মাস চারেকই হবে, আগে আমাদের ভিজিট করতে আসেন পিটার স্মিথ। পিটার ক্যান্টারবেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যালের প্রফেসর। অনেকটা অপ্রস্তুত অবস্থায় আমার করা সব কাজের একটা ম্যারাথন-প্রেজেন্টেশন দিই। সেটার স্থায়িত্ব ছিল ঘণ্টা চারেকের উপর। আমার কাজে কিছু সমস্যা আছে যেগুলোতে ভালো পরিসংখ্যান জানা কারো সাহায্য দরকার। পিটারের ব্যাচেলর ছিল পরিসংখ্যানে, তাই আশা ছিল কোন পরামর্শ দিতে পারবে। আমার আগে পরে আরো দুজন তাদের কাজ নিয়েও একই রকম প্রেজেন্টেশন দেয়। তখন আলোচনা হচ্ছিল তাদের একজনকে নিউজিল্যান্ড পাঠানোর। দিনশেষে আমার সুপারভাইজার তার বাসায় পার্টি দেন। খানা-পিনা শেষে পিটারকে হোটেলে পৌছে দিই। সব ভুলে যাই।
হঠাৎ করেই সেদিন আমার সুপারভাইজার পেছনে এসে হাজির। তার তখন ছুটি চলছিল, বনে-বাঁদারে ঘুরে বেড়ানোর কথা। আমি নিশ্চিন্তে জিমেইলে কার সাথে যেন বাৎচিত করছিলাম। এসেই বলে, নিউজিল্যান্ড যাবা? সময় খুব সংক্ষিপ্ত, তার উপর নিউজ্যিলান্ডের ভিসা পেতে বেশ সময় লাগে। দোনা-মনা করে, কিছুটা ভাবনা-চিন্তা করে রাজী হই। যাওয়া-আসা টিকেট, থাকা, খাওয়া সবই স্পনসরড, কাজেই আর্থিক দিক থেকে কোন সমস্যা না। একথা জানিয়ে পিটারে ইমেইল করে দিই, স্পন্সরশিপের কাগজপত্র পাঠানোর জন্য। এক সপ্তাহ যায়, দুসপ্তাহ যায়, পিটার আর কোন উত্তর দেয় না। ধৈর্যের শেষ দেখে একদিন ফোন করি, যায় তার মেসেজ বক্সে। ধরে নিই এত অল্প সময়ে আর যাওয়া যাচ্ছে না।
অবাক করে দিয়ে একদিন সব কাগজ-পত্র ই-মেইল করে দেয় পিটার। সেসব মিলিয়ে ভিসার জন্য আবেদন পত্র পাঠাই সিডনি, নিউজিল্যান্ডের হাইকমিশন অফিসে। তিনদিন বাদে ফোন আসে, আরো এই সেই কাগজ দেও। দিলাম। ভিসার অপেক্ষায় থাকি। যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল যেদিন তার পাঁচদিন পর ভিসা আসে। সেই দিনই টিকিটের জোগাড় হয়ে যায়। এক রবিবার যাত্রা।
এর আগে স্ত্রী-কণ্যা রেখে একবারই মাত্র বাইরে ছিলাম, দিন পাঁচেকের মতো। সেটা অস্ট্রেলিয়ার মধ্যেই, প্রতিদিন ফোনে কথা হত। এবারেরটা ভিন্ন। একদিন রাতে বাইরে খেতে গিয়ে কনফুদের সাথে দেখা হয়ে গেল। শনিবার প্রায় সারাদিন বাজার-সদাই করেই কাটে। আর কিছু ছোট-খাট প্রস্তুতি। নিউজিল্যান্ডে দেখার কী আছে, আবহাওয়া কেমন, এসব কিছু জানার একটু চেষ্টা করি। আমার গন্তব্য ক্রাইস্টচার্চ, ওয়েলিংটনে আরো একজন আছে তার সাথে দেখা হলেও কাজ হবে।
রবিবার খুব ভোরে মেয়েটা মার সঙ্গ ছেড়ে আলগোছে আমার বিছানায় চলে আসে। নরোম খরগোশের মতো বুকে মুখ গুঁজ থাকে। ধক করে বুকের মধ্যে একটা আওলা ভাবের সৃষ্টি হয়। এ বোধটা অনেক আগের পরিচিত, তবু সইতে কসরৎ করতে হয়। সবকিছু গোপনে রেখে গোছগাছ করি। অফিসের কাজে বাইরে যাচ্ছি, আরো টাকা নিয়ে আসতে হবে। বসি বেয়ার এট দি সার্কাস, ম্যাথ ওয়ান এন্ড টু গেমস এসব কিছু কিনতে টাকা লাগবে না? মেয়ে কী বোঝে কে জানে!
যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, বছরের বিশেষ বিশেষ ছুটিতেই কেবল বাড়ী যাবার সুযোগ হত। বাড়ীতে থাকা মানে চাকচিক্যহীন, সুযোগ-সুবিধাহীন দ্বীপান্তর বাস। প্রায় সময়ই ছুটি শেষ হওয়ার দুতিন আগেই চলে আসার একটা চেষ্টা করতাম। খুব ভোরে বাসে করে ঢাকা আসতে হতো। তারও আগে ঘুম থেকে উঠে আমার মা ভাত রান্না শুরু করতেন। ছেলে গরম ভাত খেয়ে যাবে। কত মানা করতাম, রাগও করতাম। যাবার আগে সেই আওলা একটা বোধের জন্যে উগলে আসত খাবার। সিলেট ফিরে আবার সব স্বাভাবিক। সবই ভুলে যেতে চেষ্টা করতাম।
ক'বছর পরে যখন আমার মেয়ে থাকত চট্টগ্রাম, স্ত্রী থাকতেন ঢাকা, আর আমি সিলেট। এই তিনকোণে থেকে মাসে দুবার চট্টগ্রাম যেতে হত। যাবার আগে, ফেরার সময়ে সেই আওলা ভাবটা এসে গ্রাস করত। মানসিকভাবে বেশ শক্ত মানুষটা আমি হাঁটুতে বল পেতাম না। এই বিদেশ বিভুইয়ে নিজেকে আবার দুর্বল ভাবতে শুরু করেছি। খুব খারাপ।
রবিবার বিকেলে এক বন্ধু এয়ারপোর্টে নামিয়ে দেয়। চেকইন, ইমিগ্রেশন সব পার হয়ে বোর্ডিংএর জন্য অপেক্ষা করি। মাথা আওলা থাকলে খুব ঘুম আসে। ঘুমাতে পারলে ভাল হত। প্লেনে উঠে একটু হতাশই হই। বাজেট এয়ারলাইনস মানে যে মিরপুর-গাবতলী বাস এটা কে জানত। দোষ আমারই এয়ার নিউজিল্যান্ডের টিকিট ছিল শনিবারের, সেটা পাল্টে রবিবারে নিয়ে আসি এই ফকুন্নি-মার্কা বাজেট প্লেনে। নিউজিল্যান্ডের আবহাওয়ার খুব খ্যাতি আছে ঝড়ো হাওয়ার জন্য। অনেকটা সে কারণে খুব টার্বুলেন্ট একটা জার্নি শেষ যখন ক্রাইস্টচার্চে নামলাম, মাথাটা তখন বনবন করছে; একটু হলে হরহর করে ছেড়েই দিতাম বোধ হয়।
ইমেগ্রেশনে ভালই দেরী হল। সবুজ পাসপোর্টের বিশেষ গুণ আছে, নামের বাহার, গায়ের সৌন্দর্য সব মিলে একাকার অবস্থা। তার উপর কমাস আগে পাসপোর্ট পাঠিয়েছিলাম ক্যানবেরা নবায়নের জন্য। দুতাবাসের ভদ্রলোকেরা প্রেমে পড়ে আমাকে আস্ত নতুন একটা পাসপোর্ট দিয়েছেন। এখন আমার দুটি সবুজ বই। একটাতে এই ভিসা, আরেকটাতে ওই ভিসা। এই সব যন্ত্রণা বুঝিয়ে শেষ করে বের হয়ে দেখি কোয়ারানটাইনের কিউতে আমি সবশেষ ব্যক্তি। সাথে ছিল চিজ-বিস্কুট, বিনে ছুড়ে ফেলে দ্রুত বের হয়ে আসি। পিটার আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।
পিটার ভদ্রলোক আগাগোড়া নুছুরি-ফুছুরি। এর আগে যতবার দেখা হয়েছে, শীতে কী গ্রীষ্মে, একটা টি-শার্ট আর থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরনে। আজও তার ব্যতিক্রম দেখলাম না। গাড়ী নিয়ে আর কিছু নাই বলি। গাড়ীতে চড়ে, গল্প করতে করতে চলে আসি ডর্মে যেখানে বাকী ১৪ দিন থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গাড়ীর বুট থেকে ব্যাগ নামাই, দেখি পিটার এক কার্টুন ভর্তি কী নামায়। মাই ওয়াইফ গেভ সাম ফুড ফর ইউ, নট শিউর হোয়াটস ইন দেয়ার। রুমে এসে দেখি তাতে, দুধ, জুস, চা, চিনি, ব্রেড, জ্যাম, প্লেট, গ্লাস, মাগ- ভদ্রমহিলা কিছু বাদ দেন নাই।
বিদায় জানিয়ে ঘুমের আয়োজন করি। কাল সকালে আবার দেখা হবে তার সাথে।
পুনশ্চ: ক্রাইস্টচার্চের কেউ থাকলে আওয়াজ দিয়েন।
মন্তব্য
আনন্দময় হোক...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ফটুক টটুক নাই। শুনছি নিউজিল্যান্ডে গরু ছাড়া আর কিছু নাই। আবার দুর্দান্ত
"ছিনছিনারি"। একটু দেখবাম মন চায়।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
মনে হচ্ছে, পড়েছিলাম - নিউজিল্যান্ডে মানুষের চেয়ে ভেড়ার সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
একলা পথে চলা আমার করবো রমণীয়...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
ছিন চিনারি আসবে। অপেক্ষা করিতে হইবেক।
আরে দুই সপ্তাই তো ... দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে ...
