একখান দো-নলা বন্দুক আর পর্যাপ্ত বাঘ থাকলে মির্জার মতো শিকারে যাই এমন মন খারাপ অবস্থা। কিন্তু বাঘ-বন্দুক কোনটাই নাই। অনেকটা প্রতিজ্ঞাই করেছিলাম পড়াশোনার শেষ পেরেকটা না ঠুকে আর এদিক সেদিক কোথাও যচ্ছি না। কিন্তু চোরা অতীতকালে ধর্ম পাঠ না করে চটিপুস্তিকা পড়েছে। তাই, মহা ভারত শুদ্ধ-অশুদ্ধ যাই হোক, সহকর্মীর প্রস্তাবে হুঁ-হাঁ করে সম্মত হলাম টিউলিপ উৎসব যাব। সম্মত হওয়ার অবশ্য ভিন্ন একটি কারণও ছিল। কন্যার স্কুলে তৃতীয় সাময়িক ছুটি চলছে। তাই, সারাদিন কম্পিউটার আর টিভি ছাড়া তার আর বিশেষ কিছু করণীয় নাই। ভাবলাম তাকে নিয়ে একটু কোথাও যাওয়া মন্দ হবে না।
বেড়ানোর জন্য সপ্তাহান্ত প্রকৃষ্ট সময়, কিন্তু আবহাওয়ার অগ্রিম খবর দেখে কিছুটা দমে গেলাম। শনিবারে কিছুটা বৃষ্টির কথা বলছে আবহাওয়া দপ্তর।তাদের কথা আবহাওয়ার মতোই, ক্ষণিকেই বদলায়, তাই বিষ্যুদবার দেখা গেল শনিবারে যতটা বৃষ্টির কথা বলা হয়েছিল ততটা হবে না। আবহাওয়ার পরিবর্তন হলো, সাথে সাথে উদ্যোক্তা দুই বন্ধুর মনও। তারা বেঁকে বসলেন, যাবেন না। একজন অতদূর গাড়ীতে বসে থাকতে অপারগ, আরেকজন প্রথম জনের না যাওয়ার সিদ্ধান্তের ছোঁয়াচ-আক্রান্ত।
মেলবোর্নে, কী গোটা অস্ট্রেলিয়ায় রাস্তার সংখ্যা অত্যধিক। এর অসুবিধা হল হুট করে পথ হারানো সহজ। আবার আরাম হলো, হারানো পথ খুঁজে পাওয়াও সহজ। আরেকটা সুবিধা হলো একাধিক পথে কোথাও যাওয়া। আগে একবার জিপিএসকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে ধরা খেয়েছি, তাই এবার একটু সাবধান। গুগল ম্যাপ, মেলওয়ে (মেলবোর্নের ম্যাপবই) দেখে প্রস্তুতি নিলাম কোন পথে যাব।
টিউলিপ মেলার স্থানটি ড্যানডেনং রেঞ্জের অপর দিকে মনবাল্ক অঞ্চলে। ড্যানডেনং পাহাড়ের দু'দিক দিয়েই সেখানে পৌঁছা যায়। কিন্তু ডানদিকে গেলে কিছু আঁকা বাঁকা পথ পড়ে, সেই প্যাঁচ পড়ে পেটে গিয়ে। তাই বাঁ দিকের পথেই রওনা হই। প্রায় মাঝ-পথে গিয়ে সন্দেহ হয়, ভুল পথে যাচ্ছি না তো। রাস্তার ধারে গাড়ী থামিয়ে মেলওয়ে দেখে একটু মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করি। নাহ, ঠিকই যাচ্ছিলাম। প্রায় দেড় ঘণ্টা বাদে গিয়ে পৌঁছাই। আমিএর আগেও একবার এসেছিলাম, কিন্তু সপরিবারে এই প্রথম। গাড়ী পার্কিং করতে গিয়ে দেখি প্রচুর লোক সমাগম। একেতো শনিবার তারপর, স্কুলছুটি তাই অবাক হই না। তবে বাদামী মানুষের সংখ্যা কিছুটা বেশীই মনে হয়, শাড়ী-সালোয়ার-ফতুয়ার সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। যারা কারণ পরে বুঝতে পেরেছিলাম। শনিবার ছিল ফুটি (অস্ট্রেলিয়ার ফুটবলের) ফাইনাল; তাই সাদারা ঘরে বসে ফুটি নিয়েই ব্যস্ত।
