত সব অংশ হারায়। প্যালেস্টাইনিদের আসল দুর্ভোগের শুরু হয়।
জন্মভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য এরপর পিএলও, হামাস, ফাতাহ- বিভিন্ন সংগঠন জন্ম নিয়েছে। পিএলও একসময় সহিংস পথ পরিত্যাগ করে রাজনৈতিক পথ ধরেছে। বর্তমানে গাজা এবং পশ্চিম তীর বাদে পুরো অঞ্চল ইজরায়েল নিয়ন্ত্রিত। গাজা ও পশ্চিম তীর শাসন করে পিএ। অনুপাত হিসেবে সেটার আয়তন মাত্র কয়েক শতাংশ। হামাস ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত ইজরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করত না, আত্মঘাতী উপায়ে তাদের কাবু করার চেষ্টা করত।
নিজভূমে প্যালেস্টাইনিরা এখন অবরুদ্ধ। প্র্যাত্যহিক প্রয়োজনে তাদের ইজরাইলিদের কৃপার উপর নির্ভর করতে হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এত দীর্ঘ আর সংঘাতময় দ্বিতীয় কোনও ঘটনা নেই। এর সাথে এমন কোন বড় বিশ্বনেতা নেই যে জড়িত হয়নি। ক্লিনটন কিছুটা হাসি প্যালেস্টাইনিদের দিতে পেরেছিল, কিন্তু বুশ এসে আবার সেই অবস্থা। ইজরায়েলের ভেতরে যে বামশক্তি তাদের ভূমিকাও এ ইস্যুতে প্রশ্নসাপেক্ষ। ইউএনের ব্যর্থতা লজ্জাকর পর্যায়ের। আর তারাই কী করবে? প্যালেস্টাইনের দুর্দশা লাঘবে যখনই কোন পদক্ষেপ তারা নিয়েছে তাতে ভিটো দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইজরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র।
সেই আকরাম আল মাসরি- যার কথা বলছিলাম, যখন নিজের মানুষের কাছেও সন্দেহের ব্যক্তি হয়ে যায়, তখন জান বাঁচানোর তাগিদেই এদেশ ওদেশ ঘুরে নৌকা করে পাড়ি দেয় অস্ট্রেলিয়ায়। সেটা ২০০২ সালের কথা।
ইউএনের মানবাধিকার সনদ অনুসারে যে কোন ব্যক্তির ভিন্ন কোন দেশে আশ্রয় চাওয়ার এবং পাওয়ার অধিকার আছে। অস্ট্রেলিয়া মুখে সেটা মেনেও চলে। কিন্তু সময়টা ছিল তখনকার প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ডের জন্য বেশ খারাপ। শরণার্থীদের উৎপাত থেকে বাঁচতে তিনি কেবল নাউরু দ্বীপ ভাড়া করেছেন। সেখানেই থাকত নৌকা বা মাছ ধরার ট্রলার থেকে উদ্ধারকৃত আকরামের মতো শরণার্থীরা। 'বোট-পিপল সহানুভূতি পাবার জন্য নিজেদের শিশুদের সাগরের জলে ছুঁড়ে দিচ্ছে'- এরকম একটা ক্রেজ তৈরী করে, জনগণের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করে সে যাত্রায় নির্বাচন জিতেন জন হাওয়ার্ড।
আকরামকে শিবির থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল হাইকোর্টের এক আদেশের পর। অস্ট্রেলিয় কর্তৃপক্ষ তখন তাকে প্যালেস্টাইনে ফেরৎ পাঠানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সব কিছু ইজরায়েলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, আর ইজরায়েল তাকে যেতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে অবশ্য তারা রাজী হয়, এবং আকরামকে প্যালেস্টাইন পাঠিয়ে দেয়া হয়, কোর্ট কোন উল্টাপাল্টা রায় দেয়ার আগেই ।
আজ সন্ধ্যার খবরে জানা গেল, আকরাম গুলি খেয়ে চির বিদায় নিয়েছ। পেছনে রেখে গেছে স্ত্রী আর চার সন্তান। কারণ হিসাবে প্রচার করা হচ্ছে দুই পরিবারের কোন্দল।
মন্তব্য
"ইসরায়েল-ফিলিস্তিন" দ্বন্দ্ব খুবই দুঃখজনক। আকরাম আল মাসরীর খবরটা পড়ে খুব খারাপ লাগল।
বাংলাদেশে আবিষ্কৃত ও পেটেন্ট-করা 'ক্রসফায়ার'-এর সন্ধান মনে হয় তারা এখনো জানে না!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
কাদের কথা বলছেন, বুঝতে পারলাম না। ভারত অনেক আগে থেকেই 'এনকাউন্টার' করে আসছে। সে ভিন্ন প্রসংগ।
শিরোনাম দেখে মনে হয়েছিলো যেন প্যালেস্টাইনী হয়ে জন্মানোর ফলে আকরামের ভাগ্যবিপর্যয়ের ব্যাখ্যা/বিশ্লেষণ থাকবে। ছোট পরিসরে অনেক কিছু বলতে চেয়েছিলেন বলেই কি খুব গভীরে যাওয়া হয় নি?
ব্যাখ্যা থাকা উচিৎ ছিল। কিন্তু কিছুটা দুর্যোগপূর্ণ 'স্থানীয়' আবহাওয়ার কারণে তা আর হয়ে উঠল না।
ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনের বিরোধের একটা মূল কারণতো পবিত্রভূমির দখল নেয়া। তিনটা আলাদা ধর্মের পবিত্রভূমি ওই একই জায়গায়!!! এখান থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায় ধর্মগুলো যে আসলে একই সোর্স থেকে আসা। বিভেদ গুলি মানুষেরই সৃষ্টি...
আকরাম আল মাসরীর কথা পড়ে খারাপ লাগলো।
-টিকটিকির ল্যাজ
অল্প পরিসরে হলেও খুবই তথ্য বহুল এবং ঝরঝরে লেখা আলমগীর ভাই।
ধন্যবাদ
পাচ তারা দেয়ার ক্ষেমতা না থাকলেও দিলাম এইখানে
*****
আমিও পাঁচ তারার পক্ষপাতি। আলমগীর ভাই, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইতিহাস আরেকটু বিস্তারিত লিখবেন নাকি? আশায় রইলাম।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
দুঃখজনক পরিণতি। নিজের দেশের মানুষের হাতেই খুন!
আলমগীর ভাইকে অনুরোধ করছি ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের ইতিহাস একটা সিরিজ হিসেবে লিখে ফেলার জন্য।
প্রাঞ্জল লেখার জন্য ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন