এক.
শিহাব সাহেব একজন ব্যবসায়ী মানুষ। ঘরে ওনার স্ত্রী এবং ৭ বছরের ছেলে সোহাগ। একটা মেয়ে আছে ইউনিভার্সিটি পড়ূয়া - থাকে ঢাকার একটা ছাত্রীহলে। শিহাব খুব দ্রুত ব্যবসায় উন্নতি করতে শুরু করেছেন। খুব দ্রুত। সবাই বলে, ওনার ব্যবসাতে হাতযশ ভালো। পাড়ার বড় জামে মসজিদে উনি নিয়মিত দানখয়রাত করেন। স্থানীয় একটা মাদ্রাসাতেও সাহায্য করেন। বাবার রেখে যাওয়া একখন্ড জমির ওপর টিন-শেড একটা ঘরে থাকতেন শিহাব সাহেব। এখন সেটা পাকা ২ তলা ভবন। আরো উঁচু করার সামর্থ্য ওনার ছিল, কিন্তু বাবা ভীত করে গেছেন ২ তলার। আপাততঃ ওটা তাই ২ তলাই থাকবে। শিহাব সাহেবের পরিকল্পনা হচ্ছে জমির অর্ধেকটা বিক্রি করে বাকি অংশে বড়সড় একটা পাকা দালান তোলার। কিন্তু পুরোন ঢাকায় বলে এখনও জমির সমাদর পাচ্ছেন না। কিন্তু ওনার ব্যবসায়ী মন বলছে জমির দাম একদিন খুব বাড়বে, নতুন-পুরোনের ব্যবধান কমে যাবে; একটুকরো জমির জন্য তখন অনেক খদ্দের পাওয়া যাবে।
দুই.
রোকন মাদ্রাসার ছাত্র। ফাজিল পাশ করেছে গতবছর। ভালো ফলাফল হয়েছে তার। কামিল পরীক্ষার জন্য এখন চলছে প্রস্তুতি। মাদ্রাসার ভালো ছাত্র হিসেবে সে আশেপাশের কয়েকটা বাড়িতে টিউশনি করায়। হাতে কিছু টাকা আসে। সেটার বড় একটা অংশ সে আবার মাদ্রাসাতে দান করে। দ্বীনের পথে ব্যয় হয় সেটা; বড় হুজুর বলেছেন। পাড়ার শিহাব সাহেবের ছেলে সোহাগকে রোকন বড়ই ভালোবাসে। ভালো না বেসে উপায় নেই, এতো সুন্দর করে কথা বলে বাচ্চাটা! রোকনের মন ভরে যায়। প্রায়ই রোকন ছেলেটার জন্য টুকটাক টফি-লজেন্স কিনে নিয়ে যায়। সপ্তাহে ৪ দিন যাবার নিয়ম, রোকনের ইচ্ছা করে প্রতিদিন যায়! তবে আজকাল মাঝে মাঝে যাওয়া বাদ পড়ছে। ছেলেটা অনেক প্রশ্ন করে একদিন না গেলেই, রোকন বুঝিয়ে শান্ত করে ছেলেটাকে, কাজ ছিল তাইই আসতে পারে নাই ইত্যাদি বলে। আর কোন ছাত্রের প্রতি রোকনের এই টানটা নেই। সবাই এই ছেলেটার মতোন মন জয় করতেও তো পারে না!
তিন.
বদরুন্নেসা ছাত্রীহলের একটা রুমে থাকে জয়া। গত তিনদিন ধরে জয়ার অসুখ। ডাক্তার দেখানো হচ্ছে, লাভ হচ্ছে না। জয়ার পেটে অসম্ভব ব্যথা। জয়ার সাথে একরুমে থাকে দিপা। দিপার নিজের মোবাইল ফোন নেই, বাসার থেকে মাঝে মধ্যে ফোন আসে, সেটা জয়ার মোবাইলে আসে। জয়ার সাথে এভাবেই ঘনিষ্ঠতা দিপার। তবে দিপা বাবাকে বলেছে এভাবে অন্যের ফোনে কথা বলতে তার ভালো লাগে না; নিজের একটা মোবাইল তার চাইই। ছোটা ভাইটার কথা শুনতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে। এতো সুন্দর করে কথা বলে সোহাগ! মনটা ভরে যায়! তাছাড়া ক্লাসের একটা বন্ধু আছে। তার সাথেও কথা বলতে খুব ভালো লাগে ওর! ঐ ছেলেটা এখন মেসেজ পাঠায় জয়ার ফোনে---এটা খুব লজ্জার ব্যপার দিপার জন্য। তবে বাবা বলেছে, খুউব শিঘ্রই মোবাইল দেবেন। বাবার ব্যবসা ভালো যাচ্ছে! তবে বাড়িটা ২তলা করতে অনেক টাকা খরচা হয়ে গেছে। মোবাইল পেতে তাই একটু সময় লাগবে।
চার.
শিহাব সাহেব রাতে খেতে বসেছেন। ছেলেটা তার সাথে বসে আছে, তার খাওয়া হয়েছে অনেক আগে। বাবার খাওয়া দেখছে আর এটা সেটা প্রশ্ন করে বাবাকে জর্জরিত করে তুলছে। ‘তুমি এতো রাতে খাও কেন বাবা?! আমি তে অনেক আগেই খেয়ে ফেলি’, শিহাব পূত্রের সব প্রশ্নের জবাব দেয় না। হুঁ হ্যা বলে পার করার চেষ্টা করে। কিন্তু ৭ বছরের সোহাগ বাবার এই ফাঁকিবাজি ঠিক ধরে ফেলে। বাবাকে সে ছাড়ে না। কথায় কথায় শিহাব জানতে পারলেন যে, রোকন ছেলেটা নিয়মিত পড়াতে আসছে না আজকাল। বড় হুজুরকে একটু বলা দরকার বিষয়টা। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, রোকন আসছে না প্রায় ২ সপ্তাহ হয়ে গেল! অসুস্থও তো হতে পারে।
পাঁচ.
‘দিপা তোর ফোন’ - বলে জয়া দিপাকে ডাকতে লাগলো। দিপা টেবিলে অল্প আলো জেলে চিঠি লিখছিল। দৌড়ে এসে ফোনটা রিসিভ করলো। অপর প্রান্তে ফোনে আপু আপু বলে চিত্কার করে ডাকছে ওকে সোহাগ। ফোন ধরেই দিপা বললো -
-হ্যা ভাইয়া তুমি ক্যামন আছো?
- আমি ভালো, তুমি জানো আম্মু না আমাকে একটা মোবাইল কিনে দিছে!!
-তোকেই দেবে, আমাকে আর দেবে না….
-না না আমাকে আম্মু বলছে, তোমাকেও একটা কিনে দেবে। কিন্তু আমারটা অনেক সুন্দর তোমারটার চে!!
-আমারটা তো কিনলোই না, তুই জানলি কিভাবে যে আমারটা পচা?!
-আমারটাতে অনেক মিউজিক হয় জানো?! লাইট জ্বলে!
-তাহলে তোরটা থেকে ফোন করলি না কেন আমাকে?!
-আমারটার নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না এখন, আম্মু বলেছে, পরে ঠিক হয়ে যাবে।
ছোট ভাইয়ের কথাগুলো শুনে দিপা হাসি চাপায় মুখে হাত দিয়ে। ওপাশ থেকে মা সোহাগের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নেন;
-এই দিপা, তোর ঐ বান্ধবীটার অবস্থা এখন ক্যামন?
-ভালো না মা; আর জানো আমাদের হলে অনেকেরই এমন হচ্ছে। পেটে প্রচন্ড যন্ত্রনা। শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে জয়ার!
-বলিস কি, তাহলে তুই চলে আয়; বাসা থেকে ক্লাস করবি। হলে থাকতে হবে না।
-কি যে বল না মা! ওকে একা ফেলে আমি কিভাবে যাই?! ঢাকায় ওর কেউ নাই। আর ক্লাস তো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সামনেই। সবার অসুখ হলে ক্লাস হবে কিভাবে?! এই আম্মু, পিচ্চিটাকে আরেকটু দাও না, কথা বলি। (মা সোহাগকে আবার ফোন দেন।)
- ভাইয়া, স্কুলে যাচ্ছো তো ঠিকমতোন?
- হ্যা যাচ্ছি, কিন্তু আমার রোকন টিচারটা আর আসে না!
- কেন?
- জানি না। আব্বু নিয়ে আসবে আবার। বলেছে। জানো, আমি রোকন টিচারের একটা ছবি এঁকেছি।
- তোকে না রোকন টিচার মানুষের ছবি আঁকতে নিষেধ করেছে?!
- তাও এঁকেছি। বাবা আমাকে নতুন ১ প্যাকেট মোম রঙ কিনে দিয়েছে। ঐটা দিয়ে একেছি। ছবিটা রোকন টিচারকে গিফট করবো।
- কোরো, তোমাকে রোকন টিচার পিটান দেবে ছবি আঁকা দেখলে।
- উহহ…রোকন টিচার আমাকে কখখনোও পিটান দেয় না।
ছয়.
বেশ কিছুদিন পরের কথা। দিপা-দের হলে শুধু নয়, গোটা ইউনিভার্সিটির আরো বেশ কয়েকটি হলে মহামারি আকারে শুরু হলো একই অসুখ। অনেক শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে নিতে হলো। হাসপাতালে নিতে হলো দিপাকেও! বান্ধবীর মতোন সেও আক্রান্ত হয়েছে একই রোগে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা গেল মোবাইল কোর্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর ক্যান্টিনে আবিষ্কার করেছে বিষাক্ত তেলের ছড়াছড়ি। এই তেলে রান্না খাবার খেয়েই নাকি শিক্ষার্থীদের এই দূরবস্থা! গোটা ঢাকা শহরে এই তেলের সরবরাহকারী বেশ কয়েকটি কারখানা কোর্ট সীল করেছে, আটক করার চেষ্টা করছে মালিকদের। পত্রিকায় ছাপা হয়েছে অবৈধ কারখানা-মালিকদের নাম। অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছে!
সাত.
শিহাব সাহেবের স্ত্রী খুব অসহায় বোধ করছেন।
শিহাব বাড়িতে নেই। কোথায় আছে, কেমন আছে কোনও ধারণা নেই।
হাসপাতালে দিপা-র অবস্থাও বেশ খারাপ; ডাক্তার বলছেন লিভারে জটিল কি যেন হয়েছে।
শিহাব ফোনে স্ত্রীর কাছে জেনেছে মেয়ের এই জটিল অসুখের কথা। শুনে সে খুব কাঁদছিল।
- ইচ্ছে করছে মেয়েটার সাথে একটু কথা বলতে।
- ওর সামনে দাঁড়াতে পারবে তুমি?!! স্ত্রীর কন্ঠ শিহাবের কাছে একটু চিৎকারের মতো শোনায়।
- ওর কিছু হবে নাতো?
অপর প্রান্তে শিহাবের স্ত্রী কোনও জবাব দিলো না। সোহাগ মাকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল। মাকে কাঁদতে দেখে ফোনটা মায়ের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো। বাবাকে সে অনেকদিন দেখে না।
- বাবা! মা কাঁদছে। আপুর অনেক অসুখ বাবা।
- তুমি কেমন আছো আব্বু?
- আমি তো ভালো আছি। তুমি আসো না কেন?
- আসবো আব্বু। এইতো আর কয়টা দিন….
- রোকন টিচার আসছিল। আমি রোকন টিচারকে একটা গিফট দিছি বাবা জানো? রোকন টিচার বলেছে আর আসবে না।
- হ্যা বাবা, ভালো করছো…
- বাবা বাবা, মা বলেছে তুমি আসলে আমরা সবাই আপুকে দেখতে যাবো। ঢাকা মেডিকেলে। তুমি তারাতারি আসো।
- কাল তোমরা যাও আপুকে দেখে আসো। আমি ২/১ দিন পরেই আসবো আব্বু…।
শিহাব ফোন রেখে গুম মেরে বসে থাকলো। সে কাঁদতে পারে না। বাবার মৃত্যুর সময়ও সে কাঁদে নাই। তবে আজ বারবার তার চোখ ভিজে আসছে। চোখের কোণায় কখন একফোটা পানি জমেছে, সেটা বড় হয়ে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে উঠলো! ডান হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখটা মুছলো সে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মেয়েকে একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিল সে। কিন্তু সেটাতে ফোন করার সাহস হচ্ছে না। মেয়ের সামনে যাবার উপায় তার নেই! পুলিশ তাকে খুঁজছে। কারখানায় তালা লাগিয়েছে। কিন্তু মেয়েটাকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরে তার বলতে ইচ্ছে করছে, ‘‘মা গো, আমি বড় অপরাধী। কিন্তু আমি তোমার বাবা! আজ আমার চে’ অসহায় আর কোনও বাবা নাই মা, এটাই আমার বড় শাস্তি। আমাকে তুমি ঘৃণা কোরো না মা!’’
আট.
২ দিন পরের ঘটনা।
শিহাব সাহেবের মতোন রোকনেরও আজ মনটা খারাপ। গতকাল একটা মিশন ছিল তার; সেটা সাকসেসফুল হয়েছে। বাংলামোটর, শেরাটনের মোড়, শহীদ মিনার সহ আরো কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের দায়িত্ব ছিল তার। দায়িত্ব যথারীতি পালন হয়েছে। কেউ ধরা পরে নাই। একদিন পার হয়ে গেছে। ঢাকা থেকে অনেকদূরে এখন সে। কিন্তু পত্রিকা পড়ে মনটা খারাপ হয়েছে তার। একটা বাচ্চা ছেলের ছিন্নভিন্ন দেহের ছবি একদম প্রথম পৃষ্ঠায়! ঢাকা মেডিকেলের সামনে থেকে তোলা।
পান্জাবীর পকেটে হাত দিয়ে সে একটা দুমড়ানো কাগজ বের করলো। কাগজে মোমের গন্ধ। মোম রঙে আঁকা একটা ছবি। একটা টুপী-পান্জাবী পড়া মানুষ। নীচে বড়বড় হরফে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা “রোকন-টিচার”।
কাগজটা শক্ত করে ধরে রাখলো রোকন। তার চোখ ফেটে কান্না আসছে। কান্নার থামানোর যতোই চেষ্টা করছে, ততোই আরো জোরে কান্না পাচ্ছে।
[গল্পটি এর আগে জার্মানী থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক "অরিত্র" পত্রিকার জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০০৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সেই সময়ের লাগাতার বোমাবাজি আর ভেজাল-খাবারের আতঙ্কে থাকা লাখো মানুষের অনুভূতিকে পটভূমি করে এটি লেখা হয়েছিল।]
লুৎফুল আরেফীন
মন্তব্য
খুবই সুন্দর গল্প। গল্পের শেষটা আগে বোঝা যায়না, তাই গল্পটা শেষ হলে অনেক বেশি মন খারাপ লাগে।
পড়তে পড়তে কেনো যেন মনে হলো,আগে কি পড়েছি?
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
খুব সুন্দর লিখেছেন।
-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
@ ভাগশেষ
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। মন্তবছের জন্যও। আপনার মন খারাপ করে দেবার জন্য অবশ্য দু:খিত
@ হাসান
লেখাটা এর আগে "শিরোনামহীন" নামে "অরিত্র" পত্রিকাতে ছাপা হয়। আর জার্মানীর একটা ফোরামেও একই সময়ে পোস্ট করি।
@ কনফুসিয়াস
অনেক ধন্যবাদ!!
ভালো লেগেছে অসম্ভবরকম।
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
ঝরাপাতা কে ধন্যবাদ। অসম্ভব রকম!
মানু্য এর এই কালো দিক গুলো জানতে ভাল লাগেনা, আপনার লেখা সব সময়ের মত খুবই ভাল লাগলো।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
When I'm right nobody remembers; when I'm wrong nobody forgets!
When I'm right nobody remembers; when I'm wrong nobody forgets!
আমি গল্প ভালো লিখতে পারি না, তবে ভালো গল্প পড়লে বুঝতে পারি
তথাপি আমার দূর্বল গল্পগুগলোর ভেতরেও এই গল্পটা ভালোই লাগে
আপনাকে আবারও ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন