আমাদের মফস্বলে ওই একটিই বাঁধাই ঘর ছিল।
বাঁধাইকর ছিল কালো একটা লোক। শুকনো, অথচ কেমন খানিকটা তেলতেলে লোকটা মোটা ফ্রেমের চশমা পরে সারাদিন মুখ গুঁজে বই সেলাই করে চলত! লোকটার সরু লম্বা আঙুল দেখে সেগুলোকে মায়াবী ভাবার কিছু ছিলনা! কিন্তু কীরকম মায়া করে লোকটা বইয়ের পুরনো মড়মড়ে পাতাও নরম মাংসের মতো সেলাই করে ফেলত! বই যেন না, পুরনো কাপড়! বইগুলোও যেন গলে পড়ে যেত লোকটার হাতে! সুলতা বৌদি আমার চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কাটলে যেমন আমার অদ্ভুত আদর লাগত, সেরকম। অথবা সেইবার যখন আমি আর তনি ওদের পোড়ো ভিটের শুকনো ডোবায় পালিয়েছিলাম! তনি কেবল আমার হাত জাপটে ধরে আমার গায়ে হেলান দিয়ে পড়ে ছিল! আর আমি ওকে যতই ধাক্কাই উঠতে চাচ্ছিলোনা, সেরকম!
আমি দেখেছি, অনেক আদর না হলে বইয়ের পাতা সেলাই করা যায় না! পুরনো বইয়ের পাতাগুলো খানিকটা লালচে আর শক্ত হয়ে ওঠে! একটা পাতা পড়ে যে ভাঁজ করে চিহ্ন রাখবে, তার উপায় নেই! ভাঁজ করলে সে ওখানেই বোবা পাঁপড়ের মতো ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাবে!
আমার বইগুলো অবশ্য আমি পুরনো হতে দিতাম না। ফি সপ্তাহে ঝেড়ে মুছে তাকে তুলে রাখতাম। বই বলতে আমার ছিল ওই তনির দেয়া বইগুলোই। তনি বলত, "একটা বই হচ্ছে একটা গল্প, বুঝলি? আমার দেয়া গল্পগুলো হারাসনা!" আমি বলতাম, "একটা বই একটা গল্প কীরে! কত বইয়ে তো অনেকগুলো গল্প থাকে!" তনি বলত, "ধুর বোকা! একটা বই একটাই গল্প! একটা গল্পে অনেকগুলো পাখি থাকে!" আমি হাসতাম, তনিটা বড্ড অদ্ভুত কথা বলত।
বড় রাস্তায় যেখানে আমাদের স্কুলের রাস্তাটা এসে মিশেছে সেই মোড়ে ছিল আমাদের বাঁধাইঘর। স্কুলে যেতে আসতে ঠিক ওই মোড় থেকে আমাকে দৌড়ে গিয়ে চলতি ভ্যানে উঠতে হতো। ভ্যানের জন্যে স্কুলের পর অনেক্ষণ ওখানে দাঁড়ানো হতো প্রায়ই! যাওয়া আসার পথে দেখতাম কী নিবিষ্ট হয়ে বাঁধাইকর লোকটা সেলাই করতো পুরোনো বই! ধ্যান করছে যেন! দিস্তে কাগজ সেলাই করে আমি খাতা বানাতে পারতাম! কিন্তু বই সেলাইয়ের অন্য ধরন! সে অনেক্ষণ চেয়ে থাকলেও শিখে ওঠা যেতো না! বইয়ের থাকতো থাক থাক ছোট ছোট ভাগ! সেগুলো সব আলাদা সেলাই হতো। কিন্তু শেষে আবার সেগুলো জুড়েই শরীর পেত আস্ত বইটা। তার উপর শক্ত মলাট লাগাতে হত! মলাটের নিচে থাকত লাল রঙা পাতলা কাপড়!
