৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাস্তা-ঘাটে লুঙ্গি খুলে বাঙ্গালীর মুসলমানিত্ব যাচাই করত। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে আজকাল আর পাকিস্তানি সৈন্য লাগেনা কিছু হলে নিজেরাই লুঙ্গি খুলে দেখায় কে কত বড় মুসলমান। একটা ভাল জিনিস শিখিয়ে গেছে পাকিস্তান।
দেশের ভেতরে সংঘটিত যেকোন ঘটনা সম্পর্কিত মতামতের নিয়ামক আজকাল ধর্ম। খুব অকপটে আজকাল লোকজন বলে, আমরা আগে মুসলমান, পরে বাংলাদেশি। দুঃখজনক হলেও সত্যি, একটা জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি-কৃষ্টি যে ধর্ম দিয়ে সংজ্ঞায়িত হয়না সে বোঝার ক্ষমতা আমাদের উচ্চশিক্ষিত নাগরিকদের মধ্যেও অনুপস্থিত। তাই আজকে যখন লেখক অভিজিৎ রায় এর হত্যাকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা মুখর বিশ্ব, সেখানে বাংলাদেশ কেন্দ্রিক বিভিন্ন আলোচনার মুখ্য বিষয় 'ধর্ম', 'ইসলাম', 'অনুভূতি', অবমাননা। যেখানে নৃশংসভাবে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ প্রয়োজন, সেখানে আজকে নাগরিকদের বিভক্ত করছে মাত্র একটি বিষয়- 'ধর্ম'। অনলাইনে বিভিন্ন জায়গায় অধিকাংশ মানুষের বক্তব্যের তুলাদণ্ড 'ধার্মিক-নাস্তিক' এই বিচারে উন্মুখ আর ধার্মিকের অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হলে পাল্টা আঘাতে নাস্তিকের কল্লা নামতেই পারে- এই যুক্তিতে দূষিত। ধার্মিকেরা 'ফ্রিডম অব স্পিচ' এর পূর্ণ সুযোগ নিয়ে বিরুদ্ধ মতবাদীদের 'ফ্রিডম' এর তুলোধুনো করে চলেছেন অনায়াসে।
একটি স্বাধীন গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একজন ব্যক্তির মতামতের জন্য তাকে হত্যা করা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য না। পুরনো একটা কথা আবার বলি, একজন ব্যক্তি সৃষ্টি এবং সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করবেন কি করবেন না, ধর্ম পালন করবেন কি করবেন না, এটা সম্পূর্ণভাবেই তার ব্যক্তিগত বিষয়। "বিশ্বাস" কারো উপর চাপিয়ে দেয়া যায় না, যদি চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলে তা আর বিশ্বাস থাকেনা। বিশ্বাসকে মানুষের উপরে চাপিয়ে দেয়া শোষণের একটি হাতিয়ার মাত্র। কিন্তু যুগের পর যুগ ধরে এর চর্চা করা হয়েছে। শুধু তাই না, শক্তিশালী গোষ্ঠী এবং রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছে এই প্রক্রিয়া। আর আজকে অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পরে তাঁর 'বিশ্বাস/অবিশ্বাস' যদি এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনমতে বিভক্তি সৃষ্টি করে তাহলে ধরে নিতে হবে সামাজিকভাবে আমাদের দেশের মানসিকতা পঙ্গুত্ব বরন করেছে।
অনলাইনে সরকারপন্থী পেইড বুলিরা যেভাবে এই হত্যাকাণ্ডকে ব্যবহার করে তাদের অপযুক্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে তা গ্রহনযোগ্য না এবং যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন আমাদের পূর্বপুরুষেরা দেখেছিল সম্পূর্ণ তার পরিপন্থী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ভিত্তি ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে বাঙ্গালীর সভ্যতা-সংস্কৃতি-কৃষ্টি গুরুত্ব পাবে। যেখানে একজন মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ধার্মিক, নাস্তিক, ছোট, বড়, সাদা, কালো সব কিছু ছাপিয়ে আমাদের পরিচয় থাকবে আমরা বাঙ্গালি। আর পাকিস্তানি সামরিক জান্তার আঘাতের মূল লক্ষ্যই ছিল এই চেতনায় ভাঙ্গন ধরানো। এ কারনে বারংবার শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি, পহেলা বৈশাখ-বর্ষবরণ , রবীন্দ্র সঙ্গীত ইত্যাদি এসব কিছুই 'হিন্দুয়ানী' সংস্কৃতির বাহক বলে বাঙ্গালীর সংস্কৃতি থেকে ছিনিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা হয়েছে। শুধু পাকিস্তানি গোষ্ঠীই নয়, দেশ স্বাধীনতা লাভের পরেও একটি সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠী রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভাবে পাকিস্তানি এই সাম্প্রদায়িক মনোভাবের চর্চা করে গেছে, মদদ দিয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানে। কারন বাঙ্গালির থেকে বাংলা সংস্কৃতি ছিনিয়ে নিতে পারলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা, তখন মেধা-মননে বাঙ্গালিকে পরাস্থ করা অতীব সহজ। এ কারনেই রমনার বটমূলে বর্ষবরণ হয়ে উঠে জঙ্গিদের বোমা হামলার লক্ষ্য, এ কারনেই পহেলা বৈশাখের বিরুদ্ধে প্রতি বছর চলে প্রোপাগান্ডার স্রোত, এ কারনেই শহীদ মিনারের বেদীতে পুষ্পাঞ্জলিকে তুলনা করা হয় ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে, কারন ধর্মের বিভাজনে জাতিকে কলুষিত করতে পারলে আঘাত করা আরও সহজ হয়ে পড়ে। ১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৭১, পরিকল্পিতভাবে বাঙ্গালিকে মেধাশুন্য করতে যেভাবে দেশের গুণী সন্তানদের হত্যা করা হয়েছিল সেই একইভাবে বারবার স্বাধীন দেশেও হত্যা করা হয়েছে শিল্পী-সাহিত্যিক-মুক্তমনা-রাজনীতিবিদদের। একই প্যাটার্ন, ঘুরে ফিরে এসেছে বারবার, একই কালো রাত্রি ঘুরে ফিরে এসেছে বারবার। ঘাতকের আঘাতে বারবার রক্তাক্ত হয়েছে এদেশের মাটি। ধর্মের নামে বারবার পাড় পেয়ে গেছে অপকর্ম।
চিন্তা করে দেখুন, একজন মানুষের মতবাদের জন্য তাকে হত্যা করা যদি আপনি সমর্থন করেন। তাহলে একইভাবে বিরুদ্ধমতের জন্য আপনারও যে একদিন সময় আসবেনা, তার কি কোন গ্যারান্টি আছে?
অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডে যারা নিজেদের স্বার্থ খুঁজে, যারা এতে দলীয় রাজনীতির লাভ-ক্ষতি হিসাব করে, যারা আগে ধর্ম পরে মনুষ্যত্ব চিন্তা করে, তারা আমার দৃষ্টিতে মানুষ না। মানুষ হিসেবে তাদের গ্রহনযোগ্যতা আমার কাছে শুন্য। এক দশকের বেশি সময় হয়ে গেছে অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদের উপর একই কায়দায় হামলাকারীদের কোন বিচার হয়নি, শাহবাগ আন্দোলনের সময়কার ব্লগার রাজীব হত্যাকাণ্ডের কোন সঠিক তদন্ত হয়নি, কারো শাস্তি হয়নি। শুধুমাত্র বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এই দ্বন্দ্বে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারছেনা আমাদের সরকার। বরং হেফাজতের মত উগ্র মৌলবাদী দলের উত্থান দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির শক্তিশালী অবস্থানকে আরও পাকাপোক্ত করেছে।
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও যখন বাঙ্গালি নিজেরা কে কত বড় মুসলমান প্রমানে ব্যস্ত, সেই ব্যস্ততার আড়ালে মনুষ্যত্ব হারিয়ে গেছে বহুদিন। জাতি হিসেবে একটি উগ্র-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী হিসেবে আমরা আত্মপ্রকাশ করছি প্রতিনিয়ত নানা ক্ষেত্রে, নানা আঙ্গিকে। ৭১ সালের ঘটনাটি আজকের দিনেও তাই খুবই প্রাসঙ্গিক থেকে যায়। আর যতদিন আমরা জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ চেতনার অধিকারী হতে পারবনা ততদিন প্রাসঙ্গিক থেকে যাবে।
[লেখাটিতে প্রথমে একটি ছবি সংযুক্ত ছিল, ছবিটি সম্পর্কে আমার কাছে ভুল তথ্য থাকায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি। দুঃখপ্রকাশ করে ছবিটি সরিয়ে নিলাম।]
মন্তব্য
ইন্টারনেটে এখন ইসলামী দার্শনিক-চিন্তাবিদের ছড়াছড়ি। "ইসলামী দর্শন" যে এতো পপুলার একাডেমিক ডিসিপ্লিন, এইটা জানতাম না!
এই পোস্ট ("উগ্র" ভুদাই) এবং এর মন্তব্যগুলি
আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
Emran
অনেক বন্ধুকেই দেখেছি ‘সাচ্চা মুসলমান’ হয়ে যেতে। তাতে আমার কোনো সমস্যা নাই কিন্তু যখন সেই সাচ্চা মসলমানিত্ব (বা সেটা সাচ্চা হিন্দুয়ানিত্ব) যখন মানবতার চাইতে বড় হয়ে দাঁড়ায়, যখন কেউ একপাতা লিখেছে বলে তার মাথাটাকেই ধড় থেকে নামিয়ে নেবার বৈধতা পেয়ে যায় বলে মনে করে অন্যকেউ, তখন তা রীতিমত আশঙ্কার নয়?
দেবদ্যুতি
১। অনেক মুক্তিযুদ্ধ মনা দলকানাদের দেখছি বলতে যে অভিজিত হত্যার প্রতিবাদকারীরা পেট্রোলবোমার হত্যার প্রতিবাদ করলে আজ এমন অপরাধ ঘটতো না। অনেকটা ছাগুদের মতোই কথা বার্তা। আমি রাজাকারের বিচার চাই, কিন্তু তার সাথে বিশ্বজিত হ্যতার বিচার চাই, সাগর-রুনির বিচার চাই ইত্যাদি। একটা অন্যায়ের প্রতিবাদের সাথে আরেকটা অন্যায়ের তুলনা করে এরা ত্যানা প্যাঁচাতে থাকে এরা, আর নিজে নিজে ভীষন প্রগতিশীলের মড়েল গলায় পরে বসে থাকে ।
অভিজিত হত্যার প্রতিবাদ মৌলবাদীরা করছে না, করছে মূলত মুক্ত চিন্তার মানুষেরা (কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে)। আর এই হত্যার প্রতিবাদে সরকারের অনেক আপোষ মনোভাব, উদাসীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে বলেই দলকানারা প্রতিবাদকারীদের নানান ট্যাগ দিচ্ছে। আর ছাগুদের মতো বলে বেড়াচ্ছে কেন এটাতে প্রতিবাদ করেন নি, ওটাতে প্রতিবাদ করেন নি ব্লা, ব্লা।
২। নাস্তিক মারা অন্যায় কিন্তু উগ্র নাস্তিকত রা খোঁচা দিচ্ছে কলম দিয় আর সেটার প্রতিবাদ স্বরূপ অশিক্ষিত আস্তিকরা খোঁচা দিচ্ছে ছুরি দিয়ে। অর্থাৎ দুটোই সমান অন্যায়।। নাস্তিকতা কে যে বা যারা খোঁচা
এমন কথা যারা বলে বেড়াচ্ছে এরা আসলে নিদিষ্ট দলের এজেন্ট। অন্ধ ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লেখাকে যে বা যারা খোঁচা হিসেবে দেখে তাদের সাথে ফারাবীদের পার্থক্য কি খুব বেশি?
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
দাদা শিরোনাম টা যদি এ রকম হতো!
আগে মুসলমান পরে বাংলাদেশী। ১৯৭৫ এর পর থেকেই আমাদের বাঙালী শব্দটা ধর্ষিত হয়েছে।
------------
রাধাকান্ত
আমি বেশী মানুষের সাথে মিশিনি। যে কজন বাংলাদেশীর সাথে মুখোমুখি পরিচয় হয়েছে তাঁদের প্রায় কারও ক্ষেত্রেই মনে হয়নি যে তাঁরা নিজেদের বাঙ্গালি বলতে বিশেষ পছন্দ করেন। অনলাইন আলাপগুলিতেই বাংলাদেশের বাঙ্গালির দেখা পেতে শুরু করি। প্রাণ ভরে তাঁদের দেখা পাই এই সচলায়তনে এসে। এইখানে, এই সচলায়তনেই প্রথম অভিজিৎ-এর লেখার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। লেখা প্রকাশের বহু পরে পড়া সে লেখায় নিজের মুগ্ধতা জানাতে মন্তব্যের ঘরে লেখককে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। তাঁর নামের সূত্র ধরে সন্ধান পেয়েছিলাম মুক্তমনার। মাঝে মাঝে পড়ে আসতাম সেখানে গিয়ে। মনে হত এই রকম ব্লগ সাইটগুলিই আঁধার সমুদ্রের বাতিঘর। আঁধার সমুদ্র যে বাতিঘরগুলি ভাঙ্গার জন্য মরিয়া হবে সেটা ভাবা যায়। কিন্তু বাতিঘরগুলি বাঁচানোর লোক এত কম, মুক্তিযুদ্ধ জিতে আসা একটা দেশে - সেটা মেনে নেওয়াটা - নাঃ আর লিখতে ইচ্ছে করছে না।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
বাতিঘর!!!বাতি জ্বলবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
---------
রাধাকান্ত
মানুষকে কে আগে সাচ্চা মানুষ হতে হবে, মানবতার ধর্ম অবলম্বন করতে হবে, মানুষ হয়ে যদি প্রকৃত মানুষ ই না হতে পারলাম এর থেকে বড় লজ্জার আর কি আছে।
কোন ধর্মেই ধর্ম গুরু রা বলেনি যে মনুষ্যত্ব ভুলে গিয়ে ধর্মের ঢুল পিটাতে।
সৌদামিনী
নতুন মন্তব্য করুন