শেষবার ২ লাখ ডলার দাম উঠেছিল, কিন্তু মালটা ছিল আরও ছোট মিডিয়া হাউকাউ করছে ১ মিলিয়ন ১ মিলিয়ন বলে ১ মিলিয়ন না হোক, ২ লাখ ডলারও স্বপ্নে দেখা মুশকিল ১৬টা হান আমলে মটকা রাখা ছিল উদাম গুটিগুটি পায়ে এসে জনৈক দর্শনার্থী একটা তুলে নিল, আছাড় মারল, মাটির জিনিস, তাও ২ হাজার বছরের পুরাতন, চুরচুর হয়ে গেল
ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখের কাহিনী এটা মায়ামির পেরেজ গ্যালারিতে বিশ্ববিদিত চাইনিজ শিল্পি আই ওয়ে ওয়ের অমূল্য শিল্পকর্ম - হান মটকাগুলি যার অংশ - ভেঙে ফেললেন জনৈক ক্যামিনেরো আন্তর্জাতিক মানের হুলস্থুল পড়ে গেল
এক জায়গায় জানা গেল ক্যামিনেরো পুলিশকে বলেছেন তাঁর মতো 'স্থানীয় শিল্পী'দের গ্যালারিঅলারা পাত্তা দেয় না বলে এই প্রতিবাদ আই ওয়ে ওয়ে, যিনি বি-শা-ল প্রতিবাদী হিসেবে মশহুর, বলছেন 'ব্যক্তিগত সম্পত্তির' ওপর এহেন আঘাত এবং 'পাবলিক প্লেইসে' এহেন উপদ্রব অগ্রহণযোগ্য ভাবনার খোরাক আছে এই বক্তব্যে
কর্মসম্পাদনের পরে ক্যামিনেরোও ক্ষমা চেয়েছেন তিনি বুঝতে পারেন নাই মটকাগুলির এতো দাম তবে এমন ঘটনার উস্কানি নাকি ওয়ে ওয়েই দিয়েছেন!
মটকাগুলির 'আসল' দাম বুঝতে পারা কঠিন কারণ ওয়ে ওয়ে ঐ হান আমলের নাম-না-জানা কোনো শিল্পীর হাতে গড়া দুষ্প্রাপ্য মটকাগুলিকে আজেবাজে প্লাস্টিক পেইন্টে চুবিয়েছেন, সবই ক্যাটক্যাটা রংয়ের এবং সবই 'শিল্পের স্বার্থে' তার পেছনেই আবার টানিয়েছেন নিজের ৩টা ছবি, যেগুলিতে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে ঐরকমই একটা মটকা আছাড় মারছেন, ভাঙছেন ওয়ে ওয়ে সুতরাং উস্কানির অভিযোগটাও একেবারে ফেলনা না
বহুমূল্য পুরাতন জিনিসপাতি ভেঙেচুরে শিল্পকর্ম অনেকই করেছেন ওয়ে ওয়ে অতএব 'অ্যান্টিক' জিনিস ধ্বংস করার দায়, ওয়ে ওয়েকে বাঁচিয়ে কেবল ক্যামিনেরোর ঘাড়ে ফেলাটা অসঙ্গত অতীতে মিং সাম্রাজ্যের কারুকার্যশোভিত আসবাব কুপিয়ে ওয়ে ওয়েকে শিল্পকলা করতে দেখা গেছে
টাকায় কেনা, যা খুশি তাই করবেন মটকা ওয়ে ওয়ের, ক্যামিনেরোর না, সরল সত্য এ-ই এর আগে স্যালভিসবার্গ নামে এক সুইস শিল্পী পয়সা দিয়ে কিনে ওয়ে ওয়ের 'কোকাকোলা আর্ন' নামের একটা মটকা ভাঙেন সেক্ষেত্রে মটকা ছিল স্যালভিসবার্গের, ওয়ে ওয়ের না
ওয়ে ওয়ে সুপ্রাচীন ঐ মৃত্পাত্রের গায়ে কোকাকোলার লোগো এঁকে দিয়েছিলেন
***
মায়ামির এই ঘটনায় ওয়ে ওয়ে সম্পর্কে আরেকবার নাড়াচাড়া হল দুয়েকবছর আগেও তাঁকে গিমিকসর্বস্ব ভেবেছি কিন্তু এখনকার দুনিয়ার বড়বড় আর্টিস্ট - ডেমিয়েন হার্স্ট কি আনিশ কাপুর, গিমিকপনার দুর্নাম কার নাই?
তার মধ্যেও ওয়ে ওয়ে বিরল কেউ কেউ টিপ্পনী কেটে বলেছেন ওয়ে ওয়ে 'আর্ট-কালচারের' অং সান সুচি চাইনিজ সরকার তাকে অন্তরীণ করে রাখে, ওয়েব সাইট ব্লক মেরে দেয়, পুলিশ দিয়ে পিটায়, আবার বেইজিং অলিম্পিক স্টেডিয়ামের নকশা করতে তাকে ডাকে স্থাপত্যকলায় কোনো ডিগ্রি ছাড়াই তিনি পাখির নীড়ের মতো একটা স্টেডিয়াম ছক কেটে দেন
বামবাদীরা ওয়ে ওয়েকে বাঁকা চোখে দেখতে পারেন 'সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিম খামাখা তাকে কোলে তুলে নিয়েছে? না কখনো নেয় কাউকে?' ঝানু প্রতিবাদব্যবসায়ীরা মনে করতে পারেন ওয়ে ওয়ের প্রতিবাদ মিনমিনে; খুব বেশি জোরালো হলে কি আর তিনি চাইনিজ সরকারের আঙুলের ফাঁক গলে বিচ্ছুরিত হতেন? কর-ফাঁকির মামলায় ফেঁসে যাওয়া ওয়ে ওয়ের বিবিধ মোনাফেকি নিয়ে কানাঘুঁষা আছে কিন্তু কে কী ভাবল বা বলল তাতে ওয়ে ওয়ের বিড়ালেরও কিচ্ছু যায় আসে না 'ব্যক্তিগত সম্পত্তি' মার্কা বাম-ট্যাবু উচ্চারণেও তার আপত্তি নাই তাঁর প্রচুর পয়সা লাগে শিল্পটিল্প করতেই লাগে তাছাড়া তিনি বিড়াল পালেন
আর্টিস্টের উদ্দেশ্য, ওয়ে ওয়ে বলেন, 'পরিস্কার করে বলা, আমি লোকটা কে' ওয়ে ওয়ে পারেন কিনা সেটা আলাদা প্রশ্ন, কিন্তু তিনি - তার যাবতীয় কাজকর্মে - তিনিই, আর কেউ না
ওয়ে ওয়ের বাবা আই চিঙ ছিলেন মানী কবি, কমুনিস্ট পার্টির সভ্য কিন্তু ভুল করেছিলেন 'বাগানীর স্বপ্ন' বলে একটা কবিতা লিখে একজন তার বাগানে কেবল গোলাপ ফোটায় স্বপ্ন দেখে অন্য ফুলেরা বলছে তাদের অভিমানের কথা বাগানী ভাবে সে কতটা সংকীর্ণ চেয়ারম্যান মাও ও তার লোকেরা বুঝলেন চিঙকে সপরিবারে গোবি মরুভূমি পাঠিয়ে দিতে হবে ২০ বছর কলমে হাত দেন নাই চিঙ, গণশৌচাগার পরিস্কার করেছেন সেইসব দিনে মাটি পুড়িয়ে ইট বানানো শিখে যায় ওয়ে ওয়ে
***
২০০৮ এর সিচুয়ান প্রদেশের ভয়াবহ ভূমিকম্পে ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে অনেক এলাকায় দেখা যায় অন্য অনেক কিছু দাঁড়িয়ে থাকলেও যেনতেনভাবে তৈরি স্কুল ঘরগুলি মাটিতে মিশে গেছে যে ৫ হাজার শিশু মারা যায় তার একটা তালিকা পর্যন্ত হতে দেয় না সরকার ওয়ে ওয়ে প্রত্যেক অভিভাবকের সাথে কথা বলে তালিকা করতে লেগে যান ধ্বংসস্তুপ থেকে কুড়িয়ে আনেন দুমড়েমুচড়ে যাওয়া রড তারপর সংগ্রহ করা রডগুলির প্রত্যেকটাকে সোজা করেন একটার ওপর একটা রেখে স্তুপ করেন এই স্তুপই তার শিল্পকর্ম নাম 'স্ট্রেইট' - সিধা শিশুহন্তারক সভ্যতায় কারও মেরুদন্ড সিধা নাই শিল্পকলার 'অজুহাতে' ওয়ে ওয়ে কতগুলি সমান করা রড রেখে আসেন বিশ্বের তাবত্ বনেদী গ্যালারিতে
