বৃষ্টির দিন ছিল, রাতেও ছিল বৃষ্টি। আমাদের মাঝে যাদের বৃষ্টি প্রীতি ছিল তারা ছাড়া আর সবাই বিরক্ত। টানা বৃষ্টি কারইবা ভালো লাগে।
আমি বৃষ্টি পিয়াসি মানুষ। মেঘ আমায় মাতাল করে। আমি মেঘের ছায়ায় দাঁড়াতে পছন্দ করি। বৃষ্টিতে ভিজি বালক বেলার উল্লাসে।
শাহানার সাথে দেখা হয়। সেও বৃষ্টিময় দুপুরে। আমি হাটছিলাম কংক্রিটের রাস্তায়। মানুষের সাথে মানুষের সহজে ঘেষাঘেষি হয়না এমন রাস্তা। তবু হঠাৎ কেউ একজন আমার শরীরে হামলে পড়ার মতই আচরণ করে। সামলে নিয়ে তাকাই। শাহানা! বদলে যাওয়া শরীর নিয়ে দাড়িয়ে আছে আমার সামনে।
শাহানা, আহা শাহানা। আমার নিঃশ্বাসের মত প্রিয় ছিলে তুমি। আমার বুকে তোমার জন্যই জমে আছে গাঢ় এক বেদনা।
শাহানাদের পুকুরে শানবাঁধানো ঘাট ছিল, তাদের তিন মহালা বাড়ি ছিল। আমি সেই বাড়িতে কতবার গিয়েছি। গ্রাম থেকে উঠে আসা নিতান্ত এক কিশোরের জন্য সে বাড়ি ছিল আরামদায়ক নিঃশ্বাসের মত। সে বাড়িতে শাহানা ছিল।
শাহানার সাথে দেখা হলে মেঘ মেঘ দুপুরে সে আমাকে নিয়ে পাশের ষোলতলা বাড়িটার দিকে হাঁটা দেয়। আমি কোন কথা না বলে তাকে অনুসরণ করি। আর অবচেতন মনে চাপা ফুলের ঘ্রাণ খুঁজি। শাহানার কাছে গেলে সেই কৈশোরে আমি চাপা ফুলের ঘ্রাণ পেতাম। মূলত এই ঘ্রাণের লোভেই আমি তার পাশে পাশে থাকতে চাইতাম। মূলত এই ঘ্রাণের খোঁজেই আজও আমি শাহানার সাথে হাটতে থাকি।
কোন ফাকে এগার তলায় উঠে এলাম টেরই পেলামনা। কৃত্রিম গাছ ও লতাপাতা জড়ানো দরজা খোলে শাহানা আমায় ডাক দেয়, আয় ভেতরে আয়।
এয়ারফ্রেশনারের ঝাজালো গন্ধময় একটা ঘর। আমাকে বসতে বলে চঞ্চল পায়ে ভেতরের ঘরে চলে যায় শাহানা। আমি দেয়ালে চোখ ফেলি। ঝা চকচকে একটা প্রাসাদের সামনে দাড়িয়ে শাহানা। ইউরোপিয়ান পোষাকের শাহানাকে আমার দুরাগত এক রাজকুমারী বলে ভ্রম হয়। পাশে আরেকটা ছবি। সোনালী চুলের পুতুল পুতুল মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে শাহানা। আমি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখি। কখন যে শাহানা এসে পেছনে দাড়িয়েছে টের পাইনা। বলে, আমার মেয়ে, বাপের সাথে থাকে। শাহানার দিকে তাকাই, কি এক বিষণ্নতা দেখি তার চিবুকে।
কলেজের বেড়া ডিঙানোর আগেই শাহানার বিয়ে হয়েছিল। হাওর পারের না কিশোর না তরুণ আমি সেই বিয়েতে ছিলাম স্পেশাল গেস্ট। কনের বন্ধু বলে কথা। বিয়ের আসরেই শাহানার বড়ভাই আমার সাথে দুধে আলতা রঙের হিমায়িত মাছ কারবারি শাহানার বরের পরিচয় করিয়ে দেন। তার আগে আমার মহাজন বাবার পরিচয়টা দেয়া হয়। মুক্তোর মত দাঁত বের করে শাহানার বর হাসে। আমি তার পাশে মিনিট পাঁচেক বসি। আর বেদনায় নীল হই। আহা শাহানা সেদিন আমি তোমার জন্য বেদনাহত হয়েছিলাম, তুমি কি তা বুঝেছিলে...
এক মাসের মাথায় বরের সাথে উড়াল দেয় শাহানা। তারও পনের দিন পরে আমার কাছে রয়্যাল মেইলের চিঠি আসে। সেই প্রথম কেউ আমাকে চিঠি লিখে। শাহানার চিঠি। আমি ভালো, তুই কেমন আছিস? এর বেশি কিছু ছিলনা সে চিঠিতে। তবু আজো সে চিঠি আমি যতন করে রেখেছি। চারটা চিঠি লিখেছিল শাহানা। সবগুলোই আছে আমার কাছে। যক্ষের ধনের মত আগলে রেখেছি আমি শাহানার চিঠি।
দ্বিতীয় চিঠিতে শাহানা লিখেছিল, ওর বর মদ খায়। রাতে বাড়ি ফেরেনা প্রায়ই। শাহানা ভালো নেই এই বিষয়টা রাস্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পড়ুয়া তরুণের না বুঝার কথা নয়। সে রাতে আমি মেসে ফিরিনি। সারা রাত রাস্তায় রাস্তায় হেটেছি। সেরাতে বৃষ্টি ছিল। আমি বৃষ্টিতে ভিজে শীবগঞ্জের মেসে ফিরেছি।
তৃতীয় চিঠিতে শাহানা লিখেছিল, সে স্কটল্যান্ড চলে যাচ্ছে। তার ছোটমামার কাছে। স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ির খবরও ছিল সে চিঠিতে। শেষ চিঠিটা তারও বছরখানেক পরে লেখা। আবার লন্ডনে ফিরছে। মাঝবয়েসি এক সাদাচামড়াওয়ালা মানুষ শাহানাকে জড়িয়ে ধরা এমন একটা ছবি ছিল সেবারের খামে! এর পর আর শাহানা চিঠি লিখেনি।
দশ বছর পর শাহানা আর আমি পাশাপাশি বসি। আমার হাত নিয়ে খেলতে থাকে শাহানা। সেই আগের মত। পারমিতার কথা বলে। পারমিতা, শাহানার মেয়ে। ৮ বছর বয়েস। বলে, শেষ পর্যন্ত বিলেতি স্বামীর ঘরেও না টিকতে পারার বেদনার কথা। মেয়েটাকে ইচ্ছে করেই ফেলে এসেছে। থাকুক সেখানে। ইচ্ছেমত বেড়ে উঠুক। আর কিছু হোক আর না হোক না বোঝার বয়েসে বিয়ে অন্তত কেউ দেবেনা!
এক এক করে পরিচিত মানুষের কথা জানতে চায় শাহানা। আমি তাকে কোন খবরই দিতে পারিনা। বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মত আমার জীবন। এ দ্বিপে কেউ আর তার খবরের পায়রা পাঠায়না এই সত্য জেনে কেমন বেদনায় ভরে উঠে শাহানার অবয়ব। আমি চাপা ফুলের ঘ্রান পাই।
শাহানা আমার মাথায় বিলি কেটে দেয়। যেন তাদের পুকুরঘাটে বসে আছি আমরা। আমার কেমন অস্বস্তি হয়। বিয়ে করলামনা কেন? জিজ্ঞেস করে। উনত্রিশ খুব বেশি বয়েস নয় বলে আমি পাশ কাটাই। শাহানা দৌড়ে আবার উঠে যায়। আমার জন্য খাবার রেডি করতে। আমি না না করি। বলি খেয়েছি একটু আগেই। কে শুনে কার কথা। বলি, যাওয়া দরকার। বলে, বৃষ্টির মধ্যে যাবি কিভাবে? খেয়াল হয় আমার। ভারি পর্দা তুলে বাইরে তাকাই। ঝুম বৃষ্টি। এইসব বাড়িগুলো সবকিছু থেকে আগলে রাখে! এরা রোদ পোহাতে দেয়না, বৃষ্টিতেও ভিজতে দেয়না। আমি পর্দা সরিয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকি, নিঃশব্দ বৃষ্টি। এই প্রথম আমি শব্দহীন বৃষ্টির স্বাদ নিই।
দুপুরটা গড়িয়ে যায়। আবারও রাস্তায় নামার নামার তাড়না বোধ করি। শাহানা আবারও কথার প্যাঁচে ফেলতে চায়। এবার আর পারেনা। হঠাৎ শাহারা আমার মুখোমুখি দাড়ায়। চোখে চোখ রাখে, আমি টিকতে পারিনা। চোখ নিচে নামাই। শাহানার পায়ে চোখ আটকে যায়। আশ্চর্য সুন্দর সেই তিলটা এখনও শাহানার পায়ে তারার মত জ্বলজ্বল করছে। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে শাহানা বলে, তুই একবার আমার কাছে কি চাইবি বলেছিলি, চাওয়া হয়নি। সেই চাওয়াটা ফুরিয়ে গেছে? আমি শাহানার পা থেকে চোখ তুলিনা। শাহানা আমাকে শক্ত করে ঝাকুনি দেয়, কি হল? আমার কাছেনা তোর কি একটা পাওনা বাকি রয়ে গেল অপু, চাইবিনা? আমি আশ্চর্য সুন্দর তিলটার দিকে তাকিয়েই থাকি...
মন্তব্য
অসম্ভব ভাল লেগেছে আমার। খুউউব!
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
বৃষ্টি পিয়াসি আমারো ভাল লাগল ভীষণ।
বুকে কেমন যেন একটা হাহাকারের ভাব হচ্ছে। মনে হচ্ছে, বৃষ্টিতে একটু না ভিজলে এই ভাব দূর হবে না।
ভাল আছি, ভাল থেকো।
ভাল আছি, ভাল থেকো।
সে-ই আলবাব ভাই!
