ভগ্নদৃশ্যে

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি
লিখেছেন অনিন্দ্য রহমান (তারিখ: বুধ, ১৩/০৪/২০১১ - ২:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

যেসময় চলে গেছে, যেভাবে গেছে তার নাম ভ্রমণ, কাহিনী তাতে সবসময় থাকে না। দৃশ্য থাকে। আধুনিক কবিগন দৃশ্যপিড়ীত ছিলেন খুব, জীবনানন্দ দেখেছেন কেবলই দৃশ্যের জন্ম, আর এলিয়টের মানুষ — তাদের ছেলেময়েরা, বলতে পারে না কিছু, এমনকী আন্দাজেও না — তারা দেখেছে কেবলই ভগ্নদৃশ্যের স্তূপ, হিপ অফ ব্রোকেন ইমেজেস। জীবনানন্দ, এলিয়ট ইত্যাদি নাম আরো কিছু দৃশ্যের মতোই, আজ এর বেশি কিছু নয় আমার অনেক অনেক সামান্য ভ্রমণের মতন। তারই একটা চৈত্রের দশদিন হাতে রেখে যাওয়া, দূর্গাপুর, জেলা নেত্রকোনা - বিরিশিরি নামে অধিক বিজ্ঞাপিত।

সেখানে চিনামাটির পাহাড়ের প্রচুর নাম শুনা যায়, এই পাহাড়ের শ্রেণী টেনে আনে ব্যপক মানুষ, আমাদের মতো। আমাদের রিকশাঅলা দেখায় ঐ যে কোহিনূর। কোহিনূর তার মতে একটা টিলার নাম। টিলাটার গায়ে কিছুটা লালরং ঠিকরায়, ঝিমধরা দুপুরের অনিচ্ছুক রোদে। কোহিনূর কেমিকেল ওয়ার্কস একদা এখানে খননের কাজ শুরু করেছিল। এখন আরো কম্পানি আছে। নয় বর্গ কিলোমিটার মেপে এইসব টিলা, তার কোথাও কোথাও পানি জমা থাকে, আকাশ নীল বলে নীলপানি নাম দেয়া হয়। এতে ছায়া ফেলে সম্ভাব্য তৈজসের অনুচ্চ পাহাড়।

একদিন এখানেই সিনামার দল এসেছিল। সেই বড় দিনে পনের হাজার লোক জড়ো হয়, সকলের মনে আছে। শা এসে নেচে গেছে, গর্বের বিষয়। আরো ছিল ভিলিয়ং কা। রিকশাঅলা জানায় শুটিংদলের সেবায় ছিলো সাতটা গারো মেয়ে। গারোদের গারো বলা যদিও মানা, সে জানায় - এনজিওর নিষেধ। তাদের টিলায় রাবার কমলা ফলে, সেদিকে যাই নাই। ইদানীং তাদের ইতিহাস অর্থকরী হয়।

রিকশাঅলার নাম জানা হয় নাই দুঃখের বিষয়। তবে সে ই’র নাম শুনেছে। ‘বিশ্বের মধ্যে সুদখোরে জয়লাভ’, তার ভাষ্যে ই-ই করেছে। এছাড়াও দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ ই তাদের এলাকায় আছে। পঞ্চাশ হাজার টাকা দেনা নিয়ে নামহীন রিকশঅলা তার পালিয়ে থাকার গল্প বলে। কাছেই বহেরাতলী গ্রামে কংক্রিটের তীরধনুক হাজং বিদ্রোহের স্মৃতি ধরে রাখে। ধান ফলুক না ফলুক খাজনার কাল, সর্বত্র থাকে।

বিরিশিরির সৌন্দর্য নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক। শ্যামগঞ্জ বিরিশিরি দূর্গাপুর সুসং — ছত্রিশ কিলোমিটারের জঘন্য রাস্তা নিয়েও লিখেছেন অনেকে। অথচ লেখা হয় নাই সুসং দূর্গাপুর বিরিশিরি শ্যামগঞ্জের রাস্তা নিয়ে। সেপথেও একই বারোটা সেতু। তাদের কিছু হাওয়া, আর কিছু অকালমৃত। আমি চৈত্রের দশদিন হাতে, সোমেশ্বরীর জ্বলন্ত বুকে কয়লা খুঁজতে দেখি গারো মেয়েটাকে। তার জন্য ঐ পথ অগম্য। সে আমার দিকে, আমাদের দিকে অতএব কদাপি আসে নাই। আমাদের হারমাছি ভাই বলে বাংলাদেশের নাকি চল্লিশ কোটি জনসংখ্যা! কেউ ভালো করে গুনেই না। আমি একজনকে গুনেছি আমার সামান্য ভ্রমণে।


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এতে ছায়া ফেলে সম্ভাব্য তৈজসের অনুচ্চ পাহাড়।

চমৎকার বর্ণনা!

ইদানীং তাদের ইতিহাস অর্থকরী হয়।

ইতিহাস সব কালেই অর্থকরী ফসল। তাই সাহেবরা সারা দুনিয়ার ইতিহাস চাষ করে গেছে। নতুন করে কেউ চাষ করতে গেলেও সাহেবদের কাছ থেকেই বীজ ধার করতে হয়।

ধান ফলুক না ফলুক খাজনার কাল, সর্বত্র থাকে।

চৈত্র মাসে কেউ পালিয়ে গেলে খাজনা আদায় হবে কীভাবে? তাই তো সাত দিন পর পর খাজনা আদায় করা হয়। নয়তো গরিবীকে কোথায় যেনো পাঠানো হবে সেখানে যাওয়ার ভাড়াটা মিলবে কী করে?

আমি চৈত্রের দশদিন হাতে, সোমেশ্বরীর জ্বলন্ত বুকে কয়লা খুঁজতে দেখি গারো মেয়েটাকে। তার জন্য ঐ পথ অগম্য। সে আমার দিকে, আমাদের দিকে অতএব কদাপি আসে নাই। আমাদের হারমাছি ভাই বলে বাংলাদেশের নাকি চল্লিশ কোটি জনসংখ্যা! কেউ ভালো করে গুনেই না। আমি একজনকে গুনেছি আমার সামান্য ভ্রমণে।

এইটুকুই একটা গোটা গল্প। বাংলাদেশের জনসংখ্যা সরকার যতোটা বলে সেটা কেউই বিশ্বাস করে না। গোটা ভ্রমণে বেশ লাভ হয়েছে দেখছি। কতো কিছু দেখা হয়েছে, কতো কিছু শেখা হয়েছে, সাথে একটা মানুষও গোনা হয়েছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

গল্প পাইলেন তাইলে?
এইরকম আরো একটা ভগ্নদৃশ্যে লিখতে পারি ...


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

অসাধারণ গদ্যালংকার।

আধুনিক কবিগন দৃশ্যপিড়ীত ছিলেন খুব, জীবনানন্দ দেখেছেন কেবলই দৃশ্যের জন্ম, আর এলিয়টের মানুষ — তাদের ছেলেময়েরা, বলতে পারে না কিছু, এমনকী আন্দাজেও না — তারা দেখেছে কেবলই ভগ্নদৃশ্যের স্তূপ, হিপ অফ ব্রোকেন ইমেজেস। জীবনানন্দ, এলিয়ট ইত্যাদি নাম আরো কিছু দৃশ্যের মতোই, আজ এর বেশি কিছু নয় আমার অনেক অনেক সামান্য ভ্রমণের মতন।

ইমেজিসমের প্রতিভূ হিসেবে এলিয়ট নন, বোধকরি এজরা পাউণ্ডই বেশী স্বীকৃত ও আলোচিত। মনে পড়ে তাঁর সেই বিখ্যাত চতুর্দশশব্দী,

IN A STATION OF THE METRO
The apparition of these faces in the crowd :
Petals on a wet, black bough.

'চিত্ররূপময়' জীবনানন্দের পাশাপাশি এজরা পাউণ্ডের নামটি এলো না কেন বুঝলাম না। এলিয়টের 'পোড়ো জমির' উপজীব্য ভিন্নতর।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

এলিয়টের মানুষ = এলিয়ট না

Son of man,
You cannot say, or guess, for you know only
A heap of broken images ...

'আধুনিক' মানুষের সংকট ... সে কাহিনী তৈরি করতে পারে না। একই কবিতার শেষে দেখেন

These fragments I have shored against my ruins

অন্যদিকে জীবনানন্দের মানুষ কতকটা জীবনানন্দ নিজেই ... আমার ধারণা।

'আমি' তারে পারি না এড়াতে

ইমেজিসম নিয়া আপনার ধারণা সঠিক, এবং আমার এই লেখার আওতার বাইরে দিয়া গেছে ধারণা করি।

পাঠ ও উদার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। অলঙ্কার খুইলা গদ্য লিখতে পারে আরো ভাল্লাগতো মনে হয় হাসি


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

'Son of man' কিন্তু এলিয়টের মানুষ নয়। এলিয়ট এখানে বোধকরি ওল্ড টেষ্টামেণ্ট থেকে রূপক আহরণ করেছেন। স্বর্গচ্যুত আদমসন্তান -- গূঢ়ার্থে ষীশুকেই বুঝিয়েছেন, বোধকরি। তেমনি 'A heap of broken images' ও বাইবেল থেকে আহরিত। কিভাবে পরিত্যক্ত হবে নগরের পর নগর, ছুঁড়ে ফেলা হবে সুউচ্চ স্থানগুলি, ধ্বংস হবে সবকিছু। এখানে উচ্চারিত পৌত্তলিকদের প্রতি ঈশ্বরের কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী। এলিয়ট মনে করেন, 'আধুনিক' মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস হারিয়েছে, সে শুধু চেনে ভঙ্গুর প্রতিচ্ছবির তলদেশ। স্মৃতির খড়কুটো সম্বল করেই যে তাঁর পতনোন্মুখ অস্তিত্বের সংকট কাটিয়ে উঠবার ক্ষীণ চেষ্টা, শেষ লাইনে বোধকরি তাই বিধৃত হয়েছে। এই ভেবে বিস্মিত হই, কিভাবে প্রাচীন গ্রন্থ থেকে মিথ আহরণ করেও ক্লাসিসিজম থেকে যত্নে দূরে সরে থাকা যায়। কাহিনী তৈরি করতে না পারাটা কিন্তু ইমেজিসম কিম্বা স্যুরিয়ালিজম নয় (জীবনানন্দে ব্যাপ্ত) বরং কালো সূর্যের নিচে নিদারুণ নাস্তি ও নৈরাশ্যের বহ্নুৎসব (সুধীন্দ্রনাথে ব্যাপ্ত)। কবুল করি, সেই মতো ভাবেন নি আপনি কিম্বা সেটিও আপনার রচনার ভাব-বহির্ভুত।

জীবনানন্দের বিষয়ে আপনার বিবেচনার সাথে আমি সহমত। তবে জীবনানন্দও কিন্তু কখনো কখনো 'মুদ্রাদোষ' বিস্মৃত হয়ে নিজের 'আমি' থেকে বেরিয়ে এসেছেন। উদাহরণ দুষ্প্রাপ্য হলেও একেবারেই যে নেই তা নয়।

হ্যাঁ, কবুল করি ইমেজিসম আপনার লেখার উপজীব্য নয়।

গদ্যে অলঙ্কার আসুক ক্ষতি নেই, কিন্তু তা হতে হবে সরল ও সৌন্দর্যমন্ডিত, দৃষ্টিনন্দন ও শ্রুতিমধুর। আপনার গদ্যে সেই ঘ্রাণ পাই।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

আবারো ধন্যবাদ। কাহিনী বনাম দৃশ্য না, পূর্ণ বনাম খণ্ডের কথা বুঝাইতে চাইছিলাম .... যাক আলোচনা অনেকদিকে চলে গেছে। ভালৈ হৈল ... আরেকদিন বিস্তারে হবে হাসি


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

রিকশাঅলার নাম জানা হয় নাই দুঃখের বিষয়। তবে সে ই’র নাম শুনেছে। ‘বিশ্বের মধ্যে সুদখোরে জয়লাভ’, তার ভাষ্যে ই-ই করেছে। এছাড়াও দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ ই তাদের এলাকায় আছে।

ধান ফলুক না ফলুক খাজনার কাল, সর্বত্র থাকে।

গুণী লুকদের নিয়ে মন্দ কথা বলে লাভটা কী? দেঁতো হাসি

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

মৌলিক লেখার ক্ষমতা হারিয়ে, ডিফেমেশনের মোকাদ্দমা করলুম দেঁতো হাসি


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

অসাধারণ!!!

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

এদ্দিন পরে কৈত্থুন দেঁতো হাসি


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

আরেহ বাহ! আগে পড়া হয়েছিল না... শুরুতে একটু যেন কঠিন লাগছিলো, খিটমিটে সব কবি... কাব্য... বিরিশিরি আর সোমেশ্বরী কই... তারপর শেষের লাইনটা সব ভুলিয়ে দিল! তুমি সত্যি একটা দু'টো লাইনে যত বলতে পারো... মাঝে মাঝে সেই ক্ষমতাটা দেখে খুব হিংসা হয়!

আসলেই সুসং - দূর্গাপুর - বিরিশিরি নিয়ে আলাপ পাই না... আমার নিজেরও তো যাওয়া হয় নাই... রাস্তা এতই খারাপ আবার যাবো ভাবলেও যেতে ভয় হয়... কিন্তু যাবো হয়তো... যাবোই, দেখি... আচ্ছা, গারো-দেরকে গারো বলতে মানা কেন?

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

গারোদের আদিবাসী বললে এনজিও ব্যবসা ভাল হয়।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।