মহাপ্রতিভাবান এক পাদ্রীর গল্প শুরু করেছিলাম। দেড়শো বছর আগে তিনিই প্রথম মানুষের আর অন্য সব প্রাণির নীতিমালার কথা বলেন। অনেকগুলো ব্যপার ব্যাখ্যা করব বলে এই লেখা শুরু করেছিলাম। বিষয়গুলোর একটা সূচিপত্র দিয়ে নিলে আমারই লিখতে সুবিধা হয়। তাই প্রথমেই সূচিপত্র:
পাদ্রী কি বলেছিল সেই কথা অনেকটুকু বলে ফেলেছি। এখন বাকিটুকু বলি। আগের লেখা যেখানে শেষ করেছিলাম পাদ্রীর প্রদত্ত প্রথম নীতি'টি বলে। সেখানে কিছু প্রশ্নও রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রশ্নগুলোর জবাব পাদ্রী প্রদত্ত বাকি নীতিগুলোর কথা বলে নিয়ে তারপর দেয়াই শ্রেয় বলে মনে হচ্ছে।
পাদ্রীর প্রথম নীতিটি ছিল "দমন নীতি"। আর পরের নীতিটির নাম "বিরহ নীতি" । বিরহ নীতি মানে দুরে সরে যাওয়ার নীতি The Principle of Segregation. এই নীতিতে পাদ্রী বললেন, "মিশ্রিত প্রজন্মের একটা বৈশিষ্ঠের জন্য যে দুটি করে ভিন্ন নীতি থাকে, সেগুলো গ্যামেট তৈরির সময় পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে যায়।" (“In a heterozygote, two different alleles segregate from each other during the formation of gametes.”)
জানেনই তো বুঝায়ে বলব, এতো চ্যাতেন ক্যা । আগে বুঝেন গ্যামেট কাকে বলে। খায় না মাথায় দেয়! গ্যামেট আসলে খাওয়াও যায় মাথায়ও দেয়া যায়। তবে এটা কেবল মুরগীর গ্যামেটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য । মুরগীর গ্যামেট কে বাংলায় "মুরগীর ডিম" বলে। মানুষের গ্যামেটকে বাংলায় বলে মানুষের ডিম্বানু (স্ত্রী) এবং শুক্রানু (পুরুষ)। এখনো কি গ্যামেটের সংগা দিতে হবে! সংগা তো পরীক্ষা দেয়ার দুই মিনিটের মাথায় মুরগীর গ্যামেটের মতো খেয়ে ফেলছি । যাকগা, প্যাঁচাল বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি। তো পাদ্রী তার 'বিরহ নীতি'তে যা বোঝাতে চাইলেন সেটি হচ্ছে, সেই যে একটা বৈশিষ্ঠের জন্য একটা ফাইলে দুটি করে ভিন্ন নীতি থাকে, সেগুলো বাচ্চা দেয়ার জন্য জনন কোষ তৈরির সময় পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে যায়। মটরশুটির কথাই ধরুন, তার প্রথম প্রজন্মের "রং" বৈশিষ্ঠটির জন্য ছিল দুটি নীতি। একটাতে লেখা, "রং হইবে সবুজ" আর আরেকটাতে লেখা, "রং হইবে হলুদ"। এই 'প্রজন্ম ১' যখন বাচ্চা দেয়ার জন্য জনন কোষ তৈরি করবে তখন সেই জনন কোষে কেবল একটি নীতি থাকবে। যে কোন একটি। হয় সবুজ রঙের নীতি নাহলে হলুদ রঙের নীতি। (ভুইলেন না, গ্যামেটে একটা বৈশিষ্টের জন্য একটা নীতি )
আমার জ্ঞান দেয়া স্বভাব আছে। আমাকে নিয়ে সুকুমার রায় একটি ছড়া লিখেছিলেন সেটি থেকে কয়েকটি লাইন আগে শুনেন,
"ও শ্যামাদাস ! আয়ত দেখি, ব'স তো দেখি, এখেনে,
সেই কথাটা বুঝিয়ে দেব পাঁচ মিনিটে, দেখেনে।
জ্বর হয়েছে ? মিথ্যে কথা ! ওসব তোদের চালাকি-
এই যে বাবা চেঁচাচ্ছিলে, শুনতে পাইনি ? কালা কি ?
