যা হয় না তা যে হয় না, তা বুঝতে আবুল মজিদের বার বছর লাগে। এই বুঝাবুঝি শেষ করতে করতে যখন হুঁশ হয়, ততদিনে এলাকার জলা-মাঠ-কচুরিপানা সাফা হয়ে খালি দালান আর কোঠা। ইয়ার-দোস্তরা সেইসব দালান-কোঠার কন্ট্রাকটারি করে বিয়ে-শাদি করে পোলাপানের হ্যাপি বার্থডে করে। আবুল মজিদ সেইসব হ্যাপি বার্থডে তে যায়, মোমবাত্তিতে ফুঁ দেয়, হাসি হাসি মুখে গ্রুপ ফটো তোলে। ভাবিরা বলে, বিয়া করেন না ক্যান? দাম্পত্যে ক্লান্ত কোন কোন ভাবি একটু বেশিই পাশ ঘেঁষে বসে, ফর আ চেঞ্জ। আবুল মজিদের খারাপ লাগে না। ভালই লাগে। ভালই আছে আবুল মজিদ।
ইট-সুড়কি-রডের দেনদরবার করতে করতে বন্ধুবান্ধবেরা নিজেরাই এখন দালানের মালিক। নানান আকাম-কুকাম করে তোলা সেইসব দালানের নিচে ভারি ভারি কলাপসিবল গেট, ভারি ভারি তালা। ইউনিফর্ম পরা দারোয়ান খালি জানতে চায়, কই যাবেন? কার কাছে যাবেন? এমনি সময় আবুল মজিদ ভালই থাকে। খালি এই বালের প্রশ্নই মাথা দেয় পাগলা করে। কই যায় মানুষ? কার কাছে যায়? কেন যায়? সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছে, কয়েকটা বাচ্চা স্কুল-কোচিং সেরে বাসায় ফিরছে, ঘামের গন্ধ, পাশের ছাদের প্যান্ডেল থেকে মুন্নি বদনাম হুয়ি, ঠিক সেই সময় ম্যাডামের সানগ্লাস পরা হাসি হাসি মুখের পোস্টার সাঁটা একটা রিকশা পাশ দিয়ে যায়, আবুল মজিদ আবার ভাল থাকতে থাকে। এই যে ম্যাডাম হাসি হাসি মুখে হাত নাড়ে, বড় ভাল লাগে তার। মনে হয়, সব ঠিক হয়ে যাবে। ম্যাডামের গোলাপি ঠোঁট, গোলাপি গাল আবুল মজিদ কে শান্ত করে। ম্যাডামের পার্টির দিনকাল খারাপ যাচ্ছে, জানে আবুল মজিদ। দোস্তরা এইসব ভাল বোঝে, আগের থেকে হাওয়া বুঝে ঠিক সময়ে পল্টি দিতে পারে। কখন জয়, কখন জিন্দাবাদ, কখন চিরজীবি, আর কখন দীর্ঘজীবি, এইসব ভাল জানে তারা। তাই তারা সুন্দরী বউদের পাশে নিয়ে বড় বড় হোটেলে পোলার বার্থডে করে, দশ পাউণ্ডের কেক কাটে, তুমি মিয়া কি করলা আবুল মজিদ। তুমি কই যাইতে চাও তাই তুমি জাননা। তুমি একটা ফেইলিউর, শালা।
এককালে আবুল মজিদ রিহানা কে বলছিল, সবুজ একটা ফাইন কালার রিহানা, তোমারে সবুজ শাড়ি পরলে খুব ভাল লাগে। এইটুকুই, আর কিছু বলা হয় নাই। পরে রিহানা তার বড় ছেলের নাম রাখে সবুজ। আরেকদিন রিহানা জিগাইছিল, ক্যামন মেয়ে পছন্দ আপনার, মজিদ ভাই? আবুল মজিদ কিছুই বলতে পারেনাই, মাথা নিচু করে হাসছিল। রিহানার বিয়ের দিন আবুল মজিদের বুক ধড়ফর করে, প্রবল ঘাম হতে থাকে, হয়তো ভিডিও লাইটের তীব্র আলোয় চোখও জ্বালা করে, রেজালায় অতিরিক্ত ঝালের কারণেই মনে হয়, চোখে পানিও আসে, বাবুর্চির উপর বিরক্ত হয় আবুল মজিদ। এরপর প্রতি বছর যে সময় রিহানা বাপের বাড়ি আসে, আবুল মজিদ কে দেখা যায় বছরের সেই সময় নতুন শার্ট কিনতে। রিহানা বাপের বাড়ি আসলে তার সাথে দুই-চার কথা হয়, সেই দুই-চার কথা বুকপকেটে রেখে আবুল মজিদ বছর পার করে। ইয়ার- দোস্তরা তখন ব্যস্ত পার্টি অফিস, কমিশনার ইলেকশন নিয়ে। এলাকায় পোস্টার পড়ে, চিকা পড়ে, ভাঙচুর হয়, আর দালান ওঠে। এলাকায় ভোট হয়, কচুরিপানা সাফা হয়, আর দালান ওঠে। এলাকায় খুন হয়, নতুন নতুন সাইবার ক্যাফে হয়, আর দালান ওঠে। এই জমজমাট কর্মযজ্ঞে আবুল মজিদ কে তেমন একটা দেখা যায় না। বন্ধুদের সাথে পার্টি অফিসে গেলেও ম্যাডামের গোলাপি গাল ছাড়া আর কোনকিছু নিয়ে তার তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। তুমি শালা একটা রোমান্টিক। বুক-পেট-পাছা সব তো একই দোস্ত, কয়টা লাগবো তোমার কও। আবুল মজিদ কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না।
তারও পরে, একসময় হ্যাপি বার্থডের মোমবাত্তিতে ফুঁ দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে আবুল মজিদ শেষ পর্যন্ত একটা সিদ্ধান্ত নেয়। কই যাবেন এবং কার কাছে যাবেন – এই আপাত নিরীহ দুই প্রশ্নের মীমাংসার চেষ্টা নেয়। সে ঠিক করে একটা নীল রঙের মশারি কিনবে, সাথে মিলানো বিছানার চাদর। দুইটা গ্লাস, একটা জগ, একটা নতুন টেবিল ঘড়ি। আর তারপর রিহানা। কোন এক কারণে তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় সে ডাকলেই রিহানা তার বার বছরের সংসার ফেলে তার কাছে চলে আসবে। সে রাতে ঘুম ভাল হয় আবুল মজিদের। পরদিন ফজরের ওয়াক্তে ঘুম ভাঙে বিরাট কান্নাকাটির আওয়াজে। রিহানার মৃত্যুসংবাদ এলাকায় এসে পৌঁছায়। হত্যা না আত্মহত্যা সেসব পুলিশ জানে, বা জানে না, বা কারো কিছু যায় আসে না। স্বামী হয়তো গায়ে হাত তুলত, বা তুলত না, আমরা তাও জানি না।
শুধু আবুল মজিদের বড় কষ্ট হয়। বুবু ছোটবেলায় এক শালিক দেখলেই বলত, তাকাইস না ভাই, দুঃখ হবে। আবুল মজিদ দুঃখ কে বড় ভয় পেয়েছে সারাজীবন। সে তাই শালিক পাখি দেখলেই চোখ সরিয়ে নিত, নিত রিহানা কে দেখলেও।
মন্তব্য
আহ, চমৎকার!!
চমৎকার লিখেছেন।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
চমৎকার ! দুইবার পড়লাম।
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
থ্যাংক ইউ
আহা, ফাঁকিবাজের তালিকাটা যে কতো কার্যকরী হৈছে, নামধাম ম্যাট্রিক ইন্টারের প্রাপ্ত নম্বর সহ ছেপে যাওয়ার ভয়ে লোকজন ফড়ফড়িয়ে লেখা শুরু করেছে
আপনি লুক খ্রাপ
ইস, রিহানার বদলে যদি গোলাপি ম্যাডামদের নিয়া একটু ভাবতো আবুল চাচ্চু, কি চমেৎকার হইতো!
মাত্র পাঁচ তারা দিয়ে এ লেখার মূল্যায়ন সম্ভব নয়। শুরু থেকে শেষ অবধি প্রতি লাইনে একটি করে তারা দিয়ে আপ্নার এ অসামান্য লেখা অলংকৃত করলাম।
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
অনেকদিন পরে ভয়ে ভয়ে লেখা দিলাম। আপনাকে ধন্যবাদ
মাসে অন্তত দুইটা করে লেখা দেবেন। নইলে ভাল হবে না বলে দিলাম! ( এটি অনুরোধ নয়; হুমকি)
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
অনেক অনেক দিন পরে আপনার লেখা পেলাম আনন্দী দি! আপনার সেই সব প্রতিবাদী লেখাগুলো দেখে অবাক হতাম।। ভাবতাম কে ইনি! তারপর এমন ডুব দিলেন কেন? প্রতিবাদী মুখ ডুব দিলে শুন্য লাগে দিদি।
আর ডুব দিয়েন না, মাঝে মাঝে মাথা উচিয়ে জানান দিয়েন, আছেন আপনি।
-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়
ইচ্ছা আছে আবার নিয়মিত লেখার । ভাল থাকবেন আপনি।
চমৎকার লাগলো।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
আহা আনন্দী, কত্তদিন পর|
গল্পটা একদম মাখন হয়েছে| খুব আরাম পেলাম পড়ে|
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
দময়ন্তীদি, এবার আপনার একটা গল্প পড়তে চাই
আপনি তো ভাল লিখেন - নতুন করে কী আর বলব।
লেখার ধরনের কথা বলতে গেলে - অনেকগুলো কমা গুঁজে ছোট ছোট কথায় চমৎকার ছবি এঁকেছেন। রিহানার দিক থেকে আরো দুটো লাইন আসলে মন্দ হত না। আমরাও জানতাম আড়চোখা আবুল মজিদকে রিহানার কেমন লাগত।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
রিহানা কি ভাবে সেটা পাঠকের উপর ছেড়ে দিতে চেয়েছি :)। ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
বাহ, চমৎকার। আপনার লেখা রোজ চাই। অনেক দিন স্কুলে আসেননি, লিস্টিতে নাম উঠেছে, বাড়তি হোমওয়ার্ক।
সচলায়তনে এসেও হোমওয়ার্ক করতে হইলে ক্যাম্নে কি
ধন্যবাদ
বাহ। দুয়েক জায়গায় ভাষাজনিত সামান্য খটকা ছাড়া সব মিলায়ে দারুণ লাগলো গল্পটা। ভুলও হতে পারে আমার। তবে গল্পের নামটা বাংলায় হতে পারত তো।
অফটপিক: দাজ্জালের রিভিউ কবে দিচ্ছেন?
হুম, ভাষা নিয়ে কিছুটা খটকা নিজেরো আছে। আর নামটা নিয়ে কিছু বলেন না, নামটা খুব শখ করে দিছি
অট : দ্বীনের পথে এসে নেই আগে, তারপর তো রিভিউ
facebook
দারুণ!
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
দারুণ!
এইরকম লেখা আমি কখনো লিখতে পারি না।
লিখতে গেলে যতোসব পুতুপুতু টাইপ লেখা বের হয়।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
কান বন্ধ করে লিখবেন ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
খুব ভালো লেগেছে আপু। নিয়মিত হৈয়েন..........
_____________________
Give Her Freedom!
ভাললাগা জানিয়ে গেলাম।
অনেক ধন্যবাদ
চমৎকার লেখা।
খুবই ভালো লেগেছে। গল্প পড়তে খুব ভালো লাগে, লিখতেও চাই, কিন্তু শেষে এসে তালগোল পাকিয়ে ফেলি। কতো অল্প দৈর্ঘ্যে কত সুন্দর করে গল্পটা শেষ করলেন আপনি। ঈর্ষণীয় গুণ।
অনেক ধন্যবাদ দীপ্ত আপনাকে। সাহস করে লিখে ফেলুন
চমৎকার।
অনেক ধন্যবাদ নৈষাদদা
আপনি লিখতেন বোধহয় আমি সচলায়তন পড়া শুরুর অনেক আগে। মানে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে। আপনি কী জানেন যে যারা এমন একটি লিখা লিখতে পারেন তাঁরা আর নিজের থাকেন না; জনগনের হয়ে যান? কাজেই আপনার ডুব দেয়াটা আমাদের জন্য বড়ই খারাপ ছিল। আর সেদিকে যাবেন না আশা করি। ভাল থাকুন।
হায় হায় এগুলা কি বলেন
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে পড়বার জন্য
ভালো লাগলো পড়ে......
আরো লিখবেন, নিয়মিত।
চমৎকার ।
গল্পটা পড়ে আপনার আগের লেখাগুলোও খুঁজে পড়ে ফেললাম । আপনি এত অসাধারণ লেখেন কি করে ?
ফাটাফাটি!
নতুন মন্তব্য করুন