স্বপ্ন শব

আরিফ জেবতিক এর ছবি
লিখেছেন আরিফ জেবতিক (তারিখ: রবি, ১৭/০৬/২০০৭ - ৮:৪০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ডাক্তাররটি আমাকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে।যেন আমি ছোট্ট শিশু,হাত ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবো।আমি মনে মনে হাসি,আমরা দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ,কে জানে ডাক্তারটি আমার চেয়ে বয়েসে দুয়েক বছরের ছোটই হবে বোধহয়।

তবু সে গাঢ় মমতায় আমার হাতখানি ধরে রাখে,কোমল মমতাময় হাত,সেই হাতের স্পর্শ বেয়ে আমার শরীরে আসে তার অসহায় বোধ,তার ভালোবাসা,এক অজানা মানুষের জন্য সেই ভালোবাসা আমি টের পাই বড়ো সহজে।

সে এমন করছে কেন,সে কি আমার মাঝে দেখতে পাচ্ছে তার ছবি,এখনও পেশাগত রুক্ষতা তাকে ছুয়েঁ দিতে পারেনি সেভাবে,এখনও সে নতুন এই থানা সদরের ছোট হাসপাতালে,কে জানে এখনও হয়তো হারানো বন্ধুদের জন্য তার মন পোড়ে,আমার মাঝে সে হয়তো তার কোন বন্ধুকে দেখে কিংবা কে জানে হয়তো আমার মাঝেই সে দেখে অনাগত দিনের তার নিজের ছায়া।

আমার মাঝে তার নিজের ছবি দেখলে আমি অবাক হবো না,আমি জানি থানা সদরের এই ঘুপচি কোয়ার্টারে নি:সঙ্গ দিন যাপনের মাঝেও এই তরুন ডাক্তারটি তার স্বপ্নগুলো বাচিয়ে রাখতে অবিরাম চেষ্টা করছে ,যেমন আমি করেছিলাম আরো অনেকগুলো বছর আগে,ক্রমাগত ডাক্তারের স্বপ্নগুলোও রুগ্ন হয়ে যাচ্ছে,একটা একটা করে মরে যাচ্ছে প্রতিদিন,তবু সে আমারই মতো শেষবারের মতো দেখে চলছে তার স্বপ্ন,এখনও সে ভাবছে সে বিদেশে যাবে,একটা বড়ো ডিগ্রী এনে কোন বড়ো শহরে ক্লিনিক খুলে বসবে,তার নাম হবে ,যশ হবে,সুন্দরী বউ হবে,ব্যাংকে টাকা হবে,টয়োটা গাড়ি হবে..কিন্তু সে মনের অগোচরে জানে তার আসলে মুক্তি নেই,তাকেও অন্য সবার মতোই এই জীবনের ঘানি টেনে যেতে হবে এক থানা থেকে অন্য থানায়,গ্রামের পচাঁ গলা রোগীই তার জীবনের অংশ আর এখান থেকে তার মুক্তি নেই,মুক্তি নেই।

আমি ডাক্তারকে নিয়ে ভাবছি কেন?আমি ইদানিং আসলে সবাইকে নিয়েই ভাবি,আমার সামনে যতোগুলো মুখ ভেসে যায়,সকাল বেলার পত্রিকাওয়ালা,অফিসে যাওয়ার পথে রিক্সাওয়ালা,তিনবছর থেকে একই বিছানায় ঘুমানো বিথী-আমার স্ত্রী,অফিসের বস,ফেরার পথে মোড়ের দোকানের সিগারেটওয়ালা।আমি সবাইকে পড়ি ইদানিং,নিজের জন্যই পড়ি,কারন আমি স্বস্থি পাই,আরাম পাই,আমি যখন দেখি আমারই মতো লোকগুলো ভুগছে,কষ্ট পাচ্ছে,হয়তো জানেও না তারা কেন সে কষ্ট পাচ্ছে,তবু তার ঠিকই ধুঁকছে,তখন আমার কেন যেন খুব তৃপ্তি আসে,নিজেকে তাদেরই একজন ভেবে আমি তখন এক ধরনের সান্তনা খুজিঁ।

আমি খুব খেয়াল করে দেখি তাদের কার কাধ কতোটুকু নিচু,কে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কতো বেশি স্বপ্ন আর সে অনুযায়ী তাদের অগোচরে আমি তাদের দূ:খের ,তাদের বেচেঁ থাকার স্বার্থকতার পরিমাপ করি।

