ব্লগরব্লগর

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি
লিখেছেন অনিন্দ্য রহমান (তারিখ: বুধ, ৩০/১১/২০১১ - ৯:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একদা ব্লগরব্লগর ছিল শৈশবের কালে। সে-সবই 'পয়েন্টলেস' ছিল। ইঁচড়ে পাকামি আমার আশৈশব পেশা। এবং এখন আর, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বাজে বকার অবসর নাই। অতএব যখন বন্ধুরা তাগাদা দেয়, শুভাশীষ, আনন্দী, 'লেখো না', আমি মূলত কিছুই লিখতে পারি না। আমার কখনো কখনো কিছুই বলার থাকে না যা অন্যের সামান্য হলেও জানা প্রয়োজন।

তারপরও স্রেফ নিজের জন্য লেখা, নির্লজ্জতার সীমানা ডিঙিয়ে, অন্যের কাছে জমা দেয়া, কেন? দেখ, তুমি, বা অন্য কেউ, এইসব পড়ছো এখন। কেন তোমাদের যন্ত্রণা দিই? এ এমন পরিস্থিতি, এমনই হাল, অন্যের সময়ে কামড় দিয়ে বড়ো আমোদ পাই। প্রায়শই আমি কেবল তোমাদের সময় খেয়ে, বেচেবর্তে থাকি। বাজে বকে বকে।

পয়েন্টলেস বকে যাই। আসলে কি আমার কোনো পয়েন্ট আছে? পয়েন্ট, বিন্দু। জ্যামিতির ন্যূনতম ধারণায় জানি, বিন্দুর দৈর্ঘ্য প্রস্থ থাকে না, অবস্থান থাকে। <-- এই কথা ঐতিহাসিক ক্লিশে আজ। তদুপরি, সে কেবলই 'থাকে'। আর দেখ এইভাবে আমি শব্দের সুরঙ্গে নেমে যাই। যখন আমার কোনো পয়েন্ট থাকে না।

একটা একটা শব্দ, একটা একটা ক্যাথলিক গির্জার মতন। শব্দের কাছে স্বীকারোক্তি দেয়ার ভান করে করে, আমি তার সাথে আলাপ করি। এমন অনেক হয়েছে। আমি কিছু বলতে না পেরে, শব্দের ভিতরে আশ্রয় নিয়েছি। খুলে খুলে দেখেছি তার ব্যুৎপত্তি। ব্যবহারিক ইতিহাস। কখনো কখনো অক্ষর ভেঙে দেখেছি প্রাচীন লিপিকারদের শিল্পকলা। শিলালিপিপাঠ অর্থের কাছে যেতে দেয় না। বলে দেয় না, কোন দিকে যেতে হবে শীতার্ত সকালে।

মাঝে মাঝে মনে হয় হাতে লিখি। 'হাতে লিখি'! যেন আমার আঙ্গুল যখন কিবোর্ডের উপর কম্পমান, সেটা আমার হাতের অংশ নয়। যেন হাতের লেখা আসলে হাতেরই লেখা নয়। হাতের লেখা মানে 'পেন্সিলে', 'কলমে', 'কাগজে' লেখা। 'হাতে' লেখা নয়। ইত্যাদি ভাবি।

অথবা হাতের লেখা, এই মাত্র মনে হল, ব্যক্তির নিজস্ব লিপি। নিজস্ব অক্ষরের চেহারা। কোনো এক শিশুকালে, হয়তবা আব্বার, আম্মার, শিক্ষকের, হাতের লেখার বীভৎস অনুশীলকের অনুলিপি, একসময়, নিজস্ব হয়ে পড়ে। সেই থেকে হাতের লেখা হাতের লেখা হয়। পেন্সিলে, কলমে, কাগজে যাই লেখ না কেন, তোমার হাত তোমার চেহারাই এঁকে যায়।

