মানুষের নানারকম বাতিক থাকে, আমার যেমন আছে চট করে কিছু একটা কেনার অভ্যাস। আমি ধৈর্য ধরে, যাচাই-বাছাই করে কোন কিছু কিনতে পারি না। এজন্য দেখা যায় আমি হয়ত একটা জিনিস দাম দিয়ে কিনলাম, আশেপাশের কেউ একজন সেই জিনিসটাই আস্তে-ধীরে, অপেক্ষা করে অর্ধেক দাম দিয়ে কিনে ফেলবে। তবে কিছু জিনিস আছে যেগুলো চট করে কিনতে চাইলেও অনেক সময় হয়ে উঠে না, বিশেষ করে পুরানো বই-পত্রিকা, গানের রেকর্ড ইত্যাদি।
টুকটুক করে লাগেজ গুছাই। নাহ, উইন্টার ব্রেক না, স্টেট বদলাচ্ছি। পড়াশোনার পাট চুকলো, এবার ডর্ম থেকে তো খেদিয়ে দেবেই।
দু'বছর আগে এরকম একটা সময়ে লাগেজ গুছিয়েছিলাম দেশ ছাড়ব বলে। ২৬ বছরের একটা জীবনকে দুটো স্যুটকেসে তুলে আনার গল্পটা খুব সহজ ছিলো না। দিশেহারার মতো বারবার তাকাচ্ছিলাম বুকশেলফগুলোর দিকে। এদের ছেড়ে থাকবো কী করে? কতো অসংখ্য প্রিয় বই, গান্ধর্বী কী আবোল তাবোল...বেছে নেবো কাকে, সঙ্গী করে? শেষমেশ নেওয়া হয়নি কাউকেই, ওজনবাহুল্যের গেরোয় পড়ে।
ভেবেছিলাম, থাকগে। মানুষ ছেড়ে যেতে পারছি, জড়বস্তুতে আর কী এসে যায়!
মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে যেসব দেশের পথচলা শুরু, সেসব দেশের মানুষের কাছে স্বাধীনতা এবং বিজয় দিবস ভিন্ন অনুরণন নিয়ে আসে, প্রতিবছর। এটাও হয়ত সত্য যে সবাই সেসব উদযাপন করেন না, বা করলেও ভিন্নভাবে করেন, বা উদযাপন না করার পেছনে ব্যক্তিগত (ইমার্জেন্সি) কারণ থাকে। কিন্তু নিজে(রা) উদযাপন না করলেও বাকিদের উদযাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ান বলে মনে হয় না। আমাদের দেশে জেনে না-জেনে আমরা সেটাই করি, খুব সুক্ষ্মভাবে।
শ্রীমঙ্গলের চারদিকে বিস্তীর্ণ কালেঙ্গা অরণ্য - আমাদের গেরিলাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। মাঝে মধ্যে ভুল করে পা মাড়ালেও মুক্তিবাহিনীর এমব্যুশে ফিরে যেতে বাধ্য হয় পাকিস্তানীদের। ২৪ শে সেপ্টেম্বর ১৯৭১; বড় একটি পাকিস্তানী কলাম এগিয়ে আসছে বুনো পথ ধরে। পথ দেখিয়ে আনছে রাজাকার নাম্নী ২০/২৫ জনের এদেশীয় কিছু প্রভুভক্ত কুকুর।
সেলিনা পারভীন যাবার আগে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, সুমন তুমি মামার সাথে খেয়ে নিও। আমি যাব আর চলে আসব। গিয়েছিলেন কিন্তু আর ফিরে আসেন নি। পায়ের সাদা মোজা দেখে চেনা গিয়েছিল তাকে। এমনিতে চেনার উপায় নেই। চোখ বাঁধা, নাক মুখের কোন আকৃতি নেই, স্তনের অংশ কাটা। তাঁকে যখন বেয়োনেট দিয়ে খোঁচানো হচ্ছিল তিনি তখন বারবার তার শিশু সন্তানের কথাই বলছিলেন।
আমদের স্কুল এ একটি লাইব্রেরি ছিল, যেমনটি আর দশটা স্কুল এ থাকত আশির দশক এ। স্কুল এর অবহেলিত কোনো একটি কোনে, মরচে ধরা লোহার তালায় বন্দী। দরজার খড়খড়ি তে উঁকি দিয়ে দেখতাম আলো আঁধারীর আড়ালে দাড়িয়ে থাকা সারি সারি আলমারি, শত শত বইয়ে ঠাসা। আলমারির কাঁচে রাজ্যের ধুলো, ঘরময় মাকড়সার জাল। দারুন ইচ্ছে করত তালা ভেঙ্গে একবার ঘরটায় ঢুকে পড়ি। একটি বইয়ের প্রতি ছিল আমার দুর্নিবার আকর্ষণ, "গ্রিস ও ট্রয় এর উপাখ্যান"। কতবার যে খড়খড়ি দিয়ে ওই বইটির দিকে তাকিয়ে থেকেছি! বইটি বাজারে পাওয়া যেতনা তখন। একদিন শিশু একাডেমিতে গিয়ে জিগ্যেস করে জেনেছিলাম লেখকের নাম আবদার রশিদ। আমার পঞ্চম শ্রেনীর উত্সুক মনটা সারাক্ষণ পড়ে থাকত মাকড়সার জালে ঘেরা, ধুলোয় মোড়ানো, আলমারিতে বন্দী আবদার রশিদের কল্পনায় - না জানি কী লিখেছেন তিনি!
পাড়ার স্কুল, টাকা নেই পয়সা নেই, নেই লোকবল। কে নেবে ধুলোয় ধুসরিত ওই স্বপ্নলোকের দায়িত্ব। দরজা তার তালাবন্ধই থেকে যায়। স্বপ্নলোকের চাবি পড়ে পড়ে ঝিমোয় হেড মাস্টারের ড্রয়ারে। তিনি তখন ব্যাস্ত তাঁর নতুন খেলনা নিয়ে। জাপান সরকারের কী বিভ্রম হয়েছিল কে জানে! একদিন ক্লাসে এসে দেখি দেয়ালে যেখনে ব্ল্যাক বোর্ড থাকে তার ঠিক উপরে একটা বাক্স মতন। ওটা যে কী এই নিয়ে গবেষণা করতে করতেই হঠাত শুনি রাশভারী একটি কন্ঠ, বাক্সটার ভেতর দিয়ে হেড স্যার কথা বলছেন! "ছেলেরা, আমি তোমাদের হেড মাস্টার বলছি। মন দিয়ে লেখা পড়া করবে, নইলে কান ধরে বের করে দেব স্কুল থেকে।" সেই থেকে শুরু, যখন তখন, কারণে অকারণে হেড স্যার আবির্ভূত হতেন তাঁর দৈব বাণী নিয়ে। জাপান সরকারের বদান্যতায় সেবছর ঢাকার অনেক স্কুলের ক্লাস রুমই সজ্জিত হয়েছিল অমন স্পিকার দিয়ে। কার বুদ্ধিতে জানিনা, একদিন লাঞ্চ পিরিয়ডে দেখি স্পিকার এ রেডিও চলছে। অনুরোধের আসর - রংপুর থেকে ইলা নীলা মালা বেলা, পাবনা থেকে সান্তা কান্তা, টাঙ্গাইল থেকে হাবলু, বাবলু ডাবলু..........।
লাঞ্চের অবসরে সবাই যখন ইলা নীলা মালা বেলার পছন্দের গান শোনায় ব্যাস্ত আমি তখন তালাবন্ধ বইঘরের খড়খড়ি উঁচিয়ে দেখি দুই রঙে আঁকা গ্রিস ও ট্রয় এর উপাখ্যান এর মলাট। আমার আশ মেটেনা। আশ মিটত না আরো চার জনের। শিশির মন্ডল, শহিদুল হাসান, অখিল চন্দ্র পাল আর রঞ্জিত কুমার সাহা। আমার চার বন্ধু, স্কুল জীবনের দারুন আনন্দময় একটি এডভেঞ্চারের সঙ্গী। আমাদের বই পড়তে ভালো লাগে, কিন্তু কারো কাছেই বই টই তেমন একটা নেই। টাকা পয়সাও নেই যে সপ্তায় সপ্তায় বই কিনব। সকাল বেলা মা দুটাকা দেন, এক টাকার চটপটি, আট আনার পেয়ারা আর আট আনার আইসক্রিম। ঐটি বাঁচিয়ে বই কিনব তাই কি হয়! "চল একটা লাইব্রেরি দেই", একদিন কথায় কথায় শিশিরের প্রস্তাব।
লাইব্রেরির নাম "অমরশশি", আমাদের সবার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে তৈরী নাম। মনে আছে পাড়ার দুলাল দা, দুলাল আর্ট নাম খ্যাত, আমাদের রাবার স্ট্যাম্প বানিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের সবার বইয়ের পাতায় পাতায় অমরশশি'র স্ট্যাম্প। লাইব্রেরির কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই, কিছুদিন এর বাড়ি কিছুদিন ওর বাড়ি - ঘুরে ফিরে আমাদের পাঁচ জনের বাড়ি। কিছু বই পেয়েছিলাম অন্য বন্ধুদের কাছ থেকে, কিছু কিনতাম স্কুল এর পাশের দোকান থেকে। দোকানটা চালাতেন সুমন ভাই, অভিনেত্রী সুইটির বড় ভাই। আমাদের লাইব্রেরির সদস্য হয়েছিল অনেকেই, কোনো সদস্য ফী নেই, কেবল বই প্রতি আট আনা | লেট ফী চার আনা।
অমরশশি টিকেছিল অনেকদিন। তারপর কলেজে প্রবেশ, প্রথম যৌবন। সমর সেনের কবিতার মতই। কোথায় গেল অমরশশি, কবে কখন আমার পঞ্চম শ্রেনীর কৌতুহলী মনটা চাপা পড়ে গেল জীবনের জালে! মাঝে মাঝে, যখন খুব মন খারাপ থাকে, ধুলো মাখা খড়খড়িটা আলতো করে তুলে উঁকি দিয়ে দেখি, আছে। মনের কোনে লুকিয়ে আছে দুলালদার বানিয়ে দেওয়া সেই স্ট্যাম্প। বহু বছরে অস্পষ্ট হয়ে এসেছে, কিন্তু এখনো পড়া যায় - অমরশশি।
--মোখলেস হোসেন
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, শুক্রবার
আজ ভোরে বাসায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হল। মঞ্জুর এসেছিলেন, বাড়িতে যারা আছেন, তারাও সবাই ছাদে উঠলেন। ২৫ মার্চ থেকে ফ্ল্যাগপোলটায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আবার নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম, সেই ফ্ল্যাগপোলটাতেই আজ আবার সেদিনের পতাকাটাই তুললাম।
পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ জোরেশোরে এগিয়ে চলছে। এমন পরিসরের নির্মাণ প্রকল্প বাংলাদেশে নিকট অতীতে দ্বিতীয়টি নেই। যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু আর পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে কর্মযজ্ঞকে ছাড়িয়ে গেছে পদ্মা সেতুর কাজ।