সার্টিফিকেট অনুসারে ৩রা ফেব্রুয়ারী আমার বাবার জন্মদিন (আসলটা জানা সম্ভব হয় নাই)। তাঁকে উদ্দেশ্য করে অনেকদিন আগে কোনও এক বাবাদিবসে একবার একটা লেখা লিখেছিলাম। লেখাটা যায়যায়দিন’এ পাঠাই এবং পরের সপ্তাহে চরম উত্তেজনা নিয়ে কয়েকপাতা উল্টে দেখলাম তারা সেটা ছেপেছেন। আমার প্রথম ছাপানো লেখা! বাসার সবাই কাড়াকাড়ি করে সেই লেখাটা পড়লো এবং হেসে গড়াগড়ি দিল। বাবাও লেখাটা পড়লেন শেষ বিকেলে অফিস থেকে ফিরে। মা আমাকে ডেকে নিয়ে দেখালেন সেই দৃশ্য -- বাবা লেখাটা পড়ছিলেন আর একটু পর পর চোখের জল মুছছিলেন। লেখাটা ছিল চিরাচরিত রম্যধাঁচের; বাবা কেন সেটা পড়ে কাঁদছিলেন আমি তৎক্ষণাৎ বুঝিনি। তবে প্রথম ছাপানো লেখা হিসেবে আমি সেই স্মৃতিটা আজও সংরক্ষণ করি।
লেখাটা এখানে দিতে চাইলাম, কিন্তু যায়যায়দিনের আর্কাইভে সেটা নেই। বাসায় একটা কপি অতি যত্নে সংরক্ষিত থাকলেও আমার কাছে নেই। সুতরাং আর কাঁদা না ঘেটে লেখাটি পুণরায় লিখতে ব্রতী হলাম। বুঝলাম সেটাও অসম্ভব। তথাপি, ফলাফলটা আপনাদের জন্য নিবেদন করছি।
ছোটবেলা থেকে শুরু করলে বলতে হবে যে, আমার বাবা অন্য বাবাদের চেয়ে বেশীরকমের কেয়ারিং ছিলেন। এটা ভালো না খারাপ সেই তর্কে যাচ্ছি না। তবে এই কেয়ারিং হবার কারণে, ছোটবেলার স্মৃতিচারণে কখোনই “ডাঙ্গুলী খেলতাম” – এই কথা লিখতে পারি না। গোটা চারেক লাটিম থাকলেও লাটিমের আল-যুদ্ধে মেতেছি পাড়ার ছেলেদের সাথে – একথা বলতে পারবো না। বাবা লাটিম কিনে দিয়ে বলতেন ঘরেই খেলবা। লোহার রিঙকে চাকা বানিয়ে সেটাকে একটি লাঠি দিয়ে ঠেলে রাস্তায় চালানোর খেলাটা বোধ করি সবাই খেলেছেন। একবার সেই চাকা-খেলার অপরাধে আমাকে বাবা কঠিন শাস্তি দেন। মফস্বলে থাকাকালীন পাড়ার ছেলেপুলেদের সাথে মোটামুটি কোনওরকমের সখ্যতা ছাড়াই আমার শিশু ও বালকবেলা পার হয়। কৈশোরে যখন শহরে আসি, তখন ভাবলাম বাবার এই সুপার কেয়ারীং ভাবটা এবারে একটু ঢিলে হবে; কিন্তু বিধি বাম! ক্লাস টেন পর্যন্ত বাবার ২ চোখের আড়ালে আমি কমই যেতে পেরেছি। এমনকি কলেজে ওঠার পরেও মনে পড়ে, বাবা আমাকে যখন কোনোখানে একটা কাজে পাঠাতেন তখন রিক্সাভাড়ার টাকাটা হাতে দিয়ে বলতেন,
- “শোন, রিক্সাওয়ালা যদি ১০ টাকা চায়, তুমি বলবা ৭টাকা। এরপরে রাজী না হলে বলবা ৮ টাকা। না হলে আরেকটা রিক্সা দেখবা”।
আমি ‘হ্যাঁ’ বলে মাথা নাড়ানোর পরে শুরু হতো রিক্সায় কিভাবে বসতে হবে তার কারিগরী নির্দেশিকা। যেন আচম্বিত ব্রেক করলে আমি হুরমুর করে পরে না যাই। বাবার এই শতর্ক বাণী আমি বহুবার শুনেছি, কিন্তু আমি সেটা আয়ত্ব করতে পেরেছি, এটা তাঁর বিশ্বাস হতো না। কারণ, আমি না দেখলেও বাবা আমাকে রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় প্রায়শঃই দেখে ফেলতেন। পরে বাসায় এসে মা’কে বলতেন,
-“তোমার ছেলে তো একটা গরু। ও গরু, ওর বন্ধুগুলাও গরু। ঢাকা শহরে কেউ রিক্সায় উঠে আকাশ দেখে নাকি”!!??
বলা দরকার যে, টয়লেট আর রিক্সা – এই ২টা জায়গাতে অবস্থানকালে আমি জীবনের অধিকাংশ চিন্তাভাবনার কাজগুলো করেছি এবং করি। আর আমার জিগরি দোস্ত পরাগেরও অভ্যাস আমারই মতোন ছিল। বাবা সম্ভবতঃ আমাদের ২ জনকেই এক রিক্সাতে দেখেছিলেন এরকম হা করে সূর্যমুখী হয়ে থাকতে। বাবার নির্দেশ মতো চললে রিক্সা-ভ্রমনের যে রোমান্টিকতা, সেটা আদ্যোপান্ত বিসর্জন দেওয়া লাগে! দুই হাতে সাড়াশীর মতোন ২দিকের হুড ধরে রাখতে হবে আর সর্বশক্তি দিয়ে দুইপা ঠেসে রাখতে হবে পাদানীতে। মনে আছে, প্রথমবার ফ্যান্টাসী কিংডমে গিয়ে লাফাতে লাফাতে রোলারকোস্টারে উঠে যখন ফাঁপড়ে পরি, তখন আয়াতুল কুরসী আর এই ভঙ্গীটা বহুত কাজে এসেছিল। কিন্তু রিক্সার মতো একটা নিরীহ বাহনে ঐ পর্যায়ের সতর্কাবস্থার দরকার হয় না।
শুধু রাস্তাঘাটের দেখাশুনা ছাড়াও বাবা আমাদের ২ ভাইবোনের পড়াশুনার পেছনে লেগেছিলেন অনেকদিন। আমার ক্ষেত্রে এই দেখাশোনার চুরান্ত চর্চা হতো মূলতঃ রেজাল্ট আউট হবার পরপর। স্কুলে রেজাল্ট হবার পরে খাতা বাড়িতে পাঠানো হতো গার্জিয়ানের সই নেবার জন্য। খাতায় ১ টা করে ভুল দৃশ্যমান হতো, আর সাথে সাথে আমি চোখ-মুখ কুঁচকে আগমনী চড়ের জন্য তৈরি হতাম। আমার প্রতিটা ‘ভুল’কে বাবা মনে করতেন ভবিষ্যৎ পেশাগত অবস্থান থেকে একেকটা স্খলন। আমার জন্য ওনার কল্পিত পেশা ছিল এঞ্জিনীয়ার; একটা ভুল পাওয়া মাত্রই উনি সেখান থেকে আমাকে এসিসটেন্ট এঞ্জিনীয়ার পদে নামিয়ে আনতেন। বরাবর আমার ভুল হতো একাধিক। ফলে সাইন সহ খাতা ফেরত পেতে পেতে ভবিষ্যৎ পেশা কৃষিকাজ বা মাছধরায় গিয়ে ঠেকতো। শাইখ সিরাজ সাহেব এতে খুশী হলেও বাবার খুশির কোনও কারণ ছিল না। ফলে, বাবা হিসেব দিতে শুরু করতেন, গ্রামের কোন সাইডে আমাদের কি পরিমান জমিজমা আছে – লেখাপড়ার পেছনে এইভাবে টাকা না ঢেলে জমিজমা চাষাবাদ করতে আমাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়াই যে উত্তম, সেটা বুঝাতে। এই অপমান আমার অন্তর্নিহিত পটেনশিয়াল (বাবার ভাষায়)-কে জাগ্রত করার জন্য করা হতো সেটা আজ টের পাই।
এটা অনস্বীকার্য্য যে, আমার ভুলগুলোও ছিল খুবই মারাত্মক প্রজাতির। বাক্যের মধ্যখান থেকে অক্ষর বা গোটা-শব্দ উধাও হওয়া ছিল আমার ফিচার্ড মিসটেক। এছাড়াও অমোনোযোগী হবার কারণে আরোও বাহারী ভুল করতাম। একবার পরীক্ষায় ব্যাঙের পৌস্টিকতন্ত্র আঁকতে দিয়েছে। আমি মানুষের পৌষ্টিকতন্ত্র এঁকে বিভিন্ন অংশ লেবেলিং করেছি। অতপরঃ নীচে সুন্দর করে লিখেছি ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র। বাবা এই দৃশ্যের ভয়াবহতা সহ্য করতে পারলেন না। পিকনিক-স্পট থেকে কিনে আনা পাকানো বেতের সর্বোত্তম ব্যবহার করলেন। বলাবাহুল্য যে, প্রতিবারই আমার রেজাল্ট আউটের দিন বাড়িতে রোজহাশরের অবস্থা হতো!
অবশেষে বুয়েটে ওঠার পরে, সম্ভবতঃ সাবজেক্ট (মেকা) অপরিচিত হওয়াতে, ওনার নজরদারী থেকে আমার রেহাই মেলে। তথাপি রেজাল্ট আউটের পরপর পারতপক্ষে বাবার মুখোমুখি হতাম না। নিতান্তই দেখা হলে, আগে আমার বাদবাকি বন্ধুদের রেজাল্ট শোনাতাম যারা আমার চেয়েও খারাপ করেছে। তারপর সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতাম কেন ওদের রেজাল্টের ঐ দুর্দশা- প্রশ্ন কতোটা খারাপ হয়েছে ইত্যাদি। এরপর আমার রেজাল্টটা শুনলে বাবার ভাবান্তর কম হতো - এতো কিছুর পরেও ছেলে তার বন্ধুদের থেকে ভালো করেছে -- এটাই কম কিসে!!
বাবার চরিত্রের এইসব কাঠিন্য ছিল মূলতঃ আলগা বালির মতোন। তাঁর ভেতরে একটা আপাদমস্তক নরম মানুষ বাস করতো। হিন্দি সিনেমার অসম্ভব পোকা হওয়াতে তার ভেতরের এই নরম মানুষটাকে প্রায়ই দেখার সুযোগ মিলতো। আমি চোখ বন্ধ করলে আজও দেখি থমথমে মুখ আর অশ্রুস্বজল চোখে বাবা বসে আছে টিভি সেটের সামনে। কেউ দেখে ফেলবে এই ভয়ে ঠোটে ঠোট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছেন। কারণ, ঐসময় হয়তো বুড়ো ধর্মেন্দ্রর তদপেক্ষা বুড়ো মা-বাবা’কে সপরিবারে নিপেশ করেছে অমরেশপুরীর ভাড়াটে গুন্ডা-দল। ধর্মেন্দ্র হেমার সাথে নর্তন-কুর্দন করে ঘরে ফিরে সেই দৃশ্য দেখে কেঁদে-কেটে একসা’ -- সাথে আমার বাবাও কান্নার বান ডেকেছেন। তবে বেশীক্ষণ নয়, হয়তো একটু পরেই শুনতাম, "আগার মা কা দুধ পিয়া তো.....", সাথে সাথে বাবাও চিৎকার করছেন,
-“মার হারামী গুলারে! মার! … … … শয়তানের দল, দ্যাখ এহন কেমন লাগে!! ”
তখন টিভির সামনে না থাকলেও বুঝতাম যে, ধর্মেন্দ্র পেশাদারিত্বের সাথে তার প্রতিশোধ গ্রহন শুরু করেছে। অধিকাংশ সময়ই দেখেছি ভিলেনরা প্রচুর বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন হলেও নায়ককে বন্দী করার পরে তাদের সব বুদ্ধি লোপ পায়! টুপ করে মেরে ফেললে ল্যাঠা চুকে যায়, কিন্তু তা না করে অনেকক্ষণ ধরে নায়ককে বসিয়ে রেখে নায়কের পিত্তি-জ্বালানো নানাবিধ কথাবার্তা বলবে কিংবা নায়িকাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নাচাবে। এইসব করতে করতেই কিন্তু ভিলেনের বারোটা বাজে! বাবা এরকম হাজারটা ছবি দেখেও শেষ দৃশ্যের এই উৎকন্ঠা ধরে রাখতে পারতেন না।
বাবার প্রিয়তম কাজগুলোর মধ্যে একটা ছিল বাজার করা। ছোটবেলায় সাধারনজ্ঞান বইয়ে পড়া অনেককিছুই ভুলে গেছি। শুধু কোনজায়গার কোন খাবারটা সেরা – সেগুলো বাদে। কারণ আমাদের বাড়িতে দই আসতো বগুড়া থেকে। মিষ্টি আসতো সিরাজগঞ্জ থেকে। আর আমের সময় আম আসতো রাজশাহী থেকে। আমাদের চায়ের যোগান দিতো সিলেটের এক ব্যবসায়ী। মাছের জোগান দিতো সদরঘাটের আড়তদার। বাবা সপ্তাহান্তে গাড়ি নিয়ে ভোরে বেড়িয়ে যেতেন সদরঘাটের উদ্দেশ্যে। ফিরে আসতেন বিশালাকার সব মাছ নিয়ে। সেই মাছ দেখে মা যখন বিরক্ত হয়ে বগর বগর আর কাটাকুটিতে ব্যস্ত, তখন বাবা হয়তো ফোন করে ভোজন রসিক আত্মীয়-স্বজনদের একে একে দাওয়াত দিচ্ছেন –
-“বুঝলেন, মাছের নেইজ-ই ১৬ কেজি!! (মানে হচ্ছে, মাছের লেজটার ওজনই ১৬ কেজি! ) খায়া যায়েন দুপুরে। আপনারা ঢাকার মানুষ, এরকম মাছ চোখেও দেখেন নাই জীবনে। তাজা তাজা না খাইলে স্বাদ বুঝবেন না কিন্তু … … ”
বাবার ভোজন রসিক খানদানে আমি ছিলাম সবচেয়ে বড় কলঙ্ক। কারণ অনেকদিন পর্যন্ত (সম্ভবতঃ আজও) আমি চিংড়ি এবং বাইন ছাড়া আর কোনও মাছই চিনতাম না। প্রচুর মাছ খেলেও কোনটার কি নাম সেটা জিজ্ঞেস করলেই আটকে যেতাম।
ভোজনরসিক হলেও বাবা কিন্তু পাকা বাজারী ছিলেন না। বোকা পেয়ে তাঁকে দোকানদাররা প্রচুর ঠকাতো এবং স্বভাবতঃই সেটা বাবা ঠাহর করতে পারতেন না। বাবার কাছে বেশী দামে কিছু বেচার জন্য যেটা করতে হবে সেটা হলো তার প্রিয় বিষয়গুলো, যেমন, প্রিয় রাজনৈতিক দল, প্রিয় ক্রিকেট দল অথবা বাবার গায়ের রঙ, ইত্যাদি থেকে যেকোনও একটার প্রশংসা করা। বাবা দরাজ হাতে সেটার মূল্য শোধ করতেন। অনেকদিন পর্যন্ত জানতাম মোহাম্মদপুরের কোন কসাই নাকি বাবাকে এক্সট্রা খাতির করে। মাংসের দাম কমিয়ে ৭৫ টাকা কেজি (এটা শায়েস্তা খাঁ-র আমলের কথা) রাখে। পরে আমার এক বন্ধুর কাছে জানলাম যে, ঘটনা ঠিক নয়। ও নিজেও সেখান থেকে একই দামে মাংস কেনে। শুধু আপনার জন্য কমায়া রাখলাম স্যার –কথাগুলো যে সর্বৈব মিথ্যে সেটা বাবা ছাড়া আর সবাই বুঝতো।
প্রথম প্রথম বুড়িগঙ্গা ব্রীজ হবার পরে আমাদেরকে নিয়ে প্রতি সপ্তাহে বাবা ব্রীজে যেতেন। এর কারণ যতোটা ছিল নতুন ব্রীজ দেখা তার চাইতে অনেক বেশী ছিল তাঁর ড্রাইভিং প্র্যাকটিস। ব্রীজের এপ্রোচ রোডে পৌছানোর পর থেকেই শুরু হতো ভয়াবহ রিক্সাজট। এখানে সেখানে রিক্সা। ভীড়ের মধ্যে লক্ষ্য করেছি, কোনওরকমে ৩টা চাকার সংকুলান হয় এমন কোনও খালি জায়গা রিক্সাওয়ালারা বরদাস্ত করতে পারতো না। একিয়ে বেকিয়ে নানান কায়দায় জায়গাটা ভরে ফেলতো। ড্রাইভিং এ তখন বাবার সবে হাতে খড়ি। সুতরাং রিক্সাওয়ালাদের এইসব কেরিক্যাচার সে সামাল দিতে পারতো না। ফলশ্রুতিতে দেখতাম, আমাদের গাড়ির গুঁতোয় আশপাশের একাধিক রিক্সার চাকা টাল খেত, নাহয় বসে যেত। সবক্ষেত্রেই যে রিক্সাওয়ালাদের দোষ ছিল এমন নয়, তথাপি বাবা একটা করে ঢুসা দিতো আর চিৎকার করতো,
-“এই চোখে দেখো না!! বেকুব!”
রিক্সাওয়ালা ছেড়ে কথা কইবে কেন? বিশেষ করে যাদের চাকা বসে যেত তারা নানারকম অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নামযুক্ত গালাগাল শুরু করতো। বাবার ভোকাবুলারীতে এগুলো না থাকলেও ওদের চেহারা দেখে এসবের অর্থ কিছুটা আঁচ করতে পারতেন। ফলে, এই অভিজ্ঞতা এড়াতে অচীরেই আমাদের এই সান্ধ্যভ্রমনের ইতি টানতে হয়।
যতো বড় হয়েছি ততোই বুঝেছি শুধু রাগ নয়, বোকামী, অতিরিক্ত সৌখিনতা কিংবা ভোজনপ্রীতি – এগুলোর কোনওটাই বাবার একেবারে আসল পরিচয় নয়। ওনার সবচেয়ে আপনার বৈশিষ্ট্য ছিল সন্তানদের প্রতি তাঁর অন্ধ এবং স্বার্থপর ভালোবাসা! সবার ভালোবাসার প্রকাশ একরকম হয় না। বাবার আকাশচুম্বী ভালোবাসার উপযুক্ত প্রতিদান আজও দিতে পারি নাই। তবুও ২/১ টি ঘটনা সান্ত্বনা হিসেবে স্মরণ করি মাঝে মাঝে। তেমনই একটি স্মৃতি দিয়ে শেষ করি।
সারাজীবনই আমার রেজাল্টের দিনগুলো বাড়িতে বিশেষ কালোদিবস হিসেবে পালিত হয়েছে। আমার অমোনোযোগীতা আর উদাসীনতা বারবার বাবাকে চিন্তাক্লিষ্ট করেছে। অথচ এই আমি এসএসসিতে অত্যাধিক ভালো ফল করে ফেললাম! বন্ধুরা যখন আমাকে ফোনে রেজাল্ট শোনালো তখন ফোনের আরেকপাশে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলাম। হাত পা কাঁপতে শুরু করলো! কোনওমতে স্কুলে গিয়ে খবরটা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে আসলাম। অফিসে ফোন করলাম বাবাকে জানানোর জন্য। বাবাও খবরটা শুনে অনেকক্ষন কিছুই বললেন না। খানিক পরে ঝরের মতোন ঘরে ফিরলেন। দুই চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে বাবা একবার মা আরেকবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। মায়ের সাথে চোখাচোখি হতেই মা হ্যা-সূচক হাসি দিল। খুব কাঙ্খিত আর অভাবনীয় কিছু পেলে মানুষের যেমন অভিব্যাক্তি হবার কথা, বাবারও তেমন হলো! কথা বলা দূরে থাক, ঠিক মতোন আনন্দের কান্নাটাও সে কাঁদতে পারবে বলে মনে হচ্ছিলো না। তবে আমি যখন এগিয়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম, তখন সেটা অনেকটাই সহজ হয়ে গেল! ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো বাবা। অনেকক্ষণের জমে থাকা আবেগ অবমুক্ত হলো। আমি নিজেও তাতে দ্রবীভুত হলাম! আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বাবা বললেন,
-"আমি জানতাম রেজাল্ট এরকমই হবে! আমি জানতাম!"
এই বিশ্বাস নিশ্চই বাবাকে আমি দেই নি। এটা ছিল তার নিজস্ব ধারণা! কিংবা আমার প্রতি অন্ধ ভালোবাসা! নইলে এমন ভুলোমনা সন্তানের রেজাল্ট নিয়ে কেউ এতো আশা পুষে রাখে?! সারাজীবন রেজাল্টের দিনে বাবার মার খেয়েছি, গালাগাল শুনেছি। তাতে আমার যতোটুকু ব্যাথা জমেছিল, সেদিন বারবার পিঠে হাত বুলিয়ে বাবা পরম মমতায় সেই শাসনের যন্ত্রনাটুকুই চিরতরে মুছে দিলেন! আমিও হারে হারে উপলব্ধী করলাম আমাদের এইসব অর্জনগুলোই আসলে বাবার সব থেকে বড় পাওয়া! সারাজীবনে তিনি সহায় সম্পত্তি কিছুই করতে পারেন নাই। যা উপার্জন করেছেন দু’হাতে খরচা করেছেন। কিন্তু “জমার খাতা শুন্য” বললেই আপত্তি করতেন। আমাদের দিকে হাত তুলে দেখাতেন। আমরা ২ সন্তানই নাকি তাঁর সবচে বড় সম্পদ!
মন্তব্য
চমৎকার লাগল। পুরো সময়টাতে আপনার বাবার জায়গাটাতে আমার বাবার কথা ভেবেছি।তাতে খুব বেশি বিসাদৃশ্য চোখে পড়েনি।
বাবারা বোধহয় এমনই হয়...
তবে বাবার কড়ানজর আপনার মত এতোটা ছিলনা... অনেক স্বাধীন ছিলাম... ছোট বেলার স্মৃতিগুলোও তাই অসাধারণ।
সার্টিফিকেট এজ হোক আর যাই হোক... শ্রদ্ধেয় মানুষটাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা রইল...(কানে কানে একটা কথা... শুধু তারিখ অনুযায়ী আমি আপনার বাবার দুইদিনের সিনিয়র )
স্বপ্নাহত
বাবারা এমনই হয় - কথাটার সাথে একমত
আপনাকে বিলেটেড হ্যাপি বার্থডে!!
আপনার শুভেচ্ছা পৌছে দেব বাবাকে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
চমৎকার লাগল। পুরো সময়টাতে আপনার বাবার জায়গাটাতে আমার বাবার কথা ভেবেছি।তাতে খুব বেশি বিসাদৃশ্য চোখে পড়েনি।
বাবারা বোধহয় এমনই হয়...
তবে বাবার কড়ানজর আপনার মত এতোটা ছিলনা... অনেক স্বাধীন ছিলাম... ছোট বেলার স্মৃতিগুলোও তাই অসাধারণ।
সার্টিফিকেট এজ হোক আর যাই হোক... শ্রদ্ধেয় মানুষটাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা রইল...(কানে কানে একটা কথা... শুধু তারিখ অনুযায়ী আমি আপনার বাবার দুইদিনের সিনিয়র )
স্বপ্নাহত
@ স্বপ্নাহত
দেরিতে হলেও আপনাকে জন্মদিনে অভিনন্দনাহত করার সুযোগটির সদ্ব্যবহার করা হলো
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
-- আর আমি আপনার নাটকের....
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
যথারীতি চমৎকার লেখা। চালায় যান...
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
ধন্যবাদ ভায়া!
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
...এই লেখাটা কোথায় বসে চিন্তা করেছেন ভাই??
তবে লেখাটি যাকে বলে একেবারে জাঝা। ওয়েল ডান!
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
এদেশে তো ভাই রিক্সা নাই, টয়লেটই একমাত্র ভরসা
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
খুব সুন্দর একটি লেখা হয়েছে। আসলেই সব বাঙালি বাবারাই কম বেশি একই রকম। আপনার বাবাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
স্বপ্নাহতকেও জন্মদিনের বিলম্বিত শুভেচ্ছা।
ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল
ধন্যবাদ অমিত।
সব বাবারাই অনেকখানি এক কি না, সেটা যাচাই করাও লেখাটার একটা উদ্দেশ্য ছিল
আপনাদের অভিজ্ঞতা লিখবেন।
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
জাঝা
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
আপনার নতুন আইকোন এর জন্য (বিপ্লব)
___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
আমার কোনও কৃতিত্বই নেই এতে। সকল প্রশংসা প্রাপ্য দুর্ধর্ষ সচল কার্টুনিস্ট সুজন চৌধুরীর। তিনি আমাকে এভাবেই কল্পনা করেছেন
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
খুব চমৎকার একটি লেখা। আরও লিখুন।
আপনাদের উৎসাহ যদ্দিন থাকছে, লেখাও ততোদিন থাকবে আশা করি
___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
ভারী সুন্দর লেখাটি। বাবারা এমনটিই হয় চিরটা কাল। তাদেরকে আমার নারকেলের মতোন লাগে। উপরে ভয়ানক শক্ত, অথচ ভিতরে কি ভীষণ কোমল।
আপনার লেখাটি পড়ে নিজের বাবার কথা মনে পড়লো। কি দুর্দান্ত রকমের কঠোর শাসক ছিলেন তিনি। আজ মনে হয়, আহা-আমি যদি তার মতো হতে পারতাম।
-নির্বাসিত
_______________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
লেখাটি পড়ে আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমারও ভালো লাগলো। বাবারা আসলেই হয়তো এরকম হয়।
আমি নিজেও আমার বাবার মতোই একজন বাবা এবং স্বামী হতে চেয়েছি।
আমার বোনও চাইতো ঠিক বাবার মতোন চরিত্রের একজন স্বামী।
আসলেই বাবাকে নিয়ে আমাদের আজ অনেক গর্ব হয়! এটা আগে যতোটা হতো আজকাল তার চে অনেক বেশীই হচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই
___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
- লেখাটা আগুন লেগেছে।
অভয় দিলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, গরুরা কি আকাশ দেখে, তাও রিক্সায় চড়ে?
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আপনার গরম মন্তব্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ!
এটা আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করা দরকার।
উনি আরোও অনেক মজার মন্তব্য করতেন।
"অনেক" বোঝাতে আমরা সাধারনত বলে থাকি, "হাজার বার" বা "১৪ বার" ইত্যাদি। আমার বাবা বলতেন, "আঠারো বার"!
ওনার খুব খারাপ গালির একটা ছিল "গরু" - এটা একটা ব্যাক্ষ্যা হতে পারে।
___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
পড়লাম। এই নিয়ে দুই দিনে তিনবার। একবারও কিছু লিখে রেখে যেতে পারিনি। তাই "পড়লাম" টুকুই থাক।
খুব উৎসাহ বোধ করছি।
আপনার "পড়লাম" টুকু সাদরে গৃহীত হলো। আবারও পড়তেই আসবেন। আমি সাধ্যের সবটুকু দিয়ে লিখবো
___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
কালকেই পড়েছিলাম। তবে খুব টায়ার্ড থাকায় কমেন্টানো হয়নি।
যথারিতি চমৎকার একটি লেখা। বাবাকে নিয়ে আমারও লিখতে ইচ্ছে করছে এই লেখাটা পড়ে। কিন্তু অনেক চেস্টা করলেও পারবনা। খুব কাছের কাউকে নিয়ে লেখার আপনার যে অসাধারণ ক্ষমতা, সেটা আমার নেই। একেবারেই নেই।
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
এইরকম মন্তব্য করেন বলেই লোভটা ছাড়াতে পারি না।
আপনার বইয়ের ডিটেইল জানতে চাই। তারাতারি। কিনতে পারছি না এখনই তবে জানতে সত্যি ইচ্ছে করছে।
নাম, প্রকাশক ইত্যাদি।
হ্যা, আবারও অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
খুব মন-ছুঁয়ে যাওয়া লেখা, আগে পড়ি নি কেন ভেবে খারাপ লাগলো। আরো লিখুন।
নতুন মন্তব্য করুন