একজন শ্রমিকের সর্বোচ্চ মূল্য কতো? ঘন্টায় ৭০ টাকা নাকি আরোও কম কিছু।
রুপকথার গল্পে পড়েছিলাম অচীন পুরের দানবেরা এসে কোনও রাজ্যের সবাইকে ঘুম পাড়ানী যাদূ করে গেছে! ঘুম ভেঙ্গে কেউ আর কাউকে চিনতে পারে না! সব ভোলানোর সেই ইন্দ্রজাল আজ আমাদের গ্রাস করেছে! আজ মনে হয়, সব ভুলে যাওয়ার সেই দেশে বাস করি আমরা। Rangs ভবন নিয়ে আমাদের এই সাম্প্রতিক উৎকণ্ঠার মেয়াদ কতোদিন সেটা হিসেব করলেই দেখা যাবে কেন কর্তৃপক্ষ এতো উদাসীন। ঠিক কতোদিন পরে আমরা পুরোপুরি এই ঘটনাটি ভুলে যাবো তার হিসেবটা সহজ।
২০০০ সালের নভেম্বর। নরসিংদিতে গার্মেন্টস এ অগ্নিকান্ডে ৪৫ জন শ্রমিকের মৃত্যু।
২০০১ এর আগষ্ট। মিরপুরের গার্মেন্টস এ অগ্নিকান্ড। ২৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু।
২০০৫ এর এপ্রিলে সাভারের স্পেকট্রাম গার্মেন্টস দূর্ঘটনায় ৬৪ শ্রমিকের মৃত্যু।
২০০৬ এর ফেব্রুয়ারী। চট্টগ্রামের গার্মেন্টস এ অগ্নিকান্ড। ৫০ জনের অধিক শ্রমিকের মৃত্যু।
এগুলো শুধু বড় বড় কয়েকটি উদাহরণ। ছোট গুলো আজ হয়তো খুঁজলেও জানা যাবে না! এভাবেই বিগত ১৫ বছরে ৩৫০ জন গার্মেন্টস শ্রমিক আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছে, প্রত্যেকবারই ভবিষ্যতে নিরাপত্তা জোরদারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আর ঘুম থেকে উঠে প্রত্যেকটা ঘটনাই আমরা ভুলে গেছি মন্ত্রাহতের মতো! আজ পর্যন্ত একটা ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট আমরা চোখে দেখি নি। কাউকে বিচারের কাঠগঢ়াতে দাঁড়াতে দেখি নি।
একেরপর এক গার্মেন্টস এ আগুন ধরিয়ে দিয়ে মালিকেরা যখন ইন্স্যুরেন্সের টাকা গুণতে ব্যস্ত তখন আমরা পত্র-পত্রিকাতে ২/১ টা মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে এবং পড়ে নিরাপত্বা বৃদ্ধির কাগুজে দাবী-দাওয়া তুলে অতঃপর ঘুমিয়ে গেছি। ঘুম থেকে উঠে জ্যাম জেলী সহযোগে নাস্তা এবং অতঃপর নতুন আরেকটা দূর্ঘটনা ঘটা অবধি বধীর জীবন যাপন করেছি।
এভাবেই পেরিয়ে গেছে দিন, মাস, বছর। এভাবেই পেরুবে আরো অনেক মাস। অনেক বছর। এটা আমাদের চে ভালো জানে তারা, যারা আমাদের এই উদাসীনতাকে পূঁজি করে এতোদিন বানিজ্য করে এসেছেন।
আমরা ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ ভুলেছি ২ দশকেরও কম সময়ে!
‘৯২ সালে পাকিস্তান যখন ক্রিকেটের বিশ্বকাপ জয় করে তখন ঢাকার রাস্তায় বিজয় মিছিল বের হয়। রাতের নিরবতা ভেঙ্গে “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” ধ্বনী তুলে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দেয় পাকিস্তানের সমর্থক ক্রীড়ানুরাগীরা! আমার এখনও মনে আছে সেটি ছিল ২৫ শে মার্চের রাত!
এমনই আত্মবিস্মৃত জাতির কাছে সামান্য শ্রমিকের জীবনের মূল্য ভিক্ষা চেয়ে আবেদন করবো আমরা?!! আগে তো দেশের মূল্য, স্বাধীণতার মূল্য – এগুলো ঠিকঠাক মতোন বুঝি! এরপর ছোট বিষয়গুলো তে মন দেয়া যাবে। একসাথে সবকিছু বুঝতে গেলে ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া কচি বাচ্চার মতোন স-অ-ব ভুলে পরীক্ষায় ফেল করবো!
বিজয় স্মরণীর বাতাসে এখন লাশের গন্ধ ভাসে। ঝুলে থাকা ৪টি লাশ আমাদের সেই উদাসীনতা আর অবিমৃশ্যতার দলিল! কিন্তু এরকম দলিল আমাদের সবার হাতে হাতে। আর গলিত বা পোড়া লাশের গন্ধও আজ আর নতুন কিছু নয়। নরসিংদী থেকে শুরু করে মিরপুর, সাভার আর কানসাট থেকে শুরু করে বিজয় স্মরণী -- কোথাও নতুন কোনও ইতিহাস লেখা হয়নি। হয়েছে শুধু পূণরাবৃত্তি। আজ আমরা জানি শ্রমিকের জীবনকে সামনে রেখে কিভাবে রচিত হয় মালিকের ঢাল। জনজীবনকে নিরাপত্তাহীন করে কিভাবে রচিত হয় রাজনীতির কূটকৌশল! শেরাটনের সামনে অগ্নীদগ্ধ বাসে মৃত মানুষের মচমচে শরীর আর আজকের Rangs ভবনের ঝুলন্ত লাশের গন্ধ কি এক নয়?! কাদের হাতে শেষ অবধি শ্রমিকের জীবন বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পাবে? আমরা কেউ কি গ্রহণ করেছি সেই দায়? সেটা হলেও অন্ততঃ গত ৮ আগষ্টে Rangs এর ১২ তলা থেকে পড়ে এক শ্রমিকের জীবন দান সফল হতে পারতো। কর্তৃপক্ষ সাবধান হতো! সেটা তো হলোই না বরং, নিরাপত্তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আয়োজন না করেও রাজউকের কর্মচারী সেদিন আস্ফালন করেছিলো - ঘটনাটিকে স্রেফ দুর্ঘটনা বলে।
মানবতাবাদিরা আজ আবার মাঠে নেমেছেন। দুর্ঘটনার পাঁচ দিন পরও লাশ অপসারণ ও দাফনের ক্ষেত্রে সরকার ও রাজউকের নিষ্ক্রিয়তাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং Rangs ভবন ভাঙার ক্ষেত্রে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তার কারণ জানতে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। ভবন ধ্বসে নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেকের জন্য ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ চেয়ে বুধবার হাইকোর্টে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ একটি রিট দায়ের করেছে। এই ক্ষতিপূরণের অঙ্ক শেষ পর্যন্ত কতোতে নামে সেটাই এখন দেখার বিষয়। ৭০ টাকা-ঘন্টার শ্রমিকের এতোবড় আস্ফালন সহ্য হবে কি না মালিকের তা বিবেচনার অপেক্ষা রাখে!
কাল টিভি সংবাদে দেখলাম, জনৈক শ্রমিকের একজন আত্মীয় সাংবাদিকের মাইক্রোফোনের সামনে চিৎকার করে বলছেন, “আমরা যামুনা এহেন থেইক্কা! জান দিয়া দিমু, তাও লাশ না লইয়া যামু না!” ছোট্ট একরত্তি আবেদন। অথচ সেটার জন্য জীবন বাজী রেখেছে সে! আমাদের এইটুকুনই শক্তি। কারো অশুভ পরিকল্পনা যেন এই শেষ শক্তিটুকু কেড়ে না নেয়! ভবন ভাঙ্গার দায়িত্বপ্রাপ্ত “সিক্স স্টারস” এর পরিচালক সম্প্রতি প্রতিশ্রুতি করেছেন, পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়ে ভবিষ্যতে ভাঙ্গার কাজ চালানো হবে যেন আর কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে। এই আশ্বাস বাণী শুনে আমার আবারও সেই ঘুম পাড়ানী মন্ত্রের কথা মনে হয়েছে! একই প্রতিশ্রুতি শুনে বারবার আমরা ঘুমিয়ে গেছি। এবারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন না দেখে আমরা যেন কিছুতেই আর না ঘুমাই! স্বজনহারাদের সাথে আমাদেরও কাটুক ২/১ টা নির্ঘুম রাত্রি!!
মন্তব্য
সুশান্তর নিজের উপর ঘেন্না হচ্ছে কলামটা দেখে লিখতে উদ্বুদ্ধ হলাম!
ধন্যবাদ তাকে
ড়্যাংস ভবন অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধানে ভাঙা দরকার। যতদূর মনে পড়ে, রাজউকের কাছে এই ভবনের নকশা মেলেনি, মেলেনি ভবন মালিক আর নির্মাতাদের কাছেও, ফলে নকশার অভাবে ডেমোলিশন এক্সপার্ট দিয়ে এই ভবন ভাঙা সম্ভব হয়নি। হাতুড়ি শাবল দিয়ে এতোবড় একটা ভবন ভাঙার কাজে এক কোটি টাকা খরচ হবে, পড়েছিলাম। কিছু শ্রমিকের তাতে কর্মসংস্থান হয়তো হয়েছে। কিন্তু যারা কাজটি হাতে নিয়েছেন, তাঁরা ভবন ভাঙার কাজে সুদক্ষ কোন প্রকৌশলী কি নিয়োগ করেননি, শুধুই রাজমিস্ত্রি দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন? এ ব্যাপারে অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন।
হাঁটুপানির জলদস্যু
সেই সময় আমিও পড়েছিলাম যে, ৩ কোটির মতোন খরচা করলে নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণের মাধ্যমে এটাকে মুহুর্তেই গুঁড়িয়ে ফেলা সম্ভব।
তদন্ত কি হবে রে ভাই। আজ পর্যন্ত একটা ঘটনার তদন্তও কি হইছে?
মানুষ জনমের ন্যুনতম অহংটুকু ও হারিয়ে ফেলেছি আমরা
----------------------------------------
পাখীটা উড়ে যেতেই চাঁদ উঠে পড়লো-
আজো সেই রক্তমাখা মুন্ডুটাই উঠলো ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
আসলে টেন্ডারের মধ্যেই এই শর্ত থাকা অত্যাবশ্যক যে দুর্ঘটনা হলে প্রতি শ্রমিক কতটুকু ক্ষতিপূরণ পাবে। এটা সাধারণ আইনও হতে পারে। তাহলে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে আর দরাদরির সুযোগ থাকবে না। যেহেতু ক্ষতিপূরণের ভয়ে ঘুষ দিয়ে লাশ রাতের আঁধারে লুকিয়ে ফেলার রীতি আছে, নিখোঁজ সবাইকে মৃত ধরে টাকা রেডি রাখার আইনও থাকা উচিত, এবং নির্দিষ্ট সময় পরে তার জীবিত থাকার প্রমাণ উপস্থাপিত করতে না পারলে সেই ক্ষতিপূরন দিতে বাধ্য করা দরকার।
ঠিকাদারকে এ ব্যাপারে বীমা করতেও বাধ্য করা যেতে পারে, কন্ট্র্যাক্ট পাওয়ার পরে। যার রেকর্ড খারাপ হবে , কোন বীমা কোম্পানী তার বীমা নেবে না, সুতরাং তাকে ব্যাবসা বাদ দিতে হবে।
র্যাংস ভাঙ্গার ব্যাপারে যে indecent hasteসরকার ও (আদিষ্ট) বিচারকরা দেখিয়েছেন, তাতে মনে হয় এটা কোন অধুনা পরম ক্ষমতাময়ের ব্যক্তিগত আক্রোশ। বসুন্ধরা গ্রুপ-ও এতে আছে। অন্যদিকে আওয়াল মিন্টু আর বেঙ্গলের লিটু দেশের অর্থনীতি চালু রাখার জন্য নাকি এতই প্রয়োজনীয় যে তাঁদের মুক্তি না দিয়ে উপায় ছিল না।
কাকে কি বোঝায় !
@ বজলুর রহমান,
আইন তো ভাই আছেই।
মৃত শ্রমিকের জন্য "বেঁচে থাকলে অবশিষ্ট জীবনে সে যতো টাকা আয় করতে পারতো, তার সমপরিমাণ টাকা" দেবার বিধান নাকি রয়েছে।
কিন্তু আইন মানার দরকারটা কোথায়? না মানলেই যদি চলে যায় তবে শুধুই অর্থের অপচয় আপনিও চাইবেন না, আমিও না।
দরকার আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ। কঠোর ভাবে।
নতুন মন্তব্য করুন