প্রাইমারি স্কুলে একটা বিষয় ছিল ছবি আঁকার। বাংলা স্যার মাঝে মাঝে কিছু একটা আঁকতে বলতেন। আমরা আলতো হাতে তা আঁকতাম।ক্লাস বলতে এই পর্যন্ত। কিন্তু পরীক্ষার সময় ছবি আঁকার আলাদা পরীক্ষা ঠিকই হতো। পরীক্ষার দিনে ক্লাসের সবাই রঙ, রঙ পেন্সিল, তুলি, স্কেল কত কি নিয়ে আসতো। ...আমার সে সব নেওয়া হতো না। বড় আপা কচি সীমপাতা তুলে দিত বেশ কটা, সাথে বাবার লাল কালির কলম। আর আমার লেখার কলমটাতো থাকতই। এ জন্য আমার আঁকা ছবি সব সময়ই তিন রঙের হতো। কচি সীমপাতা সবুজ, লাল আর কালো নয়ত নীল এই তিন রঙা। শুধু একবার ছাড়া সেবার বড় আপা কিভাবে যেন দুটো রঙ পেন্সিল জোগাড় করেছিল। একটার রঙ গোলাপী অন্যটা খয়েরী।
সেই শৈশব থেকে তাই রঙ আর রঙ পেন্সিলের জন্য আমার মনে কিযে বেদনাবোধ। পেন্সিল দেখলেই বুকের ভেতর অপ্রাপ্তির ব্যাথা কেমন দলা পাকাতে শুরু করে। আমার তখন বড় আপার কাছে যেতে ইচ্ছে করে। মৃত্যুর মত শীতল হয়ে যায় আমার চারপাশ।
মন কেমন হয়ে যায় কদম দেখলেও। আকাশছুয়া এক সারি কদম গাছ পেয়েছিলাম শৈশবে। তার সোনালি ফুলের কোমলতায়, কাটিয়েছি অনেকটা সময়। রাতের আধারে সেখানটায় নেমে আসে রাজ্যের নিরবতা। সূর্যবিদায়ের পর তাই সেদিকটায় যাওয়াই হতো না। মাঝে মাঝে খুব দরকার হলে কদম সারির ওপাশে বেলাদির বাড়িতে যাওয়া হতো। তিনিও আসতেন কোন প্রয়োজন হলে। ...এক রাত। খুব গভীর নয়। দশ, এগার হবে। হঠাৎ কদমতলার দিক থেকে কি রকম এক গোঙানীর শব্দ শুনে বেরিয়ে এলাম সবাই। টর্চ লাইটের আলোয় দেখলাম বিভৎস এক দৃশ্য। বেলাদি বড় কদম গাছটার পাশে পড়ে আছে। উড়না দিয়ে বাঁধা মুখ...
এক সপ্তাহের মাথায় বেলাদিরা কাউকে কিছুনা বলে কোথায় যেন চলে গেল। চন্দন ভাইয়া বলেছিলো 'মালাউনরা' আর কোথায় যাবে। ইন্ডিয়াতেই গেছে। সত্য হতে পারে আবার মিথ্যাও। কিন্তু বেলাদি চলে যাবার পর থেকে কদম দেখলেই তার কথা মনে হয়। মাসিমার কথা মনে হয়। আর মনে হয় সেই রাতের কথা ...মনটা খারাপ হয়ে যায়। আর তাই, প্রতি বর্ষায় মুঠো মুঠো সোনা ছড়িয়ে যে কদম শোষে নিত বালক বেলার কষ্টগল্প। সে নিজেই আজ কষ্টের অংশ, রঙ পেন্সিলের মতো।
বড় আপা পেন্সিল কার কাছ থেকে পেয়েছিলো সেটা আমি পরে জেনেছিলাম। ওগুলো ছিল চন্দন ভাইয়ার।যে চন্দন ভাইয়া বেলাদিকে মালাউন বলত। দাবড়ে বেড়াত মোটরসাইকেল। আমাদের পাড়াতেই ওদের বাড়ি। যে সকালে বড় আপা বিছানা ছেড়ে উঠলোনা, যতক্ষণ না মা আর হাসু খালা তাকে পাটি বিছিয়ে উত্তর দক্ষিণ করে শোয়ালেন...। সেদিন আমি জেনেছিলাম পেন্সিলগুলো চন্দন ভাইয়ার। আমাকে কেউ বলে দেয়নি। তবু। আর বলবেই বা কী। এই যে আপা ইচ্ছে করে মরে গেল। মা, বাবা কিংবা দিদা কেউ সে কথাটা আমায় বলেনি। তবু বুঝেছি। আসলে তখন বুঝতে শিখছি অনেক কিছু।
কবিতার কামড়ে অস্থির হওয়ার তখন থেকেই শুরু।
কবিতা! কবিতা আমাকে ছেড়ে যায়নি, আরও অনেকের মতো।
সমাজ বিজ্ঞান নবম শ্রেণীতে।
একসাথে কাস ছেলে মেয়েতে।
প্রথম দেখলাম শময়িতা...
বাদামী ত্বক, চিবুকে বিষন্নতা...
বুক জুড়ে ঝড়, শরীরে জ্বর ...
আকাশের বুকে দেখা তারাদের ঘর।
তারাদের আয়ু খুব বেশি ক্ষীন...
ফর্সা পৃথিবী, আলোতে রঙিন।
চোখ খুলি আলোয়।
শময়িতা নেই!
শময়িতা নেই...
সামনে মিছিল...
আলগোছে হয়ে গেলাম মিছিলের জন...
