টেবিলের দু’পাশে বসে আছি আমি আর আম্মা। টুকটাক কথা বলছি। বেশিরভাগই খাবার নিয়ে। কোনটা নিচ্ছি, কোনটা নিচ্ছি না, সেটা দেখছেন আম্মা। বছর দেড়েক আগে আমি আর আম্মা মাসখানেক প্রবাসে ছিলাম। একসাথে বসে বসে মা ছেলে খেতাম। আমি কখনো দেশের বাইরে যাইনি। আম্মা আমাকে আগলে রাখার চেস্টা করতেন! তখন কিছুটা মনে হয় অস্বাভাবিকও ছিলাম আমি। মাথাটা ফাঁকা ছিলো... আজকে আবার বছর দেড় পর, আবার আমরা মা-ছেলে। দাদাভাইর খবর বলেন আম্মা, খুব বিখ্যাত কোন এক পাহাড়ের না উপত্যকার মাঝ দিয়ে বেড়াচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে কথা বলি আমরা, বউরা একসাথে বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে গেলো, সেটা নিয়ে আলাপ করি, গ্রামে রাতের পাহারা কিছুটা কম হচ্ছে সেটাও আসে আমাদের আলাপে। ইমাম সাহেব প্রায়ই রাতে ভাত খেতে আসেন না, আম্মা সেটা নিয়ে চিন্তিত।
এতো গরম পড়েছে, শরীর জ্বালা করে। বারান্দায় ফ্যান দাড় করিয়ে জানলায় দিয়ে ঘরের ভেতর ঠান্ডা বাতাস ঢুকালে বেশ শান্তি লাগে। প্রায় মাঝরাতে খেয়াল করি, আম্মা ঘুর ঘুর করছেন আমার আশেপাশে! আমি ঘুম ঘুম চোখে প্রশ্ন করি ঘটনা কি? জানালা দেখিয়ে বলেন পর্দাটা তুলে দিলাম। বাতাসের ঝাপটায় সেটা হয়তো পড়ে গিয়েছিলো। তুলে দিতে এসেছেন...
রাত জেগে থাকার অভ্যাসটা এসেছে সম্ভবত বই পড়া থেকে। তারপর ৭/৮ বছর পত্রিকায় কাজ করেছি। রাত জেগে থাকতে হয়েছে। এখন আর সহজে ঘুম আসে না। জেগে থাকি, জেগেই থাকি। তেমন আরেকটা অভ্যাস সোফায় শুয়ে থাকার। আগে পড়তে পড়তে একসময় সেখানে ঘুমিয়ে পড়তাম। মাঝে মাঝে দুস্টামিও করতাম। ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকতাম। আব্বার ঘুম ছিলো খুব পাতলা। শুয়ে পড়লেই ঘুমিয়ে পড়তেন, আবার মশা মারার শব্দে সেই ঘুম ভেঙে যেতো। রাতে একটু পর পর এ ঘর ও ঘর করাও ছিলো অভ্যাস। কে কেমন করে ঘুমালো, মশারী টানানো হলো কী না এসব দেখতেন। মাঝরাতে আব্বা ঘুম ভাঙিয়ে কাউকে দিয়ে মশারী টানাচ্ছেন, কাউকে দিয়ে কয়েল জ্বালিয়ে নিচ্ছেন... নিয়মিত ঘটতো এসব। ব্যতিক্রমটা শুধু আমার বেলায়। টেনে হিচড়ে কোলে করে বিছানায় নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে চাকরী পাবার পরও। কতদিন বিছানায় শুইয়ে দেবার পর বিকট হাসি দিয়েছি, আব্বা কপট রাগ দেখিয়েছেন। তবু মন খারাপ করেননি। কলেজে পড়ার সময়ও অনেকদিন মনে আছে, ঘুমিয়ে গেছি ভেবে আব্বা কোলে নিয়েছেন আমাকে, পাজাকোলে শুয়ে আমি আব্বাকে বলছি, আজকে আপনার কাছে ঘুমাই আব্বা, আব্বা হয়তো বলতেন, আহা বিলাইর বাচ্চারে... তারপর নিজের বিছানায় শুইয়ে দিলেন... আমি আব্বার বুকের ভেতর ঢুকে বাকি রাত কাটিয়ে দিলাম।
তার অনেক বছর পর, ডিসেম্বরের কোন এক শীতে, হাসপাতালের সিসিইউ'র ছোট্ট বিছানায়, আমরা বাপ-ছেলে বিড়ালের মতো একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকি। পাশের বেডের কেউ একজন চলে গেলে, সে খবর যাতে টের না পায় আমার বুড়ো শিশু, আমি মুখটা বুকে চেপে ধরি। কানের উপর আলতো করে হাতটা চেপে রাখি... সোফা থেকে বিছানায় যাবার পথে আমি চোখ মেলে জানিয়ে দিতাম ঘুমাইনি... আব্বা বাড়ি ফিরে সেরকমই সবাইকে জানিয়ে দেন, সব টের পেয়েছেন তিনি! তারপরও পরেরবার, আরও দু’তিনবার আমাদের হাসপাতালবাসে আব্বা রাতভর আমার বুকে মুখ গোজে থেকেছেন। আর বাড়ি ফিরে আমি সোফায় শুয়ে পড়লে কাছে এসে বলেছেন, ‘ও ফুয়া, উঠতে, বাফেনু আর কুলো নিতাম পারি না, উঠো... আও বাপ-পুত ঘুমাইযাই একলগে...
আম্মার কতো অভিযোগ। আমি তারে ভালোবাসি না। আমি আগে বাইরে গেলে ঘন্টায় ঘন্টায় আব্বার সাথে কথা বলতাম। এখন তার সাথে বলি না। রাগ করি সেসব কথা শুনে। আম্মার মনের ভুল বলি। তারে বলি এতো বয়েস হলে আর বাড়িতে বার বার ফোন করতে হয় না। আমি আর বাচ্চা নই, বাচ্চার বাপ... কিন্তু আম্মাকে বলা হয় না, আব্বা এতো বেশি ছায়াময় ছিলেন, আব্বা এতোবেশি জড়িয়ে রাখতেন, অসুস্থ দুর্বল আম্মার পক্ষে সেটা অতিক্রম করা সম্ভব না। এই যে, মাঝরাতে, আম্মা এসে জানালার পর্দা তুলে দেন বাতাস ঢুকবে বলে, আমার যে তখন আব্বার কথা মনে পড়ে যায়। খাবার টেবিলে এখন আর কেউ হাজার চেনা মাছটার ঠিকুজি বলে সেই মাছ পাতে তুলে দেয় না আম্মা। মাছ আমি খাইনা, এটা সবাই মেনে নিয়েছে, আর একটা মানুষ ৩০ বছর ধরে যে কোনভাবে মাছ খাওয়াবার চেস্টা করেই গেলো... এমনকি শেষদিনে, শেষবেলাতেও...
আমার কোন দোষ নাই আম্মা। সব দোষ সেই কালো গাব্দা গোব্দা লোকটার
মন্তব্য
কেন আপনি আমার বাবার গন্ধ পাইয়ে দিলেন। ৫ টি বছর বাবাহীন আমি বড় একা প্রতিদিন পার করি ।।।
আমি নিশ্চিত ছিলাম বাবা দিবসে তোমার একটা লেখা আসবে।
আমার আব্বা মারা যাবার পর ১৫ বছর পার হয়ে গেছে।
মনে হয় স্মৃতিও ফিকে হযে যাচ্ছে।
শুধু মাঝেমাঝে রাত গভীর হলে যখন নিজের পাড়ি দেয়া সময় নিয়ে চিন্তা করি তখন মনে হয় যে আমার আজকের অবস্থানে আাসার জন্য যে মানুষটার অবদান সবচেয়ে বেশী সেই মানুষটাই আমার প্রতিষ্ঠিত হওয়াটা দেখে যেতে পারেননি।
লেখা যথারীতি
.....................................................................
বাবার সাথে আমার সামনাসামনি অতটা অ্যাটাচমেন্ট নাই । বাড়ির বাইরে চলে আসার পড়ে নিজে থেকে খুব কমই ফোন করেন আমাকে, কিন্তু প্রতিদিনই আমি ফোন করেছি কিনা তা জিজ্ঞেস করে মাকে ব্যাতিব্যস্ত করে রাখেন । বাড়ি গেলেও আমার সাথে কথা অতটা হয় না ঠিকই, কিন্তু বাজার করার সময় আমি যা খেতে ভালবাসি সেইসবই শুধু ব্যাগভর্তি করে কিনে আনেন । আর যা খাই না, আমি থাকাকালীন বাড়িতে তা ব্রাত্য । একবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম, সারাদিনের ছোটাছুটিতে একসময় মা ক্লান্ত হয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়লেন । বাবা ঠায় বসে থাকলেন সারারাত ।
আমি জানি, আমাদের প্রায় প্রত্যেকের বাবাই এমন ।
খুব আবেগময় লেখা; নিজের আবেগ পাঠকের মাঝেও ছড়িয়ে দিয়েছেন দারুণভাবে । অভিনন্দন !
ভালো লাগলো লেখাটা, খুব ভালো লাগলো। একটা কোমল স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে গেল ভিতরে বাহিরে। ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আমার বাবা আছেন পৃথিবীর আরেক প্রান্তে। কদাচিৎ ফোনে কথা হয়। মাঝে মাঝে সেটাও হয় না।
গতকাল থেকে ফেসবুকের ফীডে বাবাকে নিয়ে মানুষের স্মৃতিচারণ দেখে, নিজেকে জোর করে দূরে সরিয়ে রেখেছি। প্রবাসের এই প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে দুর্বল দেখতে ভালো লাগে না। তাই কোনো স্ট্যাটাস নেই,কোনো মন্তব্য নেই। তবু শেষ রক্ষা করতে পারলাম না - বেখেয়ালে আপনার লেখাটা পড়ে ফেললাম।
মন খারাপ করানোর জন্য হয়তো আপনাকে কঠিন একটা কিছু বলতাম, শুধু এতো চমৎকার করে লিখেছেন দেখে চুপ করে থাকলাম।
আফসোস, এতো চেষ্টার পরও শেষ পর্যন্ত আমি একজন আবেগপ্রবণ, দুর্বল মানুষই থেকে গেলাম।
অলমিতি বিস্তারেণ
facebook
এর বেশী লিখতে বসলে থামা কঠিন হয়ে যাবে!