টিউলিপ মেলা, বা উৎসব নাম যাই হোক, আসলে আয়োজন করে টেসালার নামের একটা প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন ফুলের কন্দ বিক্রী করাই এদের মূল ব্যবসা। মেলা ঢুকার জন্য বড়দের টিকিট কিনতে হয়, বাচ্চাদের মাগনা। টিউলিপ যত ইচ্ছা দেখা যাবে, ছবি তুলা যাবে, ছেঁড়া যাবে না। (ছেঁড়া বা কেনার জন্য আলাদা জায়গা আছে।) ভাল রোদ ছিল; ভাল কি বলি অতিরিক্ত রোদ। গায়ে তামা পড়ে যাওয়ার অবস্থা। সান-স্ক্রিনের একটা ছোট রোল ছিল, মেয়েকে দেয়ার পর আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। সলতে আর কালির পার্থক্য নাই; আমার গায়ের রঙ কালো হলেও সমস্যা না, কিন্তু পুড়ে গেলে আসলেই জ্বলে, স্কিন ক্যান্সারের ভয় তো আছেই। অস্ট্রেলিয়ার আকাশে ওজোনের মধ্যে বড় বড় কিছু ফুটো এর প্রধান কারণ।
ঢুকার পরই ডানদিকে কিছু পুরনো ইঞ্জিনের শো। এর আগেরবার দেখেছিলাম পুরনো গাড়ী। ফুল আর মানুষের প্রচুর ছবি তুলি। এক সময় ক্লান্ত হয়ে গান আর মদের আয়োজন দেখতে যাই। কোনটাই জুতের লাগে না, তাই একটু ঘুরাঘুরি করে বের হই। পরের গন্তব্য সিলভান লেক।
সিলভান লেকের অবস্থা শোচনীয়, পানি নাই বললেই চলে। কিন্তু পাশের পার্কে পিকনিক স্পটটা দারুন। বৃষ্টির দিন হলে সাহস করতাম না, কিন্তু বেশ শুকনা বলে এবার পাথর ছড়ানো কাঁচা রাস্তা ধরে, খানা-খন্দ পার হলে যাই ওলরিচ লুকআউট (Woolrich lookout) নামে একটা জায়গায়। দেখার মতো দৃশ্য। বেশ কিছু ছবি খিচলাম।
মেলবোর্নের সব টিভি স্টেশনের মূল ট্রান্সমিটিং এন্টেনাগুলোর অবস্থান ড্যানডেনং রেঞ্জে। উচ্চতাগত সুবিধাই এর মূল কারণ। ওলরিচের পর যাই বার্কস লুকআউটে (Burke's lookout)। এর পাশেই তিনটি বড় বড় টাওয়ার। চারদিক কাঁটাতারের বেড়া, ঠিক তার ভেতরে আরেক স্তর ইলেকট্রিক বেড়া। অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে কেউ ধরা খেলে করার কিচ্ছু নাই, এরকম সতর্কবাণী দেয়া আছে। গাড়ী রেখে দেড়-দুশো মিটার হেঁটে সন্ধান পেলাম সেই লুকআউটের। প্রায় ৬০০ মিটারের মতো উচ্চতা, বাতাসের তোড়ে ভালমতো ছবি নেয়া হলো না। আর হেলায় পা পিছলে নীচে পড়ে যাবার ভাল সুযোগ থাকায় সেখানে আর বেশীক্ষণ না থেকে যাই পরের গন্তব্যে, স্কাই-হাই (Sky high)।
স্কাই-হাই অনেকটা রেস্তোঁরার মতো, বিয়ে ফাংশনের সুবন্দোবস্ত আছে। আছে লাগোয়া বেশ কিছু বাগান, আর একটা মেইজ ফিল্ড। স্কাই-হাইয়ের আকর্ষণের মূল কারণ হলো এখান থেকে পুরো মেলবোর্ন, আশে পাশের আরো পাহাড় সব দেখা যায়। রাতের বেলায় দেখার মতো দৃশ্য। আমরা যখন যাই তখন গনগনে রোদ। খালি চোখে মেলবোর্নের অট্টালিকার সারি কিছুটা দেখা গেলেও সূর্যটা ঠিক চোখে পড়ে, ক্যামেরাতে কিছুই আসে না। তারপরে বাগানের দিকে যাই। একটাতে দেখি বিয়ে হচ্ছে। আরেকটাতে বেশ কিছু স্ট্যাচু। পেঁচা, ময়ুর আর তারপরে বস্ত্রোন্মোচনরত মহিলা!
