এই বয়েসে একটা দলের সাথেতো আর সময় কাটানো যায়না। নানা ধরণের বন্ধু বান্ধব জুটে যায়। তারপর বয়েস বাড়ার সাথে সাথে যেকোন একজন, দুজন অথবা বিশেষ একটা গ্রুপের সাথে যোগাযোগ হয়তো বেশি থাকে, অন্যদের সাথে সেটা কমে। কোন কোন ক্ষেত্রে বন্ধই হয়ে যায়। স্টেডিয়াম পাড়ার সৈকত রেস্তোরাতে বসে আমরা যারা আড্ডাবাজি করতাম, সেটা খেলাধুলাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিলো। সেই গ্রুপে কেউ ক্রিকেট খেলতো, কেউ হকি, কেউ ফুটবল। কোন ধরণের খেলাধুলা না করেও আমি আর শামীম সেই গ্রুপে কেমন করে ঢুকে গিয়েছিলাম সেটা আর মনে নাই। কিন্তু টানা ৪/৫ বছর সেই আড্ডাটায় ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়েছি আমরা। আর সেই আড্ডার মধ্যমনি ছিলো এই ঝুমুরদা। বিচিত্র কাণ্ডকারখানা, মজার মজার কথা দিয়ে আড্ডা মাতিয়ে রাখতো। সৈকত রেস্টুরেন্টের টেবিল কিংবা স্টেডিয়ামের যে কোন একটা গ্যালারী দখল করে প্রতিদিনের আড্ডার আজান দিতো এই ঝুমুর।
শামীমের বাবা মারা গেলেন হঠাৎ। বাড়ির বড় ছেলে হিসাবে সংসারের হাল ধরলো সে। বাবার ব্যবসায় যোগ দিলো। আমি আস্তে আস্তে নাটকের কাজে জড়িয়ে গেলাম। সৈকতের সেই আড্ডায়ও যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো একসময়। অন্যরাও এদিক সেদিক চলে যেতে লাগলো, রেস্টুরেন্টের টেবিলতো ফাঁকা থাকেনা। সেখানে নতুন আড্ডারুরা এসে যোগ দেয়। আমার সেসব খবর নেয়া হয় না। স্টেডিয়াম পাড়ায় যদিও যাওয়া হয়। একদিন সেখানেই পাকড়াও করলো ঝুমুরদা। ব্যপক হাউকাউ, টানতে টানতে নিয়ে গেলো সৈকতে। একটা টেবিল ঘিরে বসে আছে জুনিয়র কয়েকটা ছেলে, মুখ চিনি কারো, কাউকেবা নামে চিনি, ঝুমুর টুপ করে সেখানে বসে গেলো, তখনও সমানে খিস্তি করছে। তার খিস্তি, সামনে আমি এসব নিয়ে বসে থাকারা যেমন বিব্রত, আমিও ততটাই। মিনিট দশেক সেখানে বসে ফিরে এলাম। আমাকে আবার এগিয়ে দিতে এলো ঝুমুরদা, মন খারাপ করে বল্ল, তোমরা কেউ আসোনা, এই বাচ্চা বাচ্চা পোলাপানের সাথে আমি এখন আড্ডা দেই! কিছু বলার ছিলো না আমার, কাজের দোহাই দিলাম শুধু।
ম্যালাদিন পরে, সম্ভবত বছর দশেক হবে, আমাদের পাশের পাড়াতেই ওর সাথে আবার দেখা। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ইয়া আলী বলে কোলাকুলি... মুখে কাচাপাকা দাড়ি! কি অবস্থা, কেমন আছো এসব আটপৌরে কথাবার্তা হয়। হাতের ব্যাগ থেকে এক প্যাকেট মোম বের করে দিলো ঝুমুরদা! ‘লোকনাথ মোমবাতি’। এই মোম ফ্যাক্টরির মালিক সে। আমাদের পাশের পাড়াতে বাড়ি করেছে তারা। সেই বাড়িতেই এই মোম ফ্যাক্টরি। দেখে খুব ভালো লাগে। প্রশংসা করি। ভালো চলছে তার, সে কথা শুনে আনন্দিত হই। কিন্তু ঝুমুরদা বেশ মন খারাপ করে বলে, কারো সাথে যোগাযোগ হয় না আর। সময় পায় না! আমি বলি জীবনের নিয়মই এই। কিন্তু ঝুমুর সেটা মানতে নারাজ। তার কথা হলো, রোজ যদি বন্ধুদের সাথে আড্ডাই না দিলো, তাহলে আর কিসের জীবন! সেই শেষ দেখা। আর কখনো দেখা হয়নি ওর সাথে।