দূর্দান্ত লিখেছেন।
পড়লাম আর ডুবে গেলাম; কখনো অপু কখনো শাহানা কিংবা কখনো 'তাহাদের' মাঝে।
আমি আশ্চর্য সুন্দর তিলটার দিকে তাকিয়েই থাকি...
________________________
'আজকে না হয় ভালোবাসো, আর কোন দিন নয়'
উত্তম!
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
জাঝা
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
"আমার কাছেনা তোর কি একটা পাওনা বাকি রয়ে গেল অপু, চাইবিনা? আমি আশ্চর্য সুন্দর তিলটার দিকে তাকিয়েই থাকি... "
একটু কি কষ্টবোধ ছিল না?
ভালৈছে
___________________________
"Intelligence is like an underwear. It is important that you have it, but not necessary that you show it........"
তারেক, মাশীদ, শিমুল, বদ্দা, বড়ভাই, টুটুল ভাই সবাইরে ধন্যবাদ।
বড়ভাইয়ের মন্তব্যে সন্তুষ্ট হইতে পারলামনা। একটু কাটাছেড়া আশা করছিলাম :(। জাঝা দিয়াই তিনি দায় সারলেন। বেজার হইলাম।
মাশীদ বেশি ভিজিসনা আবার, জ্বর আসবে শেষে।
শিমুল আমাতে একটু বেশিই মনে হয় মুগ্ধ!
টুটুল ভাই, বেদনা না থাকলেকি আর হৃদয় পোড়ে?
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
উঁহু। আমি মুগ্ধ 'সেই আশ্চর্য সুন্দর তিলটার' গল্পে।
_________________________
'আজকে না হয় ভালোবাসো, আর কোন দিন নয়'
উপায় আর রাখলেন কি? এইরকম লিখবেন আবার বলবেন ভিজিসনা। যান, আমি খেলব না।
শুধু শেষ লাইনটা নয়, গল্পটার পুরোটাই মন ছুঁয়ে গেল। অনেকগুলো লাইনই বুকে ধক্ করে লাগল। তেমন একটা লাইন 'সে বাড়িতে শাহানা ছিল।'
পুরনো ফর্মে ফিরে আসার জন্য অপু ভাইকে অনেক ধন্যবাদ।
ভাল আছি, ভাল থেকো।
ভাল আছি, ভাল থেকো।
ঠিক আছে শিমুল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
ধন্যবাদ হাসান
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
শেষ পর্যন্ত পান্তাভাতে ঘি!
ঘি ঢাললাই যখন সাথে শ্যামাংগী কাঁচামরিচ আর ঝাঁজালো পেয়াজকুঁচি হলে জমতো বেশ ।
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
আমি শাহানার পা থেকে চোখ তুলিনা। শাহানা আমাকে শক্ত করে ঝাকুনি দেয়, কি হল? আমার কাছেনা তোর কি একটা পাওনা বাকি রয়ে গেল অপু, চাইবিনা? আমি আশ্চর্য সুন্দর তিলটার দিকে তাকিয়েই থাকি...
আর কি করবো বল মামু? সবাই দেখি বিভিন্ন তরিকায় লিখে। তাই আমিও একটা তরিকা নিলাম @ হা.মো.
আমি তাকিয়েই থাকি অপালা...
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
থাকুন।
ভালো লাগলো।
----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।
----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।
ধন্যবাদ সুমেরুদা
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
এরকম হলে পান্তাভাতে ঘি-ও জায়েজ।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
দারুন।
কিয়ের কি!
গরম ভাতে ঘি!!
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
জুবায়ের ভাই যখন জায়েজ রায় দিয়াই দিছেন এরপরেও ঝরার কেন চিত্ত চাঞ্চল্য? গরম ভাত টানেন কেন? মিয়া পান্তাই জুটেনা আর আপনে কন গরম!
জুবায়ের ভাই, ঝরা দুজনকেই ধন্যবাদ
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
মামু,দারুন লেখা তবে মন খারাপ করে দিয়েছে।
মনে হয় না এটি একটি গল্প। একদম বাস্তব।
এরকম হাজারো নাম না জানা শাহানাদের লন্ডনী কুলাঙ্গারদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত।এটা আমাদের সিলেটিদের রেওয়াজ।
পান্তা ভাতে ঘি না। যা হইছে একদম পোলাও বিরয়ানী।
ধন্যবাদ মাহবুব সুমন। অতিথির নামটা জানতে পারলে ভালো লাগতো।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
এবার 'বিরুইন ভাতে ঘি' টাইপের কিছু নামুক ।
-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
শরির জঘন্য রকমের খারাপরে বাবা। পান্তা আর ঘি মিশ খায় নাই। জ্বরে ধরছে।
----------------------------------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
---------------------------
থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার...
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
অনেকটা সময় মনে করে রাখার মতো এ লাইনগুলো! চমৎকার!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
এইটা কইথিকা বাইর করছেরে!!!
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
'মনের মুকুরে'তে ভাসছিলো তখন।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
আট বছর হয়ে গেলো!
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
নতুন মন্তব্য করুন