সকালে, সেটা সাতসকাল ছিলো না। আবার রোদও কড়া হয়নি এমন সময়ে বাবাই আমার ঘড়িটা পরলো। বেশ দামি এই ঘড়িটা। বলাই বাহুল্য, এটা আমি কিনিনি। লিল্লাহ পেয়েছি। (এইটা কেনার মুরোদ আমার নাই।) আমি হালকা রা..রা.. করলাম। সে রুম থেকে বেরিয়ে হেডকোয়ার্টারে আশ্রয় নিলো। চিফ অব ফ্যামেলির আশ্রয়ে থেকে একটা আছাড়া মারলো। শখের ঘড়ি গেলো...
সাত সকালে উঠতে হতো আগে। শহর যারা রাঙাতো আমিও তাদের একজন ছিলাম। এখন আর সেইসব দায় নাই। ইচ্ছে হলে ঘুরি, নাহলে ঘুমাই। শুনেছি আমাদের হাতে গড়া কলেজের উৎসব এখন মিলেঝুলে করা হয়। জিয়া আর মুজিবের সৈনিকেরা নাকি এককাতারে দাড়িয়ে বগল বাজায়। শুনতে খারাপ লাগে না। এই একটা উপলক্ষে কুকুরের চরিত্র ভুলে তারা গলাগলি করে এইটাইতো অনেক! তবু কিছুটা খচখচানি বুকের ভেতরে, খুব গভীরে করতেই থাকে।
এক ভদ্রলোক বিবাহ করছেন, নববর্ষের দিনে বউভাত হচ্ছে। ভুলেও ভাববেন না, বাঙালিয়ানার টানে এই তারিখ নির্ধারন। ছুটির দিনটা কাজে লাগানোই মূল উদ্দেশ্য। গোসল টোসল করে, মাকে নিয়ে, বউকে নিয়ে, ছেলেকে নিয়ে আমি চেপে বসি আমার প্লাস্টিকে। (ঢাকার লোকজনে এই জিনিস চেনার কথা) ভালই চলে বেটা। অনভ্যস্থ আমি হালকা চালে এগুতে থাকি। কিন্তু মিনিট পনেরো পরে একেবারে মাঝরাস্তায় আটকে যায় বেটা। নিউট্রাল করে কোনোমতে রাস্তার পাশে দাড় করাই। খেশ খেশ করে কাশতে থাকে, স্টার্ট হয় না। ইঞ্জিনিয়ারকে ফোন করে মা-বউ-বাচ্চাকে তুলে দিই বেবিটেক্সিতে। আমি রোদে দাড়িয়ে মেকানিকের অপেক্ষা করি। ঘটনা সেটাই ঘটে, ফোনে যা জেনেছিলাম। কি এক্টা বেল্ট ছিড়ে গেছে। সেটা এই দাঁড়ানোতে ঠিক হবার না। একটা টেম্পু ডেকে তার পেছনে বাধা হয় আমার সাধের মারুতিরে। আমি পেছন পেছন মোটর সাইকেলে টানি। প্রিয় মোটর সাইকেলের কাছে এই ফাঁকে ক্ষমাও চাই। এভাবে তারে ফেলে চারচাকায় চাপা যে বিরাট অন্যায় ছিলো সেটা স্বিকার করি।
মেকানিকের হাতে গাড়ি সপে দিয়ে এইপাশ ওইপাশ ঘুরি। কারখানায় যাই। সেখানে আল্লার নাম ছাপায় আমার মেশিনম্যান। অন্যছাপার বেলায় যে অনায়াস ভঙ্গি থাকে, সেটা নাই তার। মাঝখানে ইম্প্রেশনে ইম্প্রেশনে একেকটা দোয়া দরূদ ফুটে উঠে আর সুলতান (কোনো মূলকের সুলতান নয় এ বেটা, জিহ্বা খাটো স্রেফ এক অফসেট মেশিনম্যান, ঘটাঙ ঘটাঙ কর্ড মেশিন চালায় যে) আরো আড়ষ্ঠ হয়। কাগজের মাঝখানে আর হাত দেয় না। গ্রিপার মার্কের বাইরের সাদা অংশে আঙুলে টিপ দিয়ে ধরে ছাপা পরীক্ষা করে। বেরিয়ে আসি, ফোন করি, মা তাড়া দেন, গাড়ি ঠিক না হলে হোক, তুমি খেতে আসো, বউ ফোন করে, তুমি মোটরসাইকেল নিয়েই আসো। বিয়ের আসরে গিয়ে দেখি যে যার মতো চলে গেছে, মা গেছেন তার বোনের বাড়ি, আমার ছেলে খেলছে, দৌড়াচ্ছে, লাল পাড়ের সাদা শাড়িয়াল মেয়েরা পরিশ্রান্ত হয়ে চেয়ারে বসে বসে কলবল করছে, এদের দু একটাকে আমি কোলে নিয়েছি। আজকাল প্রায়ই এমনটা হচ্ছে। যেখানেই যাই, দেখি পিচ্চিগুলো বড়ো বড়ো হয়ে উঠছে। নাকি আমি বুড়ো হচ্ছি? আমাদের বুড়ো আক্তার ভাই এর বিয়েতে গিয়ে একসাথে পেলাম তিন ভাগ্না ভাগ্নিকে। একেকটা পুরা মুরুব্বি। সবচে ছোট যেটা ছিলো, সেটা নাকি ব্যবসা করে! মনে হয় এই সেদিন বেটা হিশু করে পেন্ট ভিজিয়ে ক্যাকু-ক্যাকু করছে, আর আমি নেঙটা করে তারে ছেড়ে দিয়েছি। এর বড়োটা বিদেশে থাকে, আর ভাগ্নি তার পিচ্চিটারে কোলে দিয়ে বলে, অপু মামা দেখো, বিয়ে না করলে আমার মেয়ের সাথে তুমি গুডু মারতে পারতে। আমি বিচ্ছিরি ঠা ঠা হাসি দিয়ে বলি, আমি কি বুড়া হয়ে গেলামরে লুবনা? হাসি ফেরত দিতে দিতে বলে, কি যে বলো মামা, আসলে তুমি আগের মতোই আছো, আমরাই বরঙ বড়ো হয়ে গেছি।
আমার উনিশ বছরি মোটর সাইকেল, বিশ্বস্থ বাহন নিয়ে রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে কেন যে থামলাম... এই ফাঁকে গরম ইঞ্জিনে পা লাগিয়ে ছ্যাকা খায় বাবাইটা। কিন্তু কিছুই বলে না, এমনকি কাঁদেও না। শুধু ঘাবড়ে যাওয়া চোখ নিয়ে তাঁকায়। আমি তার চেহারায় আতঙ্ক দেখি, কান্না দেখি, বলি কি হইছেগো বাবা, সে বলে কিছু হয় নাই। পা তুলে খুঁজেও পাইনা কিছু। তবু মনটা খারাপ হয়। ফিরে চলি। তারপর রাতের শুরুতে বাবাই তার নানার বাসার সোফায় ঘুমিয়ে পড়লে দেখি পায়ের পাতায় টসটস করছে একটা ফোস্কা...
আমার সোনাবাবাই তুমি এমন হচ্ছো কেনা? এতো চাপা কেনো? এখনই, এই চারবছর বয়সেই এতো এতো বেদনা ভেতরে চাপতে শিখেছো কেনো সোনা বাবা আমার? একটু চেচালে, একটু কাঁদলে, একটু ঠোট উল্টালে কি হতো? তুমি কি বাবাকে ভয় পাও, নাকি এই বয়েসেই বুঝে গ্যাছো, এই লোকটাকে, এই কালো লোকটার ভেতরে থাকা টিপটিপ করা হৃদয়ে ধাক্কা দেয়ার কোনো দরকার নাই। দুর্বল চিত্তের বাবার সন্তানেরা বুঝি এমনই হয়?
মন্তব্য
- হুরো মিয়া...
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আসলেই?
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
অসাধারণ লেখা, এমন ব্যক্তিগত অনুভূতি অথচ কী সার্বজনীন। প'ড়ে মন খারাপ হ'য়ে যায়।
আহা কি যে সুইট লাগল লেখাটা, হাসি, খুশি, কষ্ট সব মিলিয়ে খুবি ভাল লাগল, বিশেষ করে শেষের দিকে, আহারে বাবাই ব্যাথা পেয়েও কাঁদলো না
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
ধূগো'দার মতো আমিও কই, হুরো মিয়া!
ঘড়িটা ভেঙ্গে সে একটা কাজের মতো কাজ করেছে। তার ছেঁড়া মানুষের পোলা না?
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
বাবাইটাকে জোরে একটা থাপ্পড় দিসতো অপু
কেন এখুনি সে এতো বড় হয়ে গেল?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
বাহ! খুব ভাল হয়েছে। পড়তে খুব ভাল লাগল।
বাবাই নামটা খুব সুনদর।
তন্ময়
ওহে দুর্বল চিত্ত ( ভয়শূন্য নয়?) !
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
প্রতিবার যা হয়, লেখাটা পড়ে আবারও সেরকম হলো!
... ... যদি এরকম লেখা বাইর হতো আমার হাত দিয়াও!!!
___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ
এসব লেখা একদম ছুড়ির মতো কেটে কেটে বসে। তবুও কী ভীষণ ভাল লাগল লেখাটা।
চারুকলায় ঘুরতে ঘুরতে পোলাটার মাথায় এখন খালি "ছুঁড়ি"-র কথা। নাইলে ছুরিরে ছুড়ি কয় ক্যান?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
না বস, আপ্নে আসোলেই মানুষ্ণা!
ক্যাম্নে ক্যাম্নে কী কী যে খুঁইজ্যা বাইর করেন কৈ কৈ আইসা! একটা কিচ্ছু মিস যায় না!
০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"
___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি
হা হা হা। অনেক ধন্যবাদ সন্ন্যাসী'দা। আর কখনো সজ্ঞানে এই ভুল হবে না আশা করি।
এর আগে আপনার ধরিয়ে দেওয়া 'পড়া/পরা' এখন কিন্তু আর ভুল হয় না
সম্ভবত আমরা ডিজিটাল যুগে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছি ! আমাদের সন্তানরা এ যুগের একেকজন ডিজিটাল মানব হয়ে যাচ্ছে....!!
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
অপুভাই, আপ্নের এই বাইকটাই ফাউল, আমার ঢাকার বাস প্রায় মিস হইয়া গেসলো! বাইক বদলান, এরপর বাবাই ও ব্যথা পাইলে চিক্কুর দিবে, এটা ভাইস্তার নীরব প্রতিবাদ!
শাহেনশাহ মিয়া উঠছিলো আপনের বাইকে? সেইটা এখনো আস্ত আছে?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আজ্ঞে না, ওটায় অপুভাই নিজেই চড়ে আসতেছিলেন।
শেষে এসে এ কী লিখলেন! মনটা খুব হুশ করেই ডুবে গেল! খারাপ হয়ে গেল। আমি আবার তেলেসমাতি, একটা বিষণ্ণ-সুরের গানও শুনছিলাম! বিগড়ে দিলেন খুব।
মন ছুয়ে গেল বাউল ভাই
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
হুমম .....................।।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
ধুগোর মন্তব্য দেখুন।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
এত সাবলীল আর ধারালো দিনপঞ্জি!
বাবাইকে নিয়ে শেষের দুই প্যারা পড়ে বুক মোচড়ানো অনুভুতি হলো।
নাহার ম নিকা
এত সাবলীল আর ধারালো দিনপঞ্জি!
বাবাইকে নিয়ে শেষের দুই প্যারা পড়ে বুক মোচড়ানো অনুভুতি হলো।
নাহার মনিকা
ধুগো কিংবা তারেকের মতো আমার তেমন চেনা টার্ম নাই আপ্নের সাথে। (আমি আগেও কথা কৈছি, আপ্নে কন নাই, তাই পরিচয় নাই-ই ধৈরা লৈলাম।) তাই অ্যাট লিস্ট 'হুরো মিয়া' কৈতে পারতেছি না। কিন্তু, আর কী যে কমু, সেইটাও বুঝতে পারতেছি না। আপ্নের দিলে রহম নাই?! অ্যাম্নে ব'লে আততায়ী ল্যাখা ল্যাখে মানুষ! অ্যাম্নে ব'লে মোচর দ্যায় ঘাও মারে এক ব্লগার আরেক ব্লগারের বুকে! কৈ থেইক্যা কৈ লৈয়া গ্যালেন হালখাতা-খেরো! এই ছিল আপ্নের মনে?!
নজমুল ভাই, ।
০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"
___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি
চমৎকার এবং চমৎকার!!!! আপনি নিয়মিত গদ্য লিখুন, নাহলে এরপর মোটর সাইকেলের গরম ইঞ্জিনের ছ্যাঁকা কিন্তু .........
সিরিয়াসলি বলি, অপু ভাই, বাবাইটাকে মানুষ করেন। কষ্ট, ব্যথা, যন্ত্রণা এগুলো চেপে রাখা কোনো কাজের কথা না। ওগুলোকে প্রকাশ করতে শেখান। নাহলে অনেক বেশি কষ্ট পাবে। বাবাইসোনা অনেক অনেক ভালো থাকুক।
আপনার লেখার কথা নতুন করে নাই বা বললাম।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
দিলেন মনটা খারাপ করে...
কালকে পড়ে কমেন্টাইতে পারি নাই। ইশতি ডিটো...
তীব্র মন খারাপ নিয়া এইটা লিখছিলাম। এরপর থেকে যতবার পড়ি ততবারই মন খারাপ হয়। কমেন্ট পড়লেও তাই হয়। এজন্য কারো কমেন্টেরই উত্তর দেয়া হয়নি। দুঃখিত।
সবাইকে চমৎকার সব মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
দিবি্য পড়ছিলাম। শেষে এসে মন খারাপ হয়ে গেল। বাবাইকে অনেক আদর।
নতুন মন্তব্য করুন