স্কুলে যাওয়ার পথে এক পাগলের সাথে প্রায়ই দেখা হত। নির্ঝঞ্ঝাট-নির্বিবাদী মানসিক ভারসাম্যহীন সিধা সাধা মানুষটা বিড়বিড় করতো আর বাতাসে আঙ্গুল নেড়ে কি জানি হিসাব করত। স্কুল ছাড়ার পরে আর কখনও তাকে দেখিনি। সে কিসের হিসাব মিলানোর চেষ্টা করতো কখনও জানা হয়ে উঠেনি। তবে তার চেহারায় একটা অদ্ভুত হাসি লেগে থাকতো সেটা এখনও মনে পড়ে।
আমরা সবাই ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ইতিহাসের মুগ্ধ ছাত্র। ইতিহাস খালি সাল আর রাজা-বাদশাহের নাম মুখস্ত করে পরীক্ষায় পাস করা না, এর চেয়ে আরও অনেক বেশি কিছু এটা অনেকেই উপলব্ধি করিনা। ইতিহাস যে নিজের শেকড় চেনায় এটা বোঝার ক্ষমতা সবার থাকেনা। কাগজে-কলমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪২ বছরের বেশি হতে চলল। কিন্তু এখনও দেশের অধিকাংশ মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে শিখল না।
ছোট ছিলাম তখন, এখনও মনে পড়ে, ফকির আলমগির ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে ভরাট দরদী কণ্ঠে গাইত, "মায়ের একধার দুধের দাম, কাটিয়া গায়ের চাম, পাপোশ বানাইলেও ঋণের শোধ হবে না আমার মা গো..."। মাঝে মাঝে রাতের বেলা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ভ্যাবলার মত ঝিম মেরে বসে বসে ভাবি, মায়ের দুধের দাম শোধ করতে পারে নাই যে বাঙালি, সেই বাঙালি এত সহজে মায়ের রক্তের ঋণ কি করে শোধ করে ! রক্তগঙ্গায় স্নাত মায়ের বুকের উপর দাড়িয়ে কি করে তার জন্মঋণ অস্বীকার করে। ঠিক কতটা কুলাঙ্গার হলে নিজের মায়ের খুনিদের মাথায় তুলে নাচে ! আমি কোন হিসাব মিলাতে পারিনা।
স্কুলে যাওয়ার পথে যে পাগলটা হাসি মুখে তাকিয়ে থাকত, স্বপ্নে তাকে দেখি। একই রকম হাত নেড়ে হিসাব মিলাতে মিলাতে হুট করে বলে উঠে, "ইতিহাসের অঙ্ক কখনও ভুল বলে নারে ভাইটি। সব হিসাব একদম কড়ায়-গণ্ডায় মিলে, মিলতেই হবে।"
আমি ভাবি, শালা, পাগলে কি না বলে!
৭১ সালে, মোমেনা বেগমের দুই ভাইকে মারা হয়েছিল আছাড় দিয়ে, দুই বোনকে জবাই, এক বোনকে ধর্ষণ এবং তাঁর মাকে গুলি করে। নিজের চোখের সামনে ঘটনাগুলো ঘটতে দেখে এরপরে নিজে ধর্ষিত হয়ে বেঁচে ছিলেন তিনি এতটা বছর। অনেক দিন মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন তিনি, তারপরেও বেঁচে ছিলেন, শুধু ন্যায়বিচারের আশায়। ৪২ বছর পরে বিচার পেয়েছেন মোমেনা বেগম। ফাঁসি হয়েছে মিরপুরের কসাই যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার। তিনি একা নন, বিচার পেয়েছেন আরও অনেকে।
আমি হিসাব মিলাতে পারিনি সত্যি, কিন্তু ইতিহাস ঠিকই নিজের হিসাব ঠিক করে নিল।
রাজীব, জগতজ্যোতি, জাকারিয়া সহ আরও অসংখ্য মানুষ যারা প্রাণ দিয়েছে এই বিচারের লগ্নে তাদের হিসাবও কড়ায়-গণ্ডায় মিলিয়ে নিবে ইতিহাস, আমি জানি।
মন্তব্য
জয় বাংলা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে--
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি
জয় বাংলা!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
একদিন হবেই জয় আমাদের, আমরা শুধু শুরুটা করে দিতে চাই।
মাসুদ সজীব
অনেক হিসাব-ই হয়ত মিলিয়ে ওঠা হবে না। কিন্তু এখন যা মিলল তার দাম অনেক।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
নতুন মন্তব্য করুন