“অপরিচিত ব্যক্তির দেওয়া কিছু খাবেন না।“ এই কথা আগে শুধু বাসের ভেতরে লেখা থাকতো। আজকাল পার্কে বা খোলা রাস্তায়ও এই রকম সতর্ক বাণী লেখা প্ল্যাকার্ড চোখে পরে। বোঝা যায়, আমাদের দেশে ‘অপরিচিত’ ব্যক্তির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। ফেইসবুকের ভরপুর ‘সামাজিক’ যুগেও কিভাবে এত এত মানুষ অপরিচিত থাকে সেটা একটা বিস্ময়! যাহোক, এই কথাগুলো ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ স্বপ্রনোদিত হয়ে ঢাকা শহরের জায়গায় জায়গায় লিখে দিয়েছিল।
আগে অপরিচিতদের খপ্পরে পরলে টাকা পয়সা নিয়ে ফেরা কঠিন হত, এখন জীবন নিয়েও টানাটানি হয়। কারণ, আগে এরা বিস্কুট, কমলা, ডাব, আপেল ইত্যাদি ভাল ভাল খাবারে চেতনা নাশক ঢুকিয়ে আপ্যায়ন করতেন। উদ্দেশ্য থাকতো যে, টাকা-পয়সা নিয়ে ত্রিসীমানার বাইরে যেতে যতক্ষণ লাগে, ততক্ষণ যেন আক্রান্ত ব্যক্তি অনলাই’নে না থাকে! এটার ভাল দিকও ছিল, সরাসরি ক্রাইম হতে দেখলে অনেকেরই হৃদযন্ত্রে ব্যথা হতে পারে, জ্ঞান না থাকায় অন্তত ঐসব হ্যাপা কম! ঐ ক্ষেত্রে ঘটনার আধা ঘন্টা পরে চেতনা ফিরে পাওয়ার জোড়াল সম্ভাবনা থাকত। অত:পর ‘আমি কোথায়?!’ টাইপের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পর্দা নামতে আরও মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা, তার পরেই বাড়ির পথ ধরা যেত!
আজকাল ফলমূলের দাম বাড়তি বলেই হয়ত ‘মাসিক ছিনতাই খরচ’ কমাতে এরা ঝানডু মলম, মরিচের গুড়া, টাইগার বাল্ম – এগুলোর দিকে ঝুঁকেছেন। উপরন্ত, হাতেনাতে ফল পাবার জন্য এইসব ‘অপরিচিত’ ব্যক্তিরা বাধ্য হয়েই জিনিসগুলার মধ্যে চেতনা-নাশক মিশিয়ে’ও প্রয়োগ করছেন! টাইগার বাল্মের কৌটা ২/৩ হাতের মধ্যে কোথাও খোলা থাকলেই আমার চোথ জ্বালাপোড়া করে! সেখানে পুরো কৌটা মুখে লেপে দিলে কিরকম অবস্থা হতে পারে সেটা ভাবতেও গা শিউরে উঠছে!
অন্য যেকোন দেশের মানুষ, মুখে এই জিনিস লেপে দিলে, অজ্ঞান হওয়ার ভদ্রতা করবে বলে মনে হয় না! সরাসরি মৃত্যু বরণ করবেন! শুধু বাংলাদেশের মানুষ বলেই হয়ত আমাদের ওপরে অপরিচিত ভাইবোনদের এই ‘বেপরোয়া’ আস্থা! তদুপরি, আমাদের বেঁচে ফেরার হার খুবই সন্তোষ জনক। আমি অনেককেই চিনি যারা এইসব ছিনতাইকারীদের আর ‘অপরিচিত’ মনে করেন না! তবে ঘটনা যাইই হোক, ছিনতাইকারীদের এই বাড়াবাড়ি যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমি দেশে তেমন একটা বিপদে না পরলেও বিদেশে এই রকম আপ্যায়নের স্বীকার হয়েছি। ঘটনা প্রায় ১৭ বছর আগের। বলা বাহুল্য যে, জার্মান দেশে আইন কানুনের প্রয়োগ বেশি রকম কড়া। ফলে সেখানে আমাদের দেশীয় কায়দায় কিছু করা প্রায় অসম্ভব। যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেটা নিতান্ত আমার অভিজ্ঞতার স্বল্পতার কারণে। এর সাথে প্রাণ সংহারী আপ্যায়নের কোন সম্পর্ক নেই! বরং, খুবই সুশীল ধরনের আপ্যায়ন!
উলম শহরে আমি তখন মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। প্রচুর পড়াশুনার চাপ। ছেলেপেলেদের নাভিশ্বাস অবস্থা। কিন্তু পড়াশুনা কোনওদিন আমাকে কাবু করতে পারে নাই! সেখানেও অবস্থা তথৈবচ, পুরোদমে ক্লাস চলছে, কিন্তু আমি উদাস হয়ে ক্যাম্পাসের যততত্র হেঁটে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ দেখলাম এক ‘অপরিচিত’ এবং যথেষ্ট সুন্দরী (!) ধরণের এক মেয়ে বিশাল এক বইয়ের স্তুপ নিয়ে ক্যাফেটেরিয়ার ঠিক বাইরে দাড়িয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের তাদের আসা-যাওয়ার পথে লিফলেট দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করছে। অধিকাংশ ছেলে মেয়েই তার এই ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। তাদের ব্যস্ততা চরম। তবে আমি এই ডাকে সাড়া না দেওয়ার কোন উপযুক্ত কারণ পেলাম না! আমার সাথে চোখাচোখি হতেই হাসি দিলাম। মেয়েটার মুখেও হাসি বেড়িয়ে এলো। এই হাসির মধ্যে যে একটা ‘পাইছি!’ ভাব ছিল সেটা আমি ধরতে ব্যর্থ হলাম! বলা দরকার যে, আমার বন্ধু মহলে দুই/এক’জন বিশিষ্ট তালেব-এলেম ছিল যারা মেয়েদের চোখ বা হাসি দেখেই বলতে পারত, এই মেয়ে প্রেম করে কি না! করলে কয়টা করে! চাইলে ফোন নাম্বার দেবে কি না! পরিচয়ের কয়দিনের মাথায় রুম-ডেট করার প্রস্তাব দেওয়া যাবে ইত্যাদি। ইত্যাদি। আমি ওদের এই ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হতাম, কারণ সেই সময় মেয়েদের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলে তার একটাই তরজমা আমার কাছে ছিল – “আমি তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছি।“ মেয়েদের চাহনীতে এর বাইরেও যে ডিএনএ’র মতন এত এত তথ্য লুকানো থাকে সেটা বুঝবার মতন পান্ডিত্য আমার ছিল না!
যেহেতূ দেশী মেয়েদের চোখের ভাষাই ঠিক মতন পড়তে পারতাম না, বিদেশী মেয়ের চোখ পড়ার প্রশ্নই আসে না!
জার্মান ভাষার দখল তখনও ‘ইয়েস’ ‘নো’ ‘ভেড়িগুড’ পর্যায়ে। এগিয়ে গিয়ে বড় ভাইদের শিখিয়ে দেওয়া বিপদের ভরসা এক রত্তি জার্মান বাক্য ছুঁড়ে দিলাম,
- ‘স্প্রেখেন জি এংলিশ?’
এর মানে হচ্ছে, ‘আপনি কি ইংরেজি বলতে পারেন?’ জবাবে অধিকাংশ জার্মানের মতন এই মেয়েও বলল,
- ‘সামান্য। তবে যা পারি সেটা দিয়ে কুলাবে বলে মনে হয় না’।
এই কয়টা কথা ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতেই বলল। আর সেইটুকুন শুনেই বুঝলাম আমাদের ভাব বিনিময় চলতে পারে। আমি তখন সবে জার্মান ধারাপাত এবং বর্নমালা শেষ করেছি। সেইটুকুন আর ‘আই.ই.এল.টি.এস.’ এর ৭.৫ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরলাম। বললাম,
- এত এত বই! বিষয় কি?
মেয়ে আমাকে বুঝালো, তার কাছে নানান কিসিমের পত্রিকা আছে। বিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজ, ফিলোসফি, বাণিজ্য, টেকনোলজি ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ের পত্রিকা। মেয়েটা আরও বলল, পত্রিকাগুলো খুবই ভালো; তবে সেটা কোন বড় কথা না; বড় কথা হচ্ছে, আজকে এক আশ্চর্য রকমের সুন্দর দিন! কারণ পত্রিকার মালিকেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আজকে কয়েকজন সৌভাগ্যবানকে ‘বিনা পয়সা’তে তাদের এই ‘মূল্যবান’ পত্রিকার স্বাদ নিতে দেবেন। আমি চোখ গোল করাতে সে আশ্বাস দিল যে, আমিও সেই সৌভাগ্যবানদের একজন। কিন্তু আমি (পড়ুন, “মফঃ”) তখনও বুঝতে পারলাম না যে মারাত্মক দূর্যোগে পরতে যাচ্ছি। উল্টা বললাম,
- একদম ফ্রী?!
- হু। কোন পয়সা লাগবে না। তবে যেকোন তিনটা পত্রিকা নিতে পারবা।
- তিন’টা??!!!
আমি অবাক হলাম, কারণ বড় ভাইদের বক্তব্য অনুসারে এই মরার দেশে ‘কিছুই ফ্রী নাই।‘ ভাবলাম, পুরা দেশ না দেখেই এই উপসংহার টানা’টা বিরাট অন্যায় হয়েছে! আজকে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবার কঠিন সুযোগ হাতে এসেছে! তাদের সবার পরে জার্মানী’তে এসে এরকম একটা ঘটনা ঘটাতে পারলে গোটা উলমের বাঙালী’র চোখ খুলে যাবে! মেয়েটা বলল,
- তুমি এখন বল কোন কোন পত্রিকা তোমার পছন্দ।
- ইংরেজী ভাষায় যা যা আছে দেখাও।
- একটাও নাই।
- বল কি? সব জার্মান?
- হু; স্যরি। তুমি জার্মান শিখছো না?
- শিখছি। তবে শম্বুক গতিতে। এই গতিতে আগালে পত্রিকা পড়তে আগামী দুই তিন বছর লেগে যাবে!
কথা কয়টা ইংরেজীতে বলে মাফ চাইলাম, কারণ মেয়েটা না বুঝে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে অর্থহীন ভাবে হাসছিল। বলল,
- ইয়ে, ... তুমি যদি জার্মান কোর্সে ভর্তি হয়ে থাকো তাহলে এই বই তোমার কাজে লাগবেই। পত্রিকা হচ্ছে ভাষা শিক্ষার অন্যতম সহায়। শুধু লেকচার শুনে ভাষা শেখা যায় না। পত্রিকা পড়তে হয়, মানুষের সাথে কথা বলতে হয়। বই পড়ে ভাষা শেখা যায় না।
আমি এই মেয়ের যুক্তিতে মুগ্ধ হয়ে গেলাম! অতি সত্যি কথা! এই মেয়ের বুদ্ধি অসাধারণ! বললাম, তাইলে কি নেবো? তুমিই বলে দাও। মেয়েটা বলল,
- একটু চোখ বুলাও। দেখো কোনটা তোমার চোখে ধরে। যেহেতূ কোনওটাই বুঝবে না, সেহেতূ সবগুলাই তোমার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
আমি এই কথায় আরও মুগ্ধ হলাম, জার্মান মেয়েদের বুদ্ধি সম্পর্কে মারাত্বক ভুল ধারনার সেটাই ছিল শুরু!
চোখ বুলাতে বুলাতে হঠাৎ দেখি একদিকে কয়েকটা ‘প্লে বয়’ এর কপি। আনকোড়া নতুন মোড়ক। পত্রিকার কাভার চকচকে মোটা কাগজে বাঁধানো হলেও সেখানে যাদের ছবি দেওয়া তাদের গায়ে কোন ‘কাভার’ নেই! একে তো বিদেশ বিভুম, তার ওপরে অল্প বয়স। উথাল পাথাল যৌবন নিয়ে চোখে শর্ষে ফুল দেখতে লাগলাম! আমার চোখ যে ঐদিকে আটকে গেছে সেটা মেয়েটারও চোখ এড়াল না। বিরাট লজ্জা পেয়ে গেলাম .....!
বড় ভাইদের কথা আবার স্মরণে আসল, কোন কিছুতেই লজ্জা পাবার কারণ নাই। এই দেশ হচ্ছে লজ্জাহীনতার দেশ! তথাপি, ঐ মুহুর্তে দুষ্টু-পত্রিকার দিকে তাকিয়ে ছিলাম ভেবে যথার্থই লজ্জিত হলাম।
ছোটবেলায় যখন ঢাকা কলেজে পড়ি, তখন কলেজের গেটের বাইরে এক মামু নানাবিধ ‘দুষ্টু’ বইয়ের পসার সাজিয়ে বসে থাকতেন। হাতে থাকতো একটা পাখা। মামুর হাতে পাখা কেন থাকতো সেটা বোঝা সহজ; সেই দোকানের সামনে দাঁড়ালে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা যেকোন ঋতূকেই মনে হত প্রখর গ্রীষ্ম। দোকানের বিভিন্ন বইয়ের রগরগে প্রচ্ছদ আর ততোধিক রগরগে শিরোনাম কোনমতেই তাপমাত্রা ৪০ এর নিচে নামতে দিতো না! কলেজে উঠে গেলেও সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে বই দেখতে লজ্জা লাগত; তাই নানান ছুঁতায় আর্মির কুচকাওয়াজের ভঙ্গিতে ঘাড় দোকানের দিকে ফিরিয়ে রেখে সামনের রাস্তাটায় অনবরত আগে-পিছে করতাম। তখন বয়সটাই এমন যে, কোন অমসৃণতা বা উঁচু-নিচু’ই দৃষ্টি এড়াত না! “আপনার স্বাস্থ্য, সেবা রোমান্টিক, অমূকের যৌনজীবন, মাসুদ রানা” ইত্যাদি বইয়ের মলাটে চোখ আটকে যেতো!
আমাদের বয়সে জার্মান ছেলেমেয়েদের পঞ্চকলা দর্শন শেষ হয়ে যায়। সুতরাং, এই সব পত্র-পত্রিকা তাদের মনে ততোটা ঢেউ তুলতে পারে না, যতটা আমার মতন বুভুক্ষ এবং চরিত্রবান যুবকের মনে তুলতে পারে। আমরা যে জীবনের প্রথম কোয়ার্টার সেঞ্চুরী বিনা সেক্স’এ পার করি সেটা শুনে ওরা এমনভাবে তাকায় যেন, ‘বিগত পঁচিশ বছর যাবৎ দানা-পানি ছাড়া শুধু কাঠালের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকা’র রোমহর্ষক কাহিনী বয়ান করছি।‘
যাহোক, আমার মনের অবস্থা আঁচ করতে পেরে মেয়েটা বলল,
- ‘এমন একটা পত্রিকা তোমার নিতে হবে যেটাতে কথা কম, ছবি বেশি’। এই যেমন ধর এই ‘প্লেবয়’ পত্রিকাটা। এইটাতে প্রচুর সুন্দর সুন্দর ছবি আছে। কিন্তু লেখাজোখা কম। তোমার ডয়েচ জানার কোন দরকার পরবে না।
আমি এই কথা শুনে সজোড়ে সায় দিয়ে বললাম, ‘ঠিক ঠিক। একদম ঠিক কথা’! এরপরে বাকি দুইটা পত্রিকা নিয়ে আমার কোনোই আগ্রহ ছিল না। নিতান্ত মেয়েটার কথা মোতাবেক আম-জাম গোছের আরও দুইটা পত্রিকা বগলদাবা করে আমি তখন ডরমে ফিরতে উন্মুখ। এমন সময় মেয়েটা বলল,
- জাস্ট একটু ফরমালিটি আছে, আমি একটা জরিপ রাখছি, যারা আমার কাছ থেকে বই নিচ্ছে। তোমাকে এই কাগজে নাম আর ঠিকানা লিখে একটা দস্তখত দিতে হবে।
ভাবলাম বিদেশ বিভুঁইয়ে কে কার খোঁজ রাখে, দিলামই না হয় দস্তখত! এইখানে স্মর্তব্য ছিল যে, বড় ভাইয়েরা না পড়ে এবং না বুঝে কোন কাগজে সই করতে বারন করেছিলেন, আমি শয়তানের ওসওয়াসা’য় পরে সেই তথ্য বেমালুম ভুলে সই দিয়ে বই নিয়ে চলে আসলাম।
পত্রিকা এনে ডরমে সকল বাঙালিকে তাক লাগিয়ে দিলাম! মনজু ভাই আমার কাছে পত্রিকা ধার করার বুকিং দিলেন! পরের মাসে আমার মেইল বক্স চেক করতে গিয়ে দেখি সেই তিন পত্রিকার নতুন মাসের চকচকে নতুন তিনটি সংখ্যা হাজির! গাণিতিক নিয়মে আমার আনন্দ ছয় গুন হল। সেই কাহিনী’ও রাষ্ট্র হয়ে গেল! পত্রিকা ভাড়া দেবার বিষয়ে মনজু ভাই ছাড়াও আরও অনেকের সাথেই চুক্তি হল! তৃতীয় মাসে আবারও সেই অবস্থা! আনন্দ এবারে বন্যার রুপ নিল! এর চেয়ে ভাল দেশ আর কিভাবে থাকা সম্ভব! – নিন্দুকদের উদ্দেশ্যে এইসব প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলাও হল।
দিন যায়, মাস যায়। আমার ঘরে পত্রিকার ওজন বাড়ে। ছয় মাস পরে যখন পরীক্ষার ঠেলা সামলাতে ব্যস্ত তখন মেইল বক্সে বরাবরের মতন নতুন কপি এসে হাজির। সাথে একটা খাম। খাম খুলে চিঠি পড়তে সচেষ্ট হলাম। তখন জার্মান ভাষায় দুই একটা বাক্য বলতে পারি। চিঠিতে বিষয়ের ঘরে বোল্ড করে ‘Mahnung’ লেখা দেখে ভড়কে গেলাম। কারণ শব্দটার অর্থ হচ্ছে ‘জরিমানা”। অফিসে জার্মান কলিগের দ্বারস্ত হলাম। সে চিঠির মর্মদ্ধার করে বলল,
- তুমিও?!! এইগুলা ফাঁদে তো পঞ্চাশোর্দ্ধ লোকজনে পা দেয়। তুমি তো টগবগে তরুণ, পত্রিকা দিয়া তুমি কি করো?
তাকে বুঝাতে পারলাম না যে, সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের ছেলেদের তরুণকাল আর বৃদ্ধকালের মধ্যে নারীচর্চায় তেমন পার্থক্য নেই! আমার কলিগ চিঠির তিন লাইনের সহজ পাটিগণিত আমাকে বুঝায়ে দিল। এক মাসের বকেয়া ২০, সুতরাং তিন মাসের বকেয়া ৬০। ‘বিলম্ব ফি’ ৮। মোট ৬৮ ইউরো। তারও নিচে লেখা আগামী অমূক তারিখের মধ্যে উপরেল্লিখিত টাকা অমুক ব্যাঙ্কের তমুক একাউন্টে জমা না হলে অতিরিক্ত জরিমানা সহ ধার্য টাকার বর্ধিত ডেডলাইন জানানো হবে। এরপরেও টাকা না পেলে কর্তৃপক্ষ আইনগত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
- বাহ্! পত্রিকা তিনটাই তো ফ্রী ছিল!
- হু ছিল। প্রথম তিন মাসের জন্য। তৃতীয় মাসের মাঝামাঝি গিয়ে তুমি যদি চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দিতে যে, চতুর্থ মাস থেকে এই জিনিস তোমার আর চাই না, তাহলে ঐ তিন মাসের জন্য কোন টাকা ছাড়াই তুমি এই বিপদ শেষ করতে পারতে। সেটা না করায় এখন বিষয়টার তরজমা হয়েছে এই যে, তুমি তিন মাস পত্রিকা পড়ে মুগ্ধ হইছো, তাই এইটা আজীবন পড়তে চাও। ফলে এখন ৪র্থ মাস থেকে ষষ্ঠ মাস পর্যন্ত তিন মাসের টাকা দিতে হবে।
আমি নিরুপায় ভঙ্গী করে বললাম,
- এইসব কথা আমি কেমনে জানবো?
- পত্রিকা নেবার সময় কোন কাগজে সই করো নাই?
- করেছি তো!
- সেই কাগজেই কথাগুলা লেখা ছিল ...
- নাম আর ঠিকানা’র ঘর ছিল আর তাদের নিচে সই করার জায়গা। এর বাইরে কিছু দেখি নাই ....!
- সেটা তোমার দোষ না
- মানে?
- কারণ ঐগুলা পড়ার জন্য লেখা হয় না। এমনভাবে লেখা হয় যেন তুমি পড়তে গেলে চোখে যন্ত্রনা হয়।
আমি ভেবে দেখলাম কথা ঠিক। এইসব কথাবার্তা লেখা হয় পোলাউয়ের চালের সাইজের ফন্টে। সচরাচর কেউ পড়ে না, বা পড়তে পারেও না। সফটওয়্যার ইনস্টলেশনের সময় ‘লাইসেন্স এগ্রিমেন্ট’ যেমন কেউ পড়ে না, সেরকম। বললাম,
- তাইলে লেখে কেন?
- লেখে পিঠ বাঁচানোর জন্য। এখন তুমি মামলা করলে ঐ লেখাগুলাই ওদের বাঁচাবে
- সবই আমার দোষ বুঝলাম। এখন করণীয় কি?
- এনজয়!
- সেটা তো প্রচুর হয়ে গেছে। এবারে মাফ চাই।
- তাইলে বইগুলা আমারে দিয়া দিও!
- সেটা নাহয় দিব, কিন্তু এখন জরিমানা মওকুফ করার কি ব্যবস্থা?
- নাই। ঐটা দিতেই হবে। ঐটা দিয়ে ‘কানে ধরছি’ টাইপের একটা চিঠি লিখতে হবে; তারপরে মনোযোগ দিয়ে ঈশ্বরকে ডাকবা। ভাগ্য প্রসন্ন হলে এতেই মুশকিল আসান হবে!
- সেটা তুমি করে দাও দয়া করে ...
- হুমম ..
ঐ যাত্রা আমার কলিগের চিঠিতে কাজ হয়েছিল। পত্রিকার স্তুপ পরে ডরমের কমন স্টোরে বদলি করা হয়। ২/১ টা কপি ঐ বেটা কলিগ’কে দেওয়া হয়েছিল হয়ত!
(লেখাটা অনেক পুরোনো। ২০০৫ সালের কোন এক সময়ে লেখা! আজকাল লেখা হয় না তেমন, ভাবলাম এইটা দিয়েই শুরু হোক!)
আমার ফেউসবুক নাই!
মন্তব্য
নতুন করে লেখা শুরু করুন আবার।
টানা কয়দিন ছুটি। সচলে ঢুকেই লিখতে ইচ্ছে হল। এটা ঠিক লেখা নয়, পুরানা লেখাকে নতুনভাবে বাজারজাত করলাম। সামনে লেখার আশা রইল!
নতুন করে ফিরে আসার প্রত্যাশা রইলো।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
আমারও .... দেখা যাক কি হয়!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
কারো মন্তব্য পড়েই মনে হল না যে আমার মতন মদনামি আর কেউ করেছে! লেখা জমা দেবার আগে ধারণা করেছিলাম ২/১ জন অন্তত থাকবেন যারা এক'ই রকমের প্যাঁড়া'য় পরেছেন! সেটা ঠিক না মনে হচ্ছে! এটা আরেক প্যাঁড়া!
বাহ, অনেকদিন পরে আপনার লেখা পেলাম।
পত্রিকা নিয়ে এই ঝামেলায় পড়িনি, কিন্তু অ্যাপ নামিয়ে ফ্রি ট্রায়ালের পরে ক্যান্সেল করতে ভুলে গেছি এরকম কয়েকবার হয়েছে।
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
অনেকদিন পরে আপনার মন্তব্য দেখে আমারও ভালো লাগলো। আমিসাধারণত যেকোনো ফ্রী থেকে একশো হাত দূরেথাকার চেষ্টা করি।
বেলতলায় বার বার যাওয়া অনুচিত! ভালোথাকুন।
নতুন মন্তব্য করুন