অথচ আমার আঙ্গুল কিবোর্ডের উপর কম্পমান, দেখতে পাই, যদি কিবোর্ডটটা অদৃশ্য করে দাও, আমার আঙ্গুলগুলো গায়েবি বাতাসে হিংটিংছট করে যায়। সিয়াম রূপালিকে ধন্যবাদ জানাই। যদিও অংসখ্য লোক সিয়াম রূপালি অবিকল লেখে, যান্ত্রিক দক্ষতায়, আমিও আমার মতো, ভেবে নেই, এই লিপিমুখ আমারও নিজস্ব। আধুনিক কালে। আধুনিক কালে আমাদের পছন্দ করার, বেছে নেয়ার অমূল্য অধিকার। নিরূপায় নিজস্বতা, যা কিনা আমাদের বেছে নেয়া না নেয়ার অতীত, গায়ের রঙের মতো, স্বাভাবিক সম্পত্তি, তাকে বাদ দিতে হয়।

কখনো ভেবেছি এই যে লেখা, আমাকে দারুণ শান্তি দেয়। যাই লিখি না কেন। যখন আমার বলার কিছু থাকে না, তখনও আমি লিখে যাই। মানুষ তার নিজের চেহারায়, চোখে, মুখে, চুলে প্রায়শই হাত বুলায়। কখনো কপালে নিজের জ্বর দেখি। কখনো চিবুকে করতল ঠেকিয়ে ভাবি জগতের শতেক সমস্যা। লেখাও তেমন এক নিজেকে 'ধরে দেখা'র আনন্দের মতো। কিন্তু সদাগরি অফিসের কারণিক, তার কি আনন্দ হয়। আমোদ? ফুর্তি? নাকি সে নিজেকে কদাচিৎ ধরে? বুর্জোয়া নিজেকে ধরে হাতসুখ পায়। শ্রমিকের কর্কশ কালো হাত অন্যকে, অন্যের পেলবতা আঁচড়ে দেয় সুযোগ পেলেই – একারণে তাদের চোখে চোখে রাখার নিয়ম।

বাজে বকতে বকতে ভাবি, বাক্যের অর্থহীনতা কতো অসাধারণ স্বস্তি দেয় আমাকে, এই মুহূর্তগুলোয়। মাঝে মাঝে বাক্য কেবল একটা চিত্রকল্পের মতো স্মৃতিতে সজ্জিত থাকে। থাকুক। অর্থ তার গভীর সংকট নিয়ে হাজির হয় না। আজকে সকালে বিছানায় শুয়ে ভাবছিলাম, চিত্রকল্পের মতো বাক্য, নকশী কাঁথার গরুগাড়ির মতো, ভেঙে ভেঙে কী দারুণ ভাঁজ হয়ে যায়।

বহুদিন আগে, সেটাও আজ আবার মনে পড়ল পরিষ্কার, বাংলা মটরের মোড়ে মিশুকের পেছনে লেখা ছিল, স্বর্গের বাগানে প্রবেশ করবে সেই যার অন্তর পবিত্র। 'পবিত্রতা'র বিবিধ স্ববিরুদ্ধ অর্থ ভাবতে পারি না। বন্ধুরা, বাজে বকবকের ভিতরে, আরো অনেক বিভ্রান্ত পার্শ্বভাবনার সাথে আজকে ভেবেছি, স্বর্গের বাগান প্রকৃতই দেখতে কেমন।


মন্তব্য

উচ্ছলা এর ছবি

মন খারাপ?... নেন গান শোনেন-

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

রবির্দ্রনাথের এই স্কটিশ গানটা আমি বড় ভালু পাই। গুরুদেবের স্কচপ্রীতি ছিল।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

গুরুদেবের স্কচপ্রীতি ছিল।

হো হো হো

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

কাউকে কিছু বলার নেই আর। জানানোর নেই। শুধু নিজের জন্য লেখার একটা অকপট পবিত্র আনন্দ আছে।

আবার অন্যের জন্য লিখলে, শব্দের ভাণ-ভণিতা, অর্থ ইত্যাদি নিয়ে খেলাধুলাটা বেশি হয়, তবে সেই লেখা বোধহয় স্বর্গে প্রবেশ করে না।

তোমার এই লেখাটা পড়ে মনে হইসে নিজের জন্য লেখা, ভোরবেলায় লেখা। আর মাঝে মাঝে "বাজে বকবক" করাটা খুব জরুরি বলে মনে হয়।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

অন্যের জন্য লিখলে, শব্দের ভাণ-ভণিতা, অর্থ ইত্যাদি নিয়ে খেলাধুলাটা বেশি হয়, তবে সেই লেখা বোধহয় স্বর্গে প্রবেশ করে না।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

সাফি এর ছবি

নিজের হাতের লেখাই তো ভুলে গেছি, চিন্তেও পারিনা

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

উমবার্তো ইকোর হাতের লেখা নিয়া একটা রচনা পড়ছিলাম। দি লস্ট আর্ট অফ হ্যান্ড রাইটিং। গার্ডিয়ান পত্রিকা সেইটা সরায় নিছে।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অন্যকেউ এর ছবি

দেখ, তুমি, বা অন্য কেউ, এইসব পড়ছো এখন।

হ্যাঁ, পড়ছিলাম তো। চোখ টিপি

_____________________________________________________________________

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

হাসি


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রশ্নটা যদি হয় - কার জন্য লিখব? তাহলে উত্তরটা অবশ্যই - নিজের জন্য লিখব। আমি তো রবিনসন ক্রুশো নই, তাই আমার লেখা (তা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ব্লগর ব্লগর যা-ই হোক) সমাজ বা মানুষকে সরিয়ে রেখে ইউনিক এক আমি'র জন্য কিছু হতে পারে না। নির্জন দ্বীপে থেকেও ক্রুশো সমাজচিন্তার বাইরে যেতে পারেননি। আর সেখানে আমি সমাজে বাস করে তার প্রভাবমুক্ত কী করে হই? রাবেয়া বসরী'র একটা কথা মনে পড়ে। "হে ঈশ্বর, আমি যদি স্বর্গের লোভে তোমার প্রার্থনা করি তাহলে সেই স্বর্গকে আগুনে জ্বালিয়ে দাও; আর যদি নরকের ভয়ে তোমার প্রার্থনা করি তাহলে সেই নরককে পানি দিয়ে নিভেয়ে দাও"। আমার ভাবনা'র প্রকাশ স্বর্গে যাবে নাকি নরকে যাবে সেটা নিয়ে ভাবার কী দরকার? আমি আছি তাই আমি ভাবি, আর আমার ভাবনার বহিঃপ্রকাশ আমার লেখা। সে লেখা কেউ পড়ুক বা না পড়ুক, কারো ভালো লাগুক বা না লাগুক আমাকে লিখতেই হবে। কারণ, আমি আমার কাছে দায়বদ্ধ - সমাজ বা ঈশ্বরের কাছে দায়বদ্ধতাকে আমি স্বীকার করি আর না-ই করি।

অটঃ যেটুকু সময়ের জন্য প্রবাস জীবন বেছে নিয়েছো সেটুকু সময় নষ্ট করার উপায় তো নেই। তাই দু'চোখ ভরে মানুষ দেখো, কান ভরে তাদের কথা শোনো। আর যেটুকু মনে ধরলো সেটুকু, বা যে নতুন ভাবনাটা মনে জাগলো সেটুকু লিখে ফেলো। দেশে ফিরে কী করতে হবে সেটা তো জানোই। তখন এই দেখা, শোনা, ভাবনা আর লেখাগুলোই কাজে লাগবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

অনেককটা একমত। কিন্তু আমার মনে হয়, নেসেসারি নার্সিসিজমটা পার হওয়াটাও দরকার মাঝে মাঝে। অন্তর্গত রক্তের খেলা জগতের সার নয়।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

দ্রোহী এর ছবি

কবিতা লিখতে গিয়ে গল্প লিখেছেন নাকি গল্প লিখতে গিয়ে কবিতা লিখেছেন ধরতে পারলাম না। মন খারাপ

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ইয়ে, মানে...


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আনমনা শৈল্পিক গদ্য

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ধন্যবাদ নীড় সন্ধানী।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

চিন্তিত
প্রেমে পড়লে এরকম লেখা বের হয়। অক্ষরের।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

আমি তো ভাবলাম এইটা ছ্যাকাটাইপ হইছে।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

রানা মেহের এর ছবি

বেশ একটা নারকোল নারকোল দেঁতো হাসি

(লেখা অনেক সুন্দর হয়েছে)

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ওঁয়া ওঁয়া


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

তিথীডোর এর ছবি

হয়তো পয়েন্টলেস, চোখ টিপি
তবে লেখাটা ভাল লেগেছে পড়ে।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ধন্যবাদ তিথী


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।