স্কাই-হাই শেষ করে ফিরতি পথে আরেকটা লুকআউট (Rendezvous lookout), কিন্তু ততক্ষণে আর উদ্যম নাই। ফিরতি পথে ক্লান্ত ছিলাম, তাই মাথায় থাকতে থাকতেও একটা লেইন মিস করে যেখানে বের হওয়ার কথা তার এক এক্সিট আগে বের হয়ে গেলাম। দুই-মোড় ঘুরে সিটির মধ্যে দিয়ে মিনিট বিশেক আয়ু ক্ষয় করে বাসায় ফিরি।
মন্তব্য
চমৎকার হয়েছে ছবিগুলো !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
থ্যাংকস রণদীপ দা।
কে যেন বলেছিল মুচমুচে লেখা। আমিও সেটাই বলি। আপনার বর্ণনা অতি গতিময়। পড়তে ভালো লাগে আবার সময়ও কম লাগে। ছবিগুলো খুব সুন্দর। অস্ট্রেলিয়া মনে হয় খুবই সুন্দর জায়গা।
এই ছবি সুন্দর কন! সনির সবচেয়ে কমদামী ক্যামেরা দিয়ে তোলা।
ছবিগুলা আপনার বর্ণনার সাথে খুবই মানানসই, আর তাই খুবই সুন্দর। তাছাড়া কোয়ালিটি ওয়াইজ বেশ ভাল যেটা সনির ক্যামেরার বৈশিষ্ট বলা যায়।
খুব সুন্দর লেখা আর অস্বাভাবিক সুন্দর ছবিগুলো। পড়ে আর দেখে আনন্দ হচ্ছে। জার্মানী আর সুইজারল্যান্ডের সীমানায় মাইনাও বলে একটি দ্বীপ আছে এক লেকে। সেখানেও এমনি এক বাগান করে রাখা হয়েছে। অনেক আগে গিয়েছিলাম।
তবে দু:খ হচ্ছে আপনার অলস বন্ধুদের জন্যে, যারা মাত্র দেড় ঘন্টার জার্নিকে ভয় পেয়ে এমন সুযোগ হেলায় ছুড়ে ফেললেন।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
মাথায় থাকল তীরুদা, ধন্যবাদ। জর্মান দেশে যাওয়ার সম্ভাবনা জাগতে পারে।
আমার স্বল্প মেয়াদি জার্মানি বাসে সৌভাগ্য হয়েছিলো ইনসেল মিনাও যাওয়ার। ওখানে ঋতু ভেদে ফুলের আয়োজন হয়, আমি গিয়েছিলাম যখন তখন গোলাপের মেলা। যাত্রাপথও খুব সুন্দর, লঞ্চে চড়ে যেতে হয়, ভোরের হাল্কা কুয়াশায় মায়াময় এক জগত। দ্বীপে একটা গীর্জাও আছে, হাতে সময় থাকলে ভেতরে একটু ঘুরে আসতে পরামর্শ দেবো, সুন্দর সাজানো গোছানো জায়গা।
ছবি যা তুলেছিলাম সব দেশে পড়ে আছে, আপনাদের সাথে ভাগ করা গেলো না, দু:খিত।
তার এক চাচারে কোন এক বানরে তাড়া করছে- এইটা শুইনাই মন খারাপ
আলমগীর ভাই, সামনের মে তে নেদারল্যান্ডস আসেন, টিউলিপ থেকে জ্যান্ত বায়ুকল দেখাবো আপনাকে।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
ওইদিকে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। গেলে দেখে আসব। ধন্যবাদ।
সুন্দর লেখা আলমগীর ভাই, ছবিগুলোও খুব সুন্দর। আপনার বন্ধুদের জন্য মায়া লাগতেছে
এই আপনার বস্ত্রোন্মোচনরত মহিলা! হাহাহা, মজা পেলাম। আপনার মেয়েটা খুব কিউট তো। কোন গ্রেডে পড়ে?
__________________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?
অতন্দ্র ভাই ধন্যবাদ।
মেয়ে প্রেপ এ পড়ে। (গ্রেড শুরু হয় নাই।)
ভাইয়া আপুর ছবি তোলার হাত তো ভালই, আপনরা নায়ক নায়ক ছবিতো বেশ ভালই এসেছে
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
আমাদের তো আর পেশাদার ফটোগ্রাফার বন্ধু/বান্ধবী নাই
আহ্... বাগানটা দেখেই লোভ হইতেছে... এখানে শুটিং করা যাইতো!!!
আর পুরান গাড়িটা তো দারুন। নেক্সট একটা ধারাবাহিকের জন্য এইরকম একটা গাড়িই খুজতেছি। কি যে করি...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
পরশু যাবো ভাবতেছি টিউলিপ মেলায়। আবহাওয়া ঠিক থাকলে আর কি.... !
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
নতুন মন্তব্য করুন