মেলার সেই বিকেলটায় আর একবারও বাবাইকে কোলে নিতে হয়নি আমার। চারুকলার সামনে এসে যখন ভিড়ের কারনে দলছুট হয়ে পড়েছি। তুলি উদ্বিগ্ন মুখে নিজের ছেলেকে খুঁজছে। তখন অনেক দুরে ভিড়ের মাঝখানে একটা শক্ত কাঁধের উপর বসা বাবাইকে দেখিয়ে দিয়েছি। সেটা সিমনের কাঁধ। নির্ভরতার।
সিমনের সাথে আমার পরিচয় আরো আগে। ২০০৬ এর শেষ নয়তো ০৭ এর শুরুতে। সামহ্যোয়ার ইন ব্লগে। একটা টিভি স্টেশনের স্থানীয় অফিসে কাজ করি। ফুটেজ পাঠাতে হয় ইন্টারনেটে, তাই হাইস্পিড ইন্টারনেট কানেকশন সেখানে। সারাদিন নেটে থাকি। সামহ্যোয়ার ইন ব্লগের ভারি ইন্টারফেস যখন দেশের স্লো নেটে খুলতে অনেক সময় লাগে, তখন আমরা ধুমায়া কমেন্ট করি। সিমন সেটা দেখে অবাক। তখনকার ছাগু তাড়ানোতে সে বেশ এক্টিভ। আমার সাথে কাজ করতো মিঠু। কেমন করে যেনো তার সাথে সিমনের খাতির হয়ে গেলো। শাহেনশাহ ছিলো সিমনের ব্লগনাম। মিঠুর সাথে খুব বন্ধুত্ব তার। ফোনেও কথা হয়। একদিন আমার সাথেও কথা বল্ল। তারপর জিটকে এড করা হলো। তবে সামুর কমেন্টের ঘরেই বেশি আলাপ হয়। সেখানেই কোন এক ফাঁকে সে ভাইজান ডাকা শুরু করলো। যুক্তি ছিলো মিঠুর ভাইজান হলে তারও ভাইজান। আমি মেনে নেই। মিঠু ঢাকা আসলে তাদের আড্ডাও হয়। এরমাঝে একদিন সে সিলেটে হাজির। পরিচিত কার বিয়ে ছিলো। বিয়ের গাড়িতে উঠে সিলেটে চলে গেছে। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য আমার সাথে দেখা করা!!! এইটা বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমার জন্য। আমি মরমে মরে গেলাম, তারচে বেশি অবাক হলাম। কি একটা রিপোর্টিং এর জন্য তখন শহরের বাইরে। সেটা শেষ না করে ফিরতে পারছি না। এদিকে বিয়ে শেষ করে ঢাকা ফিরে যাচ্ছে সবাই। সিমন যাবে না। সে একটা গাড়িই আটকে রাখলো। মিঠু সেই কথা ফোনে আমারে জানায়। আমি আরও অবাক হই। গাড়ি আটকে রাখা!!! কাজ অর্ধেক রেখেই ছুটে আসি। দশাশই শরীরের সিমনের সাথে আমার প্রথম দেখা হলো। গাড়িতে বসে থাকা কয়েকজন তরুন খুবই অবাক চোখে আমাকে দেখছিলো। সম্ভবত মেলাতে পারছিলো না। বিশেষ কোন কারণটার জন্য সিমনের মতো একটা ছেলে এভাবে নতজানু হয়ে বসে থাকবে, তা তারা বুঝতে পারছিলনা নিশ্চিত। আমি নিজেইতো বুঝতে পারছিলাম না।
