এই লেখাটি উদ্দেশ্য চিকিৎসকদের উপর একটি সীমাবদ্ধতার দায় চাপিয়ে দেয়া নয়।
এই লেখাটির উদ্দশ্য একটি সম্ভাব্য সীমাবদ্ধতাকে বিবেচনা করা এবং সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার পথ খোঁজা।
স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অণুজীববিজ্ঞানের যেসব পাঠ্যপুস্তক একেবারেই হাতে ধরা, সেইসব বইগুলোর মূল সংস্করণের একেকটির দাম ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। কখনো আরো বেশি। ক্রেতা নেই বলে এইসব বই স্থানীয় বাজারে সহজলভ্য নয়। টাটা-ম্যাকগ্রহিলের মতো দুয়েকটি প্রকাশনা সংস্থা শুধুমাত্র দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশের জন্য এইসব অতি দামী কিছু কিছু বইয়ের 'সুলভ সংস্করণ' তৈরি করে। কিন্তু সেগুলোও আমাদের দেশের গড়পরতা শিক্ষার্থীদের ক্রয়ক্ষমতার নাগালে আসেনা। তবে, শিক্ষার্থীর অর্থনৈতিক অবস্থা যেমনই হোক, উচ্চপর্যায়ের সব পাঠ্যপুস্তক কিনে ফেলা সম্ভব নয়, আর তার প্রয়োজনও নেই। কারণ উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষার বড় সহায়ক বিশেষায়িত গ্রন্থাগারগুলো, যাদের পক্ষে উঁচুদামে পাঠ্যপুস্তক কিনে শিক্ষার্থীদের জন্য সরবরাহ করা সম্ভব এবং সেটা তাদের দায়িত্বও।
সমস্যা হচ্ছে, আমাদের গ্রন্থাগারগুলোরও উঁচুদরে সকল প্রয়োজনীয় বই কেনার সামর্থ নেই। কোথাও কোথাও সামর্থ থাকলেও সেই সদিচ্ছা অথবা অভ্যাস নেই। বিজ্ঞানের বিশেষ ব্যপার হচ্ছে, সে প্রবহমান। তারমানে বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত সাম্প্রতিক হয়। গতকালকের বিজ্ঞানের চাইতে আজকের বিজ্ঞান আধুনিক বলে, প্রতিনিয়ত বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকের নতুন নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হতে থাকে। অন্তত অণুজীববিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকের ক্ষেত্রে বলতে পারি, এইসব নতুন সংস্করণের প্রকাশনা কেবল ব্যবসায়িক প্রয়োজন নয়, বরং সেসব সত্যিই বিজ্ঞানের সাম্প্রতিকতম তথ্য সম্বলিত। চিকিৎসাবিজ্ঞানের বইগুলোর ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য।
যতটুকু জেনেছি আমাদের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে আধুনিক বিজ্ঞানের বইগুলোর নকল প্রতিলিপি তৈরি করে শিক্ষার্থীদের কাছে সরবরাহ করা হয়। (পাঠ্যপুস্তকের নকল প্রতিলিপি তৈরি প্রথমত বেআইনী, আর তা বিজ্ঞান শিক্ষায় অনেকক্ষেত্রে দূর্বলও, তবে সেই আলোচনা এখানে নয়।) দূর্ভাগ্যজনক হচ্ছে নকল প্রতিলিপির বইগুলোও সকলক্ষেত্রে সাম্প্রতিক নয়। মূল সংস্করণ হোক আর প্রতিলিপি, প্রতিবছর গাদাগাদা সাম্প্রতিক বই নিয়ম মেনে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছায় না। আমাদের গ্রন্থাগারগুলো সেই দায়িত্ব পালন করেনা অথবা করতে পারেনা।
কেবল পাঠ্যপুস্তকেই সমস্যা নয়। আধুনিক বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত নিজেকে উন্নত করে, মানুষের জ্ঞান প্রতিনিয়ত বাড়ে। বিজ্ঞানের সেই সাম্প্রতিক জ্ঞান পাঠ্যপুস্তকের আগে এবং পাঠ্যপুস্তকের চাইতে আরো বিপুলভাবে প্রকাশিত হয় বিজ্ঞান প্রব্ন্ধগুলোতে।
সেইজন্য উচ্চপর্যায়ের শিক্ষার অতি-আবশ্যকীয় উপাদান হচ্ছে বিজ্ঞান প্রবন্ধ। সাম্প্রতিক বিজ্ঞান প্রবন্ধ শিক্ষার্থীদেরকে পড়তে হয় পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি। অনেকক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তকেরও আগে। দুঃখজনক হচ্ছে, যেসব বিজ্ঞান পত্রিকায় সেরা গবেষণার তথ্য প্রকাশিত হয় সেসব পত্রিকার প্রবন্ধ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিনামূল্যে পাঠ অথবা সংগ্রহযোগ্য নয়। পাঠ্যপুস্তকের মতো এই সমস্যাটিরও সমাধান গ্রন্থাগার। বিভিন্ন বিজ্ঞান পত্রিকার এসব প্রব্ন্ধ কিনে শিক্ষার্থীদের কাছে সরবরাহ করা গ্রন্থাগারগুলোর দায়িত্ব। আমাদের দূর্ভাগ্য, এতো এতো বিজ্ঞান পত্রিকার প্রবন্ধ কিনে আমাদের গ্রন্থাগারগুলো শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করেনা। সেজন্য ইচ্ছে থাকলেও সাম্প্রতিক বিজ্ঞানপ্রবন্ধগুলো পড়ে আমরা আমাদের জ্ঞানকে এই সময়ের করে নিতে পারিনা।
২.
বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতই, চিকিৎসার নতুন দ্বার প্রতিদিন উন্মুক্ত হয়। রোগ এবং রোগের কারণ সম্পর্কে তথ্য প্রতিদিন সমৃদ্ধ হতে থাকে। রোগনির্ণয় আর চিকিৎসার নতুন উপায় উদ্ভাবিত হয় নিয়মিত। সেইজন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষা গ্রহন করেন, সে প্রতিনিয়ত সাম্প্রতিক না হলে চিকিৎসকের জ্ঞান দ্রুত পশ্চাৎপদ হয়ে ওঠে। অনেকক্ষেত্রেই সেই পশ্চাৎপদ জ্ঞান হয়ে ওঠে সেবা গ্রহনকারীর জন্য ক্ষতিকর। অথচ, অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো আমাদের মেডিকেল কলেজগুলোতেও সাম্প্রতিকতম পাঠ্যপুস্তক আর বিজ্ঞান প্রবন্ধের যথেষ্ঠ যোগান নেই।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ এবং পরীক্ষার পর দৃশ্যত শেষ হয়ে গেলেও বাস্তবে চিকিৎসকের শিক্ষাজীবন কখনো শেষ হয়না। ১০ বছর আগে যে চিকিৎসক সর্বশেষ পরীক্ষা দিয়ে সনদ নিয়েছেন তিনি যদি সাম্প্রতিক জ্ঞানের সংস্পর্শে না থাকেন তাহলে তার দেয়া সেবা হবে ১০ বছর পুরনো। সেইজন্য চিকিৎসককে পুরোটা কর্মজীবনে প্রতিনিয়ত শিক্ষার সংস্পর্শে থাকতে হয়। যেহেতু একবার ডাক্তারি পাশ করে চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেলে পরবর্তীতে কোনো চিকিৎসককে তার জ্ঞান সাম্প্রতিক কিনা সেই পরীক্ষা দিতে হয়না, সেহেতু সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের জ্ঞান সাম্প্রতিক কিনা সেটাও তাই সার্বিকভাবে জানার কোনো সুযোগ নেই।
একজন চিকিৎসক যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরবর্তী পর্যায়ের পড়াশোনা না করেন, অথবা যদি ব্যক্তিগত পর্যায়ে সাম্প্রতিক জ্ঞানের খোঁজ না রাখেন, তাহলে সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের জ্ঞান সাম্প্রতিক হওয়ার উপায় অতি-অপ্রতুল কিছু সেমিনার এবং বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির সরবরাহ করা ওষুধ-সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত কিছু প্রবন্ধ। এইসব সংখ্যায় নগণ্য আর এসব প্রবন্ধ ওষুধ কোম্পানিগুলো কেবল তাদের নিজস্ব ওষুধের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করে। খুব গবেষণা না করেই বলা যায় এই দুটি উপায়ে একজন চিকিৎসকের সার্বিক জ্ঞান সাম্প্রতিক হয়না।
[আমি ব্যক্তিগত পর্যায়ে একাধিকক্ষেত্রে খুব আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ্য করেছি, কিছুদিন আগে শিক্ষা শেষ করা চিকিৎসকের জ্ঞানও সাম্প্রতিক নয়। অনেক সাম্প্রতিক চিকিৎসার খোঁজ তারা জানতে পারেন নি, অনেক রোগ নির্ণয়ের অধিক কার্যকরী অথবা দ্রুততর পদ্ধতির কথা তারা জানেন না, অনেক ওষুধের নতুন খুঁজে পাওয়া পার্শপ্রতিক্রিয়া অথবা ব্যবহারের কথা তাদের জানা হয়নি। জানার চেষ্টা করেছি, জ্ঞানের পশ্চাৎপদতা কি চিকিৎসকের অবহেলা, নাকি তার পাঠ্য উপকরণের প্রাচীনতা। দেখেছি, প্রাথমিক কারণ দ্বিতীয়টিই। পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান চিকিৎসকেরা ঠিকই আত্মস্থ করেছেন, কেবল তাদের কাছে কেবল সাম্প্রতিকতম পাঠ্যপুস্তকটি পৌঁছায়নি। আমি দেখেছি, আজকের চিকিৎসকরা যে জ্ঞান নিয়ে মানুষের সেবায় যাচ্ছেন তার অনেকটাই ক্ষতিকরভাবে প্রাচীন।]
৩.
আমাদের চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ পশ্চাতপদ জ্ঞানের উপর নির্ভর করে সেবা দেন। দেশের সার্বিক চিকিৎসাব্যবস্থায় এটি কতভাবে কতটা প্রভাব ফেলছ তা গবেষণা করা যেতে পারে। কিন্তু সেই প্রভাব যে দারুণভাবে নেতিবাচক তাতে কোন সন্দেহ নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসক এবং সবমিলিয়ে চিকিৎসাব্যবস্থার এই দূর্বলতা কাটিয়ে ওঠার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে সমস্যাটিকে স্বীকার করা এবং গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা। আমার ব্যক্তিগত ভাবনায় এই সমস্যাগুলো সমাধানে কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে বলে মনে হয়েছে। আমি বিশেষজ্ঞ নই, সমস্যার গভীরতা বিচার করাও ব্যক্তিগতভাবে আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সেইজন্য আমার পদক্ষেপগুলো কেবল আলোচনায় জন্যেই প্রাথমিকভাবে বিবেচ্য হতে পারে।
প্রথমত, সকল পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তক এবং পাঠের উপকরণ যাতে সাম্প্রতিক হয় সেটি নিশ্চিত করা। অর্থনৈতিক কারণে আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে সবসময় সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, উপকরণ ইত্যাদির সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারিনা। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছে জ্ঞান যেন সাম্প্রতিকতম পৌঁছায় সেটি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। আরেকটু গুরুত্ব দিয়ে নিলে এই প্রয়োজনটি শিক্ষা বাজেটের অংশ থেকেই মিটতে পারে বলে আমার মনে হয়।
দ্বিতীয়ত, বিশেষভাবে আমাদের চিকিৎসকরা যেন পেশাদ্বারিত্বের সকল পর্যায়ে সার্বিকভাবে সাম্প্রতিক জ্ঞানের সংস্পর্শে থাকতে পারেন সেটি নিশ্চিত করা দরকার। সকল হাসপাতালে প্রয়োজনীয় বইয়ের একটি সংগ্রহশালা এবং সাম্প্রতিক বিজ্ঞান প্রবন্ধ সংগ্রহের ব্যবস্থা থাকলেই সে অনেকখানি সম্ভব।
তৃতীয়ত, উচ্চশিক্ষার প্রথম স্তর থেকেই শিক্ষার্থীরা যেন সাম্প্রতিক বিজ্ঞান প্রবন্ধ পড়ে জ্ঞান আহরণ করতে অভ্যস্থ হয়ে ওঠেন সেটা নিশ্চিত করা।
চতুর্থত, শিক্ষাজীবনের পরেও অন্তত যতদিন চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত আছেন ততদিন যাতে চিকিৎসকেরা সার্বিকভাবে সাম্প্রতিক জ্ঞান আহরণ করেন তা নিশ্চিত করা। চিকিৎসকেরা পেশাগত জীবনে সাম্প্রতিক জ্ঞানের সংস্পর্শে আছেন কিনা সেটা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে তা নিয়ে আমি বেশ সন্দিহান। নির্দিষ্ট সময় পরপর হয়তো স্থানীয় অথবা জাতীয় পর্যায়ে একটি মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে শিক্ষাজীবনেই যদি চিকিৎসকেরা সামগ্রিকভাবে সাম্প্রতিক জ্ঞান আহরণে এবং সেই জ্ঞানের উপর নির্ভর করে সেবা দিতে অভ্যস্থ হয়ে ওঠেন আর সেইসঙ্গে কর্মক্ষেত্রের সকল পর্যায়র সাম্প্রতিক জ্ঞান তাদের জন্য সহজলভ্য হয়, তাহলে সেই মূল্যায়নের হয়তো কোন প্রয়োজনই হবে না।
