প্রতিটা জেনারেশনেই একটা 'বিশেষ সময়' থাকে, যেটাকে স্মৃতীচারণের সময় 'আমাদের সময়' বলে উল্লেখ করা হয়। অনেক ঘেঁটে দেখলাম যে আসলে উদ্দাম কৈশরকালকেই সেই 'আমাদের সময়' বলে উল্লেখ করতে আমরা ব্যাপক ভালোবাসি। প্রত্যেকটা জেনারেশনের কাছেই সেই সময়টা থাকে একটা ভিন্ন মাত্রা নিয়ে, সবার থেকে আলাদা। আমাদের সময়ে অমুক প্রচলন ছিলো, আমাদের সময়ে আমরা এইটা করতাম, ঐটা হতো ইত্যাদিকার কথায় এগিয়ে চলে স্মৃতীর পাতা।
জীবন গাড়িকে প্রায় চার দশক বয়ে বেড়িয়ে আমিও পেছনে তাকিয়ে মাঝে মাঝে দেখি 'আমাদের সময়'কে। খুব একটা ধূসর হয়ে যায়নি সেই সব হল্লাময় দিন গুলো, কেবল সেই উষ্ণ সম্পর্কগুলো নেই, মুখগুলোও প্রায় ১২-১৫ বছরের যোগাযোগ হীনতায় আবছা ঘোলাটে। সারা মাস রোজা রেখে আমরা ম্যারাথন আড্ডা মারতাম, মানে এক্কেবারে সকালে বেড়িয়ে মাগরিবের আধাঘন্টা আগে বাসায় ফেরত। কারো আবার 'রোজায় ধরলে' সে বেশ আগেই বাসার পথ ধরতো। এই আড্ডার রেশ একদিন শেষ হলো, শুরু হলো ম্যারাথন ক্যারাম খেলা। ম্যারাথন মানে, এক্কেবারে ম্যারাথন। অপুর বাসার ছাদে দুই বোর্ড বসতো, চলে যাবার সময় যা যেভাবে ছিলো ঠিক সেভাবেই রেখে উপরে চাদর দিয়ে দেয়া হতো। বাদ মাগরিব থেকে রাত অব্দি আবারও চলতো খেলা। কোনো বোর্ড শেষ না হলে সেটা আবার তার পরের সকাল পর্যন্ত ওভাবেই থাকতো। একদিন বৃষ্টিতে বোর্ড ভিজে একসারা আর আমার অগ্রীম ঈদ। কারন আমি ক্যারাম খেলতে জানি না, দর্শক হয়ে হৈ হল্লা করতে আর কতো ভালো লাগে?
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে টুয়েন্টি নাইনের সে এক বিশাল জনপ্রীয়তা ছিলো। কেবল আমি হাবলাই পারতাম না। অপু, টিটু, মামুন আর দূর্লভ এক বিশাল স্কিম নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে আমাকে সেই খেলা শিখিয়েছিলো। তখন এমন একটা অবস্থা ছিলো ফ্রেন্ড গ্রুপে যে, টুয়েন্টি নাইন পারি না তো আমি হলাম গাছ ভুদাই। সুতরাং আমিও দিন-রাত প্র্যাকটিস করে ঊনত্রিশ ফোঁটার হিসাব মুখস্ত করে ফেললাম। তো, সেই ম্যারাথন ক্যারাম গায়েব হয়ে যাবার পর শুরু হলো ম্যারাথন টুয়েন্টি নাইন। এক্কেবারে সকাল থেকে বাদ আছর আবার বাদ মাগরিব থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চলতো এই পাগলামি। শেষ পর্যন্ত ওটা নিয়ে একটা টুর্নামেন্টও হয়েছিলো এবং টুর্নামেন্টের চান্দা দিয়ে বিজয়ী দুজনকে প্রাইস আর ঈদের দিন জম্পেশ পার্টি হয়ে সেই ম্যারাথন শেষ হয়েছিলো।
আমাদের সময়ে 'চাঁন রাইত' শুধু মাত্র মার্কেটে ঘুরে শপিং-এ সীমাবদ্ধ ছিলো না। এই দিনটা থাকতো এলাকাবাসীকে 'হেডম' দেখানোর দিন - কার কতো হাই ভল্যুমের ডেক সেট আছে, সেই হেডম দেখানোর। সেই সময়ে সত্যিকার অর্থে জোরে জোরে হিন্দি গান বাজানোটা ছিলো চরম ক্ষ্যাত একটা কাজ। এক হলে বাংলা ব্যান্ডের গান, নইলে ওয়েস্টার্ন পপ বা রক ঘরাণার গানই ছিলো বেশী জনপ্রীয়। সেই ওয়েস্টার্ণের পুরো জোগানটাই দিতো এ্যালিফেন্ট রোডের রেইনবো। সেটাও কম ঝক্কির ছিলো না, এক্কেবারে রোজার পয়লায়ই ক্যাসেট কিনে সিরিয়াল দিয়ে আসতে হতো, যেনো চাঁদ রাতের আগেই পাওয়া যায়। আর যতোই আগে পাওয়া যাক না কেনো, চাঁদ রাত ছাড়া ঐ ক্যাসেট একা একাও শুনতাম না। কী এক আশচর্য পাগলামী! তারপর দিদারের গ্যারেজে ডেক সেট এনে হাই ভল্যুমে সেই ক্যাসেট একের পর এক বাজিয়ে রাস্তায় চলতো আমাদের চুড়ান্ত হৈ হল্লা। মহল্লায় পরিচিত থাকার কারনে সবাই এই পাগলামীটা শুধু সহ্যই করতো না, মাঝে মাঝে কিছু অতিউৎসাহী এসে এক সঙ্গে নেচেও যেতো। অনেক রাত হলে পরে ভাংতো সেই গানের আসর। পরেরদিন সকালে সবাই কোন ঈদগাঁয় একসাথে নামাজ পড়বো সেটা ঠিক করে যে যার মতো বাড়ি ফেরা।
অনেকের ঈদের জামা-কাপড় আগেই দেখা হয়ে যেতো, কেউ কেউ দেখাতো না, তাদেরটা দেখার জন্যে ঈদের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। এই টাইপ বন্ধুদের জন্যে আমাদের পক্ষ থেকে থাকতো 'বিশেষ স্কিম', মানে এক্কেবারে কঠিন পঁচানো। কতো দাম দিয়ে কোথা থেকে কেনা হয়েছে - এই সব খবর খুব ভাবের সাথে নিয়ে শুরু হতো পঁচানি। ঐ ব্যাটা ঠকছস, এইটা কি রঙ কিনছস, ঐ এইটা কী তোর নানার পাঞ্জাবী ইত্যাদি টাইপ মন্তব্য ছুড়ে দিয়ে বেজায় মজা নিতাম সবাই মিলে। সকালের ছোট্টো একটা আড্ডা শেষে যে যার বাসায় তারপর বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাইরের মহল্লার বন্ধু সহযোগে বিশাল আড্ডা আর সেই সাথে সিনিয়রদের 'সিল' দেয়া। তার পরের দিন থেকে শুরু হতো অন্য মহল্লায় গিয়ে হৈ হৈ আর আড্ডা। তখন আমাদের ঈদ হতো একেবারে পাক্কা তিন দিন, পারলে আরো দুই-একদিন এক্সটেনশন করে নিতাম।
আমাদের সময়টা এখন আর নেই। পাশের বাসায় বেদম জোড়ে চলছে হিন্দি গান, কে যেনো জঘণ্য নাঁকী সুরে 'পাঁনিঁ পাঁনিঁ' করছে। হয়তো কারবালা নিয়ে গানকে ভুলে এরা বাজিয়ে চলছে, ঠিক জানি না। মোড়ে মোড়ে ছেলেরা দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে, হৈ হল্লা করছে। কিন্তু সেই নাচানাচি নেই। ঈদটা এখন হয়তো এদের কাছে আর 'নাচানাচি' টাইপ আনন্দের কোনো উপলক্ষ নেই। কি জানি, হয়তো আমার চোখেই দোষ, আমার সময়টা হারিয়ে এখন নতুন সময়ের আনন্দটাকে খুঁজে পাচ্ছি না! আমি এখন ঈদ এলে মন খারাপ করি। হিসাব করি কতো তারাতারি পাড় করা যায় এই 'ঈদের দিন' গুলো, এখন আর এক্সটেনশন চাই না। এখন সময় গুলোকে পাড় করে দেয়াই উপলক্ষ, তারপর ব্যাস্ত ঢাকার ব্যাস্ত জীবনে যেনো অনেক শান্তি।
কাল ঈদ, কী করবো জানিনা। এখন আর ম্যারাথন কিছু করার মতো ধৈর্যটা নেই। হয়তো ঘুমাবো, সিনেমা দেখবো, গান শুনবো, বিকেলে একটু এদিক-সেদিক বের হবো ... এই তো ...
সবাইকে ঈদ মোবারক।
মন্তব্য
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
==========================================================
ফ্লিকার । ফেসবুক । 500 PX ।
অনেক কিছু মনে পড়লো এই লেখা পড়ে, আমি মেয়ে হলেও বেশ অনেক বয়স পর্যন্ত রাস্তাঘাটে বখাটেপনা করেছি :D। চাঁদ রাতের দিন একটা গান গেয়ে মিছিল করতাম ওই সময়, ' আজকা চাঁন্দ উঠসে রে, কালকা ঈদ হইবো রে'।
আপনার লেখা খুব ভাল্লাগলো।
অনন্যা
অনেক ধন্যবাদ ...
==========================================================
ফ্লিকার । ফেসবুক । 500 PX ।
আর লেখার ট্যাগিং টা সেরাম হইসে
অনন্যা
==========================================================
ফ্লিকার । ফেসবুক । 500 PX ।
কেমন গেল এই সময়ের ঈদ আপনার?
দেবদ্যুতি
গেলো তো ভালোই ...
==========================================================
ফ্লিকার । ফেসবুক । 500 PX ।
এটার একটা তাত্ত্বিক ভিত্তি দাঁড় করানোর জন্য কিছুদিন পড়ালেখা করেছিলাম। শেষ করতে পারি নাই। আমাদের সময় বিষয়টা নির্ভর করে ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর। যেমন, ক্যাডেট কলেজে যারা পড়েছে তারা সাধারণত তাদের ক্যাডেট কলেজ জীবনটাকেই সেরা সময় বলে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল রাজনীতি যারা করেছে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর ঘোর কাটাতে পারে না। চিন্তাটা আরো গোছানো দরকার।
লেখায় ক্যাসেট, ক্যাসেট রেকর্ড এইসবের প্রসঙ্গটা এসেছে। আমার মনে হয় এই বিষয়ে একটা বিস্তারিত পোস্ট আসা দরকার। স্মৃতিগুলো লিখে রাখতে হবে ডিটেইলে। নাহলে এগুলো হারিয়ে যাবে।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
আসলে প্রবল জ্বর থেকে মাথা তুলে উঠার সময় পেয়েই ১০-১৫ মিনিটে মাথা থেকে ঝেড়ে দিয়েছি এই লেখা। তাই বেশ তাড়াহুড়ার ছাপ স্পষ্ট। আশা করি একবার টুকরো টুকরো করে হলেও গুছিয়ে লিখে ফেলবো 'আমাদের সময়ের' কথা গুলো।
==========================================================
ফ্লিকার । ফেসবুক । 500 PX ।
আমরা আপনার চেয়ে কয়েক বছর পরের জেনারেশন। আমাদের ছিল সিডি-সাউন্ড লেবেল লাগনো ক্যাসেট কেনা, ঈদের সময় জেমস, আইয়ুব বাচ্চু বা প্রিন্স মাহমুদের ক্যাসেটের ভাজাভাজা করা
ঈদ মোবারক!
নতুন মন্তব্য করুন