তারপর ঝুম ঝুম করে মেঘ নেমে আসে। আমাদের ঘিরে ধরে। পর্দার পর পর্দা পড়তে থাকে। চোখের সীমানা ছোট হয়ে আসে। একটা হালকা স্বচ্ছ চাদরে ঢাকা পড়ে আমাদের চারপাশ। মেঘবাড়ির মানুষ আমরা, মেঘেতে হই মশগুল...
তারও আগে, ভোর হবার আগে আকাশ ভেঙে পড়ে বাড়ির ছাদে, পাশের টিলায়, ঝুম ঝুম শব্দ হয়। বারান্দায় দাড়িয়ে রাতের আলোয় দেখি সেই জলধারা। জঙ্গলযাত্রা শুরু করবো, অপেক্ষা।
এই পথে এর আগে যখন গিয়েছি, সেদিন রানা ছিলো। মাঝখানের দশকধরা বিচ্ছিন্নতার পর সেটা আমাদের লম্বাযাত্রা। এই সড়কটা প্রিয় আমার। দুপাশে বিস্তির্ন ধানক্ষেত, বর্ষায় জলে টইটম্বুর। সবুজ। একটা রেলপথ এই আসে, এই দুরে সরে যায়। সবুজ বাড়তে থাকে। ছোট ছোট টিলা, ঘন সবুজ, মাটির ঘ্রাণ, নাম না জানা বুনো ফুলের ঘ্রাণ, অচেনা মানুষের মুখ। মনে হয় এই বুঝিবা হারিয়ে যাচ্ছি, অথচ হারানো হয় না। পালাতে চাইলেও পালানো যায় না, তবু কিছুটা সময় গোপন থাকা যায় নিজের খোলসে। এবার এই পথে আমার সঙ্গি শাওন, সায়েম, শান্ত আর আরেকটা শাওন।
বাবাইকে নিয়ে আমি আর তুলি এই পথে ভুল করে একবার ঢুকে পড়েছিলাম বছর তিনেক আগে। হারাচ্ছি, হারাচ্ছি কিন্তু হারাচ্ছি না এমন একটা পথ, আঁকাবাঁকা। চায়ের ঘ্রাণ, ছায়া, প্রচ্ছায়া। অনেকটা পথ আমরা গিয়েছিলাম সেদিন। একেবারে ঘড়ি ধরে ২ ঘন্টা। হিসাবটা এমন, ২ ঘন্টায় যতটা যাওয়া যায় যাবো, তারপর আবার ফিরে আসবো... ভেতরে হারিয়ে যাবার তীব্র বাসনা তবু সংসারী মানুষের প্রগলভতা হয়তো। হাজার দিন পেরিয়ে গেছে তারপর। তবু আমরা এখনও সেই ৪ ঘন্টাকে প্রায়ই মনে করি। বাবাই বলে, বাবা আরেকদিন আমরা হারিয়ে যাবো... হয় না। কতকিছু যে হয়না...
এবার ঠিক উল্টোপথ ধরে সেই সবুজের কাছে ফিরে যাওয়া। সকালটা শুরু হয়েছে সিলেটের প্রেমময় ‘মেঘ’ দিয়ে। তারপর ঠান্ডা বাতাসে এগিয়ে চলা। আকাশে জমে থাকা কালনীর ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে, সেই কালনী ভাসতে ভাসতে নিচে নেমে আসে, ঝর ঝর, ঝরে পড়ে...
আদিবাসী লোকটা চায়ের কাপগুলো ধুতে থাকে, ধুতে থাকে। একবার, দুবার, বার বার। কি যে যত্ন। মায়া হয়। লজ্জা হয়। আমরা এভাবে কারো যত্ন নিতে পারি না। আমরা গ্রামদেশ থেকে কত্তো দুরে চলে গেছি... তারপর সেই মানুষটা কেটলিতে প্রণাম ঠুকে ঢেলে দেয় অমৃত... আহ...
বন ঘন হবার মুখে, একটা ছোট্ট দোকান আগলে থাকেন আরেক আদিবাসী। শরীর থেকে পানির ছাট মুছতে মুছতে যখন প্রশ্ন করি, বসি এখানে? প্রান্তবর্তী সেই নারী সম্মতি জানান। অভ্যস্থ চোখে আমাদের দেখেন। নির্জনতার মানুষদের নির্জনতা আমরা ভেঙে দিচ্ছি রোজ। এখন আর তারা অবাক হন না। মনে মনে বিরক্তই হন হয়তোবা।
বন শেষে বন, চায়ের বাগান, তারপর ধান। বাঁক খেয়ে, পাক খেয়ে, কখনো সিথির মতো একহারা হয়ে রাস্তাটা শুধু এগিয়েই চলে। তারপর ঝুম-ঝুম, ঝুম-ঝুম, ঝুম-ঝুম... আমাদের ঘিরে ধরে। পর্দার পর পর্দা পড়তে থাকে। চোখের সীমানা ছোট হয়ে আসে। একটা হালকা স্বচ্ছ চাদরে ঢাকা পড়ে আমাদের চারপাশ। মেঘবাড়ির মানুষ আমরা, মেঘেতে হই মশগুল... আমাদের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে একটা যুবতি কদম্ববৃক্ষ। তার পাতার পরতে পরতে মখমলের মতো মোলায়েম পুষ্প ফুটিয়া আছে। অঝোরধারায় সেই পুষ্পের গায়ের ঘ্রাণ নেমে আসে মাটিতে। তার ছাট পড়ে চোখে, কেমন পাগল পাগল লাগে তখন...
