সময়টা হবে গত বিশ্বকাপের আগে আগে, হয়ত ২০০৮ কি ০৯। তখনই প্রথম জানতে পারি যে দক্ষিণ আফ্রিকার পরেরবার বিশ্বকাপ হবে ব্রাজিলে। ১৯৫০ এর পর এই প্রথম ! বিশ্বকাপের টিকিট কোথায় পাওয়া যায়, আদৌ পাওয়া যায়, না ভর্তি পরীক্ষা টাইপ কিছু দিতে হয়-এসব তথ্য তখনও কিছু জানি না। এখনও পুরোপুরি জানি বলাটা ঠিক হবে না। তো সেই বিশ্লেষণ আর ৬ বছরের অপেক্ষার বর্ণনা এবং 'কী করিয়া এই অমূল্য ধন আমি হস্তে পাইলাম" টাইপ রচনা না লিখে মোটামুটি এক কথায় যা বলা যায় সেটা হলে ফিফার সব কথা সব সময় বিশ্বাস করবেন না। প্রথমবার সহজ সরল মনে দেড় ঘন্টা অপেক্ষার পর পেলাম গ্রিসের টিকেট। পরেরবার সেই ভুল না করে দুই মিনিটের মাথায় পেলাম স্পেন-ডাচ আর আর্জেন্টিনা-বসনিয়ার টিকেট। এরপর এক হাতে সেই টিকেট আর আরেক হাতে বউকে ধরে এক গভীর রাতে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে যাত্রা হল শুরু রিওর দিকে (রিওতে বউ নিয়ে যাবেন না রেখে যাবেন, এই প্রশ্নের কোনও সহজ উত্তর নাই, অনেক যেহেতু আর যদির উপর এটা নির্ভর করবে। যেহেতু আমার বউয়ের এই পোস্ট অথবা পোস্টের এই অংশটুকু পড়ার একটা ছোটখাট সম্ভাবনা আছে, সেহেতু ফর দা রেকর্ড-অবশ্যই নিয়ে যাবেন। যদি বউ না থাকে, তাহলে আগে বিয়ে করবেন না রিও যাবেন, সেটাও একটা আলোচনার দাবি রাখে।)। যাওয়ার পথে মায়ামি আর ডোমিনিকান রিপাবলিক থামতে হয়েছিল। স্যান্টো ডোমিঙ্গো থেকে যখন প্লেন ছাড়ল মোটামুটি অর্ধেক যাত্রী কলম্বিয়ার হলদে আর বাকি অর্ধেক চিলের লাল। সেই কলম্বিয়ানদের ভুভুজেলা আর চিলিয়ানদের "চিলে চিলে" হাঁকডাক শুনতে শুনতে এক ভোরবেলা এসে নামলাম রিওতে।
এই লেখাটা যখন শুরু করি, তখন মূল লক্ষ্য ছিল আমার ওয়ার্ল্ড কাপের দুটি ম্যাচ দেখার অভিজ্ঞতা কিছুটা হলেও শেয়ার করা। এই পোস্টে ব্রাজিলের ইতিহাস থাকবেনা এবং এটা ট্রাভেল গাইড হিসাবে কেউ পড়া শুরু করলে ভুল করবেন। কিন্তু লিখতে যেয়ে মনে হল যে ন্যূনতম ইতিহাস আর জায়গার কিছুটা হলেও বর্ণনা অনেকটা ছবির ক্যানভাসের মত কাজ করে।সেই হিসাবে ইতিহাসের যেই কিছু লাইন আসে, সেটা শুরু করলাম পর্তুগীজ কলোনিয়াল শাসন থেকে, যার ব্যাপ্তি ছিল ১৫০০ থেকে ১৮২২ পর্যন্ত। এর মধ্যে শেষের কয় বছর, ১৮১৫-১৮২২, ব্রাজিল শুধুমাত্র কলোনী ছিল না, সমগ্র পর্তুগাল রাজ্য পরিচালনা করা হত এখান থেকে, যার রাজধানী ছিল রিও ডি জ্যানিরোতে। নেপোলিয়নের তাড়া খেয়ে কিংডম অফ পর্তুগালের মহাবীর রাজা এই কাজটা করতে বাধ্য হন। স্বাধীন ব্রাজিল রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু ১৮২২ থেকে এবং রিও তার রাজধানী ছিল ১৯৬০ সাল পর্যন্ত, রাজধানী এরপর স্থানান্তরিত হয় ব্রাসিলিয়াতে। ইতিহাসের আগের এবং পরের অংশ উইকিপিডিয়াতে।
