বাবার শরীরে একটা ঘ্রাণ ছিলো। ঘাম জমে জমে সম্ভবত ঘ্রাণটা তৈরি হতো। মায়া মায়া একটা ঘ্রাণ। বাবার কাপড় চোপড়ে সেই ঘ্রাণ। বাবার বিছানায় সেই ঘ্রাণ... আর কেউ সেই ঘ্রাণ পেতো কী না জানি না। আমি পেতাম। বাবার গামছায় লেগে থাকা ঘ্রাণ নিতে রোজ সকালে আমি মুখ ধুয়ে তার রুমে ঢুকতাম। বাবা সম্ভবত সেটা জানতেন। ভোরে ওঠা ছিলো বাবার অভ্যাস। ওজু পড়ে গামছায় হাত মুখ মুছে আলনার একটা পাশে সেটা মেলে দিতেন। আমি সেই গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বাবার সাথে কথা বলতাম। গুরুত্বহীন আলাপ সেসব। আমি আলাপের আড়ালে ঘ্রাণ গিলতাম। বাবার ঘ্রাণ...
মধ্যপর্ব
বছর শেষ হলেই হিসেব সকল চুকেবুকে যায় না। ইজা লিখে পুরনো হিসেব যোগ করতে হয় নতুন খাতার প্রথম পাতায়, তারপর পুনর্বার সেই পুরনো নিয়ম। মানুষ মূলত বেহিসেবী হলেও তাকে হিসেবের ঘেরাটোপেই বন্দি থাকতে হয়।
একটা বছর, কতিপয় সংখ্যা আমাদের বেধে রাখে, আমাদের দুরে ঠেলে, কিংবা শুধুই অংক হয়ে থাকে অনন্তে।
পেছন ফিরে দেখা হয় প্রতিনিয়তই। স্মৃতিখোর মানুষের তাছাড়া আর কিইবা করার আছে? ইতিহাস যখন প্রিয় বিষয় হয়ে উঠে, তখন সকল ইতিহাসই আসে চর্চ্চায়। মানুষ হিসেবে যারা মহান, তারা হিসেব করেন, ভাবেন সমষ্ঠির ইতিহাস। আমি এক দু’আনি মানুষ। ব্যর্থ বোকালবাব, আমি অতটা বড় মনের নই, তাই নিজের হিসেবই শুধু করে যাই নিরন্তর... শুধুই নিজের হিসেব...
গত বছর পাখি বন্যা হয়নি, বেদনার বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমি জেনে গেছি আর কোনদিন এ জীবনে পাখিবন্যা হবে না। ২০১১ একটা অশ্লিল বছর, যে আমারে আপাদমস্তক বদলে দিয়ে একটা শূন্যতার সামনে দাড় করিয়ে তারপর ছুটি নিয়েছে। তীব্র শীতের রাতে জমে থাকা থিকথিকে কুয়াশার মতো এই শূন্যতা আমায় ঘিরে থাকবে বাকি জীবনভর, এখানে রোদের কোন কারসাজি কাজে আসবে না। না কখনই না। আশ্চর্য কোন আলো নেই এই কুয়াশা কাটাবার জন্য। প্রতিনিয়ত এই কুয়াশা গাঢ় হবে। দরজা জানালাহীন গৃহপ্রবেশ ছাড়া মুক্তি নেই, মুক্তি মিলবে না।
মিছিল করে বাবাগুলো চলে গেলো। একেবারে মিছিল করে। একটার পর একটা মৃত্যুর খবর আসে আর আমি দেখি ছায়াহীন হচ্ছি আমরা। মানুষ এই সত্য জানে, তাকে ছায়াহীন হতে হবে, তাকে কায়াহীন হতে হবে। তবু বড় উচাটন। বড় বেশি উচাটন এই জীবনভর। এই উচাটনে অপুর পেছনে মিছিল করে বাবুভাই, লিটনভাই, আনিসভাই আর একেবারে শেষে এসে পিচ্চি শান্ত। বাবাগুলো-মাগুলো এভাবে চলে গেলে পাখিবন্যা থেমে যায়। আর কখনো পাখি বন্যা হয় না সেইসব জীবনে।
শুরুর শেষ
বাবাই মাঝে মাঝে সকালে বিছানায় আমাকে জড়িয়ে ধরে। বুকে নাক ঘষে বলে, বাবাগো তোমার শরীরে গামছার মতো খুশবো হয় কেনে?! আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাই! ও আবার বলে, হু, হাছা হাছা খুশবো করেগো বাবা। তোমার গামছাত মুখ মুছলে ই খুশবো পাই আমি...
মন্তব্য
চোখ ভিজে উঠলো...
আপনি অনেক খারাপ একটা লেখক অপু ভাই। শান্ত ভাইয়েরও বাবা মারা গেছেন জানতাম না।
যেখানেই থাকুন বাবারা সব ভালো থাকুন।
----------------------------------------------------------------------------
একশজন খাঁটি মানুষ দিয়ে একটা দেশ পাল্টে দেয়া যায়।তাই কখনো বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করতে হয় না--চেষ্টা করতে হয় খাঁটি হওয়ার!!
লেখক খারাপ, এইটা ঠিক। মানুষও সম্ভবত বেশি সুবিধার না।
কেমন আছেন?
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
আমি ভালোই আছি -- আপনি ভালো থাইকেন!
----------------------------------------------------------------------------
একশজন খাঁটি মানুষ দিয়ে একটা দেশ পাল্টে দেয়া যায়।তাই কখনো বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করতে হয় না--চেষ্টা করতে হয় খাঁটি হওয়ার!!
বাবা বাবাই ! এ স্থান কখনো পূরণ হবার নয় । আপনার বাবার জন্য শুভ কামনা ।
ধন্যবাদ
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
এই ২০১১ সালটা আসলেই খুব অশ্লীল একটা বছর। ক্রমেই আমাদের উপর থেকে ছায়াগুলো সরে যাচ্ছে। এই বছরে আমরা অনেক মা-বাবাদেরকে হারিয়েছি। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন সব মা-বাবা।
এমনিতেই এ বছর অনেক মানুষ হারিয়ে গেছেন, আমার বছরটাও ভালো যায় নি নিজের হিসেব মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি, বড় ভাই হিসেবে আপনি জানেন সেসব কথা, কিন্তু তাও আমি নতুন বছরে এসে ছায়াহীন নই এটা ভেবে সান্তনা... আর একই সাথে ভয় হয়। হয়তো বাবারাও সন্তানদের বুকে অন্যরকম একটা ঘ্রাণ পান, হয়তো আকুল হন সে কারণেই চোখের আড়ালে থাকলে... ভালো থাকুন, মন ভালো হোক। বাবাইরা, আমরা আপনাদের ছায়ায় যেন থাকি দীর্ঘদিন।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
সম্ভাবিলিটি নাই। ছায়া দেয়া সম্ভব না। বাবাই আর বছর দেড়েক সময় নিতে পারে বেশি হলে। তারপরই সে আমার হাইট ছড়িয়ে যাবে। এরপর আমিই তার ছায়ায় ঢুকে যাবো, সেই ছায়ায় বসে গুলগুলা মিস্টি খাবো।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
টাঙ্গুয়ার হাওরের পুরো ট্যুরটাতে সেটা খুব ভালোভাবে বুঝেছি। রাতে যখন বাবার চাদরটা গায়ে দিয়ে ঘুমালাম, অদ্ভুত ঘ্রাণ পেলাম বাবার শরীরের ... এত বছর পরেও !
হমম
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
এইভাবেই হয় শুরুর শেষ... এবং জীবন বয়ে যায়
ডাকঘর | ছবিঘর
হুমম! শেষে শুধুই ঘ্রাণ পড়ে থাকে, পাখি পালক ফেলে চলে যায়, ফিরে আসে না!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
অস্বাভাবিক সুন্দর একটা পোস্ট। আপনার জন্য শুভকামনা।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
ধন্যবাদ
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
থিকথিকে কুয়াশার মতো এই শূন্যতা আমায় ঘিরে থাকবে বাকি জীবনভর, এখানে রোদের কোন কারসাজি কাজে আসবে না...
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
আমার বাবার শরীরে ও একটা ঘ্রান আছে।ছোটবেলায় বাবাকে জড়িয়ে ধরে সেই ঘ্রান নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়তাম।অনেক, অনেক ভালো লাগলো আপনার লিখা।
ধন্যবাদ
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
মন খারাপ করা লেখা
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
লাইন ধরতে হবে, সময় বড় অল্প। কিংবা হয়তো লাইন ধরেই আছি, সময়ের অপেক্ষা মাত্র!
ঐদিন স্নিগ্ধা আপা সত্য কথা বলছিল, এই লোকটা খালি মন খারাপ করা লেখা লিখে
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
আমি কি তাইলে আড্ডায় আর আসুম না?