[এই লেখাটি বিচ্ছিন্ন কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে উপলক্ষ্য করে লেখা নয়। সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা এবং মন্তব্যের জন্য মন্তব্যের অংশ উন্মুক্ত থাকলো।]
মন্তব্য
সুন্দর টপিক। আসলে মানসিকতার পরিবর্তন হতে কিন্তু পরিবেশ লাগে। নিজের কথাই বলি--আমি আমার এরিয়ার বই কিনতে গেলে আগে দেখি কোন সালে বইটা বেরিয়েছে। ভাবনার এই বিবর্তন কিন্তু দেশের বাইরে এসে পরিস্থিতি থেকে শিখে হয়েছে।
ক্লাসিক বই পুরানা হলে সমস্যা হয়না, কিন্তু সময়ের সাথে বিজ্ঞান/শিক্ষা/জানাশোনায় যত অগ্রগতি হয়েছে, তদুপরি নতুন "জ্ঞান" অর্জনের জন্য বা সে সম্পর্কে জানার জন্য নতুন বইয়ের কোন বিকল্প নেই।
ধন্যবাদ পিপি'দা
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
সুন্দর আলোচনা। যেকোন পেশায় পড়ার বিকল্প নাই। বিশেষত সাম্প্রতিক জ্ঞান আহরণ করা। নতুবা নিজেকে লজ্জায় আর বিপদে পড়তে হবে, অন্যরাও বিপদে পড়বে।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
বহুকাল আগে আমি ঢাবির বাজেট ঘেটেঘুটে দেখেছিলাম। তখন ঢাবির পুরো বাজেট ৮০কোটি টাকার মতো ছিলো। এর মধ্যে লাখ তিনেক টাকা ছিলো গ্রন্থাগারের বই সাময়িকী ইত্যাদি কেনার জন্য। দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট যদি এরকম হয় তাহলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী অবস্থা সেটা বলাই বাহুল্য।
শিক্ষকরা নতুন বিষয়গুলো সাম্প্রতিকীকরণ করেন না দুটো কারণে। প্রথমত তাদের হাতে রিসোর্স নেই, দ্বিতীয়ত তাদের নিজেদের আগ্রহের অভাব। খেটেখুটে নিজেকে প্রতিনিয়ত আপডেট করার প্রবণতা বাঙ্গালি সংস্কৃতির মধ্যে নেই। এই কারণে দেশে রিগোরাস কাজ হয় না। শিক্ষকদের এই স্বভাবের আছর শেষ পর্যন্ত ছাত্রদের উপর গিয়ে ভর করে।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
মনেহচ্ছে বইয়ের বাজেট গবেষণার চাইতে বেশি আছে
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
অথচ, অনার্যদা, অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের চিকিৎসকরা পড়াশুনোটা চলমান রাখেন না। একজন চিকিৎসককে দেখেছি ব্যবসা প্রশাসনের বইতে মুখ গুজে থাকতে। আর একজন চিকিৎসক চোখে পড়েছিল, তিনি কাগজে জমি-জমার হিসেব-নিকেশ করছিলেন, কোথা থেকে কত কম দামে ক্রয় করে পরে কত বেশী দামে বিক্রি করে লাভবান হওয়া যায়, সেই হিসেব-নিকেশ।
অনেক দিন পর আপনার লেখা পড়ে খুব ভাল লাগল, অনার্যদা। আপনি আরো নিয়মিত লিখলে খুশী হব।
(অতিথী)
চিকিৎসার মত গুরুত্বপূর্ণ একটি পেশায় এসে তার নিজের বিষয় ভিত্তিক সাম্প্রতিক জ্ঞানের সংস্পর্শে না থাকাটা খুবই দুঃখজনক। কিন্তু চিকিৎসক হলে ব্যাবসা প্রশাসনে বা জমি-জমার হিসেব নিকেশে আগ্রহ থাকা যাবে না এমন ভাবারও কোন কারণ নেই।
একমত, ভাইয়া। আসলে একশ্রেণীর প্রচন্ড বৈষয়িক চিকিৎসক, যাদের মধ্যে সেবার মনোভাব তেমন দেখতে পাওয়া যায় না, তাদের কথা বলতে চেয়েছি। তবে এমনিতে আমাদের দেশের চিকিৎসকগন অনেক কম সুযোগ-সুবিধার মধ্যেও চেষ্টা করেন রোগীদের সর্বোত্তম চিকিৎসা নিশ্চিত করতে। বাংলাদেশ চিকিৎসাসেবায় অনেকদূর এগিয়েছে, বিশেষত, অনেক এলডিসির জন্য বাংলাদেশের অগ্রগতি একটা অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।
ভাল থাকবেন, ভাইয়া।
(অতিথী)
অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
খুবই গুরুত্বপূর্ণ টপিক এবং একাডেমিয়ায় জড়িত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এ নিয়ে কত্তাদের একদমই মাথাব্যথা নেই। অনার্যদাকে অশেষ ধন্যবাদ বিষয়টি নিয়ে লেখার জন্য। লেখার মূল বক্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ সহমত। লেখাটা হয়ত খুব একটা তথ্যভিত্তিক বা নৈর্ব্যক্তিক নয়, কিন্তু তার দায় লেখকের ওপর বর্তায় না, কারণ এ নিয়ে দুঃখজনকভাবে কোন গবেষণা দেশে হয় না বলতে গেলে। যেগুলোও বা সেন্টার ফর মেডিকেল এজুকেশনের মাধ্যমে হয়- মেডিকেল কলেজগুলোতে অধ্যাপকগুলো সেই ফলাফলকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা এবং উপেক্ষা করেন।
বস্তুত এই প্রাচীনপন্থার নিদর্শন খুবই ব্যাপক।
- এখানে একটু দ্বিমত করব। আসলে সমস্যা পাঠ্যপুস্তকের প্রাচীনত্বে না। মূল সমস্যা পাঠ্যপুস্তক খুব কম ছাত্রই পড়ে। বদলে রয়েছে নানা জাতের ও নানা ভাইয়ের গাইড বই বা চোথা। টেক্সটবই যারা কেনে অধিকাংশই সাম্প্রতিকতম সংস্করণটিই কেনে। কিন্তু বড় সমস্যা হল, বিশাল একটা অংশ টেক্সটবুক চোখেই দেখে না। খুব কম মেডিকেল কলেজই এখন ছাত্রদের হলে বই নিয়ে যাবার অনুমতি দেয়। অবশ্য এর পেছনে বহুবিধ কারণ।
অধ্যাপকদের প্রাচীনপন্থা একটা মুখ্য কারণ। আমি কিছুদিন আগে এফ,সি,পি,এস পরীক্ষার একজন পরীক্ষকের সাথে কথা বলে প্রচণ্ড আতঙ্ক নিয়ে আবিষ্কার করলাম যে, তিনি আসলে বর্তমান বিশ্বে সার্জারির পরীক্ষা কীভাবে হয় তার কিছুই জানেন না। উনি আশির দশোকে পাশ করেছিলেন, এখন পরীক্ষক। অথচ বিশ্বের অন্যান্য মেম্বারশিপ ও ফেলোশিপ পরীক্ষার পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ অজ্ঞ! স্যার ভালো মানুষ, তাই স্বীকার করে নিলেন যে, ১৯৮৫ তে পাশ করার পর তিনি আর এসব নিয়ে ঘাঁটেন নি। আমি দেশের সেরা বহু সার্জনের সাথে কাজ করেছি। সত্যি বলতে কৈরী স্যার আর প্রাণগোপাল স্যার বাদে কাউকে এ নিয়ে ভাবিত দেখি না। বরং অনেকেই নতুন উন্নত পদ্ধতিগুলো এপ্লাই করলে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেন!
একবার এক সহকারী অধ্যাপককে একটা হেমোরয়ডেক্টমিতে এসিস্ট করলাম। ফারকুহারসনের অপারেটিভ সার্জারির টেক্সটবুকে অপারেশনের অনেক নিয়মের কথা বলা আছে। কিন্তু স্যার যেভাবে করলেন সেটা আসলে ধরে-বেঁধে-কেটে দেয়া ছাড়া কিছু না! অপারেশন শেষে আমি স্যারকে বললাম- স্যার এখন কিন্তু আর টি-ব্যান্ডেজ দেয় না( এনাসে অপারেশন হলে টি শেপের যে বিশাল ব্যান্ডেজ কোমর, জননাঙ্গ ও এনাস জুড়ে দেয়া হয়)। উনি রীতিমত উড়িয়ে দিলেন, এমনকি বল্লেন-"তুমি বানিয়ে বলছ।"- দেখুন তো! বানিয়ে বলে আমার কী লাভ? আসল কথা ঐ স্যারের দুনিয়া ২০০১ সালে থেমে গেছে! তিনি ২০০১ সালে এফ,সি,পি,এস করার পর অপারেশনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, আধুনিক সার্জিক্যাল এক্সেলেন্সের কোন খোঁজই রাখেন নি।
বাকি পেপার? অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি বহু অধ্যাপকই জার্নালে পেপার লেখার মত সঠিক ভাষাজ্ঞানও রাখেন না। বাইরে কনফারেন্সে যেতে হলে সি,এ রা লিখে দেন। সেটাতে নিজের নাম জুড়ে অনেকেই দিব্যি আম্রিকা ঘুরে আসেন। নোবেল মনোনয়ন কমিটির সদস্য জনৈক অধ্যাপক আমার পরিচিত। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন- এরা কি কনফারেন্সের নামে স্রেফ বিদেশে প্রমোদভ্রমণে আসেন?
যাবতীয় নতুনত্বকে অধ্যাপকরা কুচলে ফেলেন। আমি থার্ড ইয়ারে থাকতে- বিভিন্ন বিষয়ে কো-অর্ডিনেশন করার জন্য কোর্স এবং ওয়ার্ড-প্লেসমেন্টগুলো ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব নিয়ে ডিনের কাছে গিয়েছিলাম। যেমন ফার্মাকোলজিতে কার্ডিয়াক ড্রাগস পড়ানোর সময়ে কার্ডিওলজি ওয়ার্ডে পোস্টিং ইত্যাদি। ডিন আমার কথা কিছুই বুঝলেন না। কিছুক্ষণ ফটিকের মত চেয়ে থেকে বললেন, "এইগুলা করা যাইব না। রেজিস্ট্রারে কইবা- ক্লাসেরটা আবার পড়ায়া দিতে। শালায় ফাঁকিবাজ!"
আমার সেই ডিন স্যার এখন আমীরে মেডিকেল এজুকেশন। দেশে আর কী হবে। জার্নাল পড়ার তো কোন চর্চাই নেই।
গ্রেজ এনাটমির পুরনো সংস্করণগুলোতে এপেন্ডিক্সের বিভিন্ন পোজিশনের পার্সেন্টেজ দেয়া ছিল। আমাদের সেগুলো দশমিকের পরের দুই-তিন ঘর পর্যন্ত মুখস্থ করতে হত। ৩৯ তম এডিশনে এটা তুলে দেয়া হল কারণ কিছু স্টাডি সম্পূর্ণ বিপরীত ফল পেয়েছিল। এর ফল হল ভয়াবহ। যারা নতুন বই এর রেফ্রেন্স দিয়ে এটা বলতে পারে নি- তারা ফেল করল!
এ নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখির ইচ্ছে আমার প্রচুর। কিন্তু আপনি কি জানেন - রিসার্চ ব্যাপারটাই মেডিকেলে হাসাহাসির বিষয়? বি,সি,পি,এস নামক প্রতিষ্ঠানটি ডিজার্টেশনের কাজ করে পুরো উল্টোভাবে। যেকোন ছাত্রের অধিকার আছে তার পছন্দসই টপিকে কাজ করার। অথচ এখানে ছাত্রের ওপর একজন সুপারভাইজার চাপিয়ে দেয়া হয়- যিনি নিজেও হয়তো কোন জাতেরই রিসার্চার না! তারপর শুরু হয় কুস্তি!
আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্যিই বাজেট ঘাটতি বা জনগণের দারিদ্র্য ও অসহিষ্ণু মনোভাব দায়ী। যেমন হার্ট এটাকের ক্ষেত্রে টেক্সটবুক বলে সিরিয়াল এনজাইম ও সিরিয়াল ইসিজি পরীক্ষার কথা। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ রোগীই এর ব্যয় বহনে অক্ষম। আবার অবস্থাপন্ন রোগীকে এইভাবে চিকিৎসা দিলে অপসাংবাদিকতার কল্যাণে এবং কিছু ইতর ডাক্তারের কারণে ভাববে কমিশনের জন্য বেশি বেশি টেস্ট করাচ্ছে।
কাজেই সমস্যা অনেক। কিন্তু এত কিছুর পরও কিন্তু মূলত তরুণ চিকিৎসকদের জন্য বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে সাফল্য অনেক। আমরা কিন্তু হেলথ র্যাঙ্কিং এ বিশ্বে ৮৮ তম এবং শ্রীলঙ্কা বাদে আর সব দক্ষিণ এশিয় দেশ থেকে অনেক এগিয়ে। নিদারুণ দারিদ্র্য আমাদের প্রায়ই বাধ্য করে আধুনিকতম চিকিৎসার প্রয়োগ থেকে। সেটা স্বাভাবিক। চিকিৎসা সব সময়ই অনেক ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে।
এই অসাধারণ লেখার জন্য অকুণ্ঠ ধন্যবাদ অনার্যদা।
এটা কেবল বাংলাদেশের সমস্যা না। আমি যেখান থেকে পিএইচডি করেছি, এবং বর্তমানে যে মেডিক্যাল স্কুলে অ্যানাটমি পড়াই (দুটো ভিন্ন প্রতিষ্ঠান), সেখানেও ছাত্রদের এই প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। বইয়ের মধ্যে অনেক তথ্য থাকে, সময় এবং স্থানের অভাবে যেটা সবসময় লেকচারে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। পাওয়ারপয়েন্ট লেকচারে উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু বইয়ে আছে এবং প্রফেসর মৌখিকভাবে ক্লাসে বলেছেন - এমন তথ্যের ভিত্তিতে যদি পরীক্ষায় প্রশ্ন করা হয়, তাহলে ছাত্ররা সেটা নিয়ে অনেক সময় ডীনের কাছেও অভিযোগ করে। ছাত্রদের যুক্তি হল ৫০০+ পৃষ্ঠার বই পড়ার সময় তাদের নেই!
অ্যাপেন্ডিক্সের বিভিন্ন পজিশনের পার্সেন্টেজ একটা অপেক্ষাকৃত অগুরুত্বপূর্ণ তথ্য, এবং ছাত্রদেরকে দিয়ে এই তথ্য মুখস্থ করানর ধারণাটাই হাস্যকর। অ্যাপেন্ডিক্স সিকাম থেকে ঝোলে এবং এটা মেসোঅ্যাপেন্ডিক্সের মধ্যে এম্বেডেড থাকে - এইটুকু জানা থাকলেই একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে অ্যাপেন্ডিক্স খুঁজে বের করা সম্ভব।
গুরুত্বপূর্ণ লেখার জন্য অনার্য সঙ্গীতকে ধন্যবাদ।
Emran
ধন্যবাদ আপনাকেও।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
আপনি ডাক্তারি, সঙ্গীতবিদ্যা, ভাষাতত্ত্ব ছাড়া আর কি কি জানেন বলেন তো?
****************************************
ধন্যবাদ অলয়'দা। এই লেখাটার একটা যেসব বিষয় বাদ পড়েছে সেসব মিলিয়ে আরেকটা লেখা লিখতে পারেন কিন্তু। খানিকটা দ্বিতীয় পর্বের মতো। একজন ডাক্তারের কাছ থেকে সরাসরি জানলে আরো স্পষ্ট হবে অনেক কিছু।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
সে কি! অন্তত শিক্ষাপ্ড়তিষ্ঠানে লাইব্রেরির একটা পেইড অ্যাকাউন্ট থাকা উচিত শীর্ষস্থানীয় জার্নাল পাবলিশিং কম্পানিগুলোতে। গুগল করে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট পড়ে নিয়ে যদি জরুরি মনে হয়, তবে সেটা লাইব্রেরির থেকে সংগ্রহ করার আয়োজন রাখা খুব একটা দু:সাধ্য না মনে হয়। এটা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ফতুর হয়ে যাবার কথা না।
লেখককে শুভেচ্ছা
বেশিরভাগ জায়গাতেই সেরকম কোন একাউন্ট নেই।
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
নতুন মন্তব্য করুন