ফের মটকার প্রসঙ্গ ওয়ে ওয়ে বলছেন পুরাতনকে ভাঙা সহজ না খুব ভালোভাবে জেনে তবেই ভাঙা যায় তাই বলে হান আমলের মৃত্পাত্র! অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও? আর সেগুলোর গায়ে অদ্ভুত প্লাস্টিক পেইন্ট ঢেলে দেওয়াও শিল্প? তবে মাওয়ের কালচারাল রেভুলুশন কী দোষ করল? তিনি শ্রেণীহীন সমাজের নতুন সংস্কৃতি গড়তে পুরাতন 'সামন্তবাদী' ঐতিহ্য ধ্বংসের হুকুম দেন নাই?
দিয়েছেন দিয়েছেন বলেই, পুরাতনের সঙ্গে অস্বাভাবিক এক সম্পর্কের জন্ম হয়েছে পুরাতনে অতিভক্তি (ফেটিশ?) তাকে আর ভালোভাবে জানতে দেয় নাই 'কালচারাল রেভুলুশনের' মতো 'বিকৃতি' পরম্পরার স্বাভাবিক গতিপথকে কোথায় নিয়ে গেছে ওয়ে ওয়ে সে বিকৃতি সংশোধন করে, অতীতের সাথে সরাসরি সম্পর্ক গড়েছেন মাওয়ের মার খেয়েছে বলে তাকে রেহাই দেন নাই আরেকটা ব্যাখ্যা হল পশ্চিম যেভাবে প্রাচ্যকে দেখে তাতে মনে হয় যেন প্রাচ্যের কোনো বর্তমান নাই, ভবিষ্যত্ নাই, কেবল একটা ধোঁয়াশাপূর্ণ অতীত আছে সেই 'অতীত'কে মাঝেমধ্যে আছড়ে না ফেললে 'অরিয়েন্টালিজমের' অবসান হবে না
পুনশ্চ:
ওয়ে ওয়ের মটকা ভাঙার ঘটনায় মনে হচ্ছে আইয়ুব খান রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বদমায়েশি না করলে, আমরাও ঠাকুরের সাথে সিধা খেলতে পারতুম
ছবি: উইকিমিডিয়া
মন্তব্য
ঘটনাটা খুবই ফানি। ক্যামিনেরো কামের কাম করছে।
এই সেই মায়ামী একজিবিশন:
মটকা ভাঙার ইন্সট্রাকশন তো সচিত্রই দেয়া আছে। আমিও ভাবতাম এগুলো বুঝি ভাঙার জন্যই রাখা আছে।
লেখা মজা লাগলো, ইচ্ছে হচ্ছে লেখাটাকেই হান আমলের মটকার ভেতর ঢুকিয়ে...
[মেঘলা মানুষ]
পড়তে খুবই ভালো লাগছিলো, আরো লম্বা করতে পারতে। লেখার এই ঢঙটা আমার পছন্দ, কিন্তু এই ঢঙে লিখতে পারিনা - অন্য কিছু হয়ে যায়। শেষের দুই প্যারাগ্রাফ আর পুনশ্চ নিয়ে সহমত বা দ্বিমত নয়, স্রেফ আলোচনা করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সারাদিন ধরে যা পরিশ্রম গেছে (এবং যাচ্ছে) তাতে আর লম্বা লম্বা কথা টাইপ করার ক্ষমতা নাই। একদিন আড্ডাতেই না হয় সারা যাবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এট্টুকই কত কষ্টে নামাইলাম ...
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
শালার মটকা, তার আবার এই দাম!
আমি একটা মটকা বানাইয়া কোন এক জায়গায় লুকায় তার লোকেশান নাতিপুতির হাতে দিতাম। তারপর হয়তো দুইশ বছর পর এইডার দাম, এক দুই হাজার হইবো। পুরাই তামশা।
অলস সময়
মাঝে মাঝে আফসোস হয়, কেন আমার দাদার দাদা একটা মটকা মাটির নিচে রেখে যান নাই
[মে মা]
কেন যেন ওয়ে ওয়ে কে কানে ধরে টেনে এক চড় লাগাতে ইচ্ছা করছে।
ওর মা যদি সময় থাকতেই এই চড়টা দিতেন, তাহলে আর আজ আমাদের এই দিন দেখতে হয় না।
তবে যা বুঝলাম, মিং মটকা ভাঙার পেছনে আসল কালপ্রিট চেয়ারম্যান মাও এর কবিতা-পিপাসু মন, আর ওয়ে ওয়ের বিলাই।
............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্ চিনে।
মাও আর ম্যাও
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
লেখার স্টাইলটা খুব ভাল লেগেছে। যেভাবে শুরু করেছিলেন, তাতে যে কেউ ভাববে, ওয়ে ওয়েকে উঠাবেন, কিন্তু পুরো লেখাটিতে তার যে অধোঃপতন ঘটল আপনার কাট কাট বাক্যগুলির হাতে, তা ভীষন ইন্টারেস্টিং ছিল।
আর শেষে যে ধাঁধা রেখে দিলেন, তাও পাঠককে মাথায় রেখে দিতে বাধ্য করল লেখাটা।
মটকা ভাঙ্গার কাহিনি মজাদার ছিল, তবে তার চাইতেও চমৎকৃত করেছে আপনার লেখার স্টাইল। তবে আফসোস কিন্তু রয়েই গেলঃ আপনি আগের মত আর লেখেন না! না জানি, কদ্দিন পরে আসবে পরের লেখা!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
ধন্যবাদ
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
বহুদিন পর আপনার লেখা পেলাম। আপনার লেখার ধরনটা আমারও ভালো লাগে। যদিও তুচ্ছ কারণে আপনার সাথে একবার লেগেছিল, তবে আপনার প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার কমতি ছিল না কখনও।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
ধন্যবাদ
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ওয়ে ওয়ে - ওয়াও! শিক্ষক ডট কম কোনদিন 'হাউ টু রাইট এ ব্লগ' টাইপ কোন কোর্স চালু করলে এ লেখাটি একটা উদাহরণ/ রেফারেন্স হয়ে থাকবে।
আপনার লেখা গল্প/ উপন্যাস (দুরাশা?!) পড়তে চাই।
দুরাশা
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
দারুন একটা লেখা। মটকার আড়ালে কত কিছু মটকা মেরে ছিল, জানতে পারলাম।
হায় মটকা !
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
মটকা ভাঙাভাঙিতে দুনিয়ার কতটুকু ক্ষয়ক্ষতি হলো তা জানা নেই।
তবে সচল পাঠকদের লাভ হলো অনেকদিন পর অনিন্দ্য ভাইয়ার চমৎকার লেখা পাওয়া গেলো!
আচ্ছা এসব মটকা/বা অন্যান্য কিছু তো প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ, যা রাস্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে থাকবার বিষয় ব্যক্তিগতভাবে কেউ চাইলেই কি তা রাখতে পারেন? এসব বিষয়ে একদম জানা নেই আসলে। 'দিরাশা' শব্দের মধ্যে কিন্তু মটকা মেরে থাকে আশা'ও।
তাই আশা রাখছি কিছুদিনের মধ্যেই আপনি গল্প লিখবেন সচলের জন্য। শুভকামনা থাকলো।
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
নতুন মন্তব্য করুন