১.
তখন গবর্নমেন্ট ল্যাবোরেটরী স্কুলের দশম শ্রেনীতে পড়তাম। ১০ম শ্রেনী মানেই হলো স্কুলের মোড়ল। হাটাচলায় ভাবসাবই অন্যরকম। হালের ফ্যাশন সব মুখস্ত, খালি স্কুলে নেভি ব্লু আর সাদার কড়াকড়ি থাকায় কিছুই ফুটাতে পারি না। অবশ্য এর মধ্যে থেকেই কোনও কোনও ‘বাবা রাসেল’ বঙ্গবাজার ঘেটেঘুঁটে নেভিব্লুর কাছাকাছি কিন্তু “ক্ষ্যাত” না এমন রঙের টাইট জীন্স, সাদা রঙের ২ পকেটওয়ালা পাঙ্ক-শার্ট (স্কুলেরটা ছিল ১পকেট, সঙ্গে স্কুলের লোগো) আর হাই কলারযুক্ত জুতো পড়ে স্কুলে আসতো। এগুলো পড়ার বিড়ম্বনা হিসেবে সারাদিনই টিচারদের দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে হতো। শেভ করাটাও তখন সবেমাত্র ক্লাস আর পরিবারের সর্বত্র ‘স্বীকৃত’ হয়েছে। সুতরাং সুগন্ধী আফটার শেভ মাখার দুর্বিনীত ইচ্ছেটাও পূরণ করা হতো! ‘স্বীকৃত’ এজন্য বলছি যে, এর আগেই শেভ করাটা প্রাকৃতিক কারণে শুরু করা লাগলেও, ১ম ১ম হাঁ-গোফ হবার পর নাকের নীচে যে আকস্মিক শূন্যতা সৃষ্টি হয় সেটা যথার্থই দৃষ্টিকটু – অনেকদিন ইট চাপা পড়ে থাকা ঘাসের মতোন একটা ফ্যাকাসে ভাব চলে আসে জায়গাটায়! অনবরত শেভ করতে করতে ১০ম শ্রেনী নাগাদ সেটা একটা সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছিল।
২.
যাহোক, সেসময়ে দেশে ব্যান্ড সঙ্গীতের বেশ চল। পাড়ায় পাড়ায় ব্যাঙের ছাতাবৎ ব্যান্ড গজাচ্ছে। আমরা কতিপয় সঙ্গীত পিপাসু সেই সূরে গা ভাসাতে চেয়েছিলাম। কাহিনীটা সেই ব্যান্ড আর সেটার অকুতোভয় ১ম কনসার্ট নিয়ে।
গান আমাদের প্রিয় বিষয় হলেও এসেমব্লীতে দাঁড়িয়ে “আমার সোনার বাংলা …” গাইতে আমাদের ছিল নিদারুন আলস্য। বিশেষ করে “কি শোভা কি ছায়াতে…” এসে আমরা অধিকাংশই শুধু লিপ্সিং করতাম। কিন্তু পি.টি. স্যারের গজকর্ণ সেটা প্রায়ই ধরে ফেলতো! হঠাৎ করে গানের ভলিয়ূম কমে গেলেই একটা পাকানো বেত হাতে উনি লাইনের এমাথা-ওমাথা করতেন। আমরাও কম কিসে – ওনার সাথে সিনক্রোনাইজ করে শব্দ একবার মিউট করতাম একবার বাজখাই করতাম।