একটা শহরে আমি যখন প্রথমবারের মত যাই, তখন তুলনাটা কেন জানি সবসময় ঢাকার সংগেই আগে করি। আমার জন্ম, বড় হওয়া সবই ঢাকাতে। দশ বছরের প্রবাস জীবনের পরও নিজেকে এখনও ঢাকাবাসী হিসাবেই মনে করি। কত মানুষকেই তো কাজের জন্য ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেটে থাকতে হয়। আমি আরেকটু দূরে থাকি এই যা পার্থক্য। তুলনা বিশ্লেষণ করতে যেয়ে গ্যালেও ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের সেই কিছুটা অপরিষ্কার, অপরিকল্পিত অ্যারাইভ্যাল লাউন্জকে অনেকটা ঢাকার অ্যারাইভ্যাল লাউন্জের মতনই লাগল। ভোরবেলার ঘুম ঘুম চোখে ট্যাক্সি করে যেতে যেতে মনে হল আসলেই ঢাকা না কী ! একটু পর বুঝলাম, যদিও রাস্তার পাশের পুরোনো অ্যাপার্টমেন্ট আর দোকান আশির দশকের ঢাকার কথা মনে করিয়ে দেয়, এটা ঢাকা না। এখানে যে একটা বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে সেটার কোনও নামগন্ধই তো নেই ! ঢাকা হলে এতক্ষণে আশিটা গেট, একশ যাটটা বিলবোর্ড আর দেশি-বিদেশি অসংখ্য পতাকা(মূলত আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল) দেখা যেত। এখানে সেটার নাম থাকলেও গন্ধ নেই-মানে খুব বেশি হলে তিন চারটা জায়গায় বিশ্বকাপের (হয়ত সেগুলা বিশ্বকাপেরও না, অ্যডিডাসের ছিল) বিলবোর্ড দেখলাম। এসব উচ্চমার্গের চিন্তা করতে করতে অনেক ভোরবেলা এসে পৌছালাম কোপাকাবানার একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে, যেটা আমার পরবর্তী কয়েকদিনের নিবাস।
আগেই বলেছি, এই লেখা রিও বা ব্রাজিল নিয়ে না। আমার অনেক আগেই মহা মহা পরিব্রাজক তারেক অনু এসব জায়গায় তার পদচিন্হ রেখে গেছেন। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে তার অতীব সুস্বাদু কিছু লেখা আছে। আগ্রহীরা পুনর্বার সেগুলো পড়ুন। কিন্তু না চাইলেও আর লেখার অনভ্যাসের কারণে কিছুটা বর্ণনা চলে আসে। সেইরকমই না চাইলেও, বাসায় যাওয়ার পর চোখে নেমে এল রাজ্যের ঘুম। অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠে চলে গেলাম কোপাকাবানা সৈকতে। রিও নামটা শুনলে তিনটা ছবি ভেসে ওঠে-কার্নিভাল, ক্রাইস্ট আর সমুদ্র সৈকত। রিওর পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দু হল এই কোপাকাবানা এবং এর পাশের ইপেনিমা-লেবলন সৈকত। বলার অপেক্ষা রাখে না যে দুটোই সুন্দর। কোপাকাবানা অনেকে বেশি "টুরিস্টি", সেই তুলনায় ইপেনিমা-লেবলন কিছুটা হলেও "লেইড ব্যাক"। তবে নৈসর্গিক কথাটা আমার মনে হয়নি দুটোর একটা দেখেও, বলা যায় শহুরে সৈকত। সমুদ্র বিলাস ছাড়া রিওর আরেকটা পর্যটক/বোহেমিয়ান প্রিয় আরেকটা জায়গা হচ্ছে স্যান্টা টেরিসা। এটার কথা আসবে পরের পোস্টে।
আমি এইরকম অনেককে চিনি যারা একটা জায়গায় যায় পকেটে লিস্ট নিয়ে। তারপর স্বল্পতম সময়ে যতগুলো টিকমার্ক দেয়া যায় সেটাতেই সাফল্য। সেটা ভাল না খারাপ, সেই বিচার আমি করব না। যার যেইরকম ইচ্ছা, সে সেভাবে ঘুরবে। আমি পছন্দ করি একটা জায়গায় যেয়ে কিছুটা উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটা। একটু হাঁটব, থামব, কফি খাব। এর মাঝেই যা দেখার সেটা একটু সময় নিয়ে দেখা। কোনও শহরে যেয়ে আমার কখনো মনে হয় নি এটাই আমার শেষ আসা এই শহরে (ব্যাতিক্রম থাকবে না চাইলেও, যেমন এল প্যাসো)। যা পারি দেখি, বাকিটুকু পরের বার। এভাবেই দেখলাম করকোভাডো যেখানে অবস্থিত ক্রাইস্ট দা রিডিমার(নতুন সপ্তাশর্যের একটা), সুগারলোফ মাউন্টেইন (অপূর্ব)। কোপাকাবানা আর ইপেনিমার সমূদ্র সৈকত তো আছেই। উল্লেখযোগ্য আরেকটা জায়গায় যেটা গেলাম, সেটা হল কোপাকাবান বিচে ফিফার ফ্যান ফেস্ট। সৈকতের একটা বিশাল অংশ নিয়ে এই ফ্যান ফেস্ট, যেখানে খেলা শুরু আগে কনসার্ট টাইপ ব্যাপারস্যাপার হয়। খেলা শুরু হলে সেটা দেখান হয় বড় স্ক্রিনে। এখানেই হাজার লোকের ভিড়ে দেখলাম ব্রাজিল আর ক্রোয়েশিয়ার ওপেনিং ম্যাচের প্রথমার্ধ। দ্বীতিয়ার্ধে ফেরার সময় আশেপাশে দেখে মনে হল মধ্যরাতেও রিওর রাস্তা এত খালি থাকে না। সমস্ত ক্যারিওকারা এখন টিভিস্ক্রিনের সামনে। এসব দেখতে দেখতে আর চুরাসকারিয়া ভক্ষণ এবং কাইপিরিনিয়া আর সুস্বাদু বিশুদ্ধ ফলের রস পান (ব্রাজিলিয়ানরা ফলখোর জাতি, রাস্তায় একটু পর পর জুসের দোকান) করতে করতে আমার রিও ভ্রমণের প্রথমার্ধ শেষ হল। চলে গেলাম সালভাডরে, স্পেন-নেডারল্যান্ডের খেলা দেখতে।
শুগারলোফ পাহাড় থেকে কোপাকাবানা
শুগারলোফ পাহাড় থেকে রিওর সূর্যাস্ত
কোপাকাবানা সৈকতে ফিফা ফ্যানফেস্ট
ব্রাজিল ভ্রমণের এই সালভাডর অংশটুকু নিয়ে আমার আক্ষেপের শেষ নাই। এখন মনে হয় টিকমার্ক ভ্রমণ ব্যাপারটা মাঝে মাঝে খারাপ না। ছিলাম পুরো ২৪ ঘন্টাও হবে না। এর মাঝে খেলা বাদে ইতিহাসসমৃদ্ধ আর নৈসর্গিক সালভাডরের আর কিছুই দেখা হয় নি। এক দিনের বেশী থাকাও সম্ভব ছিল না। কারণ তার একদিন পরেই মারাকানায় মেসির খেলা দেখতে যেতে হবে। কী আর করা! যাই হোক, হোটেল থেকে বের হতে হতে দূপুর হয়ে গেল। ট্রাফিকের ভয়ে একটু আগেই বের হলাম। প্রথম ওয়ার্ল্ডকাপ ম্যাচ বলে কথা, তাও আবার গতবারের ফাইনালের পুনরাবৃত্তি। ম্যাচ তো পরের কথা, ওয়ার্মআপ অংশটুকুও মিস করতে চাই না। আমাদের হোটেলটা ছিল এরোপোর্টের কাছে, আর স্টেডিয়াম - এরিনা ফোনটে নোভা হল সিটি সেন্টারের কাছাকাছি। যেতে যেতে একবার মনে হল প্রথমে স্টেডিয়ামে না যেয়ে আগে পাশেই অবস্থিত পেলোরিনিয়ো যাই, পরে সেখান থেকে হেটে যাওয়া যাবে। পেলোরিনিয়ো হল বর্তমান শহরের কিছুটা দক্ষিণ-পশ্চিমভাগে অবস্থিত পুরোনো শহর, যেটা পর্তুগীজ কলোনিয়াল সময়ে সিটি সেন্টার ছিল। এখন ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্গত। কিন্তু যাওয়ার পথে যথারীতি পড়লাম বিশাল ট্রাফিক জ্যামে, আর স্টেডিয়ামের মোটামুটি এক মাইল আগে থেকেই সমস্ত রাস্তা ব্লক করা ছিল, শুধুমাত্র হেঁটে যাওয়া যাবে। ট্যাক্সি থেকে নামার সংগে সংগেই দেখলাম বাস থেকে এক দঙ্গল লাল জার্সি গান গেতে গেতে নামল। এসব দেখে আর পেলোরিনিয়ো আর যাওয়া হল না। পুরোনো শহর, আরও অনেক বছর থাকবে, যতদিন দিন যাবে তত আরও নাম হবে। পরে আবার কখনও আসা যাবে। তখন একই সংগে সালভাডরের বিখ্যাত কার্নিভালও দেখে ফেলব।
স্টেডিয়ামে ঢোকাটা যতখানি সমস্যা হবে ভেবে ছিলাম তার বিন্দুমাত্র হয়নি। হয়ত একটু আগে যাওয়াও এর কারণ। আমেরিকায় থাকতে থাকতে কোনও চেকপোস্ট দেখলে মনের অজান্তেই জুতা, প্যান্ট খোলা শুরু করি। এখানে দেখলাম নামে মাত্র স্ক্যানার। এদের মূলচিন্তা হল কেউ বাইরের পানীয় নিয়ে ঢুকছে না কি। ব্রাজিল স্টেডিয়ামগুলোতে বিয়ার পান করা নিষিদ্ধ। কিন্তু ফিফার চাপে পড়ে এই ওয়ার্ল্ডকাপের জন্য তাদের নিয়ম বদলাতে হয়েছে। কারণ এই ওয়ার্ল্ডকাপের একটা বড় স্পন্সর হল অ্যানহাইজার-বুশ কম্পানি এবং শুধুমাত্র তাদের ব্র্যান্ডের বিয়ার পাওয়া যাবে ভেনুগুলিতে। আমার দেখার ইচ্ছা কাতার ২০২২-এ ফিফা কি করে!
ঢোকার পর এত বড় স্টেডিয়ামে সিট খুঁজে পেতে কোনও সমস্যাই হয় নি। ধন্যবাদ প্রাপ্য ওখানে কর্মরত অসংখ্য ভলান্টিয়ারদের। আমি জানি না অন্য সময় কেমন থাকে, তবে আমার গড়পড়তা ব্রাজিলিয়ানদের যথেষ্ট উপকারী, আন্তরিক আর সৎ মনে হয়েছে। রিওতে ক্রাইস্ট দেখে ফেরার সময় কোনও ট্যাক্সি পাচ্ছিলাম না, সেটা দেখে এক ট্যাক্সিচালক (সে নিজে রিজার্ভড ছিল) গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার অন্যদিকে যেয়ে আমার জন্য একটা ট্যাক্সি ঠিক করে দেয়। খুব একটা কম দেশ তো দেখিনি। এরকম আচরণ আজ পর্যন্ত পাই নি কোথাও । রিওতেও যে অ্যাপার্টমেন্টে ছিলাম, সেটার তো ফ্রন্টডেস্ক বলে কিছু নেই। এদিকে আমার ফ্লাইট ছিল অনেক ভোরে। এয়ারপোর্টে কিভাবে যাব জানি না। এত সকালে তো আর মেট্রো থাকে না (পরে মনে হয়েছিল, থাকলেও লাভ হত না।কোপাকাবানায় মেট্রো স্টেশন থাকলেও কোনও লাইন সরাসরি এয়ারপোর্টে যায় না।) ভাবলাম পাশের হোটেলে যেয়ে একটু খোঁজ নেই। ওদেরকে বলামাত্রই তারা এয়ারপোর্ট ট্রানজিট ঠিক করে দেয়। এতটা আতিথেয়তা আশা করিনি ব্রাজিলে। আমারই ভুল ছিল।
যাই হোক, বসার পর ফাঁকা স্টেডিয়ামেই কিছু ছবি টবি তুললাম। আস্তে আস্তে স্টেডিয়াম ভরে যাওয়া শুরু হল। লালের থেকে কমলাই বেশি মনে হল। আর ব্রাজিলিয়ান হলুদও দেখি এই খেলাতে কমলা সাপোর্ট করছে। ওরা হয়ত স্পেনকে এবার বিশ্বকাপের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবেই মনে করেছিল। দেড় ঘন্টায়ই অবশ্য সেই ভুল ভেংগে যা্য়। একটু পরেই শুরু হয় ওয়ার্মআপ। একদিকে রবেন, ভ্যান পার্সি, স্নাইডার। আরেকদিকে দিয়েগো কস্তা, শাভি, ইনিয়েস্তা, ক্যাসিয়াস। ডাচদের ওয়ার্মআপের পুরোটা সময়ই কিপার ছিল টিম ক্রুল, কিন্তু পরে দেখলাম খেলতে নামল ইয়াসপার সিলোসেন। তখনতো আর বুঝিনি এই ক্রুলই হবে কোয়ার্টার ফাইনালে লুই ফন হালের তুরুপের তাস। ওয়ার্মআপে সবার শেষে মাঠ ছাড়ল রবেন। তখনই বোঝা উচিত ছিল ব্যাটার মতলব খারাপ।
ডার্ক কাউট, রবেন, স্নাইডার ছবি তোলার জন্য পোজ দিচ্ছেন
যথাসময়ে খেলা শুরু হল।
এর আগে ফুটবলে খেলা দেখার অভিজ্ঞতা আমার একবারই হয়েছিল। গতবছর, জুভেন্টাস আর এভারটন। সেবার যেই ব্যাপারটার অভাব সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছিলাম সেটা হল কমেন্ট্রি। আসলে ভুল বলা হল। সবচেয়ে বেশি মিস করেছিলাম জিয়েনলুইগি বুফোকে, ব্যাটা খেলতে আসেনি। দ্বিতীয় স্থানে কমেন্ট্রি। এবারও মনে করেছিলাম সেটাই হবে। কিন্তু ৫০০০০ দর্শকের মধ্যে আসলে কিছুই মিস হয় না। খেলা ২২ জন খেলে না। এত চিৎকার আর হৈচৈ এর মধ্যেও সবাই এতটাই নিবদ্ধ থেকে যে, মনে হয় ভ্যান পার্সি আমার পা থেকেই বলটা কেড়ে নিল। ইকারকে মনে হচ্ছিল ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আমিই বলটা ক্লিয়ার করে দেই, তাহলে তো আর গোলটা হয় না। রামোস যেভাবে দড়ি ছেঁড়া বাছুরের মত দ্বিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে রবেনের পিছনে ছুটতে থাকল, মনে হল আমি ওর সংগেই আছি আর এখনই পা বাড়িয়ে রবেনকে এক রাম আছাড় খাওয়াব। খুব বেশি হলে হলুদ কার্ড, গোলটাতো আর হত না। কিসের কী! তিনটা গোল খাওয়ার পর তো মনে হল আমার সামনে বসা স্প্যানিশ মেয়েটার মত স্পেনের প্লেয়াররাও ডাচদের গোল হলে হাততালি দিয়ে উঠবে।
অথচ শুরুটা হল কত ভালভাবে। ডিয়েগো কস্টার আদায় করা পেনাল্টি থেকে আলোনসোর গোল। কিন্তু ভ্যান পার্সির সেই অসাধারণ গোলটাই পাল্টে দিল সবকিছু। আর ব্রাজিলিয়ান দর্শকরা দেখলাম চরম ক্ষিপ্ত ডিয়েগো কস্টার উপর। বল পায়ে গেলেই পুরো স্টেডিয়াম বু করে উঠে। ব্রাজিলের মত এরকম একটা ফুটবল পাগল দেশকে অস্বীকার করে যে অন্য দেশকে, সেটা স্পেন হোক আর যাই হোক, খেলার জন্য বেছে নিতে পারে, সে মোটামুটি একটা প্রথম লেভেলের দেশদ্রোহী। ব্রাজিলের মাটিতে খেলতে আসা যে তার জন্য একটা অত্যন্ত দুঃসাহসের কাজ, সেটাতে সন্দেহ নাই।
খেলা শেষ হওয়ার একটু আগেই বের হয়ে আসলাম। ৫০০০০ দর্শকের চাহিদা মেটানোর জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন থাকবে কি না সেটা নিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু একটু পরেই ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। যা ভাড়া চাইল সেটা শুনে মনে হল এরা মিটারের বাইরে ভাড়া চেয়ে অভ্যস্ত না। মিটারের থেকে ৩০ হেআইস (Reais) বেশি চাইল। বাংলাদেশ হলে কত চাইত ভাবতে চাই না।
অনেক বছর অপেক্ষা করার পর জীবনের প্রথম ওয়ার্ল্ডকাপ ম্যাচটা এভাবেই শেষ হল। স্পেন জিতলে ভাল লাগত সন্দেহ নাই। তবে ডাচরাও আমার খুব পছন্দের একটা টিম। আসলে ব্যাপারটা হল ক্লাব ফুটবল নিয়মিত দেখলে একটা দেশকে সাপোর্ট করা খুব কঠিন, যদি না সেটা নিজের দেশ হয়। পছন্দের ফুটবলাররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে বিভিন্ন দেশে। এছাড়া অনেক বছর তো হল। দেখা যাক ২০১৪ সালটা অবশেষে ওরানিয়া (Oranje)-দের বছর হয় কি না।
পরের দিন অনেক ভোরবেলায় ফ্লাইট। রিও ভ্রমণের দ্বিতীয় পর্ব। এর গল্প হবে আরেক পোস্টে-মারাকানায় মেসি (আজকের খেলার পর পোস্টের নাম বদলাতে হতে পারে-মরকান্নায় মেসি)।
মন্তব্য
খেলার বাইরে বিস্তারিত জানার ইচ্ছা থাকলো।
পাঁচতারা।
...........................
Every Picture Tells a Story
অবশ্যই হবে মুস্তাফিজ ভাই।
আর কয়েকটা দিন থাকলে আধুনিক যুগের অষ্টমাশ্চর্য পুটুন্দা আর সাড়ে অষ্টমাশ্চর্য উটুন্দার সঙ্গে মোলাকাত করে জীবনটাকে দহন দানে পুণ্য করতে পারতি।
উনাদের দেবালয়ের প্রদীপ হওয়ার এত সুখ সইত না। তাই আগে আগেই আমার এই দেহখানি তুলে ধরে ফেরত নিয়ে আসছি
ধন্যবাদ
আরে! দুর্দান্ত লেখা।
হিংসা হইতেছে, আপনি ভ্যান পার্সির সেই অসাধারণ গোলটা নিজের চোখে দেখসেন, একদম সামনা সামনি। আমার হিসাবে, ওইটা এই বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা গোল- ইনফ্যাক্ট বেস্ট হইলেও অবাক হবো না (অবশ্য হামেস রড্রিগেজের গোলটাও বেশ ভালো, আর মেসির গোল দুইটাও)।
ব্রাজিল সম্পর্কে দ্রুত আরো কিছু জ্ঞান দান করুন। খুব ইচ্ছা ছিলো ব্রাজিলে খেলা দেখতে যাওয়ার... আফসোস, টাকায় কুলাইলো না। তাই আর চেষ্টাও করি নাই টিকেটের। শুনতেছি ২০২২-এ কাতার থেকে সরে গেলে মারিকাতে আসতে পারে আবার- তখন দেখতে হবে আর কী।
পরের পর্বের অপেক্ষায়, নাজির।
অলমিতি বিস্তারেণ
ধন্যবাদ
বসনিয়ার বিপক্ষে মেসির গোল দেখার সৌভাগ্যটাও হয়েছিল। সেই গল্প আর একই সংগে ব্রাজিলের আরও কিছু টুকরো টুকরো ছবি দেখানোর আশা রাখি। ব্রাজিল যাওয়াতে খরচ অনেক সন্দেহ নাই। তবে অনেক আগে থেকে যদি প্ল্যান করা যায়, তাহলে মোটামুটি সহনশীল মাত্রায় খরচটা নামিয়া আনা সম্ভব।
লেখা, ছবি, সমস্তই চমৎকার লাগল।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ
কপাল আপনের। আপনের কপালের সাথে কপাল ঘষার শখ
রোযা রমজানের মাসে এরম ঘষঘষির প্রস্তাব দিলেন !
..................................................................
#Banshibir.
শুগারলোফ পাহড়ের নাম বদলে শুগারলোভ রাখ উচিত, এমন লোভনীয়, দৃষ্টিনন্দন জায়গা!
আপনার ছবিগুলোর প্রসংশা না করলে অন্যায় হবে। আপনার সরঞ্জামাদি (Camera Gears) একটু বললে খুশি হতাম। খেলোয়ারদেরও পাকড়াও করেছেন টেলি দিয়ে, আবার চওড়াভাবে পুরো স্টেডিয়ামের ছাদের দিকটাও ধরেছেন -মুগ্ধ!
শুভেচ্ছা
অনেক ধন্যবাদ। ক্যামেরা আর লেন্স ক্যানন। ৫ডি বডি, ৭০-২০০ টেলি আর ১৭-৪০ ওয়াইড।
পরের বিশ্বকাপে যাবার আগ্রহ জাগলো। ছানাপোনা নিয়েই গিয়েছিলে নাকি?
ছানাপোনাদের এখনও বয়স হয়নি ব্রাজিল যাওয়ার, উনারা চাচার বাসায় চিল আউট করেছে
পরেরটাতে গেলেও যেতে পারি, তবে তার পরেরটাতে না মনে হয়।
দুর্দান্ত! ছবি, লেখা সব।
হাহাহা এটা আমার টিভিতে দেখলেই হয় আর আপনি তো ...
আপনার শেষ লেখা দেখলাম গত বিশ্বকাপে! তাও ভাল বিশ্বকাপ নিয়মিত হয়
ধন্যবাদ। বিশ্বকাপ চার বছর পর পর হয়, এটা আমার দোষ ! আমি তো নিয়মিত হতেই চাই
অমিত, লেখার ক্যালেন্ডারটা বিশ্বকাপ অনুযায়ী ফিক্স না করে এই লা লিগা, ইংলিশ প্রিমিয়ার, লীগ ১, সিরি এ -এসবের কোন একটা অনুযায়ী ফিক্স করলে ভালো হয় না!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ঐ সময়ে রেলিগেশনে থাকি যে
অসাধারন টু ইন ওয়ান লেখা। শুধু (রিওতে বউ নিয়ে যাবেন না রেখে যাবেন, এই প্রশ্নের কোনও সহজ উত্তর নাই, অনেক যেহেতু আর যদির উপর এটা নির্ভর করবে। যেহেতু আমার বউয়ের এই পোস্ট অথবা পোস্টের এই অংশটুকু পড়ার একটা ছোটখাট সম্ভাবনা আছে, সেহেতু ফর দা রেকর্ড-অবশ্যই নিয়ে যাবেন। যদি বউ না থাকে, তাহলে আগে বিয়ে করবেন না রিও যাবেন, সেটাও একটা আলোচনার দাবি রাখে।) এই অংশটুকু বোধগম্য হল না। খেলা দেখতে যাওয়ার সাথে বউ নেয়া না নেয়ার কি সম্পর্ক বুঝলাম না?
ফাহিমা দিলশাদ
ধন্যবাদ এবং সর্বনাশ
এখানে আসলে একটু বড় ভুল করে ফেলেছি। খেলা দেখা ব্যাপারটা মাথায় রেখে এই লাইনটা লিখিনি, অন্য কিছু হবে হয়ত বরং বলা উচিত ছিল "বর/বউ", কারণ রিওর সৈকত কাউকেই হতাশ করবে না
কি সুন্দর করে লিখেন আপনি! পতাকা নিয়ে মফিজটাই আপনি, নারে ভাইয়া?
ইয়ে, ফল ভক্ষণ করে আর তাহার জুশ পান করে
পরের পর্ব পড়বার আগ্রহ থাকলো।
অনেক ধন্যবাদ। ঠিক এবং ঠিক। আসলে যেটা হয়েছে ঐ চুরাসকারিয়া শব্দটা লেখাতে মনটা "চরম উদাস" হয়ে গেল। বিভিন্ন ধরণের মাংস ভক্ষণের স্মৃতি লোড করতে যেয়ে মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশগুলো একটু হ্যাং হওয়াতে পানীয় পান না করে ভুল করে ভক্ষণ করা শুরু করলাম। ঠিক করে দিয়েছি এখন।
ভাগ্যিস লিখেছেন! প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি সচলে লিখতেন। অনেক বছর আগে আপনার লেখা পড়েই বোধহয় সচলে যাত্রা শুরু করেছিলাম। বিশ্বকাপ শুরুর পর থেকে অপেক্ষা করছিলাম কোন এক প্রত্যক্ষদর্শীর সরাসরি বর্ননা পড়বো। তারেকঅনু মিয়াতো কম্বোডিয়া থাইল্যাণ্ড ঘুরতেছে ব্রাজিল বাদ দিয়ে।
যেটুকু লিখেছেন গোগ্রাসে গিলেছি, তবু আধপেটা হয়েছে মাত্র। বাকী পর্ব লিখে ফেলুন সামনের সপ্তাহের মধ্যেই। আবার পরের বিশ্বকাপের অপেক্ষায় থাইকেন না।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ধন্যবাদ। আমার লেখা পড়ে সচলে যাত্রা শুরু করা আর ফ্রেডের খেলা দেখে ব্রাজিল সাপোর্ট করা একই ব্যাপার
চেষ্টা করছি লেখাটা শেষ করে ফেলার।
নতুন মন্তব্য করুন