মামার ব্যামো ? বদ্যি ডাকবি ? ডাকিস না হয় বিকেলে ;
না হয় আমি বাৎলে দেব বাঁচবে মামা কি খেলে।
আজকে তোকে সেই কথাটা বোঝাবই বোঝাব-
না বুঝবি ত মগজে তোর গজাল মেরে গোঁজাব।
..."
(এই ছড়াটার নাম "বুঝিয়ে বলা"। ও হ্যাঁ, এই ছড়াটা আপনাকে নিয়েও লেখা, এখানে গুরু আপনাকে আদর করে শ্যামাদাস বলেছেন। )
পাদ্রীর আরেকটি নীতি বলেই কঠিক কথা বলা থামাবো। এই নীতির নাম স্বাধীনতার নীতি (The principle of independent assortment)। এই নীতিতে পাদ্রী বললেন, " একই বৈশিষ্ঠের ভিন্ন নীতিগুলো পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে স্বাধীনভাবে সংযোজিত হয়" । এইটার মানে বোঝা খুব সহজ। আগের নীতিতে বলা হয়েছিল যে "নীতিগুলো আলাদা হয়ে যায়" আর এই নীতিতে বলা হল তারা পরবর্তী প্রজন্মে স্বাধীনভাবে সংযোজিত হয়। কেমনে কি, এইবার আরেকবার প্রথম থেকে আসি।
ধরেন যে নীতি মেনে মটরশুঁটির রং সবুজ হয় তার নাম " সবুজ রংবাজি নীতি"। হিসাব নিকাশের সুবিধার জন্য আমরা সংক্ষেপে বলব "G"। আর যে নীতির জন্য মটরশুঁটির রং হয় হলুদ তার নাম "হলুদ রংবাজি নীতি" আমরা বলব "g"। বলেছিলাম যে, একটা বৈশিষ্ঠ প্রকাশের জন্যেই যে নীতি তা সবসময় জোড়ায় জোড়ায় থাকে। তা একই হোক অথবা ভিন্ন হোক। আবার বলেছিলাম যে, মাতৃপ্রজন্মে কোন একটি বৈশিষ্ঠের জন্য যে দুইটা নীতি থাকে তা সবসময় একই। অর্থাৎ মটরশুঁটির মাতৃপ্রজন্মে রংয়ের বৈশিষ্ঠের জন্য থাকে একই সঙ্গে দুইটা "সবুজ রংবাজি নীতি" (GG) অথবা একই সঙ্গে দুইটা "হলুদ রংবাজি নীতি" (gg)।
এইবার মাতৃপ্রজন্মের একটা সবুজ আর একটা হলুদ মটরশুঁটির সংকর করলে কি হবে?
GG X gg = ?
বাচ্চা দেয়ার জন্য লাগবে গ্যামেট। মানে জনন কোষ। পাদ্রী তার দ্বিতীয় নীতিতে বলেছিল, গ্যামেট তৈরির সময় নীতিগুলো আলাদা হয়ে যায়। তারমানে, একেটা নীতির জন্য দুই রকমের গ্যামেট হতে পারে, সবুজ রংয়ের ক্ষেত্রে দুইটা G এবং হলুদ রংয়ের ক্ষেত্রে দুইটা g
G এবং G X g এবং g = ?
এখন? আবার পাদ্রীর পয়ে ধরা। পাদ্রী তার তৃতীয় নীতিতে বলেছিল, আলাদা হয়ে যাওয়া নীতিগুলো স্বাধীনভাবে সংযোজিত হয়। (সংযোজিত না হলে তো আর পরবর্তী প্রজন্ম হয়না )। পাদ্রীর এই নীতি অনুসারে মাতৃপ্রজন্মের দুইটা ভিন্ন রংয়ের মটরশুঁটি সংকর করলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পাওয়া যাবে যে নীতির ফাইল সেখানে থাকবে চার ধরনের মিশ্রন, Gg, Gg, Gg এবং Gg। সবগুলা একই । প্রশ্ন হচ্ছে পাদ্রী এই পরীক্ষা করার পর পরবর্তী প্রজন্মের সবগুলার রং সবুজ হল কেন! এইখানে তো সবুজ হলুদ দুইটা রংয়ের জন্যই নীতি আছে। এই প্রশ্নের জবাব দিছেন পাদ্রী তার প্রথম নীতিতে। দমন নীতি। দুইটা নীতি এক সঙ্গে থাকলে একটা আরেকটারে চাপা দিতে পারে। রংয়ের ক্ষেত্রে প্রকাশিত হয় একটা রং। মটরশুঁটির ক্ষেত্রে সবুজ রংয়ের ক্ষমতা বেশি তাই সবুজ রং প্রকাশিত হয়। মনে রাখবেন, হলুদ রং প্রকাশিত না হলেও রংয়ের নীতি কিন্তু নষ্ট হয়ে যায়না। সে সুস্থ হালেই থাকে।
এবার দেখুন এই ছবি:
প্রজন্ম ১ এর কাহিনী তো হল। কিন্তু পাদ্রী তো এখানেই থামেনাই। বরং এরপর দুটি 'প্রজন্ম ১' মটারশুঁটির সংকর করে সে দেখেছিল চারটার মধ্যে একটার রং হলুদ আর বাকি তিনটা সবুজ।
একটা পুরোনো ছবি দেখেন:
কেমনে? এই জবাবটাও পাওয়া যাবে পাদ্রী প্রদত্ত নীতি মেনে হিসেব করলে। কেবল সবুজ রং দেখাগেলেও আসলে প্রজন্ম ১ এর সবারই রংয়ের জন্য আছে দুইটা নীতি, একটা সবুজের জন্য আরেকটা হলুদের জন্য (Gg)।
'প্রজন্ম ১' X 'প্রজন্ম ১' = Gg X Gg = ?
পাদ্রীর নীতি অনুযায়ী রংয়ের নীতিগুলো আলাদা হয়ে এবার গ্যামেট গঠন করবে এবং স্বাধীনভাবে সংযোজিত হবে পরস্পরের সঙ্গে।
Gg X Gg = G ও g X G ও g = GG, Gg, Gg এবং gg
দুইটা সবুজের নীতি একসঙ্গে থাকলে রং তো সবুজ হবেই। একটা সবুজ আর একটা হলুদের নীতি থাকলেও রং হবে সবুজ, কারণ সবুজের নীতির ক্ষমতা বেশি। হলুদ রং হবে তখন যখন হলুদের সঙ্গে কোন সবুজ নীতি থাকবে না।
ছবি দেখুন:
সব মিলিয়ে পাদ্রীর দেয়া নীতি এ-ই। এগুলোর কথা তিনি প্রথম বলেন ১৮৬৫ সালে স্থানীয় ন্যাচারাল হিস্টরি সোসাইটিতে। পরের বছর সেই সোসাইটিরই জার্নালে তা প্রকাশিতও হয়। কিন্তু সেসময় এইসব কথা বোঝার মতো ঘিলুওয়ালা লোক হয়তো ছিলনা। তাই তিনি অথবা তাঁর কাজ কোনটাই বিশেষ পাত্তা পায়নি।
পাদ্রী এই সব নীতির কথা বলেছিলেন মটরশুঁটির উপর গবেষনা করে। এরপর তিনি মৌমাছির প্রজনন নিয়েও গবেষনা করেন। সব মিলিয়ে তার গবেষনার সময় ছিল কমবেশি দশ বছর। এই সময় তাঁর গবেষনার পরিধি দুটোই হয়তো বাড়তে পারতো। কিন্তু ধর্মের আগে বিজ্ঞান কখনোই স্থান পায়নি। অন্তত সেই সময়ে নয়। তাই গবেষনায় ইস্তফা দিয়ে পাদ্রীকে ব্যস্ত হয়ে যেতে হয় চার্চের কাজে। ১৮৮৪ সালের ৬ই জানুয়ারি ৬১ বছর বয়সে মারা যান এই মহাপ্রতিভা। চার্চের উপর ট্যাক্স বসানো সংক্রান্ত যে বিতর্কে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন মৃত্যুর আগে, সেই বিতর্কের জের হিসেবে পুড়িয়ে ফেলা হয় তার সমস্ত কাগজপত্র। ধর্মের কাছে দৃশ্যতঃ আবারো হেরে যায় বিজ্ঞান।
১৯০০ সালের (সঠিক সময়টি নিশ্চিত হতে পারছিনা ) পর আলাদা আলাদা ভাবে তিনজন বিজ্ঞানী আবারো পাদ্রীর নীতিগুলোকে আবিষ্কার করেন। সেসময় আবার ইতিহাস হাতড়ে বের করা হয় 'কি বলেছিলেন মেন্ডেল'। কাজের স্বীকৃতি পাদ্রীকে সেসময়েই দেয়া হয়। শ্রদ্ধাভরে জীববিজ্ঞানের আধুনিকতম শাখা জেনেটিক্সের (Genetics) জনক হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয় তাঁকে।
তবে পাদ্রীর নীতি কিন্তু ধ্রুব সত্য নয়। ব্যতিক্রমও আছে। যেমন কখনো কখনো সাদা আর লাল রঙের সংকর হলে প্রকাশিত হয় গোলাপি রং। কখনো লাল চুল আর কালো চুলের সংকর হলে পরবর্তী প্রজন্মের চুল হয় দু'রকমের, লাল এবং কালো। (এটি কেবল সহজে বোঝানোর জন্য একটি অবাস্তব উদাহরণ। আর কোন উদাহরণ মনে আসতেছে না )
[পাদ্রীর দেয়া নীতি কিন্তু মূলতঃ মানুষের বা প্রাণিদের নীতিমালা নয়। পাদ্রীর নীতিমালা আসলে নীতিমালা সম্পর্কিত নীতিমালা । পাদ্রীর নীতিমালায় বলা হয় "মানুষের নীতিমালার আচরণ" কেমন হবে :)। আর মানুষের নীতিমালায় বলা হয় "মানুষের আচরণ" কেমন হবে । মানুষের নীতিমালা নিয়ে কথা বলার আগে তাই পাদ্রীর দেয়া নীতিমালা জানা জরুরি ছিল।
...
অর্থাৎ কিনা, এই মনে কর রোদ পড়েছে ঘাসেতে,
এই মনে কর, চাঁদের আলো পড়লো তারি পাশেতে-
আবার দেখ ! এরই মধ্যে হাই তোলবার মানে কি ?
আকাশপানে তাকাস খালি, যাচ্ছে কথা কানে কি ?
কি বল্লি তুই ? এসব শুধু আবোল তাবোল বকুনি ?
বুঝতে হলে মগজ লাগে, ব'লেছিলাম তখুনি।
মগজভরা গোবর তোদের হচ্ছে ঘুঁটে শুকিয়ে,
যায় কি দেওয়া কোন কথা তার ভিতরে ঢুকিয়ে ?-
ও শ্যামাদাস ! উঠলি কেন ? কেবল যে চাস পালাতে !
না শুনবি ত মিথ্যে সবাই আসিস কেন জ্বালাতে ?
তত্ত্বকথা যায় না কানে যতই মরি চেচিঁয়ে-
ইচ্ছে করে ডানপিটেদের কান ম'লে দি পেঁচিয়ে।
সূচিপত্র শেষ করতে ইচ্ছা করে। মানুষের নীতিমালা নিয়েও লিখতে ইচ্ছা করে... !
মন্তব্য
"বলছি দাঁড়া, ব্যস্ত কেন? বোস্ তাহলে নিচুতেই-
আজকালের এই ছোকরাগুলোর তর্ সয়না কিছুতেই।"
তত্ত্বকথা ঢুকবে কানে সহজ ভাষার গুণেতেই।
চলছে যেমন চলুক তেমন সূচিপত্রের ক্রমেতেই
-------------------------------------------------------------
জানতে হলে পথেই এসো, গৃহী হয়ে কে কবে কি পেয়েছে বলো....
-----------------------------------------------------------------------------------------------------
" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি
আমার লেখা শিশি-বোতল খায়না মরার ছাগলেও
নামটা দেখেই দৌড়ের উপর জান বাঁচাতে পাগলেও
এই দেখে শেষ ভাবতেছিলাম লিখতে যাওয়াই পাগলামি
নিজের লেখার নিজেই পাঠক একলা একা এই আমি
হঠাৎ দেখি হা-রেরেরে তেড়ে মেড়ে আসছে তো
কঠিন নামের দারুন মেয়ে যত্ন করে পড়ছে তো !
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
নতুন মন্তব্য করুন