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
আনমনে আমি এখনও খুঁজে বেড়াই আমার বাবার শরীরের সেই মিষ্টি ঘ্রাণ ...
বাইরে যাওয়ার আগে যখন নিজের শরীরে স্প্রে করি, তখন প্রায়ই মনে পড়ে যায় আমার বাবার বড় প্রিয় ছিল পারফিউম, কেউ গিফট করলে বাচ্চাদের মত খুশি হতেন, আর নিজে বেশ খরচ করে করে কিনতেন। বাবার শরীরে সেইসব সুগন্ধি আর ঘামের মিলিত একটা মিষ্টি গন্ধ আমাকে আবিষ্ট করে রেখেছে সারাটা শৈশব, আর আমি এখনও আনমনে ডুবে থাকি ...
আপনি মানুষ ভাল না অপু ভাই।
------------------------------------
সময় এসেছে চল ধরি মোরা হাল,
শক্ত কৃপাণে তুলি বরাহের ছাল।
হ, খ্রাপলুক
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
কী মায়াভরা মনখারাপী একটা লেখা! এমন এক একটা লেখার জন্য অপেক্ষা করা চলে দিনের পর দিন, হাতে পেয়ে গেলে পড়া যায় অগণিতবার...
ভুল হতে পারে, তবে কেন জানি মনে হয় বাবারা ভাল থাকেন আমরা ভাল থাকলেই।
ভাল থাকুন আপনি, সুস্থ থাকুন।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
আপনিও ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
আমি বাবার মত হতে পারিনি, বাবার মহত্তম গুনগুলো পাইনি, আমার অনাধুনিক সহজ সরল বাবাটা তবুও আমার চোখে শ্রেষ্ঠ, আমার অস্তিত্ব জুড়ে তাঁর সরব উপস্থিতি। আপনার লেখাটা পড়ে আবার বাবার কাছে ফিরে গেলাম।
শরীরটা একটা ঝাঁকি দিয়ে দাড়াও। জীবন থেকে থাকতে নেই।
...........................
Every Picture Tells a Story
ধন্যবাদ ভাই। দাড়ায়া আছিতো...
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
সবার লেখাতে বাবার প্রতি ভালবাসা ফুটে ওঠে। আমি লিখব আব্বুকে কতটা অভালবাসি সেইটা নিয়ে।
আমার পিতার মুখ: আমিও লিখব হয়তো, কোন একদিন...
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
তিথি এবং রু, আপনাদের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
অফু বাই মোটেও একজন বালা লুক না
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
ভাই, একদম নামায়ে দিলেন আমারে কত কথা মনে আসতেছে এখন :(।
আমার ছোটবেলায় অনেকবারের মত আম্মা রাগ করে বোনের বাসায় চলে গেলো । আমি বিকেলে খেলে বাসায় এসে দেখি আম্মা নাই। কাঁদতে কাঁদতে আম্মার শাড়ি বুকে নিয়ে গন্ধ নিচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম আম্মা আর ফিরবেনা।
আম্মার ক্যান্সার ধরা পরার শেষ তিনটা মাস আম্মার পাশে দিন-রাত জেগে ছিলাম। প্রচন্ড কষ্টে দাঁতে দাঁত চেপে যখন ব্যাথায় চোখ নীল হয়ে যেতো আমি চোখে চোখ রেখে সাহস দিতাম আর মাথায় হাত বুলায়ে ঘুম পারায়ে দিতাম। শেষ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পায়ে চুমু দিয়ে ঘুমাতাম। জানিনা কেন ভালো লাগতো এটা করতে।
খুব নিরব খুব ঠান্ডা একটা সকালে আম্মা মারা গেলো।
============================
শুধু ভালোবাসা, সংগ্রাম আর শিল্প চাই।
আমার বাবা মারা গেছেন সাতাশ বছর আগে। আমার কাছে উনার একটি গেঞ্জি আছে,মাঝে মাজে গন্ধ নেই।
বাবাকে খুব মিস করছি লেখাটি পড়ার পর থেকে।
এই লেখার পাঠক এবং যারা কষ্ট করে মন্তব্য করলেন তাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
আমি আজ আর কিছু বলব না ।।। কেবল শূণ্য হাতের ওপর আরেকটা শূণ্য হাত রাখারই আশ্বাস দিতে পারি ।।।
আফরিন আহমেদ
নতুন মন্তব্য করুন