ঠিক জন্মের মুহূর্তে, আমাদের স্মৃতিতে সম্ভবত কোন তথ্য জমা পড়েনি। পড়লেও, সেই তথ্য, ছবি বা শব্দ উদ্ধারের ক্ষমতা আপাত-সাধারণ মানুষের নাই বললেই চলে। আমার কেন জানি মনে হয় স্মৃতিধর মানুষের জীবনের এটা একটা করুণ পরিহাস, সে নিজের সৃষ্টির মুহূর্তের কোন স্মৃতির সাক্ষী হতে পারে না। সেইসময়টিকে মনে করে কী অপার্থিব অনুভব হতে পারে, সেটা আমাদের কারোই জানা নেই। এগুলো নিয়ে আমি প্রায়ই ভাবি, এবং খুব অদ্ভুতভাবেই আমি এমন একটা মুহূর্তের অধিকারী। এমন একটা সময়, যার পর থেকে আমার বাকি জীবনের সবকিছুই বদলে গেছে। বলা চলে একটা নতুন জন্ম, একটা দ্বিতীয় জন্ম- নব উন্মোচন ঘটেছে আমার জীবনেই। আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই সময়টিতে তার গুরুত্ব বুঝে উঠতে আমি একেবারেই পারিনি। এখন তেরো বছর পিছনে তাকালে, ক্রমশ আমার কাছে এটাও পরিষ্কার হয় যে আমাদের জীবনে ঘটমান চমকের স্বরূপ বুঝতেও আমাদের অনেকদইন লেগে যায়।
চৌঠা জুনের বিকেলে, ঈষৎ ঢালু পিচের রাস্তা দিয়ে গাড়িটা যখন গেইট পেরিয়ে ঢুকছিল, গাড়ির কাচের উপর দিয়ে সারবাঁধা পাতাবাহারের রেলিং আমার চোখে পড়ে। এখনও। আরো একটু এগুলেই সবুজ। সবুজ আঁধারের মত ঘন নরোম মাঠ। চোখের ভিতরে সেই সবুজ আগুন ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে খুব অজান্তেই। আমি টের পাই যে এখানে বিস্তৃত মাঠের পাশে আমি কতটা ক্ষুদ্র, অপাংক্তেয়। এর পরের ছয়বছরে যতবারই গেইটটা পেরিয়ে ঢুকেছি, আমার ঘাড় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ডানদিকে ঘুরে গেছে। কী সবুজ! মায়াময়, তীব্র আকর্ষণী, কুহকের মতো টানে। আজকে সেই সবুজ মাঠটাকে এড়িয়ে বাকি সময়ের দিকে চোখ মেললে কেবলই ঘোলাজল, কেবলই ঘূর্ণন। এক একটা দিনের গল্প, এক একটা মুহূর্তের কথাতেই কত গল্প মিশে গ্যাছে। সেই গল্পে হাসি, কান্না, দুঃখ, সুখ, রাগ, বিরক্তি, বিষাদ, একাকীত্ব আর সৌহার্দ্য কীভাবে গুলে গ্যাছে বেমালুম। আজ কোন চেহারাই সেখানে আলাদা করতে পারি না। একটা সুতোকে খুলে আনতে গেলে, সাথে জড়াপাকানো সুতোরাই বাকবাকুম কথা বলে ওঠে!
