দৌড়ের উপরেই তুষার দর্শন

আলমগীর এর ছবি
লিখেছেন আলমগীর (তারিখ: মঙ্গল, ১২/০৮/২০০৮ - ৯:১৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এ মাসেই কোন এক সময় যাব এরকম একটা চিন্তা মনে ছিলো। পরিচিত এক যুগলকে বললাম, তাদের একজনের লিগামেন্টে সমস্যা, আরেকজনকে তুষার দেখার মতো কী তা বোঝাতে পারলাম না। হঠাৎ করেই শুনলাম তারাই গত সপ্তাহে কয়েক পরিবার মিলে ট্যুর মেরে এসেছে। লক্ষণ ভাল না, একাই যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।

শনিবার রাতে ঠিক করলাম সোমবারই যাব। ওয়েব সাইট খুঁজে একটা মোটেলে বুকিং দিলাম এক রাত থাকার জন্য। ভিক্টোরিয়াতে তুষার পড়ে মূলত আলপাইন পর্বতমালায়। আলপাইন আবার বৃহত্তর গ্রেট ডিভাইডিং রেঞ্জের অন্তর্ভূক্ত। আলপাইন পর্বতমালায় বেশ কয়েকটি রিসোর্ট আছে স্কি এবং তুষারে অন্যান্য মজা করার জন্য।

সুবিধার জন্য বলে রাখি, স্কি সাধারণত দুই ধরণের হয়: ক্রস কান্ট্রি, আর ডাউনহিল। ক্রস কান্ট্রি স্কি হলো প্রায় সমতল ভূমির উপর পড়া তুষারের উপর। অনেকটা সিলেট শহরে তুষার পড়লে, রাস্তাগুলো ক্রস কান্ট্রি স্কি করার জন্য উপযোগী হয়ে যাবে। মোট কথা, এতে ভূমির উচূ-নীচুর জন্য বিশেষ কোন সুবিধা হয় না, স্কি-আর স্টিক ঠেলেই কাজ সারতে হয়। অনেকটা রোলার স্কেটিং করার মতো। আর ডাইনহিল স্কি হচ্ছে পুরো তুষারাচ্ছাদিত পাহাড়ের শীর্ষ থেকে স্কি করে নীচে নামা। এতে স্টিক দিয়ে ঠেলাঠেলির দরকার হয় না, পাহাড়ের ঢালই প্রয়োজনীয় বল জোগায়। একবার নেমে যাবার পর, আবার পাহাড়ের চূড়ায় উঠার জন্য ক্যাবল-কার বা লিফট থাকে। ক্রস-কান্ট্রি অনেকটা বাচ্চা, বুড়োদের, বা নভিসদের জন্য- এতে আহত হওয়ার সম্ভাবনা কম। অন্যদিকে, খুব ভাল দক্ষতা না থাকলে কেউ ডাউনহিল স্কি করে না। কারণ এতে আহত হওয়ার খুব বেশী সম্ভাবনা থাকে।

যারা, আমাদের মতো, স্কি করতে পারে না, তাদের জন্য আছে টোবোগান। ছোটবেলায় সুপারি বা নারকেলের ডালে বসিয়ে একে অন্যকে টানতাম- ব্যপারটা অনেকটা সেরকম। একটা প্লাস্টিকের বড় গামলা নিয়ে একটু উচুতে গিয়ে, গামলায় বসে নিজেকে ছেড়ে দিতে হয়। গামলাটা ঢাল বেয়ে ১৫-২০ মিটার গিয়ে থামে। আবার হেঁটে হেঁটে উপরে উঠে একই কাজ।

ভিক্টোরিয়াতে ক্রস-কান্ট্রি স্কি করার জন্য আছে খুব কাছে লেক মাউন্টেন। এতে টোবাগানের সুবিধা থাকলেও মূল তুষারের স্থানগুলো কেবল স্কি-অলাদের জন্য। ট্র্যাক নষ্ট হবে বলে সেথানে অন্য কাউকে যেতে দেয় না।

সে তুলনায়, মাউন্ট বুলার হলো আদর্শ স্থান। এটি ডাউনহিল স্কির জন্য হলেও, বিস্তার এত বিশাল যে চোখ জুড়িয়ে যায়। আর স্কি না করলেও তুষারের একেবারে চূড়ায় উঠতে কোন বাধা নেই। আর এবার মাউন্ট বুলারে টনকে টন তুষারপাত হয়েছে। আগ-পাছ ভেবে মাউন্ট বুলার যাওয়ার পরিকল্পনা করি।

মেলবোর্ন শহর থেকে মাউন্ট বুলারের দূরত্ব হলো ২৩৬কিলো। কিন্তু, মাঝে ৬০, ৫০ এমনকি ৪০কিমি সীমার রাস্তাও আছে। শহরের শেষ সীমা হলো লিলিডেইল। লিলিডেইল ছাড়ালেই গাড়ী ১০০ তে চালানো যায়। সোমবার সকাল ৯টার দিকে যাত্রা শুরু করি। আমার বাস শহরের যে দিকে লিলিডেলইল তার উল্টোদিকে। সোমবারের সকালের ভীড় শেষ করে প্রায় ১টার দিকে মাউন্ট বুলার পৌঁছাই। পথে ম্যান্সফিল্ড থামতে হয়েছিল টোবোগান আর চেইন ভাড়া করার জন্য।

ভাল কথা, রাস্তায় তুষার পড়লে গাড়ীর চাকা পিছলে যায়, তাই বিপদ এড়াতে চাকায় লাগানোর জন্য বিশেষ ধরনের চেইন বহন করা বাধ্যতামূলক। তবে এর আগে যতবার গিয়েছি, কখনও চেইন লাগাতে হয়নি, এবার এত বেশী তুষার পড়েছে যে লাগাতে হয়েছিল। রাস্তা আঁকা-বাঁকা, একটা বাঁক মিস করলে একেবারে খাদে। ফেরার পথে অবশ্য লাগেনি।

ঘণ্টা চারেক তুষারের মধ্যে মজা করে ফেরার সময় হয়। এর মধ্যে একটা ঘরে বসে দুপুরের হালকা খাবারটাও হয়ে যায়। ফেরার সময় গন্তব্য মেরাজিগ, মাউন্ট বুলার থেকে ১৫কিলোর মতো দূরে। মেরাজিগে মোটেল খুঁজে পেতে কোন সমস্যাই হয় না। দরজায় নাম্বার লক, কোড আগে থেকে ইমেইল করে জানিয়ে দিয়েছে। ঘরে ঢুকে আমার মেয়ের মাথা খারাপ। জানালার নীচেই ডেলাটাইট নদী। আমাদের দেশের হিসাবে বড়জোড় নালা। নদী দেখে, তার আর বিষ্ময় কাটে না।

রাস্তার অপর দিকে বার-কাম-রেস্তোরা। রাতের খাবারের জন্য ওখানে যাই। বড় একটা ফায়ারপ্লেস। সাদারা একেকটা বাইরে থেকে আসে আর আগুনের মধ্যে পাছা দিয়ে দাঁড়ায়। হারে, আমরা ছোটবেলায় আগুনের মধ্যে হাত শেকতাম। খুব ভাল একটা ডিনার করে রুমে ফিরি। ক্লান্ত থাকলেও সহসাই ঘুম আসে না।

ভোর উঠে নাশতা সেরে আবার মেলবোর্ন যাত্রা। পথে ম্যন্সফিল্ডে বিরতি, চেইন আর টোবোগান ফেরৎ দেয়ার জন্য।

অসম্ভব ভালো গেল দুটো দিন।

কয়েক দানা ছবি জুড়ে দিলাম।
auto
১. আসল তুষার-১।
auto
২. আসল তুষার-২।
auto
৩. শাটল বাসের অবস্থা।
auto
৪. পার্ক করে রাখা গাড়ীতে তুষার।
auto
৫. গাছে তুষার।
auto
৬. মোটেল থেকে দেখা দৃশ্য।
auto
৭. মোটেল থেকে দেখা দৃশ্য।


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

তিন নাম্বার ছবি দেখে মনে হচ্ছে ফ্রীজিং রেইন হয়েছে- এহ্ একেবারে বাজে অবস্থা। ভালই মজা করেছেন মনে হচ্ছে।

স্বপ্নাহত এর ছবি

তুষারপাত জিনিসটাই এখন পর্যন্ত দেখতে পারলাম না মন খারাপ

---------------------------

থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার...

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

রায়হান আবীর এর ছবি

আচ্ছা।

---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল

সবজান্তা এর ছবি

ছোটবেলায় ভাবতাম, একটা করাত দিয়ে হিমালয়টা কেটে ফেলবো, তাহলে যদি এ দেশে বরফ পড়ে। এখন মনে হয়, যাক অন্তত বাঁচা গেছে যে এদেশের লোক তুষারপাতে মরে না !


অলমিতি বিস্তারেণ

মুশফিকা মুমু এর ছবি

দেখে খুব লোভ লাগছে ভাইয়া, হাসি খুব মজা করলেন।
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

ছবিগুলি ভালো হইছে ... আর লেখাতো দারূণ ...

আমারও ছোটকালে হেভি মেজাজ খারাপ হইতো বাংলাদেশে বরফ পড়ে না ক্যান এই জন্য ... সবজান্তার মত আমিও হিমালয়রে কঠিন গালি দিছি ... সেই বরফ দেখার শখ মিটছে কানাডা আসার পর ... স্কীইংটা শিখে নিতে হবে সুযোগ পাইলে ...

মুমু, বরফ দেখতে চাইলে কানাডা আসো দেঁতো হাসি
................................................................................
objects in the rear view mirror may appear closer than they are ...

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

আমার জীবনের অনেকগুলো (এখন পর্যন্ত) পূরণ না হওয়া ইচ্ছার একটা হলো, চারপাশে গুড়ো গুড়ো তুষার পড়ছে আর আমি তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। জানি না আদৌ কখনো পূরণ হবে কি না এই ইচ্ছা!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।