মালাউন কোপানো চলছেই, চলবে।

অরফিয়াস এর ছবি
লিখেছেন অরফিয়াস (তারিখ: সোম, ০৬/০১/২০১৪ - ৮:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হিন্দু নির্যাতন বাংলাদেশে নতুন কিছু না। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা যেমন বহমান, হিন্দু নির্যাতনের জাঁতাকলও একইভাবে চলমান। প্রত্যেকটা ঘটনার পরে এই নিয়ে আমার মত কিছু পাব্লিক খামাখা হাউ-কাউ করে, বাকিরা তামাশা দেখে, কেউ মজা নেয়, কেউ আহা-উঁহু করে, তারপরে সব আগের মত। দেশে গণতন্ত্র আছে কিনা এই প্রশ্নে দ্বিমত, ত্রিমত, বহুমত থাকতে পারে তবে মালাউন কোপানো হবে কি হবেনা এই প্রশ্নে কোন দ্বিমত নাই, একটাই উত্তর, হবেনা মানে? হতেই হবে

মালাউন কোপানোর কথা উঠলে কিছু উচ্চ পর্যায়ের সুশীল নানা যুক্তি তুলে ধরে তার মাঝে একটা অবশ্যই, "আরে মিয়াঁ, ভারতে কি মুসলমানদের দুরবস্থা নাই?" যেন ভারতে মুসলমানদের দুরবস্থা জায়েজ করতে বাংলাদেশে মালাউন কোপানো অবশ্য কর্তব্য। সেইসব সুশীলদের জন্য আমার ঘৃণা নাই, দয়া আছে। তাদের বলতে ইচ্ছা হয়না, সিরিয়াতে কিভাবে মুসলমানরা মুসলমান ভাইদের পুটু মারছে, কিভাবে ইরানে-ইরাকে মারছে, কিভাবে পাকিস্তান-আফগানিস্তানে মারছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাইয়ে ভাইয়ে মারলে কোন দোষ নাই, যেভাবে ৭১ এ মারলে দোষ হয়না।

দেশে ফি-বছরে কত হাজার হিন্দু মালাউন দেশ ছাড়ে তার কোন পরিসংখ্যান নাই। দরকার নাই, অনুমান করতে কারও সমস্যা হবার কথা না। কিছুদিন আগে প্রথম আলোর এক খবরের পরিসংখ্যানের সুবাদে সবাই জানে মালাউন সংখ্যা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ্‌। খুশির খবর। পুরা সাফা হলে আবার একটা আওয়াজ দিয়েন।

পুরান ঢাকার যেই বাসায় ভাড়া থাকতাম তাতে ১০টা ফ্ল্যাটে ৮টা হিন্দু পরিবার। বাড়ির মালিক হিন্দু ভাড়া দেয় কারন তারা ঝামেলা কম করে। আশেপাশের প্রত্যেকটা বাড়ির বাসিন্দাদের টার্গেট ছিল এই বাড়ি। একটু আধটু ঘণ্টা-কাসির শব্দ বেশি হলেই অজস্র অশ্রাব্য সুকথা দিক দিক হতে ভেসে আসত। পেছনের গলির সোনার ছেলেরা উঠতে বসতে হিন্দুদের ইয়ে মারত। তবে হ্যাঁ, নির্বাচনের আগে নেতা এসে প্রত্যেকের ভোট কেন্দ্রে যাওয়া পাক্কা করত, নাহলে গণতন্ত্র সমুন্নত থাকেনা। এই ঘটনা শুনে যারা অবাক হওয়ার ভান করবে তারা ভাল মানুষ।

দেশে একটা মজার মিডিয়া সংস্কৃতি আছে। কোন জায়গায় পাব্লিকের লাইন দেখলেই তাদের ক্যামেরা হিন্দুর শাঁখা-সিঁদুর খোঁজে। সেইটা যে কোন জমায়েতই হোক। এই কারনে নির্বাচনের সব ছবির মাঝে হিন্দু মালাউনদের লাইনের থাকে আলাদা মর্যাদা। তাই সব পত্রিকা-টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাতে মালাউন নারীদের শাঁখা-সিঁদুরের একটা না একটা ক্লোজ শট অবধারিত। দেখতে ভাল লাগে, গনরিয়ার মত গণতন্ত্র আর গনিমতের মাল এক জায়গায় দেখলে কার না ভাল লাগে। আমি একমাত্র জামায়েত-এ-ইসলামির সমাবেশে হিন্দু মালাউন দেখলাম না এই দুঃখ এখনও আছে।

এইদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের মানুষদের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকুক এটা কেউ সরাসরি মুখে বলে, কেউ গোপনে। আমি নিজেও এই ভাবনার সমর্থক। দেশের ৯০ ভাগ মানুষ এক কাতারে দাঁড়ালে বাকি ১০ ভাগ বঙ্গোপসাগরে ডুবলেও কোন সমস্যা থাকার কথা না। গনতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের জোর চলে। এখানেও চলবে, অস্বাভাবিক কিছুনা। যেই জোরের কারনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায় এক রিকশাচালক আমাকে শুনিয়েছিল, দেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম না হলে চলবে না, ওটা থাকতেই হবে। অবাক হওয়ার এখানে কিছু নেই, দেশের অশিক্ষিত-শিক্ষিত অধিকাংশ মানুষের ধারনাও একই। এটার কোন পরিসংখ্যান নাই তবে আগে পরে সবাই একই লাইনে।

দেশে নির্বাচন হলে মালাউন কোপানো আর মিষ্টি বিতরন একই কথা। একইভাবে দেশে কোন ঘটনা ঘটলেই মালাউন কুপিয়ে সেটা শুদ্ধ করা জায়েজ। কেউ পাদ দিলেও নাকি আজকাল মালাউনরা ভয়ে বাড়ি ছেড়ে নিরাপদে সরে যায় যাতে গণতন্ত্র রক্ষাকারীরা আরামসে তাদের শুদ্ধিকরণ করে যেতে পারে। মালাউনদের একমাত্র কর্তব্য বাকি থাকে, সক্কাল সক্কাল ঘর পোড়া ছাইয়ে দাঁত মেজে টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁত কেলিয়ে পোজ দেয়ার।

হুমায়ূন আজাদের "পাক সার জামিন সাদ বাদ" বইয়ে অপ্রাপ্তবয়স্কা মালাউন ধর্ষণের বর্ণনায় অনেক সুশিলের সুশিলতা হানি হলেও, কদিন আগে মালাউন নারীর প্রতিবন্ধী শিশুকে আগুনে ছুড়ে মারতে যাওয়ার ঘটনায় কারও কোন প্রতিক্রিয়া থাকেনা। এদেশে মালাউন মরবে এটা ধ্রুব সত্য, মেনে নিতে না পারলে আর ট্যাঁ -ফো করলে আপনার সমস্যা। আপনি দেশের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির ফকফকা নিশানে আন্তর্জাতিক চক্রান্তে কালিমা লেপনে ব্যাস্ত।

যাই হোক, ব্লগ লিখে বিপ্লব হবেনা বুঝে গেছি অনেক আগে, তারপরেও অক্ষম ক্রোধে এইসব লেখা। দেশ খুব শীঘ্রই মালাউন মুক্ত হোক এই আশা পোষণ করি। দেশে শান্তির সুবাতাস বয়ে যাক। গণতন্ত্র আর ঈমান সমুন্নত থাকুক। যেভাবে লীগ-বিম্পি-জামাত-বাম-ডান এক হয়ে মালাউনের ঘরে আগুন দেয় সেভাবেই দেশকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাক।

তবে যাওয়ার আগে একটা কথা, বাংলাদেশ কখনই অসাম্প্রদায়িক একটি সমাজ গড়ে তুলতে পারবেনা, এইদেশ কখনই রাজাকারমুক্ত হবেনা, বলে গেলাম।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ডিস্টার্ব দিয়েন না আমরা ১০০% মুসলমানের দেশ করতাম চাই। আমি বাংলাদেশ বলি না বাংলাস্তান বলি আজকাল

সাইদ

শব্দ পথিক এর ছবি

মানুষের বাড়ি-ঘর যারা কথায় কথায় পুড়িয়ে দেয়, আমি সবসময়ই তাদের জন্ম-পরিচয়, জন্মক্ষণ এবং বড় হয়ে উঠার পরিবেশ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করি।

অনেক গালি দিতে মন চাচ্ছে, ভিতরে জমে থাকা ক্রোধ হালকা হবে কিভাবে জানিনা-নিজেকে এবং চারপাশের সবাইকে অক্ষম মনে হয়। সরকারকেও দেখলাম না কখনো দায়িত্বশীল হয়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে, বিচারের আশাতো করাই যাবেনা।

----------------------------------------------------------------
''বিদ্রোহ দেখ নি তুমি? রক্তে কিছু পাও নি শেখার?
কত না শতাব্দী, যুগ থেকে তুমি আজো আছ দাস,
প্রত্যেক লেখায় শুনি কেবল তোমার দীর্ঘশ্বাস!''-সুকান্ত ভট্টাচার্য

চরম উদাস এর ছবি

গণতন্ত্র বলে কথা !

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হুমম... নয়-দশমাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, কে বলেছে দেশ বিভক্ত? মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হ। গরিষ্ঠ সংখ্যা নিয়া ভোট হইব আর গরিষ্ঠের উর্দ্ধ অধ নিম্নচাপ থাকব না এইটা কী হয়?

অতিথি লেখক এর ছবি

যাই হোক, ব্লগ লিখে বিপ্লব হবেনা বুঝে গেছি অনেক আগে

এটার সাথে আমি পুরো একমত না, ৫ তারিখের আগে আমিও এমনটা ভাবতাম কখনো হয়তো জাগবে না বাঙালি। এই জাগরনের পেছনে ব্লগ আর ফেসবুকের অবদান সবচেয় বেশি। তবে এটা ঠিক বাঙালি যতদিন খাঁটি মুসলমান হওয়ার পথে থাকবে ততদিন নিরাশার জয় হবে।

মাসুদ সজীব

অতিথি লেখক এর ছবি

মন খারাপ

সুবোধ অবোধ

আয়নামতি এর ছবি

...

কল্যাণ এর ছবি

ঠিকাছে।

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

রিক্তা এর ছবি

কি করছেন ভাই, হিন্দু ধর্মীদের সাথে এক বিল্ডিঙ্গে থাক্তেন এই খবর প্রকাশে আপনার পাঠক সংখ্যা কমে যাবে তো! আমার কথা বিশ্বাস না হলে নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা গুলো দেখেনঃ

১) ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত রামপুরা একরামুন্নেছাতে পড়তাম। আমাদের ক্লাসে একটা বেঞ্চে শুধু হিন্দু মেয়েরা বসতো। আমরা মুস্লমানের বেটিরা অই বেঞ্ছের ত্রিসীমানায় যেতাম না।

২) আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধুরে কতবার কতজনের কাছে শুনতে হইছে ভারতে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়ায়ে আছে! কিছু ক্লাসমেট তো থাকতে না পেরে আমাকে জানাইছে হিন্দু মেয়েগুলার সংগ ছেড়ে তাদের সংগ নিতে।

৩) আমার এক দুঃসম্পর্কের মামা গ্রাম থেকেই হিন্দুরে কিভাবে গরুর মাংস খাওয়ানো যায় তার বুদ্ধি দেওয়া শুরু করতো।

৪) আমার দুলাভাইয়ের বাড়ি যশোর। গ্রামের ছেলেরা নাকি হাল্কা ফুর্তিফার্তার আশায় নিম্নবিত্তের হিন্দুপরিবারের মেয়েদের ঘরে রাতে কাজুয়ালি হানা দিত।

৫) মসজিদের খুতবা/ওয়াজে অন্য ধর্মনিয়ে কটাক্ষ করা খুব স্বাভাবিক ঘটনা।

৬) ইস্কুলের ধর্ম ক্লাসে প্রচলিত ধর্মীয় গল্পের ভিলেন গুলা কিভাবে জানি শিক্ষকের মুখে হিন্দু হয়ে যায়। যদিও আরবে অই সময়ে হিন্দু আস্লো কই থেকে এইপ্রশ্ন নিষিদ্ধ।

৭) আমাদের বাংলা শিক্ষক তো প্রায়ই দুঃখ করতো হিন্দু রবীন্দ্রনাথ কেম্নে নোবেল প্রাইজ ঘুষ দিয়ে পাইছে, মুসলমান নজরুল পায় নাই।

এইরকম বহু আছে। বলেন তো বিদ্যা সিনহা মিমকে কেনো মিম নামে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হয়? অনেক আশায় থাকি মানসিকতার পরিবর্তন হবে, কিন্তু কোন লাভ হয় না। সুশীলরা গোপনে আর সাধারন মানুষ প্রকাশ্যে সরাসরি বা বাকা পথে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ পোষণ করে। অন্যের কথা বলে কি লাভ, একটা করে ঘটনা ঘটে আমি ঘটনার জায়গা ঢাকায় না দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি, বাপ মা আত্নীয় হিন্দু না দেখে বেশি চিন্তা না করে আধা ঘন্টায় সব ভুলে যাই।

কিন্তু আজকে ভাবছি, আমরা কি প্রতিজ্ঞা করতে পারি নাঃ এনাফ ইজ এনাফ! বাংলাদেশে আর এক্টাও সংখ্যালঘু নির্যাতন হইতে দিবো না আমরা? শাহাবাগ আমার সাহস আর সাধ আকাশে তুলে দিয়েছে। খালি মনে হয় আমরা চাইলেই পারি। শুধু যদি সবাই মিলে সেইভাবে চাইতাম!

--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

আমরা কি প্রতিজ্ঞা করতে পারি নাঃ এনাফ ইজ এনাফ! বাংলাদেশে আর এক্টাও সংখ্যালঘু নির্যাতন হইতে দিবো না আমরা? শাহাবাগ আমার সাহস আর সাধ আকাশে তুলে দিয়েছে। খালি মনে হয় আমরা চাইলেই পারি। শুধু যদি সবাই মিলে সেইভাবে চাইতাম!

চলুক
সবাই কিভাবে চাইবে? আমরা আগে মানুষ না, বাংলাদেশী না আমরা আগে মুসলমান তারপর মুসলমান, তারপর মুসলমান --- চলবে---চলবে---
রাগ, দুঃখ, কষ্ট,লজ্জা, ক্ষোভ, ঘৃণা করতে করতেও ক্লান্ত হয়ে গেছি।
আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু টাকে মুখ দেখাতে লজ্জা লাগে ভীষণ।

কিছুই তো করতে পারিনা, আজকাল কেবলি মনে হয় আমি কেন জন্মসূত্রে হিন্দু হলাম না। জন্মসূত্রে যে ধর্মের দাগ গায়ে লেগেছে ঘৃণা করি তা ................................. মন খারাপ

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

এক লহমা এর ছবি

লেখায় ৫ তারা।
যত দূরের-ই হোক, যত দূরাশাই হোক তবু আশা রাখি আপনার এই পোস্ট-এর শেষ বাক্যটি আপনি একদিন ফিরিয়ে নিতে পারবেন।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

যত দূরাশাই হোক তবু আশা রাখি আপনার এই পোস্ট-এর শেষ বাক্যটি আপনি একদিন ফিরিয়ে নিতে পারবেন।

যদি সত্যি হত!!!

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

বলার কোন ভাষা নেই। ছোটবেলায় এক বন্ধুকে মালাউন বলায় একসাথে খেলতাম এমন আরেক জনের মাথায় ইঁট দিয়ে মেরেছিলাম। বড় হয়ে এখন পারি না - কাপুরুষ হয়ে গেছি! আমার মুখকে লুকানোর জায়গা দেয়ার মত অন্ধকার অবশিষ্ট নেই আর!!

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

আশাহত হবেন না।
সাহসের কথা লিখুন।
বিজয়ের কথা লিখুন।
হেরে যাওয়া চলবে না।

mahinaaa@gmail.com

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।