ফেসবুকে একটা ছবি পেলাম আজ, এক অচেনা সন্ন্যাসীর। এরকম ছবি দেখলে কোন আগ্রহবোধ করিনা। পরিচিত কেউ পোস্টও করেনি, ফেসবুক কোন এক বন্ধুর বন্ধুকে আমি বন্ধু বানাতে আগ্রহী কীনা সেটা জানার জন্য এই ছবি লটকে দিয়েছে। চোখের কোনায় আটকে গেলো ঝুমুর শব্দটা। পড়ে দেখি এই আমাদের ঝুমুর!!! যিনি ছবিটা দিয়েছেন, তিনিও আমারই মতো ঝুমুরের আরেক ছোটভাই বন্ধু, তার সাথেও ঝুমুরের অনেকদিন দেখা নেই। হঠাৎ করেই পেয়ে গেলেন এই সন্ন্যাসীকে, আর অবাক হয়ে আবিস্কার করলেন এ আর কেউ নয়, প্রিয় ঝুমুরদা!
ফেসবুকে অচেনা জঞ্জাল এড়িয়ে চলতে চলতে এইযে মনের খুব ভেতর থেকে কিছু একটা উকি দিয়ে ঝুমুরের নামটা দেখে ফেল্ল। এইযে ঝুমুর এসে টেনে হিচড়ে ষোল, সতেরো, আঠারো, উনিশ কিংবা বিশ বছরের আমাকে আবার নিজের সামনে দাড় করিয়ে দিলো, সম্ভবত এরই নাম বন্ধুতা!
মন্তব্য
হ্যাঁ, ফেসবুকে পুরান বন্ধুদের খুঁজে পাওয়ার এই ব্যাপারটা খুব মন-কাড়া!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
সেটাই।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
এতো উচ্ছ্বসিত হইয়েন না বাউল। ফেসবুকে অতি পুরান বন্ধুদের আবিষ্কার করার পর অচিরেই আবিষ্কারের উচ্ছ্বাসটা প্রথমে হতাশা, তারপরে আতঙ্কে পরিণত হয়। এক কালের আত্মার আত্মীয়রা কেমনে কেমনে যেন অজকুলে পর্যবসিত হয়। শালার আমরাই মিসফিট!
প্রথম অনুচ্ছেদে উদ্দাম বানানটা ঠিক করেন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সেরকম না পাণ্ডবদা। এর কাছ থেকে কোন আশা ভরসা কিছুই নাই। তাছাড়া সন্নাস নেয়া কারো কাছ থেকে কিইবা চাইবার থাকে। আমি শুধু অনেক বছর পর একটা মানুষকে খুঁজে পাওয়া, একেবারে ভিন্ন মানুষ হয়ে যাওয়া এইসব নিয়ে ভাবছিলাম। অবশ্য ভাবনাটা সেভাবে প্রকাশ করতে পারিনি।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
সম্ভবত তুমি লামাবাজারের ঝুমুর দার কথা বলছো। উনারা তিন ভাই নুপুর, ঘুঘুর আর ঝুমুর। যদি উনাদের কথা বলে থাকো তাহলে বলি, ঝুমুর দা এখন পুরোপুরি ইসকন সন্নাসী। যতটুকু জানি, ঘরে অভাবের কারণেই এই সন্নাস জীবন বেছে নিয়েছেন।
__________
সুপ্রিয় দেব শান্ত
ইসকনতো না, আমিতো যতটুকু শুনলাম বৈষ্ণব সন্নাসী হইছে সে। ইসকনের লালপাট্টি না সে।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
ফেসবুকে হারানো বন্ধুবান্ধব খুজে পাওয়া দারুণ ব্যাপার। কিন্তু একবার ভিন্ন ঘটনা ঘটলো।
বছর দুয়েক আগে স্কুল বেলার এক হারানো বন্ধুকে খুঁজে পাবার সেরকম রোমাঞ্চ পেয়ে সেরকম আপ্লুত হয়েছিলাম। কানাডার এক ইউনিভার্সিটির জাদরেল শিক্ষক সে। কিন্তু মাস দুই যেতেই একদিন টের পেলাম সেই বন্ধুর লাইকের সাথে বাঁশের কেল্লার কী সুমধুর ঐক্যতান!! নিমেষেই সুর তাল সব কেটে গিয়ে বিষাদময় হয়ে গেল বন্ধুতা।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
