গোগলের ওভারকোট পড়ার পরই আমার আলি মনসুরের কথা মনে হল। সেই গল্পের প্রসিদ্ধ কেরানি, যে মরে গিয়ে উন্মাদ ভুত হয়ে যায়, অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়, তার সাথে মনসুরের মিল আছে যৎকিঞ্চিৎ। প্রথমে যদিও গোগলের ওভারকোটটাই উল্টা করে লিখে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কিন্তু পরে মনে পড়ল আলি মনসুরের গল্পটাও অনেকদিন লেখা হচ্ছে না।
... সারা রাত কাশার পর, আলি মনসুর একটা ছাতা নিয়ে বের হয়। সকাল সাড়ে নয়টা। লেভেল ক্রসিং পর্যন্ত যেতে তিন মিনিট লাগতে পারে বেশি হলে। রেলটা আসবে দশটায় - রেলের টাইমে। সুতরাং সময় আছে। সে সুবল বা সুবলের ছেলের দোকানে কিছুক্ষণ জিরানোর সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও এই নিয়ে ভাবার সময় এখন না, তবু সে মনে করার চেষ্টা করে, সুবল আসলে কার নাম। বাপের না ছেলের?
এ বিষয়ে আমি যতদূর জানি, সুবল আসলে বাপের নাম। সুবল, আলি মনসুর, মির কাশেম, শংকর - এরা সবাই রেলে কাজ করত বছর দশেক আগেও। গণছাঁটাইয়ের পর সুবল কিছুদিন ওয়েল্ডিং মিস্ত্রির কাজ করে মারা যায়। সুবলের ছেলেটা অনেক দিন নেশাটেশা করে আকাজে পড়ে ছিল। এখন কীভাবে জানি ঠিকঠাক হয়ে গেছে। মির কাশেম আর শংকর ফুলটাইম চাকরি-ফেরতের আন্দোলন করেছে। করেছে মানে এখনো করছে। আশার কথা, ফেরত নেয়ার একটা আশ্বাসও দিয়েছে সরকার। সেইসাথে বলেছে বয়স ৫৭ হয়ে গেলে আর কোনো ফেরতটেরত নাই। আর আলি মনসুর, বছরের পর বছর চাকরি ফেরতের আন্দোলন করতে করতে নিজের বয়সটাও কোন ফাঁকে ৬০ হয়ে গেছে, টেরও পায় নাই।
লাভের লাভ গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের টাকাটা সে তার ছেলেকে দিয়েছিল। ছেলেটা কোরিয়া গিয়ে একটা ফুটা পয়সাও পাঠাতে পারে নাই। আর সে মেয়ের বাড়িতে থেকে কাশির ওষুধটাও পায় না। তাই সুবল বা সুবলের বাপ, কেউ একজন তাকে আদা চা বানিয়ে দেয়। আলি মনসুর ঘড়ি দেখে - দশটা বাজার দশ মিনিট বাকি।
কাকু খালি টাইম দেখেন কেস কি? সে বিড়বিড় করে বলে, তোর বাপেরে মারুম, হের লাইগা দেহি। তোর বাপেরে মাইরা তোর মায়েরে বিয়া করুম। সুবল বা সুবলের ছেলে হাসে। আলি মনসুরের মাথার ইস্ক্রুপ নাই। অথচ সে তার বাপের কাছে শুনেছে এই লোকের বক্তিমা শুনতে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ত এককালে।
ভাইয়েরা, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কথা শুইনা সরকার আমাদের চাকরি খাইছে। আমাদের বাচ্চারা স্কুলে যাইতে পারে না। আমাদের কোয়ার্টারে থাকতে দেয় না। বলে টাকা দিছি তো। আমরা কি টাকা চাইছি! বলেন, টাকা চাইছি আমরা? চাই নাই। তোমরা আমাদের চাকরি খাইছ। আমরা একদিন সরকার, এডিবি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, সব খায়া ফেলব। সাম্রাজ্যবাদীরা সাবধান! পাব্লিক যেইদিন খাওয়া শুরু করবে, কেউ বাঁচবা না। দুনিয়ার মজদুর ... বাকিরা তখন বলত, এক হও, লড়াই কর। ল-ড়া-ই কর! আবার কাশির দমক ওঠে। কাকু ডাইল খাইবা নাকি? ডাইল খায়া ঘুম দাও। সুবলের ছেলের হাসতে হাসতে চোখ ছোট হয়ে যায়। ডাইল তোর মারে ... আলি মনসুর কখনোই বাকিটা শেষ করতে পারে না। লেভেল ক্রসিংয়ের কিরররররররররররররররররর শব্দটা কানে আসে। সময় নাই।
আলি মনসুর ছাতা বগলে নিয়ে সোজা হাঁটা দেয়। দশটা বারো মিনিটে, দক্ষিণের দিক থেকে ট্রেনটা উঁকি দেয়। যাক দেরি হয় নাই। কুঁজা হয়ে ক্রসিংয়ের বারটা পার হয় আলি মনসুর। আশেপাশে কাউকে দেখে না। একটু দূরে একটা মহিলাকে কাপড় কাচতে থাকে। রেল লাইনের ১০ ফুটের মধ্যে কোনো স্থাপনা বা মালামাল থাকার নিয়ম নাই। অন্যসময় আলি মনসুর বিরক্ত হয় এইসব দেখে। কিন্তু এখন তার মনোযোগ ঐ ট্রেনটার দিকে।
ঠিক দশটা তের মিনিট, বা তার দশ বারো সেকেন্ড আগে, আলি মনসুরকে পার হয়ে চলে যায় বলাকা কমিউটার। গোটা দশেক টয়োটা গাড়ি আর বিশ-পঁচিশটা রিকশা ঠায় দাঁড়ান তখনো। গাড়িঅলারা অল্পতেই অস্থির হয়ে যায়। হর্ন চাপাচাপি শুরু করে দেয়। কিন্তু লাভ কি।
এই দৃশ্য দেখে, আলি মনসুর ছাতাটা মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে ফেরত আসে। আর সুবল বা সুবলের ছেলে এরকম দেখলেই বুঝতে পারে কাকুর মনটা আপাতত ভাল। প্রতিদিনের রুটিন।
রেল যখন যায়, তখন আজও এই শহরে সবাইকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়।
---
আমাদের গাড়ির ইতিহাস নামে আরেকটা গল্প লিখছিলাম আগে।
মন্তব্য
ভালো পাইলাম।
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
অনিন্দ্য'র গল্প লেখার ক্ষমতা ঈর্ষনীয়, কিন্তু বুঝতে পারলাম না যে!
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্প নিয়া আবজাব ...
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ভালো লাগলো
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
গোগলের ওভারকোট নাকি শহীদুল জহিরের সাফারি স্যুট? - এই প্রশ্নটা পাঠকের মাথায় আসতেই পারে। তাতে ক্ষতি নেই। লেখক গাছ থেকে পড়ে না, মাটি থেকে রস নিয়েই গাছের মতো মাথা তুলে দাঁড়ায়। এই পর্যন্ত বলে থেমে গেলে লেখকের প্রতি অন্যায় করা হয় - কারণ, শেষের তিনটা অনুচ্ছেদ। সেখানে পাঠক ওভারকোট বেছে নিলে এক পরিণতিতে যাবে আর সাফারি স্যুট বেছে নিলে আরেক পরিণতিতে যাবে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি অনিন্দ্যের ফতুয়া বা টী-শার্ট বেছে নিতে পছন্দ করি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সাফারি স্যুট আমি জীবনেও পড়ি নাই
ওভারকোটের অভিজ্ঞতাও সামান্য ... গল্পটা মাথা থাইকা নামায়া দেয়াটাই জরুরি মনে হইছে
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
শুরুতে একটা দুর্ঘটনার আশংকা করেছিলাম গল্পের শেষদিকে। পাঠকের আশংকা মিথ্যা প্রমাণিত করার কৃতিত্ব অনায়াসে আপনার। ভাল লাগলো গল্পটা।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
সাব্লাইমৈছে।
কৈছে আপ্নেরে ...
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
কুটিরশিল্পের ইতিহাস পড়ছিলাম দাঁড়িবিহীন
রেলগাড়ির ইতিহাসে এসে দাঁড়িয়ে গেলাম
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
খাড়াও পথিক, তিষ্ঠ ক্ষণকাল
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
এই গ্ল্পটা একটু আগে অনেক বার পড়া ধরনের মনে হলো।
অনিন্দ্য এর থেকে অনেক ভালও লিখতে পারেন
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
এই ঘটনাগুলা অনেকবার ঘটে যে ...
আপনার সহৃদয় প্রশংসার জন্য কৃতজ্ঞতা
(এই গল্পটা সময় পাইলে আরেকবার লিখার চেষ্টা করব, এইখানে ভাষার দিকে ভাবি নাই তেমন একটা)
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
কিছু জায়গা ধরতে পারি নাই হয়তো, কিন্তু মূল সুরটা ভালো লাগলো।
কত চন্দ্রভুক অমাবস্যা পেরিয়ে গেল ছ ত্ব বিধানের পরবর্তী পর্ব আর এলো না।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
ফাহিম, ছত্ববিধানের কথা মনে করানোর জন্য ধন্যবাদ। আমি কিছুদূর লিখছি, কিন্তু ভাবনাচিন্তা বাকি আছে আরেকটু। গল্পপাঠ ও মন্তব্যের জন্যও ধন্যবাদ।
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
(সংক্ষিপ্ত) মন্তব্যে ধন্যবাদ ...
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
নতুন মন্তব্য করুন