ফটু দিয়েন ...
.................................................................................................
objects in the rear view mirror may appear closer than they are ...
আমারো দাবী.........
ছবি চাই, আলমগীর ভাই!!
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
বিদেশ থেকে বিদেশ যাত্রা শুভ হোক.. আনন্দময় হোক !
ভাল থাইকেন
কাজের চাপে পড়ে মেয়ের জন্য বেয়ার এট দি সার্কাস বইটি কিনতে ভুইলেন না কিন্তু।
আরে ব্যাপার না। মাত্র কয়েকটা দিন- দেখতে দেখতেই চলে যাবে।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
- ক্রাইস্টচার্চের চার্চের সুনাম না থাকলেও ক্রিকেটের মাঠে দর্শকদের বেশ সু-নাম আছে। টিভির স্ক্রীনে যে জিনিষ দেখতাম! শীত কই যাইতোগা...!
আর কাউরে খুঁইজা লাভ নাই আলমগীর ভাই। মাঠের আশেপাশে অবস্থান নেন। হাতে অতি অবশ্যই একখানা ক্যামেরা রাইখেন এই অধমদের লাইগা।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আপনাদের অঞ্চলে কী বলে জানি না, ময়মনসিংহ অঞ্চলে বলে ঠুয়া। গরু যেত ধান খাইতে পারে সেজন্য মুখের মধ্যে লাগায়। বিয়া কইরা ঠোয়া লাগাইছি, কাজেই নরম গরম ছবি ইচ্ছা করলেও দিতারিনা। মেম্বারের অবস্থাটাই দেখেন।
আমার অস্ট্রেলিয়া প্রবাসি চাচাও কয়েকদিন আগে নিউজিল্যান্ড ঘুরতে গিয়েছেন। আসার পর আমি অনলাইনে জিজ্ঞেস করি, ক্যামন লাগলো?
উনি বিরক্তভাবে জবাব দেন, ভালো না মিয়া, ফাউল...
=============================
মেয়েকে নিয়ে লেখা খুবি টাচি।
আমার জন্য চকলেট নিয়ে আইসেন
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
সময়টা দেখবেন দেখতে দেখতে কেটে যাবে। ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা নিয়ে বিস্তারিত জানায়েন পরে। ছবিও দিয়েন সাথে।
লেখাটা ভালো লাগলো আলমগীর ভাই। বিশেষ করে, মেয়েকে নিয়ে লেখা অংশটা টাচ করলো খুব।
ভালো থাইকেন। শুভকামনা থাকলো।
ভ্রমণ আনন্দময় হোক।
আপনার মেয়েটা খুব আদুরে মনে হচ্ছে.....
ভাল লাগল।
ভ্রমন নিরাপদ ও আনন্দময় হোক
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
সবাইকে ধন্যবাদ।
@মুমু
চকলেট পাঠাবো কেমনে? ফ্রেব্রুয়ারিতে সিডনি আসব, তখন নিয়ে আসলে চলবে?
@রায়হান
এরা নিজেরা বলে লেইড-ব্যাক লাইফ স্টাইল। বাংলায় বললে হবে নেতানো না হয় পোতানো।
@ছবি প্রত্যাশীগণ
একটু সবুর করেন।
ভাল্লাগলো। তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন মেয়ের কাছে। অন্তর ছুঁয়ে গেল ঐ অংশটুকু।
নিউজিল্যান্ডে গরু ছাড়া দেখার আর কী আছে?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
হ, তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন, ওই দিনের পিজা তো ডিউ রয়ে গেলো, বেশিদিন আপনাকে ঋণী করে রাখতে চাই না।
-----------------------------------
তুমি যা জিনিস গুরু আমি জানি, আর কেউ জানে না
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
নতুন মন্তব্য করুন