রশিদ মিয়া হাসে। কুকুর থাকে তো ঘরে ফারিশতা ঢোকে না। ফারিশতা উচ্চারণটা শুনেই হাসে কিনা বোঝা যায়না। মিঠাস। রশিদের প্রশংসাসূচনা। নসিমার কুকুরটা এই সময় ঝিমাচ্ছে। এই ঘরে ফারিশতা এমনিতেও আসবেনা। আবার হাসি। হেকহেকহেকহেক। কাঁচা সুপারি গলায় আটকে যাওয়ায় থামতে হয়। নসিমার গায়ে বেতফলের খোসার মতো ভঙ্গুর অথচ পরিপাটি কামিজ। সে কৃশকায়া। খোপাটা বড়। খোপটা বড় নয়। একটা ফ্যান ঘটরঘটর করে। কুকুরটা উপরে তাকায়। তারপর আবার নিজের ঠ্যাংয়ে। মালিটোলায় এরচেয়ে ভালো বন্দোবস্ত নাই। বালিশের ওয়ারে লেবু আঁকা কেন, বোঝা যায় না। তবু এই লেবু । সপ্তাহে একবার সে আসে। দুপুর রাত রাত-দুপুর ভোর-সকাল। মালিটোলার খোপে, নসিমার বাঁধা। দারোগার মাজায় জোর নাই। ও দারোগা। নসিমা এইখানে একটা রামথাপ্পড় খাবে। তবু বলবে। তেজ। তারপর চিত্রামহলে নাইটশো। দেখা শো বারবার দেখে সে। বারবার। বারবার। লেবুচিপে তিতা হয়। শেষে তাও হয় না। ভোরবেলা রশিদ চলে যায়। বেতফলের খোসার ওপর কুকুরটা গোল্লা পাকিয়ে শুয়ে থাকে। কুকুরের দিনরাতে ব্যত্যয় নাই। সকালে রোদ কামড় দেয়ার আগপর্যন্ত নসিমা ঘুমায়। ঘুমে তার স্বপ্ন আসে। তার হাতপা সব চিরতার ডালের মতো চিকন হয়ে বেঁকিয়ে যায়। অবশ লাগে। তারপর গায়ে কাঁটা দেয়। কাঁটায় রক্তারক্তি রশিদের গা। রক্তে মাখামাখি। চিরতায় কাঁটা হয়, না মনে পড়ে। কুকুরটা ডেকে দেয় তার মালিককে। অর্থাৎ মালকিনকে। আরো একটা দিন শুরু। স্বস্তি। জুম্মার দিন খদ্দের কম। রশিদ তাকে রিজার্ভ দিয়ে গেছে উপরন্তু । সপ্তাহভর। আর সে দারোগা-টারোগা নয়। নতুন নতুন রডের ব্যবসা তার। ইংলিশরোডে। মালামাল। তার কাছে সোনার ব্যবসা কী লাগে। নিভে যাওয়া মশার কয়েলের ওপর বসে তখনও একটা মশা।
নসিমা একদা সৈয়দদের বাড়িতে ঝি। ছোটসৈয়দের কুকুর তার বন্ধু। ছোটসৈয়দের কাছে তো কুকুর যায় না। সিট বললে বসে না। রান বললে দৌড়ায় না। তো, একদিন লাথি মেরে নসিমাকে বের করে দিলে, কুকুরটাও তার পিছু নেয়। কুত্তার বাচ্চা। নসিমার বয়স কত। সাড়ে তের হবে। খোপের মধ্যে ঢোকাল মামা। দূরের না। আপন। কুকুর নিয়ে আদিখ্যেতার জায়গা এইটা না। কিন্তু নসিমাকে কী কারণে অনুমতি দেয়া হয়। সেই থেকে কুকুর আছে। নসিমা বড় হয়। কুকুর বুড়ো। আর দেশে নাকি গণতন্ত্র আসছে।
গণতন্ত্রে আবার ভোট-টোট লাগে। নতুন ঝামেলা। তাই নিসার মোল্লা ভালো হওয়ার প্রস্তুতি নেয়। কোঠার মালিক সে। জুম্মার নামাজ শেষে দলবল নিয়ে নিজেই চড়াও হয়। বেশ্যাদের উচ্ছেদ হবে। চুল ধইরা নামা সবডিরে। দরদ কইরা রাখছিলাম। দরদের ইজ্জত নাই। দরদের ইজ্জত! শব্দটা কানে আসে নসিমার। দুর্যোগের মধ্যেও কৌতুক লাগে। রশিদকে চোখে পড়ে। আজ সেও জুম্মাফেরত সমাজসেবক। নসিমাকে প্রথমটায় চিনতেই চায় না। যেন। কিন্তু আরেক সমাজসেবক নসিমার বুকে একটা বৃত্তাকার মোচর দিতেই রশিদের সব মনে পড়ে যায়। কেরামত ভাই, ছাইড়া দেন। হাত গান্দা কইরেন না। নসিমা তীব্র ঘৃণা নিয়ে ফিরে তাকায়। রশিদ তখন একটা টিনের ট্রাংক বারান্দা দিয়ে নিচে ফেলে। প্রচণ্ড শব্দে কুকুরটা ভয় পায়। সে আশ্চর্য নির্বাক হয়ে যায়। মেয়েদের চিৎকারের কাছে তা কিছুই নয়। ভয়ানক গোলমালের মধ্যে নসিমাকে চটকাতে থাকে কেরামত। এইখানে ব্যবসা করো। ব্যবসা। ব্যবসা করো। ব্যবসা। ব্যবসা করো। ব্যবসা করো। আর কোনো শব্দ বা বাক্য কেরামতের মাথায় আসছে না। একসময় কীভাবে নসিমা ছুটে যায়। কুকুরটাও। রশিদ তখন বড় বাস্তায় গিয়ে নসিমাকে পাকড়াও করে। নসিমার ডান হাতের অনামিকা ভেঙ্গে গেছে। ওটা কোনো মতে কবজির সাথে ঝুলন্ত। আর বাদবাকি রক্তক্ষরণ অন্যত্র। রশিদ তাকে সায়েদাবাদে নিয়ে বাসে তুলে দেয়। কোথায় বাস। কীসের বাস। কেউ জানে না। নসিমাকে কেউ দেখে নাই তারপর।
বহুকাল বা অল্পকাল পর। কুকুরটা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে একসময় মাথা পাগল। প্রচণ্ড গরমে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সেরিব্রাল ডিসফাংশন। ত্রাস। উল্লল চিত্তবৈকল্য! রডের দোকানের কাছে এসে হঠাৎ পুরনো গন্ধ পেয়ে রক্তে ছলাৎ লাগে তার। রশিদ তখন একটা রডের টুকরা নিয়ে কুকুরটাকে মারতে যায়। রশিদেরও তো বয়স হল। হাত কাঁপে। কুকুরটা কামড়ে ধরে তার অণ্ডকোষ। রশিদ কুকুরটার চোখ বরাবর রডটা ঢুকিয়ে দেয়। কুকুরটারও বয়স হল। অকস্মাৎ সবকিছু ঠান্ডা হয়ে আসে। আলগা হয়ে আসে। আর রক্ত।
চিত্রামহলে নতুন ছবি। আজকের দেবদাস। স্ক্রিন প্রিন্টের ব্যানার। শিল্পীরা ট্রাকের পাছায় আঁকে। সমগ্র বাংলাদেশ। কতকিছু বদলাল। গণতন্ত্র। তিন হোটেলে নিসার মোল্লার জমজমাট কারবার। রশিদ ঐসব হোটেলেও গেছে। এক কি দুইবার। কিন্তু ঠান্ডা আর আলগা যন্ত্র দিয়ে পারে নাই। দারোগার মাজায় জোর নাই। ও দারোগা। নসিমার কথা মনে পড়ে। নসিমাকে সে মুক্ত করেছিল।
মালিটোলার পাশেই বংশালের নতুন থানা। মোল্লাসাবে তো ভোটে জিতাই খালাস। ওয়ার্ডের দেখভালটা করব কেডায়। রশিদ মেম্বার। এইবার প্রথম। অফিসারের কথা শুনে। প্রত্যেকদিন দুইডাদুইডা পোলাপাইন ধরতে ভাল্লাগেনা। একদিকে দৌড়ায়া আরেকদিকে যায়গা। আপনার পোলাপাইন সবডি। মোল্লাসাবে আইলে তাও কন্ট্রোলে থাকে। রশিদ চুপ করে থাকে। কন্ট্রোলে ক্যামনে রাখি। আগে খাইত ডাইল। রাণিক্ষেতের মুরগির লাহান ঝিমাইতো। এখন খায় ইয়াবা। দৌড়ায়া পারবেন না স্যর। আমি কিছু একটা করতাছি।
কিচ্ছু করার নাই। দারোগা। ও দারোগা। পুরান ঢাকার ভিৎরে নয়া ঢাকা হান্দায়া গ্যাছে ...
মন্তব্য
অনেকটা যেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোট গল্পের মত।
"উল্লল চিত্তবৈকল্য!" - মানে বুঝি নাই কিন্তু দারুন লাগলো।
"পুরান ঢাকার ভিৎরে নয়া ঢাকা হান্দায়া গ্যাছে ..." - অসাধারন সমাপ্তি।
ফাহিম হাসান
ইলিয়াসের নাম নেয়াটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল ...
পাঠ-মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
__________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ভাল লাগল৷
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
ধন্যবাদ।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
প্যাটার্ন টা সুন্দর।
------------------মানিক
ধন্যবাদ
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
গল্প ভাল লাগল
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
ধন্যবাদ।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
পত্রিকার পাতায় দেখা হেডলাইন আর ছবি এখনো স্মৃতি হয়ে আছে।
পুরোনো বই ঘাটলে যেমন গন্ধ পাই, তেমন একটা অনুভুতি পেলাম।
"পুরান ঢাকার ভিৎরে নয়া ঢাকা হান্দায়া গ্যাছে"
ভাল্লাগসে...
তাহলে চলবে ?
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ভাল লাগল
__________
ত্রিমাত্রিক কবি
বিস্তারিত মন্তব্য পেলে ভালো লাগত আরো। ধন্যবাদ।
__________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
লেখা ভাল্লাগছে। পাঁচালাম।
তবে ছোট বাক্য বেশি বেশি থাকলে ফ্লো কেটে যায়।
---------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
সেটা সমস্যা। এইটা নিয়া আমিও ভাবতেসিলাম। যেইভাবে মাথায় আসে, সেইভাবেই তো লিখি। কিন্তু ভাবতে হবে ...
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ভাল লাগলো গল্পটা।
অনন্ত
ধন্যবাদ অনন্ত।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
বাহ!
সাবরিনা সুলতানা
ধন্যবাদ সাবরিনা।
__________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
গল্পটার ছোট ছোট বাক্য পড়তে যেয়ে মনে হলো কেউ আমাকে গল্পটা বলছে। পড়তে যেয়ে ভালোই কষ্ট হলো। যন্ত্রণা হলো। গল্পটা এজন্যই মূলত ভালো লেগেছে। মোনা'র গল্পে সেই হোটেলে বসে থাকা মেয়েটির কথা মনে হলো, তোর আগের একটা গল্পে সেই নিহত দারোয়ানের কথা মনে হলো...
শেষটা অনেক বেশি আচানক ও প্রসঙ্গত মেটাফোরিক। ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ। মেটাফোর লাগল নাকি। তাইলে তো ভালোই:)
বাক্যবিন্যাস নিয়া ভাবতেসি।
_________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
প্রথমদিকে পড়তে সমস্যা হচ্ছিলো, কিন্তু একবার গল্পে ঢুকে যাবার পর বেশ ভালো লাগলো।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
হুম ... গল্পে ঢুকলেন এই তো সৌভাগ্য
বাক্যবিন্যাসের কারণে ঝামেলা হচ্ছিল, তাই না?
__________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
মিঠাস। ফারিশতা।
জবর লাগল...
স্টাইলটা কাটা কাটা আরেকটু ম্যাডনেস দিতে পারতেন
আরেকটু পিনিকটা তুলতে পারতেন, মানে তুলতে দিতে পারতেন।
যদিও ধরতে পারি পুরান ঢাকার ভিতরে নতুন ঢাকা ঢুইকা যাইতাছে তারপরেও ভলতেই হয়
খোপাটা বড়। খোপটা বড় নয়।
ধন্যবাদ। ম্যাডনেস অ্যাড না কইরা বরং প্রকৃত ম্যাড হওয়া অপেক্ষা করি ...
______________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
মারাত্মক ! এতো চমৎকার গল্প কেন আগে চোখে পড়ে নি !
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
পাঠের জন্য ধন্যবাদ সবজান্তা। মন্তব্যের জন্যও।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
আপনার লেখা যত পড়ছি, আরো মুগ্ধ হচ্ছি। আরো অনেক ভালো গল্প যেন আপনি লিখতে পারেন।
আকাশনীলা
ধন্যবাদ আকাশনীলা। আপনার নিক/ডাকনামটা সুন্দর।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ভাই অধম পাঠক হিসেবে একটা অনুরোধ জানায়, স্টাইলের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিবর্তে আপনি যেমন লিখছেন তেমনি লিখে যান।
আপনার স্বকীয়তা আপ্নেরে আলাদা করে চেনাবে।আমি জানিনা, আপনার কাছে ফর্ম আগে না কন্টেন্ট আগে, তবে আমার কাছে কন্টেন্টের গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি।
এতো অযাচিত কথা কইলাম, কারন গল্পটা খুব ভাল্লাগছে, সেই সাথে একটা থাপ্পড়ও খাইলাম।
এই গণতন্ত্র ভুখা গনতন্ত্র, শুধু মুখে বলার বিলাসিতার গণতন্ত্র।
ধন্যবাদ পাঠক। কন্টেন্টকে হাইলাইট করতেই স্টাইলের দরকার হয়। সরলভাবে বললে।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
নতুন মন্তব্য করুন