বঞ্চনা বড় কঠিন শাস্তি, কিন্তু হতাশা তার চেয়েও বড়। কোনো একদিন মুক্ত আকাশ দেখার আশায় অর্ধেক জীবন অন্ধকার কুঠুরিতে কাটিয়ে দেওয়া যায়; কিন্তু বন্দিত্ব অবসানের কোনো আশা বা সম্ভাবনা না থাকলে কয়েক মাসেও মন ভেঙে যায়, বেঁচে থাকা নিরর্থক হয়ে যায়। আশা নিয়েই তাই জীবন। অন্ধকারে থাকলেও আশা চাই, বেদনায় থাকলেও আশা চাই, গহীন অরণ্যে হারিয়ে গেলেও আশা চাই, উত্তাল সমুদ্রে ভেসে গেলেও আশা চাই, একলা বিকেলে বিক্ষিপ্ত মনেও আশা চাই, বায়ুশূন্য অন্তরীক্ষে নিক্ষিপ্ত হলেও আশা থাকা চাই, জগতের বিশালতায় কুঁকড়ে গেলেও আশা থাকা চাই।
সেই আশাবাজি থেকেই জেগে জেগে ভাবি, এই তো আর কিছুদিন পরেই বাংলাদেশও খেলবে ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরে, এই তো কিছুদিন বাদেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ হবে সবার প্রিয় আন্ডার-ডগ দল, এই তো কিছুদিন পরই দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ লাল-সবুজ জার্সি পরবে বিশ্বকাপ এলে।
চলার পথে নিজ জীবন, নিজ দেশ কিংবা ভিনদেশে হওয়া কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়েই এই সিরিজ- তিন প্যারার তিনটি ছোট ছোট গল্প নিয়ে লেখা "তিন তিরিকে নয়"।
[justify]#১
প্রাণের কাছে জলাভূমি আজ নত হয়েছে ছায়ায়
অথবা নত জলের কাছে প্রাণ
শব্দই গাঁথে জীবনের অস্ফুট
এসো তবে আজ ঈশারায় সব গল্প বলার শুরু
যদিও কিছুই বলার নেই আমার!
যদিও মেঘের ওপারে আর কিছুই দেখিনি আমি
ভোর হয়েছে দিগন্তে যখন আমি ফিরে গেছি পশ্চিম থেকে আরও পশ্চিমে- আরও
নিজের ছায়ায় নিজেকে দেখে চিনতে পারিনি তবু
সত্য যা তা সত্যের মাঝে শিল্পের মত বাঁচে
আমার য কিছু না বলা ছিল
অস্ফুট রয়ে গেছে!
কে যেন বলেছিলো বৃষ্টির দিনে নাকি গাঢ় নীল রঙের জামা পড়তে হয়। কে বলেছিলো এতদিন পর আর মনে পড়ে না। তবুও কথাটা সত্যি মনে করে আজ বেশ খুশি খুশি লাগছে! কারণ, কাকতালীয় ভাবে আমার এখন গাঢ় নীল রঙের শার্ট।
১৪ ডিসেম্বর:
মিত্রবাহিনীর তুমুল আক্রমনে সারা পূর্ব বাঙলায় পাকিস্তানী সৈন্যরা কোনঠাসা হয়ে গেছে।
ভারতীয় বিমানবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর গোলন্দাজরা পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে বিরতিহীনভাবে বোম্বিং করছে।
পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে সকালে গর্ভনর হাউজে পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর ডা: মালিক তার ১১ মন্ত্রী সহ পদত্যাগ করে।
১।
'রোগী আসিবার পূর্বেই ডাক্তার ক্লিনিকে পৌঁছাইল' 'র একটা রেকর্ড করেছি আজ। তাও আবার একটানা প্রায় দুই ঘণ্টা ড্রাইভ করে। রোগীর জন্য অপেক্ষা করা বেশ বিরক্তিকর কাজ, অন্যপক্ষের অপেক্ষাটাও যে খুব সুখকর নয় সেটাও জানা আছে। সময়ের মধ্যেই ক্লিনিক শেষও হোয়ে যাওয়ায়, জীনের আছর লাগল। প্রিয় একটা দোকান আছে এই ছোট্ট শহরে, সেটাতে একটু ঢুঁ মারার লোভ সামলাতে পারলাম না।
স্টারপার্টি হবার কথা ছিলো এপ্রিলের শেষের দিকে, কোনো একটা সুন্দর সন্ধ্যায় যখন আকাশ স্বচ্ছ-নির্মল, একেবারে পরিষ্কার। কিন্তু কী কারণে যেন পাল্টানো হলো সময়, আসলে সেমেস্টার শেষ হবার মুখে ব্যস্ততা খুবই বেশী থাকে, সমস্ত ফাইনাল পরীক্ষা টরীক্ষা ফাইনাল-গ্রেডিং গ্র্যাজুয়েশান অনুষ্ঠান ইত্যাদি সবই তো তখন! তখনের জন্য অপেক্ষা করলে হয়তো বাতিল হয়ে যেতে পারে, তাই ফেব্রুয়ারীতেই হলো স্টারপার্টি।
সপ্তম শ্রেণীতে যখন পড়ি, ছোটোখাটো এক বিষণ্ণ চেহারার শিক্ষিকা এলেন আমাদের ক্লাসে। আমরা নতুন এই ম্যাডামকে খালি হাতে ক্লাসে ঢুকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, একটু নিরাপদে বিটকেলপনা করা যাবে, এ-ই ভেবে। সেই ভুলজন্মা স্বস্তি মিনিট পাঁচেক স্থায়ী ছিলো। ম্যাডাম নিচু গলায় জানালেন, তাঁর নাম মিসেস ত্রিবেদী। তাঁর পূর্বপুরুষ তিনটি বেদ কণ্ঠস্থ করেছিলেন বলে তাঁদের এই পদবী। তারপর তিনি চেশায়ার বেড়ালের মতো হাসিমুখ
লালচরী মাঠের উপর সুলতান মহব্বত জং এর তাঁবু। সকাল।
বড় একটা গাছের গুঁড়ি মাঠে পোঁতা, তাতে পিছমোড়া করে বাঁধা মধ্যবয়েসী হাসিন বানু। একটু দূরত্ব রেখে তাকে ঘিরে গোল হয়ে দমবন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে প্রচুর মানুষ। ভীড় ঠেলে কসাই জমির আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল তার দিকে, হাতে ছুরি। প্রতিদিন বিশটার উপর গরু জবে দেয় সে, চিকন ছুরি দিয়ে পশুর ছাল ছাড়িয়ে আনা তার জন্য কোন ব্যাপারই না। তবে জ্যাতা মানুষের ছাল ছাড়ানো তার এই প্রথম।
খুব সাবধানে হাসিন বানুর ঘাড়ের পিছনে ছুরি দিয়ে পোঁচ দিতে শুরু করল জমির, আর হাসিন বানুর আর্ত চিৎকার শুনে ভয়ে ডানা ঝটপট করে উড়াল দিল পাশের ডালে বসা দুইটা পাখি।
পেয়েছি! আর কিছু চায় না। এ যে বিভূতিভূষণের ময়নাকাঁটা। কত বন-বাঁদাড়ে এর খান তল্লাস করেছি, পায়নি। চিনিই না তো পাব কীভাবে? যারা দেখেছেন, চেনেন, তাঁদের মুখে বর্ণনা শুনে খোঁজার চেষ্টা করেছি। তবুও দেখা মেলেনি। আজ এভাবে অপ্রত্যাশিত দর্শনের কথা ভাবিইনি। ময়নাকাটা বাংলাদেশের সবজায়গায় ছিল কিনা জানা নেই। তবে আমাদের এলাকায় যে এর প্রাচুর্য ছিল তার সাক্ষ্য বিভূতিভূষণই দিয়েছেন।