এটা কী হল, বদরু ভাই?

আনিস মাহমুদ এর ছবি
লিখেছেন আনিস মাহমুদ (তারিখ: শনি, ১৩/১২/২০০৮ - ১:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনেক অনেক বছর পর আজ ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম। উপলক্ষটা ছিল একটা বিয়েতে হাজিরা দেওয়া। কিন্তু আমার উত্তেজনা ছিল বদরু ভাইয়ের সাথে দেখা করার। আমার সহযাত্রীদের ঢিলেমির কারণে বারে বারে বিরক্ত হচ্ছিলাম। আমি চাইছিলাম এগারোটার মধ্যেই কবরখানা রোডে তাঁর ডেরায় পৌঁছাতে। কিন্তু আমরা পৌঁছুলাম একটা পার করে।

রিকশা নিয়ে চলে এলাম ছোটবাজারের আজাদ মেডিক্যাল হলে। এখানেই মিলবে সব খবর; জানা যাবে এই সময়টায় বদরু ভাইকে কোথায় পাওয়া যাবে। পরিচিত কাউকে দেখলাম না দোকানে। অপরিচিত যে তরুণকে পেলাম, তাকেই জিজ্ঞেস করলাম বদরু ভাইয়ের কথা, আর জানতে চাইলাম এই সময়টাতে তাঁকে কোথায় পাওয়া যাবে। উত্তর পেলাম, "তারে তো আর পাইবেন না। হ্যার লাশ তো ঢাকায় নিয়া গ্যাছে।"

আমি বিমূঢ় হয়ে গেলাম। সময় লাগল সামলাতে। চশমার কাচ মুছে জানতে চাইলাম, "কতদিন আগে?" তরুণ জানালেন, "দুই মাস আগে। সুস্থ মানুষ। কোনো অসুক আছিল না। রাইতে মনে হয় পানি খাইতে নামছিল বিছনাত থাইকা, তারপর পইড়া গেছে। আর উঠতারছে না। সকালে পাওয়া গেছে।"

হায় বদরু ভাই, দেখা হল না! আর কখনো হবে না!

১৯৮০ সালের কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ময়মনসিংহের একগুচ্ছ ঢাকাপ্রবাসী তরুণের সাথে তখন আমার গাঢ় বন্ধুতা। এদের মধ্যে আছে আর্ট কলেজের হাবীব রইস খান আর ভাইয়ের (আমারও) বন্ধু শোয়েব আহমেদ সিদ্দিকী। এদের সাথে একদিন গেলাম ময়মনসিংহ আর পেয়ে গেলাম শামসুল ফয়েজ বাচ্চু, নাজমুল করিম সিদ্দিকী, সেলিম মাহমুদ, আহসান ইকবাল, নীহার সরকার, আশরাফ মীর, আমিন, বাদল জোসেফ নামের ঝকঝকে তরুণদেরকে। প্রথম দেখাতেই বন্ধুত্ব সবার সাথে।

আমিন নিয়ে গেল ওদের বাড়িতে আর সেখানে পরিচয় হল বদরু ভাইয়ের সাথে- আমিনের ছোটভাই অঞ্জুকে সেতারের তালিম দিচ্ছেন। আমি তো তাঁর বাজনা শুনে মহামুগ্ধ। আমি বললাম, "আমি সেতার শিখব।" বদরু ভাই, পুরো নাম বদরুল হুদা, মুচকি হাসলেন। খানিক পর জিজ্ঞেস করলেন, "ফিরুজ (ফিরোজ আমার ডাকনাম) মিয়া, কও তো দেহি মিয়া, তোমার কী মনে অয়... সঙ্গীতই জীবন নাকি জীবনটাই সঙ্গীত?" আমি মাথা নিচু করে উত্তর দিলাম, "জীবনডা সঙ্গীতময় হইলে আর মনে হয় কিছু লাগে না।" বদরু ভাই বললেন, "ঠিক আছে, আইও তুমি, যখন মনে লয়।" বুঝলাম, পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ।

তারপর থেকে সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন করে যাই। বিকেলের একতা এক্সপ্রেসে চেপে সন্ধ্যায় নামি ময়মনসিংহ। সেখান থেকে বেরিয়েই তাজমহল রেস্টুরেন্ট। রাত এগারোটা পর্যন্ত আড্ডা হয়। তারপর বদরু ভাইয়ের বন্ধ ঘরের সামনে বসে থাকা। বদরু ভাই ফিরলে তালা খুলে ঘরে ঢোকা। তাঁর জন্য ঢাকা-দিয়ে-রাখা ভাত দুজনে মিলে শেষ করা। তারপর সিগারেট (তাঁর ভাষায় চুরোট) ধরিয়ে তালিম শুরু। সেতারের বিভিন্ন তারে বিভিন্ন আঙুলে বিভিন্নভাবে টোকা দেবার কলাকানুন শেখানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাগের রূপ তুলে ধরা, পকড়গুলিতে প্রাণসঞ্চার করা... সব থাকত এই সূচিতে। বাড়তি থাকত তাঁর গুরুর কাছে তাঁর সময় কেমন কেটেছে, তার কাহিনী আর অন্য বড় ওস্তাদদের সম্পর্কে তাঁর অমূল্য মূল্যায়ণ। ঢাকায় ফিরতাম ভোরের ফিরতি একতায়।

বদরু ভাইয়ের গুরু ছিলেন বিপিন দাস, এনায়েৎ খাঁর সাথে গৌরীপুর রাজসভায় বাজান। দুজনেই সমান গুণী। কিন্তু বিপিন দাসের নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাপন তাঁর অকালমৃত্যুর কারণ হয়। এনায়েৎ খাঁ পরবর্তীতে বিলায়েৎ খাঁ, ইমরাৎ খাঁর জন্ম দেন। আর বিপিন দাস জন্ম দেন সমীর দাসের আর বদরুল হুদা নামের এই নিভৃতচারী গুণীর। সমীর দাসকে শিশু অবস্থায় রেখে বিপিন দাস চলে যান। আর সমীরের সেতারে হাতে-খড়ি হয় বদরু ভাইয়ের কাছে।

দীর্ঘদেহী ঋজু গড়নের সত্যিকারের সাধক এই নিঃসঙ্গ মানুষটি ছিলেন চিরকুমার। খুব নিয়ন্ত্রিত জীবন তিনি যাপন করতেন। শিল্পীসুলভ অহং বা অস্থিরতা, কিছুই তাঁর ছিল না। চা খেতেন পরিমিত। সিগারেট দিনে তিনটার বেশি কোনো অবস্থাতেই না। মদ্যপান আমি কখনো করতেও দেখিনি, কারো কাছে কখনো শুনিওনি। নেশা বলতে ছিল খৈনি। যেকোনো দুর্যোগে-দুর্ভোগে স্থির-অবিচল। কবরখানা রোডের যে বাড়িটিতে তিনি থাকতেন, সেখানে একটি পরিবারকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন, যারা তাঁর রান্না করে দিত। সেই বাড়ির দুটি ঘর নিয়ে তিনি থাকতেন। নিয়মিত মুষ্টিযোগ করতেন।

কুন্দনলাল সায়গলের একটা গান বদরু ভাই প্রায়ই গাইতেন গুনগুন করে, "ইয়াদ আ রাহে হ্যায়..."। আজ সেই গানটাই ঘুরে-ফিরে আসছে আমার মনে।

পুনশ্চ:
বদরু ভাইয়ের সংবাদ শোনার পর দোকানের সেই তরুণের কাছে জানতে চাইলাম, "বড়বাজারের আজাদরে চিনেন নাকি? হ্যার খবর কী?" এই আজাদ আমার বন্ধু। ওর সাথেই প্রথম গারো পাহাড়ে যাওয়া, আর পাহাড়ে এক বুড়িমার সন্ধান পাওয়া।

উত্তর পেলাম, "হ্যায় তো মরছে এক বচ্ছর আগে... ক্যান্সার হইছিল।"

ময়মনসিংহ কি ঢাকা থেকে এত দূরে?


মন্তব্য

অভ্রনীল এর ছবি

জীবনটাই এখন এমন হয়ে গেছে... কাছের মানুষগুলোর কাছে আর থাকা হয়না...

_______________

এক ছাগলের দুই কান,
তুই আমার জানের জান।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

এই বদরু ভাইয়ের কথাই কি হিমু ভাইয়ের "পিলু রাগ" সম্পর্কিত পোস্টে লিখেছিলেন? আর শেষে যে বুড়িমার কথা বললেন, এর কথা কি উল্লেখ করেছিলেন কীর্তিনাশা ভাইয়ের সাইকেল ভ্রমণ সম্পর্কিত পোস্টের মন্তব্যে?

শুনে খুবই খারাপ লাগল। যে কোন মৃত্যুই আমাদের নাড়ায়, আর তা যদি হয় এরকম কাছের মানুষদের, তাহলে যে সেটা কেমন অবর্ণনীয় কষ্টের জন্ম দেয়, তা জানা আছে বলেই আপনার কষ্টটা অনুভব করতে পারছি। সান্ত্বনা দেবার ভাষা জানা নেই, থাকলেও দেয়ার চেষ্টা করতাম না। এটুকু শুধু আশা করি, এই কষ্টের মুহুর্তগুলো যেন পার করতে পারেন মানসিক দৃঢ়তার সাথে।

ভাল থাকুন আনিস ভাই।


A question that sometimes drives me hazy: am I or are the others crazy?

সবজান্তা এর ছবি

ময়মনসিংহ কি ঢাকা থেকে এত দূরে?

ব্যাপারটা বোধহয় ঢাকা ময়মনসিংহের না। আমরা সবাই সবার থেকে অনেক অনেক আলোকবর্ষ দূরে, কেউ আমরা কারো খবর রাখি না, কারণ আমাদের রাখার সময় থাকে না।

চমৎকার একটা লেখা।


অলমিতি বিস্তারেণ

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

এত কম জীবনের সময়! এত কম দৈর্ঘ নিয়ে এসেছি আমরা ভাবতেই কষ্ট হয়।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

এরকম একজন সঙ্গীতজ্ঞের কথা কখনো শুনিনি, অবাক লাগল।
আসলেই

ময়মনসিংহ কি ঢাকা থেকে এত দূরে?

------------------------------------------------------------------------
The philosophers have only interpreted the world in various ways; the point, however, is to change it.
[MARX : Theses on Feuerbach]


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

হিমু এর ছবি

দুঃখ পেলাম পোস্টটা পড়ে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

পুতুল এর ছবি

কঠিন! গুনিরা চলে যায়! আগাছা বেড়ে উঠে!
আশা করি ওস্তাদের স্মরনে বাজনাটা ধরে রাখবেন।
আর এটাই হবে বদরু ভাইয়ের প্রতি সব চেয়ে বড় সম্মান।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

মন খারাপ
বাজনাটা ধরে রাখার সময় পান?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মুস্তাফিজ এর ছবি

বদ্‌রুল ভাই ভালো লোক ছিলেন।

...........................
Every Picture Tells a Story

রায়হান আবীর এর ছবি

মন খারাপ

=============================

নিরিবিলি এর ছবি

চলেই যায়...ধরে রাখা যায় না মন খারাপ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আনিসদা, কবি বিদুরের "দূরত্ব" কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছিঃ

"কতই বা দূর!
যেতে আসতে পনেরো টাকা রিক্সাভাড়া,
সাইকেলটা সুস্থ্য থাকলে তাও লাগেনা-
পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে সটান আধঘন্টায়।
তবুও দূর অনেক,
বোকা মানুষ, আলোকবর্ষকে অবলীলায় মাইল লিখে ফেলে।"

দূরত্বতো শুধু ভৌত নয়, হয়তো মানসিক, হয়তো সময়ের, হয়তো দুর্বল স্মৃতির জন্য......



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

আপনার খালি মরণ-চারণ!
মন খারাপ হয়ে যায়।
স্যরি। মন খারাপ

----------------------------------
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।