ঘোলাজলেই মুখ ভাসায় গোঁফওয়ালা মকবুল ভাই, আমাদের গেমসের ঠিক আগে, তিনি একটা কাঠের ট্রলি ঠেলে ঠেলে বাস্কেটবল, ফুটবল, ভলিবলগুলো নিয়ে আসতেন। মাঝবয়েসী, তখন যাকে প্রাগৈতিহাসিক মনে হত আমাদের, ঈষৎ ঢুলুচোখের মকবুল ভাই ট্রলিটা মাঠে আনলেই, আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তাম। এই হুড়োহুড়ি তার স্থৈর্যধ্যানে ব্যাঘাত ঘটাত, তাই হয়তো একটা চাপা 'গ্রান্ট' করতেন। বিরক্তির কী অনাবিল বহুমুখী প্রকাশ। আমরা পাত্তা দিতাম কই! আরো মুখ ভেসে ওঠে কার- একটা হলুদ খামের। আমার নামেই এসেছিল, বেনামি খাম। স্যারের শ্যেন চোখে আটকে গিয়ে সেটা দুইবছর আটকে ছিল অফিসের কাচের নিচে, টেবিল ক্লথেরও নিচে। আড়ালে, গোপনে, বয়ঃসন্ধিমাখা একটা ছেলের কবিতায় মুগ্ধ হয়ে কে যেন লিখেছিল। প্রেরিকার নামও পুরুষালি, যদি ধরা পড়ে যায় সেই ভয়ে! ধরা পড়েছিল ঠিকই, দুই বছর পরে সেই হলুদ বিবর্ণ হয়ে গেলে চিঠিটা আমার হাতে আসে। ততদিনে কবিতা ছেড়ে গেছে, হলুদের সাথে ফিকে হয়ে গেছে কিশোরীর স্মৃতি।
চৌঠা জুনে কেন এই মুখগুলো আকারহীন হয়ে আমার কাছেই ফিরে আসে?
এবারে চৌঠা জুনে আমি পঁচিশ পেরিয়ে গেলাম। বিকেল গড়িয়ে গেলে আমিও সেই শৈশব-ছাড়ানো ছেলেটাকে খুঁজেছি, সেই অনুসন্ধান কত ব্যাকুল, কত উদগ্র, সেটা কে-ইবা বুঝবে? সেই টানেই দেখা হলো পুরনো সাথীদের সাথে। সবুজ মাঠের পাশে যাদের বিদায় জানিয়েছিলাম সাত বছর আগে, তাদেরই কেউ কেউ সাতবছরের গল্প নিয়ে ফিরে এলো আমার কাছে। এত এত কথা কি একরাতে বলে ফেলা যায়? জীবনের পথ বেঁকে কত দূরে চলে যায় আমাদের! আমার মতোই পঁচিশ পেরুনো একজনের সাথেই এমন দেখা হলো, এখন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সাগরে সাগরে ঘুরে বেড়ায়। এই মানুষটা আমার কাছে নতউন জনপদের মতোই অজানা লাগে। যাকে চিনতাম, সে খুব অবলীলায় ঘুমাতো, দুপুরের খাবারে সব্জি দেখলে যার মুখ বাঁকা হতো, ছোটবেলায় খেতে পারতো না সে। একটু ঝুঁকে হাঁটা সেই সেলিম আজকে হেসে হাত বাড়িয়ে দিলে আমি অবাক হই, নির্বাক খুশিতে আমার ভেতরে গমগম করতে থাকে!
সাতানব্বুইয়ে চলে গিয়েছিল ফয়েজ। বাইরেই পড়েছে সে বাকিটা সময়ে। গত বারোবছরে যার সাথে দেখা হয়নি, চৌঠা জুনে দেখা হলো! তাও সেসময়ে কারেন্ট চলে গেছে। ফয়েজের গলার স্বরে আমি তাকে চিনি নাই, এমনকি সে অচেনা হয়ে রইলো কারেন্ট আসার পরেও। সেই চৌদ্দ বছরের কিশোর কোথায়? বাকিদের সাথে কথা, স্মৃতির দৌড়ে আমরা একে অপরের সাথে আজ হঠাতই মেতে উঠলাম! কত কত গল্প। সেই তোড়ে ভেসে এল কালো কুচকুচে আমীরুল স্যার। আমাদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে যিনি নিখাঁদ স্বর্ণই বানিয়ে দিয়েছেন। ঘাই মেরে জেগে উঠলেন শীলা ম্যাডাম, আঠারো বছরে আমরা বিভ্রান্ত দুপুরে যার শাদা শাড়ির লাল পাড়ে আজও মুগ্ধ হয়ে আছি!