সে এক ঘোর লাগা সময়। কত স্বপ্ন, কত কথা, সমাজ বদলের কথা। তার আগে বদলে যাই নিজে। ইশতিয়াক, অর্জুন, জাফর আরো কতো নাম। সে নামের ভিড়ে আমিও মিশে যাই। সবার হাতে একেকটা চাবি। আকাশের নিচে যাব আমরা। যেতে হলে খুলতে হবে অনেক ফটক, অনেক তালা। ওগুলো খোলার চাবি আমাদের হাতে হাতে। আমরা চাবি নিয়ে ঘুরি। খুলে ফেলি একেকটা অদৃশ্য তালা। দ্রোহের আগুনে জ্বালিয়ে দিতে চাই পুরোটা বর্তমান।
...হঠাৎ আকাশ ঝরায় বৃষ্টি। অঝোরে ঝরে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে অজর্ুন আর আমি ইশতির জন্য আফসোস করি। আফসোস করি জাফরের জন্য। ওরা যদি রক্ত স্নানের আগে একটিবার অন্ততঃ দাঁড়াতে পারত এই বৃষ্টি আকাশের নিচে...। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। আমি দৌড় দিই।
অজর্ুনও দৌড়ায়। দৌড়? ওরতো মা নেই। মুহূর্তের সে ভাবনা। অন্য কেউ নিশ্চয় আছে, আরো জোরে দৌড়। হাত থেকে ছুড়ে ফেলি ভয়ংকর সেই চাবি। ভেজা শরীরেই জড়িয়ে ধরি মাক। হতচকিত হয়ে পড়েন মা। তারপর আঁচল শুষে নেয় মাথার জল।
এ আঁচলটা এমন কেন? এত মমতা মাখা! ছোট বেলায় ভাত খাওয়া হলে মা তাঁর আঁচলে মুখ মুছে দিতেন। আঁচলের সে ঘ্রাণ এখনও পাই। বাবা খুব মেরেছিলেন এক বিকেলে। অনেক রাত পর্যন্ত কেঁদেছিলাম মায়ের আচলের আশ্রয়ে। পরের দিনও খুব মন খারাপ। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে বাবা ডাকলেন। আস্তে গিয়ে পাশে দাঁড়ালাম। পেছনে বড় আপা, বাবা একটা প্যাকেট দিলেন, বড় আপা ছোঁ মেরে সেটা নিয়ে খুলে ফেললো। বেরিয়ে এলো একটা শার্ট। নীল রং। বড় আপা বললো "আকাশী রঙের শার্ট! অপু এটা পরলে তুই আকাশের অংশ হয়ে যাবি! সেদিন থেকে আকাশ আর আকাশী রং আমার সবচেয়ে প্রিয়।
মানুষ মরে গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়। আকাশ জানে নিশ্চয় প্রত্যেক তারার ঠিকুজী। এই যে আকাশ আমার এত প্রিয় তবু সে আমায় বলে না ঠিক কোন তারাটা বড় আপা!
...বড় আপা কেমন আছিস এখন?
বৃষ্টি ছিল তোর খুব প্রিয়।
এখন বৃষ্টিতে ভেজা হয়?
আকাশ থেকে আমাকে দেখা যায়?
...আমার খুব ছবি আঁকার শখরে আপা, অনেক ছবি, রঙে ভর্তি ছবি। তার জন্য রং চাই, তুলি চাই, পেন্সিল চাই। অনেক রং...
অনেক তুলি...
অনেক পেন্সিল, রং পেন্সিল...
কে দেবে এতো কিছু?
বড় আপা, আয় না ফিরে। আমার সকল চাওয়া তোর জন্য তুলে রাখা বড় আপা। শুধু তোর জন্য। আসবিনা বড় আপা। না আসলে আমাকে নিয়ে যা তোর কাছে। তুই কাছে থাকলে আমার আকাশটা কত উজ্জ্বল হয়ে যাবে।
স্কেচ: [লিংক=যঃঃঢ়://িি.িংড়সবযিবৎবরহনষড়ম.হবঃ/হরষঁংরহযধনষড়ম]নীলু সিনহা[/লিংক]
-------------------------------
আমাদের সুসময়ে সহবাস নামের ছোট গল্পের একটা কাগজ বেরুত। [লিংক=যঃঃঢ়://িি.িংড়সবযিবৎবরহনষড়ম.হবঃ/ঐধংধহথগঁৎংযবফনষড়ম]হাসান মোরশেদ[/লিংক] ছিলেন সম্পাদক। সাথে ছিলাম নিলাঞ্জন দাশ টুকু, [লিংক=যঃঃঢ়://িি.িংড়সবযিবৎবরহনষড়ম.হবঃ/অৎরভ-ঔবনঃরশনষড়ম]আরিফ জেবতিক[/লিংক], আসিফ মনি, [লিংক=যঃঃঢ়://িি.িংড়সবযিবৎবরহনষড়ম.হবঃ/ধৎলঁহসধহহধনষড়ম]অর্জুন মান্না[/লিংক], সুরঞ্জিত সুমন, অর্ণা রহমান, জাকির আহমদ চৌধুরী, রিয়াদ আওয়াল এবং আমি। সহবাস এর চতুর্থ সংখ্যায় ছাপা হয় ব্যক্তিগত ব্যাখান। ছাপাখানা থেকে আসার পরই বড় ধরনের কয়েকটি অসংগতি আবিস্কার করি আমি। মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু কামান দাগা শেষ। তাই আর ঘাটাইনি বেশি। সাত বছর পর কিছুটা শুধরে নিলাম আজ।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন