::শ্রেণীচৈতন্য ও আত্মের সংযোগসূত্র::
একা মানুষ বিপ্লব ঘটায় না। যদিও সে বিপ্লব ‘করতে’ পারে। সকল ইতিহাস একান্তই শ্রেণীসংঘাতের। বাহুল্য, তবু বলা। একা মানুষ, দলে দলে, ঐ শ্রেণীভুক্তমাত্র। জনসাধারণের মধ্যে সেও থাকে। কখনো প্ল্যাকার্ড হাতে। কখনো নুড়িপাথর। পাউরুটিও থাকতে পারে। ‘যার যা কিছু আছে’ তাই নিয়ে সবার মধ্যে সংগ্রামী সে। তাই পুঁজিতন্ত্র তাকে বারংবার একা করে তুলতে চায়। শ্রমিকমানুষ সে সুতরাং চারভাবে একা হয়। বিচ্ছিন্ন হয়। উৎপাদিত পণ্যের সাথে, নিজের শ্রমের সাথে, এমনকি নিজের মনুষ্যচরিত্রের সাথে, এমনকি অপর সবকিছুর সাথে - একা হয়েই লড়তে হয় তাকে। এত লড়াইয়ের পর, শোষকের সাথে লড়ার শক্তি কোথায় তার। মার্ক্স তার ১৮৮৪’র
অর্থনীতিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপিতে এ-কথা বিস্তারিত বলেছেন।
তবু একা মানুষটাকে বোঝার দরকার। তারও তো দায়দায়িত্ব আছে। জেনেছি, বিপ্লবের সুপ্রচুর তত্ত্ব তার দায় নেয়নি। তবে শুষ্ক-শীতল পাউরুটিতে কামড় বসানো মানুষটার কী পরিচয়? নুড়িপাথরে যে চিনেছিল জীবনকে? শোষকের দম্ভশার্শি ভেদ করা সেই নুড়িতে, কোথায় তার চেহারা আঁকা আছে? নাকি ঐ নুড়িটাই আজ স্বয়ং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ নামে বিদ্যমান? - যুদ্ধোত্তর যাদুঘরে। তবে নুড়িটা সে নয়। সে কোথায়? একা মানুষটা কোথায়?
ঐ মানুষটাকেও খুঁজে পাওয়া চাই। অসাধারণ দার্শনিক
ফ্রান্ৎস ওমর ফানো, ক্যারেবীয় মার্তিনিক দ্বীপে ১৯২৫ এর ২০ জুলাই জন্ম তাঁর, মনোবিশ্লেষণ আর অস্তিত্ববাদকে যেকারণে যুক্ত করেছিলেন বৈপ্লবিক মার্ক্সবাদের সাথে।
::সহিংসতা::
ফানো বোঝালেন, এতকাল যাকে শোষিতের রিফ্লেক্স বলে চালিয়ে দেয়া গেছে, ‘প্রতিক্রিয়া’ বলে সীমিত করা গেছে, বিপ্লবের সেই প্রতিটি মুহুর্তে জড়িয়ে আছে গভীরের ঘৃণা-ক্রোধ-জীঘাংসা, এবং, রিরংসাও, -কেন নয়। শুধু বিপ্লব নয়। উপনিবেশের যে শৃঙ্খলিত মানুষ, সেও কেবল নির্দোষ প্রতিক্রিয়াদাতা নয়। ‘সুস্থ’ নয় সে মোটে। তাকে চিনতে গেলে বুঝতে হবে তার উন্মাদনাগুলো। ‘পাপে’র মুহুর্তগুলো। তাই কৃষক যখন জোতদারের মাথা এককোপে ফালি করে দেয়, নিথর মস্তক থেকে একটানে ছিঁড়ে নেয় জিভ, তখন তাকে শোষিত কি বিপ্লবী বলে চেনা যাবে। তার নির্দোষ, নিষ্পাপ, সুস্থ, স্বাভাবিক হওয়ার দায় নেই। নিষ্কাম তো নয়ই।
তাই যখন বিপ্লব ঘটে, তাকে ইন্ধন কি ষড়যন্ত্র যতভাবেই বোঝান না কেন, বিদ্রোহ কেটে যতই হত্যাকাণ্ড লিখুন না কেন, লক্ষণ বলে দেবে, এ কেবল শোষিতের বিশ্রী উন্মাদনা। বিশ্রী উন্মাদনার কারণ, মনে করাই, সে শোষিত হয়েছিল। একাদা অন্তত। নিশ্চিত। এইসব ভাবলে, আশপাশের ইতিহাসটা দেখলে, ফানোর কথা মনে পড়ে। ফানো লিখে গেছেন, সহিংসতা বিশুদ্ধকারী শক্তি। ঔপনিবেশিতকে তার নৈরাশ্য-নিষ্ক্রিয়তাসঞ্জাত হীনমন্যতার বিকৃতি থেকে মুক্ত করে সহিংসতা। নির্ভীক তার ভেতর ঘটায় আত্মসম্মানের প্রতিষ্ঠা। সে-ই স্বয়ং সহিংসতা হয়ে ওঠে।
ফরাসীদের সাথে যুদ্ধে নিহত আলজেরীয় গেরিলা। কী আশ্চর্য, গণহত্যার ছবিগুলো সব এক! আলজেরীয়মাত্রই সুদীর্ঘকাল পাশবিক মনোদৈহিক নির্যাতনের চিহ্ন বয়ে বেরানো নিপীড়িত মানুষ। আর তার প্রতিবাদের ভাষায় 'সুস্থতা'র প্রত্যাশা করা ভুল ...
এইসব বলাতে ফানো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীত নয়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফানোর ‘ওপর লেখা’ আত্মপরিচয়ের টানাপড়েনবিষয়ক অন্যের লেখা একটি সুশীল গদ্য পড়েছি। অথচ ফানো নয়। কিন্তু সত্য হচ্ছে তিনি সহিংসতাকে জায়েজ করতে যাননি। সহিংসতা সত্যমাত্র। দার্শনিকব্যখ্যানিরপেক্ষ।
ফানো ‘শ্রেণী’র সংজ্ঞা মার্ক্সের অনুগামী। উৎপাদন-সম্পর্কই সেখানে কেন্দ্রীয়। কিন্তু ফানো যেকোনো শ্রেণীর রাজনৈতিক চরিত্রবিচারে সেই শ্রেণীভুক্তদের জীবিকার মান, আকার ও উপনিবেশতন্ত্রে (বা যেকোনো শোষক সিস্টেমে) তারা কতটুকু আত্তীকৃত – এই সবকিছুকে বিবেচনা করেন। সার্ত্রের
ক্রিটিক অফ ডায়ালেক্টিকাল রিজনের প্রভাবে
চাহিদা ও
অভাব এই দুই বোধকেই তিনি সামাজিক সহিংসতার ঐতিহাসিক উৎস বলে বিবেচনা করে গেছেন। ঔপনিবেশিক জগত তার চোখে একটা বদ্ধ কাঠামো। দমআটকানো। দম নিতে এই কাঠামোর তছনছ প্রয়োজন। ছোট্ট ফুটো করে দম নিলে হয় না, কাঠামোটাকেই চুরমার করা চাই। তাই মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিনের দর্শনে যে শ্রমিক-সহিংসতা উপযোগবাদী, ফানোর চোখে তা অস্তিত্ববাদী। সহিংসতা তার কাছে যত না সাংগঠনিক, তারও চেয়ে অধিক মানসিক উদ্দীপনার ফল। ফানো এই মনোভাব তার অন্যান্য রচনার পাশাপাশি, ১৯৬১’র “
রেচেড অফ দ্য আর্থ”,‘পৃথিবীর ভাগ্যহত’ গ্রন্থে ব্যখ্যা করেছেন। আজকের শ্রমিক অসন্তোষ ও আনুষঙ্গিক সহিংসতাকে যখন,‘একটি বিশেষ মহলের ইন্ধন’ ‘নাশকতার উস্কানি’ 'উদ্দেশ্যমূলক' বলে চালানো হচ্ছে, তখন শ্রমিকচৈতন্যের অস্তিত্ববাদী দিকটিও সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। কারখানা গড়া হয় সুনির্দিষ্ট মুনাফার উদ্দেশ্য নিয়ে। কারখানা ভাঙ্গাতেই সেইরকম সুনির্দিষ্ট মুনাফার উদ্দেশ্য থাকতে হবে – এই ভাবনায় উপনিবেশবাদী মুনাফাবৃত্তির ছাপ রয়েছে।
ফানোর সবচেয়ে চর্চিত এই বইটির মুখবন্ধ লিখেছেন জঁ পল সার্ত্রে
১৯৫২ সালে ছাপা হওয়া ফানোর প্রথম বই, “
ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্ক” ‘কালো চামড়া, সাদা মুখোশ’ এ বলা আছে, কীকরে উপনিবেশের প্রজার ভেতরটাকে (বলপূর্বক, বলাৎকারপূর্বক) বদলে দেয়া হয়। ঔপনিবেশায়িত হওয়ার পরমুহুর্ত থেকে সে আর কখনোই ‘আগের মতো’ থাকতে পারে না (যেভাবে বৃটিশের পর, গানে আছে, ‘বাংলার নওজয়ান, হিন্দু মুসলমান’, আগের মতো ‘সুন্দর দিন কাটাতে’ পারেনি)। বলা আছে, কীকরে তার অবশ্যম্ভাবী মনস্তাত্বিক বিকৃতি ঘটে। বিকৃতি বা পরিবর্তন, যা সকল ‘নাশকতা’কে স্বাভাবিক করে তোলে।
::প্রচারমাধ্যম ও তার ঔপনিবেশিকতা::
তথাকথিত উত্তর-ঔপনিবেশিক এই কালে ফানো দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ ঐ, এটা কেবল ‘তথাকথিত’ই। নানাভাবে, হোক তা বহুজাতিক পুঁজি কিংবা জাতীয় সুবিধাভোগী শ্রেণী – ঔপনিবেশিক শোষকেরা রকমফেরে আজও বিদ্যমান। ফানোর “
আ ডায়িং কলোনিয়ালিজম” বা ‘মৃত্যোন্মুখ ঔপনিবেশিক(তা)’ নিপীড়িতের মনোজগত উন্মোচনে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। বইটি ছাপা হয় ১৯৫৯ এ। আরেক নাম “বিপ্লবের সমাজতত্ত্ব”। আলজেরিয়ান বিপ্লবের নিবিড় পাঠ। ফানো ঐ বিপ্লবে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। গেরিলাযুদ্ধে। তাই বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ে দার্শনিক প্রস্তাব ‘প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে’র ভেতর দিয়ে সত্যায়িত। একটি অধ্যায়:
দিস ইজ দ্য ভয়েস অফ আলেজরিয়া। গণযোগাযোগে উৎসুক হিসেবে এই অধ্যায়টি আমাকে চিন্তিত করেছে। আপাত উপনিবেশোত্তর বাস্তবতায়। অধ্যায়সংক্ষেপ দিচ্ছি নিচে।
১৯৫৪র আগে, অর্থাৎ
আলজেরিয়ার চুড়ান্ত মুক্তিসংগ্রামের প্রস্তুতিপর্বের আগে, দেশটির ঔপনিবেশিক শাসক ফরাসিদের এবং শাসিতের মধ্যে প্রকট সাংস্কৃতিক প্রভেদের প্রতীক ছিল ছোট্ট একটি ঘরোয়া যন্ত্র : রেডিও। যন্ত্রটি শাসকদের ঘরে থাকত। শাসিতের ঘরে থাকত না। এমন নয় যে, শাসিতের রেডিও কেনার সামর্থ্য ছিল না। কিংবা এর ভাষা তাদের বোধগম্য ছিল না। কৌতুহলের বিষয়, রেডিও এবং এই যন্ত্র মারফত প্রচারিত ফরাসি সরকারের রেডিও-আলজের যেকোনো বেতারসংস্থার মতোই যোগাযোগের আকাঙক্ষা নিয়ে পরিচালিত হতো, যে আকাঙক্ষা কখনোই সাফল্য পায়নি। একদিকে, ফরাসি শাসকশ্রেণী ও তার অনুগত আলজেরীয় সমাজ এটি কী বলছে না বলছে তা নিয়ে মাথা বেশি না ঘামিয়ে, এটিকে ‘সভ্যসমাজের’ সাথে সংযোগ থাকার লক্ষণমাত্রে পর্যবসিত করে। অন্যদিকে, উপনিবেশবিরোধীরা (এবং যারা ‘বিলাসপণ্য’ রেডিওর মূল্যবিচারে আর্থিকসঙ্গতিহীন) ফরাসি সরকারের নেটিভ-বিদ্বেষের এই প্রচারযন্ত্রটিকে বর্জন করে। যন্ত্রটির কাজ তখন ছিল একটাই। নেটিভস্বভাবত্যাগের প্রাত্যহিক আহ্বান। ঔপনিবেশিক প্রজাকে আদবকায়দা শেখানো ছিল ফরাসি প্রভুদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য (যেমন বিবিসি জানালায় আমাদের থার্সডের ককনি উচ্চারণ শেখানো হচ্ছে)।কিন্তু ‘নেটিভ স্বভাবত্যাগের’ এই আহ্বানই রেডিওকে আরও অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। কারণ, এই নির্বিচার ফরাসি কেতার প্রচার প্রায়শই ‘রক্ষণশীল’ নারী ও শিশুদের জন্য বিব্রতকর হয়ে উঠত। মৌলিক উদ্দেশ্যই এভাবে বিপত্তিতে পরিণত হলে, ফরাসিরা বয়স ও লিঙ্গভেদে অনুষ্ঠানসূচি বিভাজিত করে রেডিওকে
গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চাইল। বাড়িয়ে দিল ‘আলজেরীয়’ উপাদান। কিন্তু তাতেও আলজেরীয়দের ঐ রেডিও খাওয়ানো গেল না। উপরন্তু ফরাসিরা দেখল এরা ইউরোপীয় দোকানদারদের কাছ থেকে রেডিও কিনতে চায় না। সুতরাং আরবদের ডিলারশিপ দেয়া হল। তাতেও বিশেষ লাভ হলো না। ফানো এর কারণটা বলেছেন। যতই কৌশল খাটানো হোক না কেন, প্রভুদের রেডিওতে প্রভুরাই কথা বলে। শেষতক। আর এই কথা,
ভাষা- যা ক্ষমতার বাহনমাত্র, আলজেরীয়দের অন্তঃপুরে প্রবেশ করতে দেয়াটাই একটা মনস্তাত্ত্বিক পরাজয়ের উৎস। ঐ একটা জায়গাতেই আলজেরীয় চেতনা অজেয়। তাদের বাড়ির ভেতর-আঙিনায়। এর অর্থ, রণকৌশল হিসেবেও (অর্থাৎ
শুনে দেখি, শালারা কী বলে) আলজেরীয়রা রেডিও আলজের শোনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি।
রেডিও আলজেরিয়ায় শ্রুতিনাট্যের দল, সবাই শেতাঙ্গ
১৯৫৭তে যুদ্ধ শুরুর পর, সংবাদ জানাটা জরুরি হয়ে পড়ে। সেজন্য অবশ্য রেডিওতে কান দিতে হয়নি। আলজেরিয়ার পত্রিকাগুলো শক্তিশালী ও তখনো পর্যন্ত স্বাধীন ছিল। অতএব যুদ্ধে বাজারেও পত্রিকা কেনাটাই হয়ে দাঁড়ায় একটা বৈপ্লবিক(=)জাতীয়তাবাদী ভঙ্গী। লক্ষণীয়, এখানেও যোগাযোগের পাশাপাশি নিছক লক্ষণ হিসেবেই প্রচারমাধ্যমের গ্রাহক হওয়ার ঘটনা। এসব ঘটনায় বিরক্ত ফরাসিরা শেষপর্যন্ত পত্রিকাগুলোকে বাধ্য করল তাদের অনুকূলে খবর ছাপতে। এবার আলজেরীয়রাও উল্টো হাঁটল। এখন পত্রিকা না কেনাটাই হল জাতীয়তাবাদী ভঙ্গী। চলল ততদিন যতদিন
এফএলএনের নিজস্ব পত্রিকা
এল মুজাহিদ না বেরোলো। রেডিও প্রসঙ্গে ফিরি। ১৯৫৬ তে এসে জন্ম নিল এফএনএল বিপ্লবী রেডিও। এবার রেডিও শোনাটাই বিপ্লবের সাথে সংহতি জানানো উপায় হয়ে দাঁড়ালো। আনাচে কানাচে যত রেডিও ছিল বিক্রি হলো। এতে ফরাসিরা শেষপর্যন্ত কিছু না পেরে শেষে বেতারতরঙ্গ জ্যাম করতে লাগল। ফলত, বেতারযুদ্ধে যোদ্ধা হলো আলজেরিয়ার প্রতিটি স্বাধীনতাকামী নাগরিক। ফানো এই গোটা চিত্রের বর্ণনায় বিপ্লবের দ্বান্দ্বিক বিকাশের ওপর জোর দিয়েছেন। বিপ্লবী রেডিওতে, ফানো বললেন, ভাষার মুক্তি ঘটল। কারণ, এতে অনেক ভাষা, এমনকি ফরাসিভাষাতেও বার্তাপ্রচার হতো।
এতে আমরা যা পেলাম, তা দ্রুত নোটে এই দাঁড়ায়:
__ঔপনিবেশিক রেডিও (বৃহদার্থে গণ(/প্রচার)মাধ্যম) সকল শাসিতকে ‘ধরতে’ চায়।
__ঔপনিবেশিক রেডিও (ঐ) শাসকরা শোনে কেবল সভ্যসমাজের সঙ্গে সংযোগ প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে। প্রচারিত বিষয়বস্তুর প্রতি পক্ষপাতের চেয়ে এই সংযোগ-অভিপ্রায় মুখ্য হয়ে ওঠে।
__ঔপনিবেশিক রেডিও (ঐ) জানায় নেটিভ-স্বভাবত্যাগের নিরন্তর আহ্বান।
__শাসিতের পক্ষে এই আহ্বানে সাড়া দেয়া কঠিন। এবং সে নিজেকে এর আওতামুক্ত রাখার চেষ্টা করে।
__ঔপনিবেশিক প্রচারমাধ্যমে বিষয়বস্তুর চেয়া বক্তা প্রকট হয়ে ওঠে।
উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলাদেশে এফ এম রেডিও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। সাম্প্রতিক । যদিও এর এর চরিত্রে বাংলাদশের প্রচারমাধ্যমের উপস্থিত ঔপনিবেশিক চরিত্রের ধারাবাহিকতা লক্ষ্যণীয়। নানা কারণে এই রেডিও কখনো গণমাধ্যম হয়ে উঠতে পারবে না। যদিও আপাতদৃষ্টে এটি একধরণের শ্রেণীকৌলিন্যকে ধারণ করছে, এটিকে বৃহত্তর শোতৃমণ্ডলীকে পর্যায়ক্রমে ‘ধরতে’ হবে। বিজ্ঞাপন ও
আন্ডাররাইটিং স্পটের ব্যবসাই এদ
েরকে শ্রোতাশিকারে মাতিয়ে রাখবে। আপাতত রাস্তায় গাড়ির কাঁচ তুলে,বিকলাঙ্গ ভিক্ষুক আর সীসার বিষ থেকে বেঁচে সভ্যসমাজের সাথে একমাত্র সংযোগ হয়ে যতই থাকুক না কেন এই এফএম। এই সংযোগে কী পাওয়া যায়, তাও ভাবি। প্রেমে সাফল্যলাভ থেকে রাস্তার পার হবার তরিকা - কী নয়। প্রচারমাধ্যমের নসিহৎ দেয়ার এই মানসিকতা, বার্তা কি বিনোদন, দুটোকেই ছাপিয়ে, হয়ে ওঠে ঐ নেটিভস্বভাবত্যাগের আহ্বান। এরা ভালো কথাই বলে। তবে সমস্যটা হল, শ্রোতাকে ‘ভালো’ মনে করলে ঐ কথাগুলো আর বলা লাগতো না। ঔপনিবেশিক রেডিওর লক্ষণগুলোকে আত্মস্থ করেছে বলে, শাসিতরা একে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে। ঢাকা শহরের শ্রমজীবিরা এখনো সরকারি বেতারে অভ্যস্ত। আগ্রহী। অবশ্য, যখন তারা শ্রমবিক্রির পর রেডিও শোনার সময় পায়। দেশের শীর্ষ পত্রিকাগুলোও এই উপনিবেশবাদী মানসিকতামুক্ত নয়। তাই প্রচারমাধ্যমের সামগ্রিক চরিত্র বিশ্লেষণে ফানোর কাছে ফেরা যেতেই পারে।
ফানো আলজেরিয়ার রেডিওর ইতিহাস ও শ্রোতামানস বিচার করে, এর দ্বান্দ্বিক বিকাশের ওপর জোর দিয়েছেন। বার্তার ওপর ‘দখল’ পাওয়াটা যেকোনো গণবিপ্লবে কেন গুরুত্বপূর্ণ তা খাতাকলমে দেখিয়েছেন। সেইসাথে সতর্ক করেছেন শাসকমাধ্যমের রণকৌশল সম্পর্কেও। পাঠক-শ্রোতা-দর্শককে ‘ধরতে’ এই কৌশল সোজা-বাঁকা দুরকমই।বিচিত্রধারার ‘সমাজসেবা’ উদ্যোগ বা ‘ভালো হয়ে যা’ ধরণের নসিহৎনামা সেসব সোজা কৌশলের অংশমাত্র।চ্যারিটি ভালো (?)। কিন্তু যার যা কাজ, সেটি না করাটা সন্দেহজনক। যেমন, এধরণের প্রচারমাধ্যম যখন নিজেদের বিজ্ঞাপন দেয়,তখন সেগুলো তাদের পরিবেশিত বার্তার বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে কোনো তথ্য দেয় না। বরং মানুষের স্বভাববদলের শ্লোগান দেয়। উপরন্ত, বক্তব্যের চেয়ে বক্তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার ভেতর দিয়ে এরা নিজের ঔপনিবেশিক চরিত্রকেই পাকাপোক্ত করে নেয়। সেই সাথে যুক্ত হয় এর বাঁকা উদ্যোগগুলো। যেমন একটা পত্রিকা যখন পৃথক ব্লগফোরাম (যেটি মূলপত্রিকার পাঠপ্রতিক্রিয়া নয়) তৈরি করে, কিংবা শহরের অন্যতম সৃজনশীল বইয়ের দোকানটি কিনে ফেলে, তখন বুঝতে হবে সে নিছক বার্তা দিতে চাইছে না। বরং যা কিছু তার বিকল্প হতে পারত, তার পথ রুদ্ধ বা ‘জ্যাম’ করার চেষ্টা করছে। নিদেনপক্ষে বিকল্প নেটওয়ার্কেও একটা অংশ ক্রয় করে রাখছে। পত্রিকার এই খাবলাবৃত্তিকে ফানো ঔপনিবেশিক লক্ষণ হিসেবেই চিহ্নিত করতেন হয়তোবা।
আসলে ৮৪তম জন্মবার্ষিকীতে দাঁড়িয়েও, এই বিপ্লবী ও বৈপ্লবিক দার্শনিক আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। তার অনেক কারণ। অন্তত একটি - বেনিয়াদের অধিকৃত প্রচারমাধ্যমের বিরুদ্ধ আমাদের চলমান সংগ্রাম…
--
__এই লেখায় উপনিবেশবাদ ও পুঁজিতন্ত্র বিনিময়যোগ্য প্রতিশব্দ
__শিরোনামে ফানোঁ বানানটি সার্চে খুঁজে পাওয়ার জন্য দেয়া। অন্যথায় আমি ঁ ছাড়া ফানো লিখার পক্ষে।
__ছবি : ইন্টারনেট
মন্তব্য
ফাঁনোকে নিয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ।
জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি, কমরেড।
---------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
ধন্যবাদ। সিজনাল ফিভার থেকে গা-ঝাড়া দিলাম। ফানো আমাকে যৌক্তিকভাবে আপ্লুত করে থাকে ...
____________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ধন্যবাদ, খুব ভালো কাজ।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনি,নইলে কোন দিন নয়।
ধন্যবাদ। ফানোচর্চা আমাদের জন্য খুব জরুরি বলেই মনে করি। উৎসাহ পেলাম। উপনিবেশবাদী প্রচারমাধ্যম নিয়েও বিশদ লিখতে চাই। এই লেখাটা যথেষ্ট গুছানো না ...
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ধন্যবাদ লেখাটির জন্য। জরুরি লেখা।
একাধিক প্রসঙ্গ চলে আসায় একটু লম্বা হয়ে গেসে ... সহিংসতার মনোবিশ্লেষণ এবং উপনিবেশবাদী মিডিয়া দুইটা পৃথক আলোচনার দাবী রাখে ...
পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ফানো এখনও প্রাসঙ্গিক, আরো অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক থাকবেন। তবে ফানো আমাদের আলোচনায় নেই - একেবারেই নেই বলা চলে। আলোচনার বাইরে চলে যাওয়া ফানোকে সামনে আনার জন্য ধন্যবাদ।
এবার ফ্র্যাঙ্কফুর্ট ইশ্কুল নিয়ে লিখুন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
হাবারমাসকে দিয়ে শুরু করা যায় ... ভালো কথা মনে করাইলেন
পাঠ-মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
_________________________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
সহজ ভাষায় গোছানো লেখা, আর আগ্রহোদ্দীপক, সুপাঠ্য, প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। অনিন্দ্যকে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ। প্রচারমাধ্যম এখন 'রেসিডেন্ট' ন্যাশনাল হিরো তৈরিতে ব্যস্ত। গুলতিটা বাইর করেন ...
__________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
brilliant piece of writing. It really makes Fanon relevant in the context of our times ...
However, it is the responsibility of the Fanon-ites to spread Fanon's words and also it is they who should explain Fanon's notion of violence to the masses (the educated representatives of the masses) ...
To stop discrimination against the garments' workers and also to understand the psyche of the household workers, drivers, builders and so on, Fanon is a must.
in this complex neo-capitalist (perverted version of it) bourgeoisie society of ours, labour is a reality as widespread economic disparity exists across the classes ... hence Fanon would continue to remain relevant here ...
Also I regret that I use Aang-rezi to express myself ... the colonizer's language has kept me under lock and key (should I LAUGH OUT LOUD) ...
অতিথি, আপনার মন্তব্যের জন্য বিশেষ ধন্যবাদ।নিউ-ক্যাপিটালিজম পরিস্থিতি আরো কমপ্লেক্স করেছে। সত্যিই।
আপনার নাম দিয়ে গেলে ভালো লাগত।
আর দুইদিন শ্রম দিলেই বাংলা লেখা আয়ত্ত করতে পারবেন। সেই মেধা ও সদিচ্ছা আপনার আছে।
__________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
অনেকদিন এত ভাল লেখা পড়ি না......... লেখার ভাষাটা দারুন লাগল। এত সহজভাবে লেখার জন্য ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
"নাকি ঐ নুড়িটাই আজ স্বয়ং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ নামে বিদ্যমান? - যুদ্ধোত্তর যাদুঘরে। তবে নুড়িটা সে নয়। সে কোথায়? একা মানুষটা কোথায়?"
Very clear and thoughtful writing. For last few couple of days [i]I was planning to write something on the FM culture. You covered this while discussing Fanon. the writing sums up crucial points about him and construes a good nexus with our present situation. I liked the acerbic sarcasm of the writing, the logical criticism our that our society lacks. Good job, Aninda. Write more. Hope to get a write up on Gramsci as well.
শুচি,
গ্রামশির প্রসঙ্গটি বেশি বেশি ঘুরে ফিরে আসছে। যথার্থই। কারণ সময়ের প্রয়োজন।
এফএম কালচার নিয়ে আপনিই একটা লিখুন না কেন।
Ctl + Alt + U চাপলেই বাংলা লিখতে পারবেন।
নিচের লিঙ্কটিও দেখতে পারেন।
http://www.sachalayatan.com/faq/show/762
বাংলায় লেখাটাকে খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছি। ব্যক্তিগতভাবে। এটি রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক এমনকি অর্থনৈতিকভাবেও আত্মশক্তির বিকাশ ঘটায়।
আরো মনে করাই, সচলায়তনেও অ-বাংলা লেখা-মন্তব্যকে নিরুৎসাহিত করা হয়। নীতিমালা অনুযায়ী।
আপনার লেখার অপেক্ষায়। অনুপ্রাণিত করলেন বলে ধন্যবাদ।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
নতুন মন্তব্য করুন