গল্পে গল্পে রাত বাড়লো। কয়েকজন বিবাহিত, কয়েকজন বিবাহোন্মুখ। অনুপস্থিত একজন ফুটফুটে মেয়ের বাপ, সেটাতেই বলিহারি গেল সকলে! পুরনো কিশোর-তরুণের খোলস ছেড়ে আমাদের প্রাকৃত জীবনে ফেরার সময় এসে গেল। আমি তখনও চুপচাপ হাতড়াচ্ছি। স্মৃতি এক হতচ্ছাড়া পিঁপড়ের মতো কুটকুট করে কামড়েই যাচ্ছে। হাত মিলিয়ে কথা শুরু হয়েছিল, ফেরার সময়ে বিদায়ে গলা মিলাতে দ্বিধা হলোই না। আবার কবে দেখা হয়, কে জানে? একজন আসেনি, শুনলাম সে সেই সবুজ মাঠের কাছেই চলে গেছে গতকালই। আমরা শুনেই আফসোস করি। ঢাকার জীবন আমাদের শেকল পরিয়ে দিয়েছে, নাহলে আমরাও সেখানে থাকতাম আজকে। বলার পরেও, আমরা জানি, আসলে থাকতাম না। সেই কিশোর জীবনের মাঠটাকে আমরা ওখানেই ফেলে এসেছি। এখন ফিরে গেলে কেবল শুকনো পাতার সাথেই দেখা হবে।
এই যে পরের চৌঠা জুনে অনেকে পৃথিবীর কোণে কোণে ছিটকে পড়বে পড়াশোনা, চাকরি বাকরির টানে। নিজেকে আমার পিরিচের উপরে পানিবিন্দুর মতো মনে হয়, প্রবল ঘূর্ণনে টাল সামলাতেই পারছি না। এই মুখগুলো অপরাপর বাস্তবতায়, নাকি চোখের অহেতুক বাষ্পে, নাকি গরমের ঘামে ঝাপসা হয়ে যায়। শুধু সেই সবুজ মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উনপঞ্চাশটা কিশোরের হাসিমুখ জ্বলজ্বল করতে থাকে!
***
৪/৬/৯
মন্তব্য
হুম...... আর আমরা ছিলাম বায়ান্ন জন।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
শুরুতে একান্ন ছিল আমাদের, ভর্তির সময়েই দু'জন কী মনে করে যেন, এলো না। আর দু'জন পরের এক বছরেই কলেজ ছেড়ে দিয়েছিল। তাদের একজনের সাথে মাঝে দেখা হয়েছে, অন্যজন হলো ফয়েজ। দেখা হলো প্রায় বারোবছর পর! কত স্মৃতি!...
ধন্যবাদ নিবিড় পড়ার জন্য।
ভাল লাগল ভাইয়া...
ধন্যবাদ হে দুষ্ট বালিকা!
দোস্ত, তোর ইদনিংকালের কাব্যচর্চা মাঝেমাঝেই মুগ্ধ হই... আবার মাঝেমাঝে চোখটাকে ভিজিয়েও দেয়।
এইডা তো কবিতা না! কেম্নে কী??
তবে এই লেখা তোর চোখে কেন পানি এনেছে সেটা আমি অনুভব করতে পারি। ভাল থাকিস বন্ধু!
স্মৃতিমেদুর।
এই জুন মাসটাই এমন। গরম, গুমোট, বর্ষা এবং স্মৃতি...!
অনেকদিন বাদে লিখলাম। সেই লেখায় আপনার মন্তব্য যে পাবোই! কেমন আছেন?
আরে কদিন ধরেই ভাবছিলাম
গেলেন কোথায় আপনি
ফিরে এসেই চমতকার লিখলেন
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
"নেই জগতে" গিয়েছিলাম। এই জগতে ফিরে এলাম।
বড়োই অবাক হলাম, আমি তো অল্প কিছু লিখেছি, তাও এমন আহামরি কিছু লেখা না। মনে রাখার ঘটনায় কী বলবো বুঝে পাচ্ছি না!
লেখা ভাল লাগায় ধন্যবাদ, রানা মেহের। সামনের লেখাগুলো লিখিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়লো কিছুটা।
একটা দলা পাকানো কষ্ট মনের ভেতর জমাট বাঁধলো। ভাল লাগলো।
নির্জলা
এই দলা পাকানো কষ্টটা বহন করতে করতে আমিই সয়ে নিয়েছি, তাই সেভাবে অনুভব করি না। আপনার মন্তব্যে আবারও খেয়াল হলো, তাই তো!
ধন্যবাদ নির্জলা, পড়ার জন্যে।
হুম... ভালো লাগলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
হুম! ধন্যবাদ নজরুল ভাই।
লেখা ভালো লাগলো। কোয়ার্টার সেঞ্চুরি করার জন্য বিলম্বিত শুভেচ্ছা!
শুভেচ্ছা জেনে ভাল লাগলো খুব! ধন্যবাদ যুধিষ্ঠির।
২৫ পেরিয়ে গেলেন? তার মানে আপনার মানব জীবন শেষ, পরবর্তী ২৫ হলো গাধার জীবন :(- চাকরী বাকরী,খাটুনি, প্রতিষ্ঠা, সংসার, জন্মদেয়া- এইসব হাবিজাবি
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
হ্যাঁ, পেরিয়েই গেলাম পঁচিশ। সময় কীভাবেই না চলে যায়, আর যাওয়ার আগে একটু জানিয়েও যায় না!
এই কথাটায় আমি পুরোপুরিই সহমত। সেদিন ইশতিয়াককেও বলছিলাম এটা।
প্রথম পঁচিশের প্রথম দেড়ের মত দ্বিতীয় পঁচিশের প্রথম দেড়ও কেটেছে মোটামুটি। শেষটা প্রথমটার মত না হলেই হয়!
প্রথম পঁচিশের প্রথম দেড়ের কথা তোর মনে আছে!! কস্কী মমিন!! :।
তবে এই পঁচিশের শেষটা যে কত ভয়াবহ হবে সেটাই চিন্তা করছি!
স্মৃতিঘন। সুন্দর, আর কোথাও একটু বেদনারও।
-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি
ভুতুম, আপনাকে ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য। বেদনার অংশটুকুই সম্ভবত সবচেয়ে নিখাদ...
পঁচিশ পেরুনোর দলে স্বাগতম।
...........................
Every Picture Tells a Story
ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই। এই ক্লাবের কার্যক্রম কী?
জুন? আমি তো এপ্রিল জানতাম। পঁচিশ পেরোনোর মজাটা অন্যরকম ছিল। আর দশটার মতই হতো, যদি না সুজন্দা দারুণ একটা উপহার দিতেন।
জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পর্কগুলোর দেনা সরাসরি শোধ করা যায় না বলেই আমার বিশ্বাস। বাবা-মা-নানা-দাদা-... ইত্যাদি সম্পর্কগুলোর প্রতি সুবিচার করার একমাত্র উপায় হল অন্য কারও প্রতি তাঁদেরই মত ভাল বাবা-মা-নানা-দাদা-... হওয়া। সেই চিন্তা থেকেই লেখাটা পড়তে শুরু করেছিলাম। কিছুদূর গিয়ে একটু প্যাঁচে পড়ে গিয়েছিলাম। পোলাপানও পয়দা করে ফেললি কিনা ভাবছিলাম।
স্মৃতি নিয়ে কী বলবো আর, সেই নৌকায়ই তো ভাসছি!
হা হা হা! ঐটা গিমিকবাজি হয়ে গেছে। আসলে এই জুনে 'পঁচিশ-পেরুনো-আমি' সবার সামনে হাজির হয়েছি। এটা বুঝাতে গিয়ে ভাষাটা/বাক্যটা কেমন গোলমেলে হয়ে গেছে। তোর জানায় ভুল নেই।
যাক, প্যাঁচালো লেখায় একজন হলেও প্যাঁচে পড়েছে তাহলে!
আমি অবশ্য পিরিচে চড়ার অনুভূতিই পেলাম সেদিন, এটা নতুন। কী প্রবল ঘূর্ণন! আমি নিজেই কিছুটা বেসামাল হয়ে গেছি, সামলে সুমলে লিখতেও ছয়দিন দেরিই হলো।
আহা স্মৃতি... এইতো জীবন...
বর্তমানের তুলিতে স্মৃতির রং-এ অজানা ভবিষ্যত আঁকি সবাই...
______________________________________
কি জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়
______________________________________
লীন
বাকি জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল আর সবচেয়ে মধুর সংগ্রহ সম্ভবত এই স্মৃতিগুলোই!
খুব ভাল লাগল লেখাটা।
অনেক ধন্যবাদ প্রহরী। ভালোলাগা জেনে বিশেষ প্রীত হলাম!
নতুন মন্তব্য করুন