--------------------------------------------------------------------------------
কিছু বলার নেই।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
মন খারাপ, মন খারাপ।
- কামরুজ্জামান পলাশ
ভেজা চোখে আমিও বলছি-
আমার কোন দোষ নেই আম্মা। সব দোষ সেই কালো লম্বা লোকটার ……………
প্রিয় মুখটি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আজ সাতটি বছর এক বিশাল শূন্যতায় ডুবে আছি। সেই থেকে 'বাবা' কে নিয়ে কোন লেখা আমি পড়ি না । আপনার লেখার শিরোনাম দেখে বুঝতে পারিনি। ভুল বাড়িতে ঢুকে পরেছি।
খুব সুন্দর লেখা। গতকাল থেকে ফেসবুকে সবার স্ট্যাটাস দেখে শুধু মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, আজ থেকে ১১ বছর আগে আমি হারিয়ে ফেলেছি সেই মানুষটাকে যার জন্য আজকের এই আমি, খুব শখ ছিল তার আমাকে নিয়ে কিন্তু কিছুই দেখে যেতে পারলেননা। লেখাটা মন খারাপ করে দিল।
ছুঁয়ে গেল খুব আলবাব ভাই।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
.............................
-একলহমা
লেখার শিরোনাম দেখেই বুঝেছি কী নিয়ে লিখেছেন। তাই পড়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আপনার লেখা না পড়ে থাকতে পারি না। এটা একটা অমোঘ নিয়তির মতো। পরিণতি জানি তবু সেই পাঁকেই পড়ি। কষ্ট পাবো জেনেও ঐকথাগুলোই বার বার মনে করি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমারও আব্বার সাথে এমনই একটা সম্পর্ক ছিলো। ২৩ বছর হলো ওঁ চলে গিয়েছেন তবুও মাঝে মধ্যেই আমার স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসেন। লেখাটা পড়ে বেশ মনোকষ্ট হলো। মাঝে মধ্যে মনে কষ্ট পাবারও প্রয়োজন আছে। নয় কি ?
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
সব বাবাদের গল্প ঘুরেফিরে কেমন যেন মিলে যায়!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
বয়সের সাথে সাথে চোখের জল যে বাড়ে তাতেও সব দোষ ঐ স্যালাইভারী গ্ল্যান্ডের আর বিজ্ঞানের ।।।
আফরিন আহমেদ
আমার কিছু আজব বিষয় আছে। শুনে হয়তো অনেকে আহ্লাদ ভাবতে পারেন। কিন্তু সেটা সত্য।
বিষয়টা হলো, লিখতে বসার পর সব কিছু গুলিয়ে ফেলা। নিজের সাথে, সময়ের সাথে, জীবনের সাথে... একবার তাহের নামের একজনের গল্প বলতে শুরু করলাম। সেখানে এসে একসময় তার বোন জোনাকী ঢুকে গেলো, তারপরই ঘটলো বিপত্তি। তাহেরের সেই গল্পটা এতই বদলে গেলো যে, আমি আর সেটা আগাতে পারি না। তীব্র বেদনায় জোনাকী নামের এক মেয়ের মন খারাপের গল্প হয়ে উঠতে চাওয়া গল্প আমি আর নিজেতো শুনিইনি, বলিওনি কাউকে।
আর এরকম একেবারে নিজের কথা যখন বলি, তখন কোন নিয়ন্ত্রন রাখা একেবারেই অসম্ভব। নানা ঘটনা, নিজের কথা এসে মাথার মাঝে ভর করে। তারপর আমি সামলাতে পারি না।
ব্লগের খাতা আছে বলে সেসব লেখা, অবিন্যস্থ বাক্যাবলী দিয়ে দিতে পারি পরিচিত পাঠকের কাছে। অনেকেই সেসব পড়েন, কেউ কেউ এসে চিহ্ন রেখে যান। কি মমতাময় সেসব চিহ্ন!
ওইযে বল্লাম সবকিছু গুলিয়ে ফেলি, সবকিছুর সাথে নিজেরে মিশিয়ে দেই, এজন্য আমি অনেক সময়ই ঘোরগ্রস্থ থাকি। মন্তব্যগুলো তাই খুব করে কথা বলাতে চাইলেও বেশিরভাগ সময় উত্তর দেওয়া হয় না। কিন্তু না বলাটাওতো এক ধরনের বাজে আচরণ হয়ে যায়! তাই ক্ষমা চাই প্রথমে। কৃতজ্ঞতার কথা নাইবা বলি। শুধু বড় বেশি আপন মনে হয় এইসব মন্তব্যের পেছনের মানুষদেরকে। সেইসব মানুষের জন্য শুভেচ্ছা। ভালো থাকবেন।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
কী লিখলিরে অপু? কেন লিখলি?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
নতুন মন্তব্য করুন