এসবের জন্য ফেসবুক লাগেনাকি? আমাদের এক বন্ধু ছিলো, যে নাটক করতো, কবিতা পড়তো। সে এখন টিভিস্টার, ডিজিটাল ধর্ম প্রচারক।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
ফেসবুক যারা রেগুলার ব্যবহার করে তাদের বেশিরভাগেরই মনে হয় এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনেকটা কবর খুঁড়ে বন্ধু নিয়ে আসার মতো ঘটনা ঘটেছে আমার বেলাতেও।নতুন ভালো বন্ধুও জুটেছে। কিন্তু একইসাথে সম্পর্কগুলোর আবেদন ক্যান যেনো কমে যাচ্ছে মনে হয়।এক বন্ধু যাচ্ছে ত আরেকজন হাজির। সহনশীলতা কমে যাচ্ছে সবার। আগেরকালের আড্ডাবাজিরগুলো এখন দলবাজিতে পরিনত হচ্ছে মনে হয়। হয়ত সময়টা এমনই, আমরা হয়ত একটা ট্রানজিশন পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বাস্তব আর ভার্চুয়াল দুইটা ব্যাপারকে একসাথে করার তরিকা জানার চেষ্টা করছি।
-------------------
আশফাক (অধম)
ফেসবুকে একসময় হারানো বন্ধুদের খুঁজে পাওয়ায় মন ভালোলাগায় ভরে গেলেও এখন আর হয় না। কিছু দিন পেরিয়ে যেতেই দেখি বেশিভাগ হালাল টিভি, হালাল ধর্ম, হালাল ফেসবুক, হালাল প্রেম খুঁজে । এক আমেরিকান বন্ধু কলেজ পাশ দিয়ে আমেরিকায় গেল সেও হালাল পথে হালাল ফেসবুক ব্যবহার করে ইহুদিদের ধ্বংস কামনা করে, হিটলারের সাফাই গায়, আর যারা মধ্যপ্রাচ্যে গেছে তারা মোটামুটি বাশের কেল্লার অন্যতম শেয়ারদাতা। এদেরকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দ বেশি দিন টিকেনি, ডিলেট মারতে হয়েছে। এখন তাই পুরানোদের আর খুঁজি না।
মাসুদ সজীব
লেখাটা খুব ভালো লাগল আর মন্তব্যগুলোর সাথেও আমি একমত। আজ বন্ধু দিবসে যেসব বন্ধুরা আমাদের খুব প্রিয় ছিল কিন্তু কোন কারণে আজ আর যাদের সাথে যোগাযোগ নাই তাদের সবার উদ্দেশ্যে আমার গাওয়া একটা গান উৎসর্গ করতে চাই।
http://www.youtube.com/watch?v=hKfQg3jgkjM
ফাহিমা দিলশাদ
আলবাব হইছে দেশান্তরী বাউল আর ঝুমুর সন্ন্যাসী।
...........................
Every Picture Tells a Story
ক্লাস ত্রি এর বন্ধুকে খুঁজে পেলাম সেদিন। অন্যরকম ভালোলাগা
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ফেসবুকে কাউরে খুঁজে পাওয়া/না পাওয়া দিনশেষে একটা হতাশা কিংবা দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয়ে যায়। সুতরাং, খোঁজাখুঁজির অই রাহা পরিহার করে আসুন আমরা গীত হুনে গেবন ধন্য করি...
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
পুরোনো বন্ধু খুঁজে পেলে সবসময় সম্পর্কটা জোড়া লাগে না। স্কুলের হারানোদের কলেজে খুঁজে পেয়ে দেখেছি আর সেই ঐকতান নেই। আবার, স্কুলের অনেকের সাথে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছে কলেজে।
কি জানি, আমার বন্ধু ভাগ্য খুব একটা ভালো ছিল না
নতুন মন্তব্য করুন