সচল হবার বছরখানেক পর ঢাকায় একটা কাজে গেলাম। সাথে প্রেসের ম্যানেজার, মেশিনম্যান ছিলো। এদের একজনের বাড়ি বগুড়ায়, আরেকজন ময়মনসিংহের। কাজ শেষে দুজনেই ছুটি চাইলো। না করতে পারলাম না। কিন্তু আমি কি করবো। উদ্ধার করলো সিমন। ঝড়ের বেগে সে আমার কাজের জায়গায় হাজির। আসতে আসতেই খবর দিয়েছে এনকিদু আর বনিকরে। মিঠু ঢাকায়, তারেও জোগাড় করে ফেল্লো। বেইলি রোডে শুরু হলো আড্ডা। বসে থাকার আড্ডা শেষে হাঁটার আড্ডা। হাঁটতে হাঁটতে এরা একসময় নজরুল ভাই এর বাড়ির সামনে চলে এসেছে। সেই বাড়িতেই ঢুকে গেলো সবাই। আড্ডা দিতে দিতে আমার বাস মিস, হোটেলে যাবার সময়ও শেষ। এরমাঝে সেই বাড়ির চেয়ার ভেঙে ফেল্ল সিমন। বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। বিব্রত হয়ে বসে আছি। সে অবস্থাতেই আমারে সেখানে ফেলে এলো! এর আগে যাদের সাথে সাইবার যোগাযোগ ছাড়া আর কিছুই ছিলো না, সেই বাড়িতে আমাকে ফেলে এলো সারাটা রাতের জন্য। সে অন্য গল্প। অন্যসময় হয়তো হবে। আমি সিমনের কথা বলি আজ।
এরপর আমি যতবার ঢাকা গিয়েছি, প্রতিবার সিমনের সাথে দেখা হয়েছে। ঢাকা একটা অপরিচিত শহর। কিচ্ছু চিনি না সেখানে। সিমন দিনের পর দিন আমার কাজের জন্য ছুটি নিয়েছে। বাস স্টেশনে দাঁড়িয়ে থেকেছে। রাতে সিলেটের বাসে তুলে দিয়েছে। মন খারাপ হলে নিজেই সিলেটে চলে এসেছে। সিমনের দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠরা আমার কাছে সিমনের বিচার চেয়েছে। টুকরো টুকরো ছয়টা বছর এখন চোখের সামনে ভাসে... এই মাঝরাতে, একটু আগে ফোনে হুহু করে কান্নায় ভেঙে পড়েছে নজরুল ভাই। আমি একটা দুর্বল মানুষ। অতি ক্ষুদ্র। অল্পতেই সবকিছু গুলিয়ে ফেলি। এখনও তাই হয়েছে। সিমনের কথা বলতে গিয়ে নিজের কথাই বলছি শুধু। কিন্তু এটাও সত্যি সিমনকে আমি আমার মতো করেই চিনি।
সিমনের চওড়া কাধটা পরম নির্ভরতায় আঁকড়ে ধরা যায়। তুলি কখনই বাবাইকে আমার সাথে দিতে নিরাপদবোধ করে না। কিন্তু সিমনের কাধে চড়লে বাবাই নিরাপদ থাকবে এই বিশ্বাসটা ৬ বছর আগেই অর্জন করেছে সে। বাবাই সিমনের কাধে বসে ওর ঝাকড়া চুল মুঠিতে ধরে বই মেলায় যাচ্ছে এই দৃশ্যটা দু’দিন ধরে বার বার চোখে ভাসছে। আমার বাবাইটা এখনও কোলে চড়তে চায়, আমি ওরে কোলে নিতে পারি না। এতো বড়ো হয়ে গেছে। ওরে বলি, সিমন আসুক তোরে কোলে নেবে...
ওর বিয়ের কথাবার্তা পাকা হবার পর, ঢাকায় গিয়েছি। নজুভাই তখন কলাবাগানে থাকে। সন্ধ্যার পর সিমন হাজির। সাথে মিতু। বউকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। কতটা ভালোবাসা থাকলে এটা করা যায়? আমি তল খুজে পাই না এমন ভালোবাসার। একদম না। এরকম সময়ে শুধু কান্না আসে।
তান্তার জন্য তোর নিরাপদ কাধটা অনেক বেশি দরকার সিমন... তুই জেগে ওঠ... আমরা দুই ভাই মিলে তারেক, আকতার, বংকারে চল সুরমা নদীতে চুবায়ে আসি...