জাতীয় সঙ্গীতের ব্যাপারে এই আলস্য দুইশত ভাগ উদ্দীপনা হয়ে ফিরে আসতো ব্যান্ড সঙ্গীতের বেলায়। টিফিন আওয়ারে শুধু নয়, ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকেও চলতো আমাদের বাথরুম সিঙ্গারদের সঙ্গীত চর্চা। নতুন কোনও এলবাম বের হওয়া মাত্র টিফিনের টাকা, রিক্সাভাড়া ইত্যাদি গুচ্ছের ধনের মতোন জড়ো করে ছুটতাম নিউ মার্কেটে। ২/১ কপি ক্যাসেট এরপর হাতে হাতে ঘুরতো বেশ কদিন। আর ক্লাসে চলতো সেগুলোরই রিহার্সেল। এরকম করতে করতেই একদিন ব্যান্ডের ভুত মাথায় চাপলো। সাথে ২/১ জন বন্ধু-বান্ধবের উৎসাহ আগুনে ঘি ঢালার মতোন অবস্থা তৈরি করলো। সুতরাং তখন আর ব্যান্ড না করলেই নয়! যেমন ভাবা তেমন কাজ। পরবর্তি ১ দিনের মধ্যে ব্যান্ডের নাম, লোগো (যেগুলো করতে সঙ্গীত-সংক্রান্ত কিছুই লাগে না) নির্বাচন শেষ হয়ে গেল। এরপর গায়ক বাদক জোগাড়ের পালা। যেহেতু বন্ধুরা মিলে ব্যান্ড গড়া হবে, সেহেতু সকল ক্রীড়নক বন্ধু-সার্কেলের ভেতর থেকেই নির্বাচিত হতে হবে। সুতরাং একেকজন পছন্দ মতোন ভূমিকা নিয়ে ফেললাম, যেটা যে আগে দাবী করতে পারলো সেই হিসেবে। গুনাগুন বিচারের ব্যাপারটা এই টালটামাল অবস্থার ভেতরে খুব একটা হালে পানি পেল না। অতঃপর ব্যান্ডের লাইনআপ দাঁড়ালো নিম্নরুপ:
ভোকালিস্ট: আমি আর হেলাল। কারণ আমরা সবার আগে এই পদবী দাবী করেছি।
লিড গিটারিস্ট: সায়ান। এর কারণ, সোলস এর নাসিম আলী ওর আত্মীয় হন। সেই হিসেবে ভালো একটা পোস্ট পাওয়া সায়ানের অধিকার। উপরন্তু সে একটা গীটার জোগার করতে পারবে বলেও দাবী করলো। এটা শুনে আমরাও খুব উচ্চবাচ্য করলাম না, কারণ গীটার বাজানো দূরে থাক, কোনওদিন ধরেও দেখি নাই।
রিদম গীটার: পরাগ। কারণ ওর ভাই কোনও এক ব্যান্ডে রিদম বাজাতেন। সুতরাং, পরাগ আমাদের সবার চে' গীটার বেশী বুঝবে -এটাই স্বাভাবিক।
কি-বোর্ড: হেলাল। ও কিছুদিন গান শিখেছে, একটা হারমোনিয়ামও ছিল। অনেকেই মত দিলো যে, যন্ত্র ২টা আসলে একই; সুতরাং হারমোনিয়াম বাজাতে পারলে কি-বোর্ডও হেলাল পারবে।
বাদ পড়লো নাফিস, যে কি না শিল্পী বাছাইয়ের সময় উপস্থিত থাকতে পারে নাই। যদিও পরবর্তি জীবনে একমাত্র নাফিসই গায়ক হিসেবে ২ টি এলবাম বের করে। টিভি’র ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে গানও করে সে। “এলোমেলো” নামক সেই গান হীট হয় এবং অনেকদিন রাস্তাঘাট, হোটেল, দোকানপাট সর্বত্র বাজতে শুনেছি!! কিন্তু ছাঁইচাপা সেই প্রতিভা খুঁজে নিতে পারি নাই বিধায়, আমাদের তদানীন্তন ব্যান্ডে ওর জায়গা হলো ম্যানেজার হিসেবে।
৩.
লাইনআপ ঠিক করার পরে কিছুদিনের মাথায় আমাদের কনসার্ট করার খায়েশও চাড়া দিয়ে উঠলো। কবে এবং কিভাবে এই বাসনা চরিতার্থ করা যায় সেই আলোচনায় আমরা পরবর্তি কয়েকটা দিন নির্ঘুম কাটালাম। ঠিক হলো, আসছে ‘স্কুল ডে (School Day)’-তেই আমরা আমাদের প্রতিভা পোলাপানদের দেখিয়ে দেবো। স্কুল ডে’র গতানুগতিক মেন্যু ছিল ক্লাসরুম সাজানো এবং দেয়ালিকা করা। এরপর টিচাররা সেগুলো দেখে বিচারের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ হিসেবে ৩ টি ক্লাসকে পুরষ্কৃত করতেন। সেবার আমাদের প্রধান শিক্ষক মোঃ জহিরুল হক ওরফে ‘টাইগার’ স্যার পরিকল্পনা করলেন যে, স্কুল ডে’তে একটা মিলাদ মাহফিলেরও আয়োজন করা হবে। পরিকল্পনার এই আচম্বিত মোড় নেওয়া সম্পর্কে আমরা কয়বন্ধু ছিলাম অজ্ঞাত। কারণ তখন কনসার্ট করে স্কুল মাতানোর স্বপ্নে আমরা সবকয়টা একেবারে বিভোর।
কনসার্ট করতে হলে প্র্যাকটিস অপরিহার্য, সেটা অনুধাবন করে আমরা সুইটেবল ভেন্যূ আর ইন্সট্রুমেন্ট জোগাড়ে মন দিলাম। জায়গা নির্ধারিত হলো আমাদের এক বন্ধু কেল্টুর বাসার ছাদ। পরে কোনওদিন সময় পেলে কেল্টুকে নিয়ে বিস্তারিত লিখার আশা রইলো। ওর জন্য পুরো লেখা বরাদ্দ না করলে বন্ধু হিসেবে আমি অপাঙক্তেয় হয়ে যাবো। জিগাতলায় কেল্টুর বাসার ছাদটা ৫ তলার ওপরে। আমরা সবকজন বন্ধু একবার জায়গাটা দেখেশুনে এলাম। ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবস্থা আছে দেখে আশ্বস্ত হয়ে আমরা মন দিলাম ইন্সট্রুমেন্টের দিকে।
কনসার্টের কথায় যারপরনাই আনন্দিত হয়ে একবন্ধু তার ডেক সেটের ২টা টাইটানিক সাইজের স্পিকার ডোনেট করলো, সাথে এমপ্লিফায়ার। গীটার বাদকেরা যার যার প্রমিজ অনুসারে গীটার জোগার করে ফেললো। কীবোর্ড আর মাউথপিসের ব্যবস্থা হলো সম্ভবতঃ নাফিসের বদৌলতে। নির্দিষ্ট দিনে সায়ান দেখলাম একটা ইলেকট্রিক গীটার আর চার চ্যানেলের একটা মিক্সিং মেশিন নিয়ে হাজির! আমরা তো সেই দৃশ্য দেখে একেবারে থ’ মেরে গেলাম। নিজেদের বন্ধুদের মাঝেই এতো বিপুল সরঞ্জাম লুকিয়ে ছিল অথচ ব্যান্ড গঠনে এত্তো সময় নিয়ে ফেললাম?!!!
আমি আর হেলাল উইনিং এর “দূর পাহাড়” আর নোভার “পদ্মার পাড়ে” সহ কয়েকটা গানের লিরিক নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে কেল্টুদের ছাদে হাজির হলাম। বাথরুম সিঙ্গার হওয়া আর ব্যান্ড করা যে এক পদার্থ নয় সেটা বোঝা গেল যখন ৩/৪ ঘন্টা পরেও সবগুলো ইন্সট্রুমেন্টকে ১ স্কেলে টিউন করা যাচ্ছিল না। আমাদের মধ্যে সেই সময় স্কেল জিনিসটা বোঝে শুধু হেলাল, সায়ান আর নাফিস। পরাগ যদিও দাবী করছিল যে, সে এগুলা বিষয় কারো চে’ কম বোঝে না, তথাপি বাস্তবে ওর অবস্থা ঠিক সেরকম পাকাপোক্ত মনে হচ্ছিল না। সকাল ১০ টায় শুরু করে দুপুর ২টা অবধি সে গভীর মনোযোগের সাথে ছাদের এক কোণায় বসে ফ্রেটবোর্ডের বল্টু ঘুড়িয়ে আর স্ট্রিং খোচাখুঁচি করে যেটা করলো সেটার নাম ওর ভাষায় ‘টিউনিং’ হলেও আমরা গীটারের বাজনায় সেটার কোনও প্রতিধ্বনী দেখলাম না! সবাই বুঝলো যে, গীটারে পারিবারিক সূত্রে পাওয়া ওর জ্ঞানটুকু আমাদের এবারের কনসার্টে ঠিক কাজে আসবে না। হতাশ হয়ে বেচারা শেষ পর্যন্ত কনসার্টের সময় গীটার হাতে ধরে স্রেফ দাঁড়িয়ে থাকার অনুমতি চাইলো। আমরা সাবধান করে দিলাম - শুধুই দাঁড়িয়ে থাকা। ও তাতেই রাজি।
আমরা যখন এভাবে যন্ত্রপাতি সমেত সঙ্গীত সমর চালিয়ে যাচ্ছি তখন হঠাৎ কেল্টুর মা ছাদে এসে জানতে চাইলেন আমাদের অগ্রগতি কেমন? আমাদের সঙ্গীত সাধনায় গার্জিয়ান লেভেলের কারো এরকম আগ্রহ দেখে আমাদের আনন্দ হলো ঠিকই, কিন্তু পুর্নাঙ্গ গান শোনাতে গিয়ে কয়েকবার খাবি খেলাম। তথাপি আন্টির উৎসাহ আর হাততালি আমাদের প্র্যাকটিসের গতি তুঙ্গে নিয়ে গেল!
হেলাল গান গাওয়ার আগে প্র্যাকটিস তেমন করলো না, ওর তাল, লয় – সব মোটামুটি ঠিক। নোভার লিড ভোকালিস্ট ফজলের মতোন মাথায় পড়ার একটা ব্যান্ড খুঁজতেই ওর যতো সময় নষ্ট হলো। পোষাক-আশাকটাই যে ব্যান্ডের মূল বিষয় সেটা নিয়ে ওর সাথে তর্ক করলেও পরের দিন আমিও কালো প্লাস্টিকের চুড়ি, অষ্টধাতূর ব্রেসলেট আর রুদ্রাক্ষের মালা ইত্যাকার অতি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সব জোগাড় করে ফেললাম। একটা সানগ্লাস পড়ার ইচ্ছাও রেখেছিলাম গোপনে। পরে যখন দেখলাম সকলেরই পরিকল্পনা মোটামুটি এক, তখন সেটা বাদ দিতে হলো, কারণ দল বেঁধে সানগ্লাস পড়ে গাইতে দাঁড়ালে মনে হতে পারে, অন্ধদের নিয়ে বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে!
যাহোক মোটের ওপর আমরা ২/৩ দিন এভাবে প্র্যাকটিস করেই ক্লান্ত হয়ে গেলাম। প্র্যাকটিস সেশন শেষে এটা ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে, প্র্যাকটিস করলেও পারফরমেন্স তেমন একটা ইমপ্রুভ করছে না। ৮ টি গানের প্রস্তুতি মোটামুটি দাঁড় করিয়ে আমরা ক্ষান্ত দিলাম।
৪.
২ দিন পরে দুপুর বেলায় আমরা সবাই নাফিসের গাড়িতে করে স্কুলে হাজির হলাম। দুরু দুরু বুকে একটা করে ইন্স্ট্রুমেন্ট নামাচ্ছি আর দ্রুত পায়ে ক্লাসের দিকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম যেন টিচার্স রুমের ঐদিক থেকে মিলাদের সূর ভেসে আসছে! ইতিমধ্যে কোনও এক স্টুডেন্ট আমাদের এভাবে কম্যান্ডো স্টাইলে যন্ত্রপাতি সমেত ক্লাসমুখে যেতে দেখে ফেললো। আর দেখামাত্র সে দৌড়ে গিয়ে আরো গোটা কতক সাঙ্গপাঙ্গ সমেত জুটে গেল আমাদের সঙ্গে। ওদের কাছেই জানলাম যে, স্কুলে মিলাদ মাহফিল চলছে। ঢোক গিললাম, মিলাদের মধ্যে কনসার্ট?!
ব্যাপারটা বেশীক্ষণ গোপন থাকলো না। কনসার্ট তখন একটা জনপ্রিয় বিনোদন সবার কাছে। বুঝতেই পারছেন, মুহুর্তের মধ্যে গোটা স্কুলে রটে গেল যে, একটা কনসার্ট গড়াতে যাচ্ছে ক্লাস টেনের সি সেকশনে। আর যায় কোথায়! এ কান ওকান হয়ে সেটা টাইগারের কানেও গেল। এদিকে আমরা সবকিছু গুছিয়ে এনেছি। কি-বোর্ডে বিল্ট-ইন সিকোয়েন্স বাজছে। হাই ভলূয়্যমের সেই বিটের শব্দে পোলাপানের মাঝে আনন্দের ঢল নামলো। মিলাদের ভেন্যূ মুহুর্তে লোকশূন্য হয়ে পড়লো।
ধীরে ধীরে ভীড় এমন বাড়লো যে, ক্লাসে লোকসঙ্কুলান সম্ভব হচ্ছিল না। অনেককেই দেখলাম বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকতে না পেরে জানালার শিক ধরে ঝুলে আছে। সে জায়গা নিয়েও মারামারি শুরু হলো খানিক পরেই। জানালার বাইরের ঝুলে থাকা মুখগুলো ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছিল। অর্থাৎ, কিছুক্ষণ পর পরই নীচে অপেক্ষমানেরা ঝুলন্তদের টেনে টেনে নামিয়ে নিজেদের ব্যবস্থা করছিল।
এমনই অবস্থার মধ্যে আমরা টুংটাং যাইই করি না কেন পোলাপান চিৎকার দিয়ে ওঠে। আমাদের তো ব্যাপক অনুভূতি। নিজেকে বিশাল বড় শিল্পী ভাবতে শুরু করলাম সবাই। বন্ধুরা উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে, গা গা বলে!! সে এক অন্যরকম পরিবেশ! মাঝে মাঝে মাউথপিসে মুখ দিয়ে হ্যালো হ্যালো করি আর চারিদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে যায়!
আমাদের তথাকথিত টিউনিং যখন শেষ হলো, তখন টাইগার কয়েকজন শিক্ষক সহ অকুস্থলে এসে হাজির। রাগে টাইগারের মুখ লাল টকটক করছে। হেড স্যার রাগের জ্বালায় যথারীতি তেমন কিছুই বলতে পারলেন না। খালি আঙ্গুল তুলে শাসানোর একটা ভঙ্গী করলেন। সবকিছু বন্ধ করে মুহুর্তের মধ্যে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যেতে বললেন। জ্বীনের বাদশা ছদ্ম নাম যুক্ত এক শিক্ষক ছিলেন; তিনি বললেন, সব নালায়েকের দল! মিলাদের দিন এই সব কুফরী কাম-কাজ করতেছিস! ছি ছি!!
আমাদের ক্লাস টিচার আ. জা. সি. (আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী) নিজেও বিষয়টাতে অবাক! তিনি হেড স্যারকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফেরত পাঠালেন আর কথা দিলেন আমাদের ব্যাপারটা খুব ভালো ভাবে হ্যান্ডেল করবেন উনি। তো টাইগার বাহিনী চলে গেলে তিনি বললেন তোরা এতোকিছু কি করছিস রে?! আমি তো কিছুই জানি না। আমারে জানাবি না একটু? স্কুল ডে’ তে গান করবি সে তো ভালো কথা! কিন্তু এখন তো সব ভন্ডুল করে দিলি!
কথা কয়টা বলে উনি আমাদের বিচিত্র পোষাক আশাকের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলেন। যেন বুঝতে চেষ্টা করছিলেন ব্যাপারটা কি! আমরা কিছু বলার উপায় দেখলাম না, কারণ, পোলাপান সমস্বরে চেচিয়ে তখন স্যারকে বললো, ২/১ টা গান করতে দ্যান স্যার। স্যারও এই আবেদনে আশ্চর্যভাবে সাড়া দিলেন! বললেন, নিশ্চয়ই, এতো পরিশ্রম করে একটা আয়োজন করছে ওরা। ১ টা গান হোক। কিন্তু এরপর সবাই চুপচাপ চলে যাবা। স্যারের এই আশ্বাস পেয়ে হেলাল আমাকে বললো, “তুই দূর পাহাড় গানটা করে ফেল”। আমি গানটা করলাম। স্যার শুনে বাহবা দিলেন (সান্ত্বনামূলক)! কিন্তু বলেলন এবারে বিদায় হতে।
এইবার গোটা ক্লাসে আবারও হৈ হৈ করে প্রতিবাদ। ওরা ১ টা গান শুনে কনসার্টের মজা পেয়ে গেছে! কিছুতেই আরোও ২/৩ টা গান না শুনে যেতে দেবে না! উপায়ন্তর না দেখে স্যার আরোও ১টা গানের পারমিশন দিলেন। এবারে হেলাল ধরলো, পদ্মার পাড়ে। চারিদিকে হৈ হৈ পড়ে গেল। জানালা ভেঙ্গে পড়তে পারে বলে মনে হলো। বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে ইতিমধ্যে পোলাপানের কনসার্ট-ভিত্তিক খ্যামটা নৃত্য শুরু হয়ে গেছে! সেই জনস্রোতকে সামাল দেয়া দায়!
গান শেষে স্যার বুঝলেন সময় যতো গড়াবে এদের সামলানো ততো বেশী ঝক্কির ব্যাপার হয়ে যাবে। সুতরাং তিনি এবার কড়া ভাষায় সবাইকে সতর্ক করে দিলেন। আমরা প্যাকআপ করতে শুরু করলাম। আমাদের প্র্যাকটিস সেশনের সেরা গানদুটো গাওয়া হয়ে গেছে, বাকি গুলো সেদিন পরিবেশন করলে হয়তো স্যারকে এই জনস্রোত খালি করতে বেশী পরিশ্রম করতে হতো না! কিন্তু বলাবাহুল্য সেদিনের কনসার্টের সফলতা ব্যর্থতার পরিসংখ্যান নিয়ে আমরা কখোনই তর্কে বসিনি। ঐ সময়ের ঐটুকুন প্রাপ্তি আমাদের অনেক দিনের তুষ্টির কারণ হয়ে ছিল।
মন্তব্য
জাঝা
------------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
ধন্যবাদ ভাইজান।
ব্যপক.....। দারুন রোমাঞ্চকর ব্যাপার। স্কুলে হেভী মজা করেছেন। আমাদেরও একই অবস্হা ছিল। ক্লাস ৯/১০ মানে স্কুলের রাজা। কিন্তু আমার স্কুল বদলের কারনে আর রাজা হওয়া হলো না :(।
ধন্যবাদ আপনাকে।
সেটা আর বলতে। মজার সবটুকুন তো ছিল সেখানেই। ৯ম ১০ম শ্রেনীতে উঠে স্কুল বদলানো আসলেই দুঃখজনক!
সেরম!
ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল
@ অমিত আহমেদ,
ধানমন্ডি গভঃ বয়েজের আমার বেশ কিছু বন্ধু ছিল। সবাই পড়তাম মিশাও এডুকেয়ারে। সেখানেরও অনেক স্মৃতি আজ মাঝে মধ্যে টানাটানি করে।
আপনার ওয়েবে জানলাম, আপনি ঐ স্কুলের।
পোলারে নিয়া দেইখা গেলাম। প্রথমে কি ন্তু একলা ছিলাম।
পড়লাম।
ভাল লাগল।
সেই কথা জানানোর জন্য কমেন্ট করব ভাবলাম। তো লগইন করতে হবে। মনে মনে ভাবলাম, যাক আজকে আর পোলা লগে নাই ওমা লগাইতেই বেটায় আইসা হাজির, নিচ দিয়া টান অনুভব করে তাকায়া দেখি সে শার্টের থুতায় ধইরা আছে... কি আর করা আঙুলটা বাড়ায়া দিলাম।
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
হা হা হা, জবর হইছে!
ওরও তো পড়া চাই। চাচারা কি সব লেখে ইগুলান জানা দরকার আছে। কয়দিন পরেই তো ব্লগাইবো।
আমার ২টা ভাগ্নে আছে। পোলার চে কম না একেবারেই। ওদের টানাটানিটা বড় মিস করি এই বৈদেশে আইসা।
আপনাকে ধন্যবাদ।
স্কুলের অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন। দল বেঁধে বাদরামি করার মজা বোধহয় ক্লাস ৯-১০ এর চেয়ে অন্য কোথাও জমে না। আপনার লেখা পড়ে হুড়মুড় করে অনেক স্মৃতি একবারে মনে পড়ে গেল। ধন্যবাদ এত্ত সুন্দর একটা লেখার জন্য।
আরোও অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে করে। মূলতঃ নিজেরই আনন্দের জন্য। কিন্তু আমি ছোট করে কিছুই লিখতে পারি না।
পড়া এবং মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
আপনাদেরটাও শেয়ার করে ফেলেন।
নাকি আপনাদের মনটাই তরল? যা লিখি তারই প্রশংসা করেন! যাইই হোক অনেক ধন্যবাদ।
জব্বর হইছে।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
আপনার গীটার নিশ্চয়ই আমার বন্ধু পরাগের'টার মতোন বাজে না আশা করি! কি কন?
নারে ভাই, আমারো পরাগের মতই অবস্থা।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
খুব মজা পেলাম পড়ে। রসিয়ে লিখতে পারেন বটে!
জাঝা
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
আপনাদের মজা দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল। মজা পেলেন জেনে আনন্দ হচ্ছে।
ধন্যবাদ।
ফাটাফাটি লিখেছেন! হাসতেইয়াছি।
উইনিংয়ের দূরপাহাড়ে গানটা হচ্ছে ব্যান্ডের 'অ তে অজগর'য়ের মতন। মনে আছে, গীটার কিনে প্রথম এইগানটার কর্ডগুলো শিখেছিলাম।
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
আমি শুরু করি জেমস এর অনন্যা দিয়ে; এর পর পরই উইনিং এর দূর পাহাড়।
এখন শুধু "দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় ..." -- গাই
জাঝা x ২
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
ধন্যবাদ বিনয়ী ভাই!
আহা , আমাদেরও একটা ব্যান্ড ছিল -ক্যাটস আই নাম । সেই ব্যান্ডের আবার ম্যানেজার ছিল ৪ জন ।
পুরানা এলবামে ছবি খুজে পেতে পারি । দেখি একবার ছবিটা ব্লগে দেখিয়ে নিয়ে যাবো ।
মূল পোস্ট বহুত মজা হইছে ।
বিশেষ করে উইনিংয়ের দূর পাহাড়ে ....গানটা স্মৃতিকাতর করে দিলো ।
আরে তাইতো তোমাদেরতো একটা ব্যান্ড ছিল...
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
@ আরিফ আর নজমুল ভাই,
আমার ধারণা ছিল লেখাটা দিয়ে অনেক প্রাক্তন গবর্নমেন্ট ল্যাবের পোলাপাইনের খবর পাওয়া যাবে। সেটা না হলেও আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড আর তাদের অনেক সদস্যদের পাওয়া যাচ্ছে, মন্দ নয়!
ছবি দেবার পাশাপাশি গানও পালে তুলে দিয়েন। আমার কিছু সূর টুর ছিল, এখন আর পাওয়া যাবে না। খুঁজতেও চাই না। বলা যায় না আবারও সেই নেশা চাড়া দিতে পারে!
গান তুলে দেয়া যাবে না । ক্যাসেট খুজে পাবো না । তবে কাহিনী লেখা যেতে পারে । আপনার কাহিনীর মতোই মজাদার ।
তাহলে অপেক্ষায় রইলাম। আপনার যা হাত, তাতে লেখাটা যে ব্লকবাস্টার হবে সন্দেহ নাই! আমি আবার হাসতে গেলে ব্লাড প্রেশারের সমস্যা হয়ে যায়। আঁটঘাট বেধে থাকলাম।
দারুন লেখা।
(বিপ্লব)
কি মাঝি? ডরাইলা?
মন্তব্যটা দেখতে দেরী হলো বলে দুঃখিত। লেখা পরের পাতায় চলে গেলে লোকজন পড়ে কম।
আপনাকে ধন্যবাদ দ্রোহী।
"কারণ দল বেঁধে সানগ্লাস পড়ে গাইতে দাঁড়ালে মনে হতে পারে, অন্ধদের নিয়ে বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে!"--
হাসতেই আছি! জব্বর হইছে।
আমার সানগ্লাসটার দাম ছিল ৪২ টাকা; দোকানদার যদিও ১৫০ টাকা হাঁকিয়েছিল। আমি আর হেলাল সেটা শেয়ারে কিনেছিলাম ।
পুরা পাঁচ দিলাম। না দিয়া উপায়াছে?
-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
আপনাকেও পাঁচতারা ধন্যবাদ।
চ্রম!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
নতুন মন্তব্য করুন