সাময়িক মৃত্যু

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি
লিখেছেন অনিন্দ্য রহমান (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৯/০৭/২০১০ - ১২:১৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

::উপক্রমণিকা::

পেরিয়ে গেল খান মোহাম্মদ ফারাবীর জন্মদিন। জন্মদিনেই তাঁকে মনে করা গেল না। কারণ বহুবিধ। রাস্তায় ছাত্রদের বিক্ষোভপরবর্তী প্রতিক্রিয়া, তার প্রতিক্রিয়া, সমসাময়িক মাথাব্যথা এবং আরো দুএকটি ব্যক্তিগত। + আলস্য।

 
আরো একটি দার্শনিক কারণও রয়েছে। ২২ না পেরোতেই মৃত, ঐ মানুষটির পরিচয় কী? মৃত মানুষের পরিচয়? এই নিয়ে নানান ভাবনা এবং ভাবনা কুয়াশায় আটকে আটকে চলা। সুতীব্র হেডলাইট জ্বালিয়েও কিচ্ছু দেখতে পেলাম না।
 
::?::
 
সূচিপত্রে  ছিল ‘দু-জন মৃত তরুণ কবি’ (ফাল্গুনী রায় ও সুকুমার সরকার)। অথচ ভিতরে ‘দু-জন তরুণ মৃত কবি’। বুদ্ধদেব বসু ও তার কবিতাভাবনার অবশ্যপাঠ ‌‘কালের পুতুল’ গ্রন্থের এই ছোট অসামঞ্জস্যের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন ‘আধার ও আধেয়’ গ্রন্থে লেখক হুমায়ুন আজাদ। ‘কালের পুতুলের কালপুরুষ’ নামের প্রবদ্ধে এই প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, তিনি হলে ‘মৃত তরুণ কবি’ই লিখতেন। ‘কেননা তাঁরা কবি ছিলেন, তরুণ ছিলেন, এবং বর্তমানে মৃত। বুদ্ধদেব বিচলিত হয়েছিলেন তাঁদের অকাল মৃত্যুতে, আর সে বিচলনের ছাপ রয়ে গেছে রচনাটির শিরোনামে’।
 
অকালপ্রয়াত কবি খান মোহাম্মদ ফারাবীকে নিয়ে লিখব, এই ভাবনাতে বইয়ের স্তুপ ঘেঁটে দুই-দুইটি বই খুঁজে বের করতে হল। জানতে যে, মৃতদের সম্পর্কে কি বলেছিলেন ‘এককালের জীবিতরা’। অবশ্য তারাও আজ মৃত। এমনকী হুমায়ুন আজাদ ‘অকালপ্রয়াত’ও বটে। কী দুর্লঙ্ঘ্য কৌতুক!  
 
::প্রসঙ্গকথা::
 
ফারাবীকে ছাপিয়ে ঘন হয়ে আসল ফারাবীর মৃত্যু।
 
স্রেফ মৃত্যুই বটে। অপঘাত না। আত্মহনন না। অকালমৃত্যুও না। স্রেফ মৃত্যু। ভাষাদার্শনিক দেরিদা বলেছেন প্রতিটি প্রতিশ্রুতির ভেতর জড়িয়ে থাকে অন্তর্গত বিচলন (ইংরেজি অনুবাদে আছে ইন্টারনাল আপসেট)। যার কারণ প্রতিটি প্রতিশ্রুতিতে থাকে অবিশ্বস্ততা আর কৌতুক। প্রতিশ্রুতিভঙ্গের আশঙ্কা থাকাটা যেকোনো প্রতিশ্রুতির  অবশ্য-উপাদান।
 
জীবন একটা প্রতিশ্রুতিই তো। মৃত্যু অতএব জীবনের অনিবার্য শর্ত। জীবনের প্রতিটি কার্যকর উচ্চারণে (পারফরমেটিভ আটারেন্স) ছায়া ফেলে আছে মৃত্যু।
 
খান মোহাম্মদ ফারাবী, জন্ম ২৮ জুলাই ১৯৫২, একজন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ কবি ছিলেন। ১৪ মে ১৯৭৪ এ অকালে মৃত।
 
 
 
 
 
::খান মোহাম্মদ ফারাবীর অতিসংক্ষিপ্ত জীবনী::
 
মানছি, অতিসংক্ষিপ্ত শব্দটার ব্যবহার কোনো এক কারণে অনুচিত। হতে পারে, মাত্র ২২ বছর আয়ুষ্কালের এক যুবকের জীবনী লিখতে গিয়ে এই শব্দদ্বয় নিমর্ম রসিকতা।  
 
জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নানা বাড়িতে। ১৯৫৮তে সেন্টগ্রেগরি স্কুলে। ৬৯ এ ঢাকা বোর্ডে ম্যাট্রিকে ২য়। ঢাকা কলেজ থেকে ৭১ (৭২ এ অনুষ্ঠিত) উচ্চমাধ্যমিকে আবারও ২য়। এসময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা কলেজের সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। অর্থনীতিতে ভর্তি হয়েছিলেন। স্নাতক ১ম বর্ষ থেকে ২য় বর্ষে ওঠার সময় ১ম হন। বাংলা একাডেমী থেকে বের হওয়া খান মোহাম্মদ ফারাবী রচনাসমগ্র থেকে এইসব জানা গেছে।
 
৭৪ এ ক্যান্সার ধরা পড়ে তাঁর। কলকাতা ও লন্ডনে চিকিৎসাও হয়। বাঁচার কোনো আশা না দেখে বিলেতি চিকিৎসক শেষকটা দিন পরিবারের সাথে সময় কাটানোর জন্য তাঁকে দেশে ফেরত পাঠান।
 
প্রকাশিত গ্রন্থ ৪টি। কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা ও অন্যান্য’, প্রবন্ধের বই ‘এক ও অনেক’, একটি নাটক ‘আকাশের ওপারে আকাশ’ ও একটি শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ‘মামার বিয়ের বরযাত্রী’। শেষোক্ত বইটির গল্পগুলো তিনি ক্লাস সিক্স থেকে এইটের মধ্যে লিখেছিলেন। প্রতিটি বই মরণোত্তর প্রকাশিত।
 
:: আকাশের ওপারে আকাশ ::

ষাটের দশকে শেষদিকে কি সত্তরের শুরুতে রচিত নাটক ‘আকাশের ওপারে আকাশ’। মুনীর চৌধুরীর কবরকে মনে রাখলেও, খুব সম্ভবত বাংলাদেশের প্রথম অ্যান্টি-প্লে এই ‘আকাশের ওপারে আকাশ’। নাট্যকার নিজেই বর্ণনা করেছেন একে ‘নাটক-বিরোধী নাটক’ বলে।  

 
এর পাঠ এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এর কারণ দুটো। ষাটোত্তর বাংলাদেশী সাহিত্য পুরোদস্তুর কাঠামোবাদী। কাঠামোয় লিখিত হয়েছে সুপ্রচুর জাতীয়তাবাদী কিংবা আদর্শবাদী সাহিত্য। কাঠামোয় রচিত হয়েছে সুপ্রচুর আধুনিক/অস্তিত্ববাদী/সাম্যবাদী কবিতা। কাঠামোয় রচিত হয়েছে পাকিস্তানবাদী/ছদ্মপাকিস্তানবাদী অপসাহিত্য। অতএব কাঠামোবিহীন নাটক ‘আকাশের ওপর আকাশ’ দাঁড়িয়ে আছে একাকী। এবং অদ্ভুত। এই নাটক কেবল উত্তরকাঠামোবাদীই নয় বরং কাঠামোবিরোধীও।

কেবল নাট্যদেহে নয়, নির্দেশকের বর্ণনাতেও এর চিহ্ন পাওয়া যায়। যেমন প্রথম দৃশ্যের বর্ণনা এমন

 
দৃশ্য
একটি মধ্যবিত্ত ঘর
সময়: জানা নেই
 
অথবা
 
ঘরের তিনটি দরজা। ঘরের মাঝামাঝি যে দরজাটা বাইরের রাস্তা তথা জগতের সাথে যোগাযোগ রাখচে - সেটা স্টেজের পেছন দিকে। দ্বিতীয় দরজাটি ঘরের বাঁদিকে। এটা দিয়ে ভেতর বাড়ীতে যাওয়া যায়। ডানদিকে রয়েছে আরেকটি দরজা। সেটা দিয়ে কোথায় যাওয়া যায় আমার জানা নেই।
 
কিংবা নাটকের শেষ ৪টি সংলাপ :
 
সাবেরর কণ্ঠ : এ ছাদের নীচে আমি থাকব কিভাবে?
রানীর কণ্ঠ: কিভাবে।
আশরাফের কণ্ঠ: কিভাবে?
এটা কার কণ্ঠ: (সাবেরের, আশরাফের না রানীর?) কিভাবে! কিভাবে কিভাবে কিভাবে কিভাবে কিভাবে ...।
 
এতে আয়োনস্কোর নাটকের মতো রয়েছে আখ্যানের তীব্র অভাব। ভাষিক যোগাযোগের অনিবার্য ব্যর্থতা। যেকোনো গল্পের উত্থানকে বারবার নস্যাৎ করার অপচেষ্টা!
 
দ্বিতীয় কারণ, এই নাটক স্বস্তি-সন্ধানী দর্শকের রুচির ওপর নির্মম আঘাত। সমসাময়িককালে অস্ট্রীয় লেখক পিটার হান্ডকে লিখেছিলেন ‘অফেন্ডিং দ্য অডিয়েন্স’ নামের এক নাটক। অ্যান্টি-প্লের প্রাথমিক উদাহরণ হিসেবে ১৯৭০ এ প্রথম মঞ্চায়িত এই নাটকটির উল্লেখ হতে পারে। দু-একজন পরিশ্রমী গবেষক ছাড়া পিটার হান্ডকে অদ্যাবধি বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় চর্চিত বলে শুনিনি।  
 
গল্প নেই। তবু বলার চেষ্টা করি। পুরোটা নয়। আংশিক। নাটকটির মূল চরিত্র সাবের। একজন কবি। থাকে মায়ের সাথে। সাবেরের বন্ধু-সহচর রানী একই বাসায় থাকে। রানী সাবেরের চাচাত বোন। এর ভাড়া বাড়িতে থাকে। বাড়ির ছাদে একটা গাছ বেড়ে উঠছে। সেই গাছ মূলত ছাদটাকেই গ্রাস করছে। আপাতত ছাদের একাংশ ভাঙা। ভাঙা অংশ দিয়ে আকাশ দেখা যায়। সাবেরের এই আকাশটাকে যত ভয়। আকাশ তার কাছে অসহনীয় লাগে। আকাশ তার যাবতীয় শূন্যতা নিয়ে সাবেরের অস্তিত্বকে গ্রাস করতে চায়। রানীর ভয়, কখন বাড়িওয়ালা আসবে। বস্তুত বাড়িওয়ালা কখনো আসে না। (এছাড়া সাবেরের সমস্যা সে তার অসমাপ্ত কবিতার শেষাংশ লিখতে তিন বছর ধরে ব্যর্থ হচ্ছে, এবং রানী তার তিন বছর আগে পাঠ করা লজিক বই আজও খুঁজে যাচ্ছে)
 
বাংলাদেশের নাট্যধারায় এখনো পর্যন্ত অতুল্য এই নাটকটি মানবিক যুক্তির মর্মমূলে আঘাত হানে। আপাত-যুক্তির আবরণটাকে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে। এবং অস্তিত্বের অন্তঃসারশূন্যতা বারবার উন্মোচনের চেষ্টা করে। নাটকটি স্বস্তিকর নয় মোটে। দীর্ঘ কিছুটা। অনেক ভালো-ভালো অ্যাবসার্ড নাটকের মতোই পুনরাবৃত্তির কারণে বিরক্তিকরও বটে।
 
তবু চমকপ্রদ এই নাটকের জন্য আমরা আজও প্রস্তুত নই।
 
নৈতিক ও অনৈতিকের পার্থক্য ভেঙে পড়া নিয়ে, নাটকের আরো একটি সংলাপ:
 
সাবের: পাপ যে জিনিস পূণ্যও সেই একই জিনিস। কোন কিছুতে কোন তফাৎ নেই। তফাৎ নেই, বন্ধু, আমাতে এবং তোমাতে। তফাৎ নেই ঈশ্বরে ও শয়তানে, ... সব কিছুই আকাশ এবং ... এবং ... (কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু যথার্থ শব্দ পাচ্ছে না)
 
আকাশের ওপারে আকাশ সম্পর্কে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লিখেছেন এটি “প্রাণহীন, যান্ত্রিক এবং আধুনিক পাশ্চাত্য অবক্ষয়ী সাহিত্যধারার অনুকরণসর্বস্ব কৃত্রিম প্রতিধ্বনি”। খুব সম্ভবত এখানে একটা বিরক্তিকর সিনট্যাক্স এরর ঘটে গেছে। বাক্যটি আমার মতে এমনতর হতে পারত : প্রাণহীন, যান্ত্রিক এবং আধুনিক পাশ্চাত্য অবক্ষয়ী জীবনের সাহিত্যিক প্রতিধ্বনি। সাহিত্য জীবনের অনুকরণ। কৃত্রিম তো বটেই!
 
::যশোর রোডে সেপ্টেম্বর::
 
ফারাবী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। চেয়েছিলেন। কৈশোরত্তীর্ণ ফারাবীর মধ্যবিত্ত পরিবার স্বাভাবিক কারণেই তাঁকে বাঁধা দিয়েছিল। গণঅভ্যত্থানের সময়কালেই এই পারিবারিক সীমাবদ্ধতা কিছুটা শ্লেষের সাথে লিখেছেন কবিতায় :
 
আম্মাজান তোমার পা ছুঁয়ে বলছি
আমি আর মিছিলে যাবোনা।
...
অতএব ভয় নেই, মাভৈ আম্মাজান
জীবন কাহাকে বলে এবং মানুষ
হওয়ার সংজ্ঞা কি মর্মে মর্মে বুঝেছি
সুতরাং দিল সাফ - তওবা করেছিলাম আর
অমানুষ কখনো হবোনা
এবং হবোনা
হবোনা এবং ...
 
তবু মুক্তিযুদ্ধ ফারাবী  অন্তত একটি ইতিহাসোত্তীর্ণ কাজ করে গেছেন। ৭২ এ অ্যালেন গিনসবার্গের অসাধারণ কবিতা 'সেপ্টেম্বর অন যশোর রোডে'র অনবদ্য অনুবাদ করেছেন ফারাবী। নির্মলেন্দু গুণ সম্প্রতি প্রকাশিত ‘গীনসবার্গের সঙ্গে’ বইয়ে লিখেছেন, ‘ফারাবীর অনুবাদ শুধু যে শিল্পোত্তীর্ণ হয়েছে তাই নয়, তিনি বাঙালির হয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এক ঐতিহাসিক দায়িত্বও পালন করে গেছেন’।
 
সেই অনুবাদের কিছু অংশ :
 
লক্ষ প্রাণের উনিশ শত একাত্তর
উদ্বাস্তু যশোর রোডে সব ধূসর
সূর্য জ্বলে ধূসর রঙে মৃতপ্রায়
হাঁটছে মানুষ বাংলা ছেড়ে কোলকাতায়।
...
খেলছে শিশু বানের পানি চারটি ধার
শেষ হয়েছে দেবেনা আজ খাদ্য আর
আমার ব্যাগে পয়সা - এ কি আমার পাপ
শিশুর চোখে দেখছি মোদের মৃত্যুশাপ।
 
এর চেয়ে ভালো অনুবাদ বোধ করি অসম্ভব।
 
 
::উপসংহার::
 
(কী আশ্চর্য! উপসংহার শব্দটিতেও লুকিয়ে আছে সংহার)
 
ফারাবীর লেখা ‘প্রজ্ঞা ও স্বজ্ঞা : শিল্পের সমীকরণ’ নামের দার্শনিক প্রবন্ধে প্রথম লাইন:
 
এই মৃত্যু চিহ্নিত পৃথিবীতে জীবনে নিকটতম তুলনা শিল্প।
 
অদ্ভুত এই উপলব্ধি । অপ্রত্যাশিত, কৈশোরত্তীর্ণ যুবকের সত্তায়।
 
প্রতিভাধর খান মোহাম্মদ ফারাবীর অকালমৃত্যু হয়েছিল। এই অর্থে তিনি অনন্য নন। হয়েছিল তার স্বকালমৃত্যুও। তিনি স্মরণীয় ও প্রাসঙ্গিক থাকবেন এই জন্যই। নইলে কত কত লেখক-কবি-সাহিত্যক উপাধিজীবিই তো রয়েছেন, যাদের মৃত্যু স্বকালের বহুআগেই ঘটে গেছে...    

 


মন্তব্য

mef এর ছবি

'মামার বিয়ের বরযাত্রী' নামে ফারাবীর একটা মজার ছোটদের বই মুক্তধারা বের করেছিল. ছোটবেলায় পড়া ..মনে হলো..

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

এই বইয়ের গল্পগুলো ফারাবী স্কুলে পড়ার সময় লিখেছিলেন।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

বাবুবাংলা এর ছবি

খান মোহাম্মদ ফারাবী সম্পর্কে প্রথম জেনেছিলাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর এক বইয়ে। এর পর ইন্টারনেটে তন্নতন্ন করে ঘেটেও তাঁর সম্পর্কে কোথাও একটি লাইনও খুঁজে পাইনি। এতদিন পর এই প্রথম ফারাবীকে নিয়ে কাউকে কিছু লিখতে দেখলাম। অসংখ্য ধন্যবাদ ফারাবী সম্পর্কে আরো কিছু জানার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।

জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ 'কবিতা ও অন্যান্য' বইটির সম্পাদনা করেছেন। ঢাকা কলেজে ফারাবীর শিক্ষকও ছিলেন। এই লেখাটায় সায়ীদের একটি উদ্ধৃতি রয়েছে।

পাঠ ও মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

সব জীবন শুধু সময়ের দৈর্ঘ্য দিয়ে মাপা যায় না । কোন কোন জীবন থাকে যাপিত সময়ের দৈর্ঘ্য ছাপিয়ে যায়...

কোন কোন জীবন এমন মহৎ অর্জনে ঋদ্ধ যে তাঁর স্মরনে আনত হতে হয়...সে যত সংক্ষিপ্তই হোক ।

……………………………………
বলছি এক জ্যোতির্ময়ীর কথা

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

একমত। সময়ের দৈর্ঘ্য পেরিয়ে জীবন। পাঠ-মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

Fahima Khan এর ছবি

ফারাবী আমার বড় ভাই। আজকে তার জন্‌ম দিনে তাকে স্মরণ করার জন্য আমি কৃতঙ্গ।

হিমু এর ছবি

ফাহিমা, আপনি যদি খান মোহাম্মদ ফারাবী সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য দিতেন, আর তাঁর অন্তত একটি স্পষ্ট ছবি দিতেন, বাংলা উইকিপিডিয়ায় তাঁর ওপর একটি ভুক্তি যোগ করা যেতো। আপনি মন্তব্যের ঘরেই তথ্যগুলো জানাতে পারেন। ধন্যবাদ।



বুকে BOOK রেখে বন্ধু চলো আজ যাবো বরাহশিকারে মোরা ধার ধার ধার দিও বল্লমে ♪♫

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

অনেক ভালো লাগল আপনার মন্তব্য পেয়ে।

আমি এই একটি ছবিই বাংলা একাডেমীর সমগ্রে পেয়েছি। আর তথ্যের জন্যও ঐ বইটি ব্যবহার করতে হয়েছে।
আমাকে ইমেইল করলেও আমি এই পোস্টে সেটি যোগ করে দিতে পারি। aninda.rahman[অ্যাট]hotmail[ডট]com

আর সচলায়তনের ইমেইল ঠিকানা,
contact[অ্যাট]sachalayatan[ডট]com
সাইটের মডারেটররা আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন। বিশেষ করে উইকিপিডিয়ায় ভুক্তির বিষয়ে। এটি খুবই দরকারি কাজ বলে আমারও মনে হয়েছে।

___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

এই লেখা এবং প্রতিভাধর এই কবির কাহিনী জেনে কেন যেন বিস্মিত হলাম। স্মরণ করার জন্য লেখককে অনেক ধন্যবাদ।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

সত্যি বিস্ময়কর।
পাঠককেও ধন্যবাদ।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সুকান্ত ভট্টাচার্য, সোমেন চন্দ, খান মোহাম্মদ ফারাবী, মলয় কুমার ভৌমিক - ত্রিশের দেখা পাবার অনেক আগেই সময়কে বুড়ো আঙুল দেখানো এক একটি নাম। প্রত্যেকে স্বমহিমায় ভাস্বর। নামগুলো এক নিঃশ্বাসে নেবার নয়, তবু অকাল মৃত্যু তাঁদের একটা জায়গায় অন্ততঃ এক কাতারে এনে দিয়েছে।

ফারাবীর মৃত্যুকে আমি "অকাল মৃত্যু"ই বলব, "স্বকাল মৃত্যু" নয়। ফারাবী দুয়েকটা ক্ষেত্রে নিজের কালকে ছাড়িয়ে গেছেন, এবং সমসাময়িক পৃথিবীতে সেই কাল আসার আগেই তিনি চলে গেছেন। তাই তাঁর মৃত্যু "অকাল মৃত্যু"। এটি বিদ্যমান পারিপার্শ্বিকের কালিক বিচারে বলা। প্রাগ্রসর ফারাবীর মনোকালের বিচারে আপনার বলা "স্বকাল মৃত্যু"কে আমি অস্বীকার করিনা। তবে তা পাঠক মনে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে হয়েছে।

পুনশ্চঃ লুপ্তপ্রায় অথচ প্রাসঙ্গিক মানুষগুলোকে আমাদের সামনে আনার জন্য আপনার যে প্রচেষ্টা তা সত্যি প্রশংসনীয়। যথাসাধ্য চালিয়ে যান। অমন নাম মনে পড়লে তার দায় আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবো।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

অবশ্যই। অকালমৃত্যু তো বটেই। কিন্তু আমি বলতে চেয়েছি অকালে মৃত্যুর কারণেই তিনি স্মরণীয় নন। জীবন-মৃত্যুর মানেটাই অনেকের ক্ষেত্রে পাল্টে যায়। স্বকালের সঙ্গে সম্পর্কহীন থেকে বাঁচার কী মানে? তাই 'স্বকালমৃত্যুর' কথাটাই বড় হয়ে আসল। এটি আসলে একধরণে ব্যক্তিগত প্রবন্ধ। এর মধ্য লেখকমনের দ্বন্দ্বটাই ফুটে উঠেছে। পাঠক আসা করি এইটুকুর বাইরে নিজেকে রাখবেন। আমিও চেষ্টা করব।

পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

তাসনীম এর ছবি

একটু দেরিতে পড়লাম এই লেখাটা।

'মামার বিয়ের বরযাত্রী' বইটা পড়েছিলাম ছোটবেলাতে। তখন খুব ভালো লেগেছিল। ফারাবী সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানতাম না, কিছুদিন আগে জেনেছি "সেপ্টেম্বর অন যশোর রোডের" অনুবাদের ব্যাপারটা।

অনেক ধন্যবাদ এই লেখাটার জন্য। ফারাবীর বইগুলো কি আজকাল পাওয়া যায়?

+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

আমার কাছে দুটো আছে। রচনাসমগ্র আর আকাশের ওপারে আকাশ। রচনাসমগ্র বাংলা একাডেমী গ্রন্থ বিক্রয় কেন্দ্রে পাওয়া যাওয়ার কথা।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

কনফুসিয়াস এর ছবি

লেখাটার জন্যে অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, খুব ভাল লাগলো অনিন্দ্য।
-----------------------------------
আমার জানলা দিয়ে একটু খানি আকাশ দেখা যায়-

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

অনুপ্রেরণার জন্য ধন্যবাদ। আমাদের তরুণসমাজের ভিতর চিন্তাশীলতাকে পর্যায়ক্রমে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। স্বকালের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে বেড়ে উঠছে একালের তরুণ। এই দুঃখজনক বাস্তবতায় পিছনে ফিরে তাকালে ফারাবীর মতো মানুষদের দেখা যায়। ফিরে তাকাতেই হবে।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

খান মোহাম্মদ ফারাবীর নাম আগে শুনি নাই। আপনার লেখা পড়ে তাঁকে জানলাম। পোস্টের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

-------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

এর বেশি কিছু চাইনি। অনেক ধন্যবাদ।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

তানভীর এর ছবি

লেখাটার জন্য ধন্যবাদ অনিন্দ্য।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ধন্যবাদ।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

সাইফ শহীদ এর ছবি

অনিন্দ্য,

খুব সুন্দর হয়েছে লেখাটি। ভাল লাগলো।

কী আশ্চর্য! উপসংহার শব্দটিতেও লুকিয়ে আছে সংহার

সত্যিই কী আশ্চর্য!

সাইফ শহীদ

সাইফ শহীদ

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

আপনার মন্তব্য পেলে অনেক ভালো লাগে।

আসলে যে দার্শনিক জায়গাটায় শুরু করেছিলাম, সেটি হচ্ছে মৃত্যু সবকিছুর গায়েই ছায়ার মতো লেগে আছে। আমরা সেটা দেখতে চাইনা। না দেখাই ভালো অবশ্য।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

খান মোহাম্মদ ফারাবীর বই পড়বার সৌভাগ্য হয়েছে...।

'মামার বিয়ের বরযাত্রী' পড়ে আমি খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম; কারণ টেনিদা-ঘনাদা-ফেলুদা'র পথ ধরে খাঁটি বাঙ্গালিয়ানা ধারণ করে ফারাবী সৃষ্ট কামাল ভাই চরিত্রটি আমায় দারুণ মুগ্ধ করেছিলো...

_________________________________________

সেরিওজা

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

পাঠের মাধ্যমেই ফারাবী বেঁচে থাকবেন।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

মুস্তাফিজ এর ছবি

লেখাটার জন্য ধন্যবাদ অনিন্দ্যকে। এভাবে আমরা যদি মনে না রাখি তাহলে কদিন পর ফারবীর নাম শুনে সবাই ভুরু কুঁচকে তাকাবে।
লেখাটাই আপাতত উইকিতে যোগ করে দিন।

...........................
Every Picture Tells a Story

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

চেষ্টা করব। ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ফারাবী সম্পর্কে ভাসা ভাসা শুনেছিলাম।
আপনার অনিন্দ্য সুন্দর রচনায় যেন বা প্রাণ পেলেন প্রায় বিস্মৃত হয়ে যাওয়া মেধাবী কবি।
বহিরাঙ্গ দেখে বুঝিনি যে লেখাটি এতটাই ভারি হবে।
বর্ণনায়, উপস্থাপনায়, গুরুত্বে।

স্যালুট।

জহিরুল ইসলাম নাদিম

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

অনুপ্রাণিত হলাম।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

লেখাটার জন্য ধন্যবাদ।
"খান মোহাম্মদ ফারাবী রচনা সমগ্র" বাঙলা একাডেমী থেকে কিনতে পাওয়া যাবে। দাম খুবই কম। গায়ের মূল্য ১৫০ টাকা। কমিশনের পরে ১০০ টাকারও কম মূল্যে পাওয়া যাবে। এতো অল্প টাকায় এতো দারুণ বই না কেনাটা পাপ। ঢাকাস্থ সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ুন চোখ টিপি
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

রচনাবলীর সম্পাদনা খুবই দুর্বল। তারপরও এটাই সবচেয়ে ভালো অপশন। পাঠের জন্য ধন্যবাদ।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

বাবুবাংলা এর ছবি

খান মোহাম্মদ ফারাবী সম্পর্কে জানার সুযোগ বড়ই আজ অপ্রতুল। আমার হাতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের একটি স্মৃতিচারণমূলক বই ছিল। ভাবলাম, প্রিয় ছাত্রের কথা নতুন করে আবার সবাইকে জানানোর প্রয়াসে বই থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃতি হিসেবে তুলে দিলে নিশ্চয়ই স্যার অখুশী হবেন না। এই ভাবনা থেকেই এই রাত গভীরে অভ্র সম্বল করে বসে পড়লাম। ফারাবী স্মরণে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের “ভালোবাসার সাম্পান” বইয়ের ২৭৪-২৭৭ পৃষ্ঠায় বর্ণিত “সত্তরের সহযাত্রী” শিরোনামের স্মৃতিকথা থেকে উদ্ধৃত করছিঃ

“ সত্তরের কবিদের মধ্যে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, খান মোহাম্মদ ফারাবী, দাউদ হায়দার, শিহাব সরকার, কামাল চৌধুরী, ওয়াসীউদ্দীন আহমদ ছিল আমার ঢাকা কলেজের সরাসরি ছাত্র।

একেক সময় মনে হয় সাহিত্যগোষ্ঠী হিসেবে আমরা ছিলাম সত্যি সত্যি দুর্ভাগা। কত ছোট্ট একটা দল, অথচ মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে কতজন লেখককেই না হারাতে হয়েছিল আমাদের। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘কল্লোল যুগ’ পড়লে দেখা যায় ঐ গোষ্ঠীর লেখকেরা হারিয়েছিল মাত্র একজনকে, তাদের প্রিয় গোকুল নাগকে। আর আমরা হারিয়েছিলাম কত প্রিয় মুখ। স্বাধীনতাযুদ্ধের মধ্যেই হারাতে হয়েছিল আবুল কাসেমকে, তার কয়েক বছরের মধ্যেই এক এক করে বিদায় নিয়েছিল হুমায়ুন কবির, শশাঙ্ক পাল, আবুল হাসান, আর খান মোহাম্মদ ফারাবী। কিছুদিন পরে বিদায় নিয়েছিল রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ঘটনাগুলো আমাদের খুবই শোকাহত করেছিল।

আমি সবচেয়ে মুষড়ে পড়েছিলাম ফারাবীর মৃত্যুতে। ও কেবল আমার ছাত্র ছিল না, ছিল আমার খুবই ঘনিষ্ঠ। ঢাকা কলেজে ও যখন আমার ছাত্র তখন ওর বয়স সতেরো-আঠারো, আমার ত্রিশ-একত্রিশ। কিন্তু ওর মেধার ধার আর পড়াশোনার পরিমান এতটাই ছিল যে ওকে সমবয়সী ভাবতে এতটুকু অসুবিধা হত না। আমরা প্রায় বন্ধুই হয়ে ঊঠেছিলাম। ওর সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা তর্কবিতর্কের অন্তরঙ্গ আর আনন্দঘন মুহূর্তগুলো প্রায়ই মনে পড়ে।

ফারাবীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিছয় ১৯৭০ সালে, ঢাকা কলেজ বার্ষিকী প্রকাশ করতে গিয়ে। ঐ পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে ওর একটা প্রবন্ধ ও আমার হাতে দেয়। লেখাটা পড়ে আমি যারপরনাই অবাক হয়ে যাই। লেখাটিতে যে যুক্তিময়তা, গভীর উপলব্ধি, মেধার দীপ্তি, দার্শনিক দৃস্টি এবং বিস্তৃত পড়াশোনার ছাপ ছিল তা সতেরো বছরের একজন কলেজি ছাত্রের কাছ থেকে খুবই অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। আমার এমনও সন্দেহ হয় যে অন্য কারো লেখায় নিজের নাম বসিয়ে ও হয়তো কলেজ-বার্ষিকীতে ছাপানোর জন্য জমা দিয়েছে। আমি গোপনে ওর ব্যাপারে খোঁজখবর নিই এবং জানতে পারি যে ও মাধ্যমিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছে। (পরে আমাদের কলেজ থেকে ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাতেও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল)। কৌতুহলী হয়ে ওর সঙ্গে আলাপ করে আমি লেখাটার ব্যাপারে সন্দেহমুক্ত হই। কেবল সন্দেহমুক্ত নয়, আমি স্পস্ট অনুভব করি যে আমাদের সাহিত্যে এমন একজন শক্তিমান লেখককে আমরা অচিরেই পেতে যাচ্ছি যে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাতে উজ্জ্বল অবদান রাখবে।

আমার ধারনা মিথ্যা হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই বেরোল ওর ছোটদের গল্পের বই ‘মামার বিয়ের বরযাত্রী’। বইটায় রম্যতা, কৌতুক এবং শিশুমনস্তত্বের বিশ্লেষন অনবদ্য। ছেলেবয়সের যতরকম দুস্টুমি থাকা সম্ভব তার কোনটিই যেন বাদ নেই এতে। বইটি লিখেছিল ও ক্লাস এইটে থাকতে। আশ্চর্যঃ বইটি এখনো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের দেশব্যাপী বইপড়া কর্মসুচীর ক্লাস এইটের ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্য। ছেলেমেয়েরা বইটি পড়ে এখনও অসম্ভব মজা পায়।

ওর কবিতাও অপুর্ব। ও ছিল মার্ক্সবাদী বিপ্লবে বিশ্বাসী, ও বিশ্বাস করত রক্তময় সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আজকের এইসব নিঃস্বতা উৎরে একদিন মানবজাতির জ্যোতির্ময় ভবিষ্যত দেখা দেবেঃ

‘বেঁচে আছি আজো হয়তো তাই
মাছি তাড়ানোর মতো দুইহাতে আধাঁর সরাই,
পরম বিশ্বাসে এই শীতল মেঝেতে বুক ঘষি
চিৎকার করে বলিঃ ভালোবাসি আজো ভালোবাসি...’

বিপ্লবে আর প্রেমে বিশ্বাস- এ দুটিই ছিল অর জীবনের দুই তীরঃ

‘ আমি তো তাদেরই জন্য
সুর্যের দিকে চেয়ে থাকবার
অভ্যাসে যারা বন্য।
আমি তো তোমারও জন্য
কপাল-জ্বালানো যে মেয়ের টিপে
রক্তের ছোপ ধন্য।’

ব্যক্তিগতভাবে লাজুক আর একচোরা ছিল ফারাবী। একটি প্রবন্ধে ওর একটি বর্ণনা দিতে গিয়ে আমি লিখেছিলামঃ ‘চোখের কোণে মৃদু বিষণ্ণ হাসি ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অপ্রতিভ তরুণ’।

বর্ণনাটি ভুল নয়, কিন্ত যখন ও বক্তৃতা দিয়ে মঞ্চে দাঁরাত তখন ও ছিল সত্যি অসাধারণ। সমস্ত অপ্রতিভতাকে হাওয়ায় উড়িয়ে যেন প্রদীপ্ত এস্রাজের মতো বেজে উঠত ও। ওর বক্তৃতা ছিল পরশীলিত, বুদ্ধিদৃপ্ত ও বেগবান। আমার ধারণা, বেঁচে থাকলে একজন শক্তিশালী ও উঁচুমাপের বক্তা হত ও।

কিন্তু ওর প্রতিভার সবচেয়ে অনিন্দ্য রূপটি ফুটে উঠেছিল ওর প্রবন্ধে। ওর প্রবন্ধ ছিল শাণিত ও দ্যুতিময়। মেধার সুতীক্ষ্ণ তলোয়ারে যে-কোন বিষয়কে বিস্ময়করভাবে কেটে-কেটে তার মর্মমুলকে অনাবৃত করে ফেলতে পারত ও। ওর যুক্তিপ্রতিভা ও প্রজ্জ্বলিত চৈতন্য ওর ভাষাকেও করে তুলেছিল দীপ্তিময়। সে-সময়কার কাব্য-আক্রান্ত, আবেগগ্রস্ত, মন্থর ভ্যাপসা গদ্যের জগতে ওর গদ্য ছিল নতুন বলমের মতো চকচকে। একটা প্রবন্ধের শুরুতে ও লিখেছিলঃ

‘ এই মৃত্যু চিহ্নিত পৃথিবীতে জীবনের নিকটতম উপমা শিল্প’।

লাইনটি বহুদিন পর্যন্ত আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মাত্র আঠারো বছরে লিখেছিল ও লাইনটি।

আমরা সবাই ওর কাছ থেকে যখন বড় কিছু আশা করতে শুরু করেছি, তখনই হঠাৎ করে প্রায় বিনা এত্তেলায় চলে গেল ফারাবী। একুশ ছেড়ে বাইশ বছরে পড়তে-না-পড়তেই বিদায় নিল। ১৯৭৩-এর কোন একসময়ে একদিন পিজি হাসপাতালের (এখনকার বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের) প্যাথলজি বিভাগে গিয়েছিলাম সেখানকার কয়েকজন ডাক্তার-বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে। গল্প জমে উঠেছে ঠিক সেই সময় একজন সিনিয়র অধ্যাপক বিমর্ষমুখে ঘরে ঢুকেই হাতপা এলিয়ে একটা চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়লেন।
একজন তরুণ ডাক্তার জিজ্ঞেস করলঃ ‘স্যারের কি মন খারাপ?’
অধ্যাপক জবাব দিলেনঃ ‘বইয়েপসি টেস্টে একটা ছেলের কার্সিনোমা পেলাম। খুবই মেধাবী একটা ছেলে...’
আমি জিজ্ঞেস করলামঃ ‘কী নাম’।
উনি বললেনঃ ‘ফারাবী। ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। আমাদের পরিচিত’।
আমি আতঙ্কগ্রস্তের মতো বললামঃ ‘অবস্থা কেমন?’
উনি বললেনঃ ‘ভালো না’।

অধ্যাপকের কথার ঢেউ শেষ হতেই ডাক্তারদের হোঁচট খাওয়া গল্প আমার শুরু হয়ে গেল। কিন্তু আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। অসম্ভব কষ্ট হতে লাগল আমার। এত মেধাবী, সুন্দর সপ্রতিভ আর সম্ভাবনাময় একজন প্রতিভাবান যুবক এভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে ভাবতেও বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যেতে লাগল। আমি ওর সুন্দর, ভাবুক আর বিষণ্ণ মুখটাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। কত স্বপ্ন, কত সাধ তার বাকি। যাদের ভেতর বিভা নেই, আলো-উদ্ভাস কোনকিছু নেই, সেসব কোটি কোটি নির্বীজ আর অক্ষম কীটের মতো মানুষ এই পৃথিবীকে শুধু ভারাক্রান্ত করার জন্য থেকে যাবে; আর যাদের মধ্যে প্রতিভা আর সম্ভাবনার জ্বলিত দীপ্তি তাদের চলে যেতে হবে, এ আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।

হাসপাতালে ওকে দেখতে গেলাম। আগের মতোই মুখে সেই বিষণ্ণ চেনা হাসি ফুটিয়ে ও আমার দিকে অপলভাবে তাকিয়ে রইল। সে চাউনি দুঃসহ। যেন বলতে চায়ঃ স্যার, যাচ্ছি। ওর সেদিনের চাউনির বিষণ্ণতা আগের চেয়ে অনেক বেশী জমাট, স্থির। আজও ওর কথা মনে হলেই সেই নিঃশব্দ অপলক চাউনিকে আমি আমার দিকে একইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখি। ও আমাকে খুবই ভালোবাসত। আমাকে দেখে ওর উচ্ছসিত হবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ওর চোখ সামান্য ভিজে ঊঠলেও সেখান থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল না। আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। টের পেলাম জীবনের মতো মৃত্যুকেও ও অবিচল মর্যাদার সঙ্গেই মোকাবেলা করতে চেষ্টা করছে।

ওকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করা হল। কিন্তু ফল হল না। ক্যান্সার ওর শরীরে অনেকদুর ছড়িয়ে গিয়েছিল। বছর পার হওয়ার আগেই ওর মৃত্যু হল। ওর মৃত্যুর দিন আমি ছিলাম ঢাকার বাইরে। যখন ওর মৃত্যুর খবর আমি পেলাম তার অনেক আগেই ওর কবর হয়ে গেছে।

বিশ বছর বয়সের মধ্যেই মোট পাঁচটি বই লিখেছিল ফারাবী। প্রতিটি বই-ই ছিল প্রতিভা আর দীপ্রতায় উজ্জ্বল।”

জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

অশেষ ধন্যবাদ বাবুবাংলা। পরিশ্রম স্বীকার করে এই পোস্টটিকে সমৃদ্ধ করবার জন্য।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

সংসপ্তক এর ছবি

অসাধারণ লেখা। ওনার নামই কেবল জানা ছিল, পড়া হয় নি। আগ্রহ তৈরি করে দিলেন। ধন্যবাদ।
.........
আমাদের দূর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা

.........
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

নিবিড় এর ছবি

ধন্যবাদ লেখাটার জন্য। ফারাবীর নামটা জানা ছিল না। লেখার প্রেক্ষিতে আগ্রহ জন্মাচ্ছে। আশা করি এক সময় সুযোগমত বাংলা একাডেমী থেকে বইটা কিনে ফেলব।


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ধন্যবাদ অনেক।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

স্মরণ করলাম।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।