ভারী ভারী পুরনো বই সেলাই করে করে বাঁধাইকর থান ইট চাপা দিয়ে মৃদু রোদে শুকোতো। একেবারে সব ঠিকঠাক হয়ে গেলে শেষবেলায় পুরনো শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে ঘষে সমান করে দিত বইয়ের ধারগুলো।
আমার খুব শখ হত, বাড়ির সব পুরনো বই নিয়ে বাঁধাইকরের কাছে দিই। আর ঝামা ইট দিয়ে ঘষা লোহার পাতিলের মতো নতুন চকচকে করে নিয়ে আসি। কিন্তু মা যেভাবে আগলে রাখতো বাড়ির সব বই, সাহস পেতাম না বাইরে নেয়ার! মাও বোধহয় আমার কাছে বইগুলো দেয়ার সাহস পেতেন না! মনে মনে ভাবতাম, তনির দেয়া বইগুলো পুরনো হলে ঠিক যাবো। সারাদিন বসে থেকে সব বই নতুন করে নিয়ে আসব। অদ্ভুত কতকিছুই না ভাবতাম সে সময়! সময় যে এমন বদলাতে পারে, মনেই হতো না!
মফস্বলের বাঁধাইঘরটা উঠে গিয়েছিল ক'বছর পর! কোথায় গিয়েছিল কে জানে! বাঁধাইকর হয়তো পেশা বদলেছিল। নতুন কাজ না শিখলে সেই বাজারে খেতে পাওয়ার কথা না বেচারার!
আর আজকাল তো বই বাঁধাইয়ের চলটাই উঠে গেছে। পুরনো রদ্দি বই ফেলে দিয়ে লোকে এখন ঝটপট নতুন বই কিনে ফেলে। আমার কেবল মাঝে মাঝে বাঁধাইকর লোকটার কথা মনে হয়। মায়া লাগে। আহারে লোকটা! কীভাবে বেঁচেছিল সে? নতুন কোনো কাজ কি সে শিখে উঠতে পেরেছিল?
মন্তব্য
মন খারাপের পদ্য...
ডাকঘর | ছবিঘর
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ছোট বেলায় একবার বই বাঁধাইয়ের দোকানে গিয়ে আমার বই বাঁধাইয়ের নেশায় পেয়ে বসে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ভাল খারাপ সব বই বাঁধাই করতাম, খারাপ হত না
'গল্প' ট্যাগে লেখাটা 'গল্প' হিসেবে ঠিক জমল না মনে হয়। স্মৃতিচারণ বা এ ধরণের হলে কি বেশী মানাত?
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
এটা গল্পই
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
সেই পাকিস্থান আমলে নীলক্ষেতের এক বাঁধাইরের কথা মনে পড়ে গেল। দাড়িওয়ালা ছোটখাট মানুষটি। বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জে। আমি থাকতাম মহসিন হলে। পুরনো বইয়ের দোকান থেকে এন্তার বই কিনতাম, আর তিনি যত্ন করে বাঁধিয়ে দিতেন - এক্কেবারে নিয়ম করে।
এতদিনে তিনি এখন কোথায়, কতদূরে?
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
তনি'র কী হলো? তনি কি হারিয়ে গেলো তার দেয়া বইগুলোর মতোন?
মানুষ হয়তো পুরাতন বই বাঁধায়ে রাখে তাতে মন/স্মৃতি/সময় আটকে থাকে বলে, কে জানে! অসংখ্য নতুন বইয়ের মাঝেও কেবল সেই বইটাকেই চায়। এটা কি পুরাতন বইয়ের যে আবেদন, নতুন বইয়ের মাঝে তা খুঁজে পায় না বলে!
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
তনি
পুরান বই বাজার থেকে উঠে যাচ্ছে
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
লেখাটা কি অদ্ভুত। শেষ করার পরও কতক্ষণ চুপ থেকে যেতে হয়।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
কতকিছু মনে পড়ে গেল লেখটা পড়ে! বুকের মধ্য হু হু করে উঠল যেন!
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ধন্যবাদ।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
আমার মাথায় একটা গল্প এলো!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
লিখে ফেল
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
গল্পটা তো ঠিকঠাকই এগোচ্ছিল, তাকে হুট করে শেষ করার দরকার পড়ল কেন? শেষের দুই প্যারাগ্রাফের আগে আর পরে আরো কিছু দরকার ছিল।
অটঃ নতুন বা পুরনো বই যদি কেউ বাঁধাই করতে না পারে তাহলে আমার কাছে এনো। আমি বই বাঁধাই করতে পারি। এক কালে ঘরে বই বাঁধানোর মাল-মশলা, যন্ত্রপাতিও থাকতো। এখন ওগুলোর আর দরকার নেই বলে ঘরে নেই।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে!
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
গল্প নয়, গল্পের মলাট মনে হলো
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
আমি গল্প লিখতে সফলভাবে ব্যার্থ
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
বড় মন খারাপের গল্প।
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
নতুন মন্তব্য করুন