মন্তব্য
সিমন... ভাই আমার... সুস্থ হয়ে ফিরে আয়...
facebook
হ্যাঁ, মাত্র একদিনের তরে মাত্র একদিনের তরে তার সাথে দেখা ও কথা হয়েছিল। তারেক অনুর সাথে আড্ডা উপলক্ষ্যে আমরা কয়েকজন একত্রিত হয়েছিলাম। হাসিখুসি দশাসই মানুষটাকে সেই ক্ষণেই ভাল লেগেছিলো। আজ এই সময়ে ফেসবুক এবং ব্লগে কিছু লেখা পড়ে তাকে খুব আপন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, একজন আপনজন খুব শঙ্কাযুক্ত।
তার আরোগ্য কামনা করছি।
এখন তো সিমনকে নিয়ে কোন মন্তব্য করবো ন ! ওর সাথে আমার অনেককিছুই বাকি পড়ে আছে ! ওকে আসতেই হবে !
সিমন, ভাই আমার ---
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
সচলায়তনের গল্প সংকলন পূর্ণমুঠি প্রকাশের দিনে আপনি সিমনের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
এরপরে গড়ে মাসে অন্তত বিশদিন সিমন আমার বাসায় এসেছে... জিজ্ঞেসও করতো না আমি বাড়িতে আছি কি না... চলে আসতো, আড্ডা মারতে বাধ্য করতো।
সিমন সবসময় বলতো, আপনি আর আমি তার বড় ভাই...
অপু, আসেন... আমার কান্নাটা আসলে কেউ বুঝবে না... আপনি আসেন...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সিমন ভাইকে সবাই এত ভালবাসেন, উনি জেগে উঠবেনই।
--------------------------------
বানান ভুল থাকলে ধরিয়ে দিন!
সিমনের দ্রুত সুস্থ উঠবে, এই কামনা করি।
দুর্জয় সাব্বির
\জয় বাঙলা, জয় বঙ্গবন্ধু/
খারাপ লাগছে
...........................
Every Picture Tells a Story
সিমন, ফিরে আসুন, ফিরে আসুন ভাই।
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
সবার এত ভালোবাসা ফেলে রেখে চলে যাবে একটা তরতাজা প্রাণ - এ হতে পারে না, সিমন ফিরে আসুন।
-হিজিবিজবিজ
হুমমম।
আমার আর ভাল লাগছে না। এতো কান্না পায় কেন? ভাইয়ু কবে ভাল হবে? ৪৮ ঘণ্টা হতে এতোদিন লাগে নাকি?!
--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি
ভীষণ ভীষণ খারাপ লাগছে। ফিরে আসেন সিমন। দ্রুত ফিরে আসেন...
ডাকঘর | ছবিঘর
"সিমন" শুনলেই কেন যেন আপনার নামটা মাথায় চলে আসে। আপনাদের সম্পর্কের গভীরতা কিছুটা হলেও দেখেছি, জানি, বুঝি। মন খারাপ রাইখেন না আর, ভাই। সিমন ভাই দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে। তারপর আপনাদের "চুবানো" পরিকল্পনা সে এক হাতেই সফল করে ছাড়বে দেইখেন।
একদিন বিকেলে টিএসসিতে আমি, পান্থ আর অপু আড্ডা দিচ্ছিলাম। সেদিনই সিমনের সাথে পরিচয় হয়েছিল আমার। পান্থ যখন আমাকে বললো, ইনি শাহেনশাহ। আমি বললাম, আকারেই নামের পরিচয়!
সিমন, একবার ফিরে এসে দেখো ভাই, কত ভালোবাসা তোমার জন্য জেগে আছে!
ভাইয়া, আমাদের ডাক অগ্রাহ্য করবেনা সিমন, ও জলদিই এইসব কমেন্টের রিপ্লাই দিবে দেখবা!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
আমিন
ভালবাসার জয় হোক, ফিরে আসবে দুর্জয় সিমন।
জলেই কেন জীবন ।।।
আফরিন আহমেদ
নতুন মন্তব্য করুন