এখানে মেঘ ইচ্ছে হলেই দলা পাকায়, এপাশ থেকে ওপাশে সরে যায়। ঝুপ করে নেমে আসে মাটিতে। ভেজা সড়ক ধরে এগুতে থাকি। আরও আরও সামনে যেতে হবে, হারিয়ে যেতে যেতে বাড়ির পথ ধরবো গৃহি মানুষেরা...
*আমরা, সিলেটের মানুষরা বৃষ্টি বলি না। বলি মেঘ। বলি ঝুম-ঝুম করে মেঘ পড়ে, তার আগে আকাশে জমে কালনি...
মন্তব্য
গেল বৃষ্টির মৌসুমেও আপনি বড় যন্ত্রণা দিছিলেন। এতো দূরে আসলাম, তবুও যদি এরকম যন্ত্রণা দেন, তাইলে তো মুশকিল।
আমার এইখানে বৃষ্টি হয় অনিয়মিত। হইলেও বুঝতে পারি না, কারণ উন্নত বিশ্বে কোথাও পানি জমে টমে থাকে না। প্রথম বৃষ্টিতে মাটি থেকে কোনো গন্ধ ছড়ায় না। কাজেই এখনও আপনার লেখা পড়ে ঈর্ষা জাগলো।
*অট: লেখা ভালো লাগছে। মাঝে মধ্যে তো একটু লেখতেও পারেন।
অলমিতি বিস্তারেণ
বৃষ্টির জন্যইতো সিলেট ছাড়ি না।
এইতো লিখলাম।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
সামনের বর্ষাতে সিলেটে আসব, পাক্কা !
facebook
আইচ্চা
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
কেন কিছু মানুষ অনেক কিছু পায়? কেন প্রকৃতি তাদের উজার করে দেয়া? আর কেনই বা কিছু মানুষের কপালে কিছুই জোটে না!
অটঃ কবিতা লেখা কি ছেড়ে দিয়েছেন নাকি?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
প্রকৃতি আমাদের যা যা দিয়েছে, তার সবই আমরা শেষ করে দিচ্ছি, সেদিন আর দুরে নাই, যখন এখানে কিছুই থাকবে না।
ছাড়িনি, আগের মতোই
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
হবে না কেন? সবই হবে। হতেই হবে!
লেখা পড়ে তো বৃষ্টি উদযাপনের ইচ্ছেটা তীব্র হলো! আসছি...
তুমি আসতে আসতে বর্ষা বসে থাকবে মনে করো? হুহ
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
এরকম লেখা পড়লে সাধারনতঃ অনুরোধ করি একটা ছবি দেয়ার জন্য, এবার তার দরকার হলনা।
বাচাইছে, ছবি চাইলেন না। বিপদেই পড়তাম তখন।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
লেখাটা পড়তে পড়তে বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেলাম, মেঘের শব্দ শুনতে পেলাম।
ধন্যবাদ
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
কোন এক বছরে যেন সিলেট গেলাম। এই জুন মাসেই। পরিষ্কার নীল আকাশে নানান আকারের সাদা মেঘ... আমি পুরা দুইদিন রাস্তা না দেখে মনে হয় আকাশ দেখেই যাত্রাপথ কাটায়ে দিয়েছিলাম। তখন থেকেই সিলেটের প্রেমে পড়ে গেছি আমি। কিন্তু আর ফিরে যাওয়া হয়নি। লেখাটা এতটাই প্রাণবন্ত যে খুব করে ইচ্ছা করছে ঘোর বর্ষায় সব ছেড়েছুড়ে সিলেটে শুধু "ঝুমঝুম মেঘ" দেখতে যাব একবার।
তোমার দেখা হবে না বাবু। এই যে বল্লা, দেখতে আসবা 'একবার' এই একবার যেদিন 'এখনই' হবে শুধমাত্র তখনই তোমার মেঘ দেখা হবে।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
কথাটা মনে হয় খুব একটা ভুল বলেন নাই। যাই-যাচ্ছি-যাব করেও আর যাওয়া হলো না আজ পর্যন্ত।
ইশ্ ! সিলেটে এবার বর্ষায় যেতেই হবে । চোখের সামনে কী সব অপার্থিব ছবি এঁকে দিলেন, ভাই ! পুরো লেখাটা টুকরো টুকরো মায়া-ছবি হয়ে গেছে... দৃশ্যকল্প ! দারুণ দারুণ !
মসীলক্ষণ পণ্ডিত
ধন্যবাদ
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
আহ! পড়লাম না কি মিষ্টি কিছু খেলাম?!
বড় ভাল হাত আপনার ভাইডি। বড় ভাল।
আপনার মনটা ভালো। পড়ার ধরনটা ভালো। তাই সবসময় ভালো বলেন।
অনেক ধন্যবাদ
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
সিলেটে কেটেছে শৈশবের বেশ কয়েকটি বছর, দারুণ প্রিয় জায়গা।
এবং সিলেট আসিতেছি ২০ তারিখ। আশা করি মেঘের সাথে দেখা হবে
মেঘের সাথে দেখা হবার কথা। তখনতো আরও বেশি মেঘের বেলা।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
সিলেটের ওদিকে যতবারই গেছি ভালো লেগেছে। মনে হয়েছে আবারো আসবো ফিরে...
এই দূর দেশে লোহা আর কঙ্ক্রিটের মধ্যে পড়ে থাকি। এই লেখাটা যে কেমন লাগলো, বুঝাতে পারবো না। এমন আরো লিখেন...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
অনেক ধন্যবাদ স্পর্শ
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
সিলেটে তো গেছি কয়েকবার - সমরেশের উপন্যাসকে এইভাবে চোখের সামনে তো দেখিনি কখনো!!
নেক্সট টাইম সিলেটে গেলে আমাকে কিন্তু এই মেঘপাহাড়ীর জায়গাটা দেখাতে হবে - হবেই হবে---
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
আহা কতদিন মেঘ দেখি না। মেঘের কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
বাংলাদেশের সবখানেইতো মেঘে ভর্তি
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
মন খারাপ করে দেয়া লেখা।।।।।।।যদিও বাংলাদেশে থাকি কিন্তু কতদিন যে বৃষ্টিতে ভিজি না, খুব ইচ্ছা করছে বৃষ্টিতে ভিজতে। লেখা
দেশে থেকে বৃষ্টিতে না ভেজাতো খুবই খারাপ। আরেকবার বৃষ্টি হলে অবশ্যই ভিজবেন।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
লেখাটি পড়ার সময় থেকে ঝুপ ঝুপ করে জল ঝরার শব্দ পাচ্ছি মনে ভেতরে। গোড়ালির একটু উপর পর্যন্ত ডুবে যাওয়া জলে হেটেঁ বেড়াচ্ছি মনে মনে সেই কখন থেকে।
অনেকদিন পরে একটা জল ঝরানো লেখা পড়লাম। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
আপনি মনে মনে জল পড়ার শব্দ পেলেন। আর এখন যখন আপনাকে উত্তর দিচ্ছি, তখন ঝুম-ঝুম চলছে বাইরে।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
।।।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
মেঘ কে যেন ছুঁতে পারলাম আপনার লেখা পড়ে, ঝুম ঝুম বৃষ্টির জলধারা যেন কানের ভিতর কলকল শব্দে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমার আশপাশ, সবকিছু । অদ্ভুত এক ভাল লাগায় ভরে গেল মন।
অনেক ধন্যবাদ।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
সিলেটি বর্ষা নাকি আঠালো, একবার ধরলে ছাড়ে না। তাই বর্ষাকালে সিলেটে যাবোনা ভাবছিলাম। এদিকে আপনার স্বাদু লেখা পড়ে তো লোভ জেগে গেল।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ও মোর আল্লা!!! আম্নে বাইষ্যা মাসরে নাপছন করেন!!!
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
মেঘ হলে মন বিকেল বেলা একলা যেতাম মেঘের বাড়ি/ মেঘ হত কাশফুলের দুচোখ, বৃষ্টি কিন্তু খুব আনাড়ি, আনাড়ি।
আপনার লেখা পড়ে কেন জানিনা এই গানের দুই লাইন মনে পড়ে গেল হঠাৎ। আপনার গদ্য নির্মেদ, নির্ভার আর পড়তে গিয়ে কোথাও হোঁচট খেতে হয়না। বহমান জলের ধারার মতন। অদ্ভুত লাগলো। যারা বলেন, আপনি প্রায়ই লেখেন না কেন, হক কথা বলেন।
অনেক ধন্যবাদ।
কিন্তু আপনি অপপ্রচারে কান দিচ্ছেন কেনো?!? সচলে আমার সম্ভবত ৪০০ টা পোস্ট আছে। তারপরও না লেখার অভিযোগ তোলাটা বিরাট ষড়যন্ত্র। ওতে কান দেবেন না।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
পড়লাম
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
কতদিন পরে তোমার মন্তব্য পেলাম। অনেক ধন্যবাদ
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
সিলেট আমার অতি প্রিয় একটি শহর।আর মেঘের যে বিবরণ দিলেন তাতে মনে হল এত বছর ধরে দেখেছি তবু যেন দেখা হয়নি আরো বাকি আছে।আপনার চোখ দিয়ে মেঘ দেখে অনেক ভালো লাগলো।
বৃষ্টি এখন আমার পছন্দের ।।।
আফরিন আহমেদ
এই লেখাটা পুরানো হয় না, অফিসের মাঝেও বৃষ্টি এনে দেয়।
নতুন মন্তব্য করুন