স্বপ্নের এই চক্র থেকে আমাদের মুক্তি নেই,আমরা বয়ে নিচ্ছি স্বপ্ন জন্ম থেকে প্রজন্মে,আর প্রতিটি উত্তরাধিকারী আরেকটু বেশি বয়ে নিচ্ছে স্বপ্নকে,আরেকটু বেশি করে কুজোঁ হচ্ছে,প্রতিটি মানুষের কাধে আমি সেই স্বপ্নের চাপ দেখি ,সেই স্বপ্নের ওজন টের পাই।

আমি আমার নিজের কথাই তবে বলি এবারে।আমার কাধের সবথেকে পুরোনো স্বপ্নটি বোধহয় আমার দাদাজানের,আমার দাদা,আজীবন গৃহস্থ কৃষক ;ভেবেছিলেন তার পুত্রদের কেউ উকিল হবে,জজ হবে ,আহা অসহায় মানুষ,তার কল্পনাশক্তিতে তার থেকে বেশি কতোই বা কুলাবে,তবু তিনি তার সাধ্যমতো ছেলেদের পড়াতে চেষ্টা করেছিলেন,তার বড়ো সন্তান মানে আমার বাবাই সবথেকে বেশি পড়েছিলেন,একলাফে ক্লাস নাইন পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন তিনি,তারপর দাদা মারা গেলেন আর বাবার পক্ষে উকিল হওয়া আর হয়ে উঠা হলো না।

স্বপ্নের এই চক্রটি,এই ওজনটি প্রথমে টের পাই যখন আমার বয়েস মাত্র ৯ বছর,ক্লাস ফাইভে আমার বৃত্তি পরীক্ষার আগে আগে বাবা আমাকে বারবার বলতেন আমি যেন খুব ভালো করে পরীক্ষা দেই,বৃত্তিটা পাই,আমি যেন শহরের একজন বড়ো উকিল হই কোন এককালে।সেই থেকে মানুষের স্বপ্ন আমার কাধে জোয়ালের মতো এটে যায়,আমি প্রানপনে চেষ্টা করি যাতে বৃত্তিটা আমার হাতছাড়া না হয়ে যায়।

আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল আমি বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করব,পাশের বাসার পাভেল ভাই তখন সাইপ্রাসে পড়াশোনা করেন,প্রতি বছর জুলাই মাসে বাড়ি ফিরেন,তার সানগ্লাস,তার হাতের চকচকে ঘড়ি আমাদের আপ্লুত করে ,তিনি কথায় কথায় “শিট্”বলে আমাদের মোহিত করেন আর আমার সহজ সরল মা সেই পাভেলের মাঝে আমাকে স্থাপন করতে চান।
আরেকটু বড়ো হলেই আমি বুঝে যাই যে সাইপ্রাসে বাসে চড়ে যাওয়া যায় না,সেখানে যেতে হলে টোফেল নামে এক রহস্যময় পরীক্ষা দিতে হয়,সেই পরীক্ষার জন্য বই আর ক্যাসেট কিনতে হয়,সেই পরীক্ষার ফিস হচ্ছে কয়েক হাজার টাকা,আর আমার বাবার পক্ষে ,আমার মায়ের পক্ষে সেই কয়েক হাজার টাকা জোগাঢ় করা কোনদিনই সম্ভব না।

আর তাই আমি আমার কাধে আরেকটি স্বপ্নের লাশ চাপিয়ে রাখি,সেটা আমার মায়ের স্বপ্ন,সেই স্বপ্নটিকেও আমার টেনে নিতে হয়।এভাবেই বাবার স্বপ্ন,মায়ের স্বপ্ন,ভাইয়ের স্বপ্ন,বোনের স্বপ্ন এরকম অনেক স্বপ্নই আমার পূরন করা হয় না,আর আমার কাধে একের পর এক জমতে থাকে স্বপ্নের শব,সেই শবের ভারে আমি ক্রমাগত নতজানু হতে থাকি,স্বপ্নের ওজন আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায় আর আমি সেই স্বপ্নের হাত থেকে বাচাঁর জন্য ধুকতে ধুকতে দৌড়াতে থাকি আর দৌড়াতে থাকি।আমার উকিল হওয়ার কথা ছিল,আমার বিলাত ফেরত হওয়ার কথা ছিল,আমার সত্যায়ন ক্ষমতাধারী অফিসার হওয়ার কথা ছিল,আমার আরো অনেক কিছুই বুঝি হওয়ার কথা ছিল।

আমি অবশেষে এই মফস্বল শহরে,আন্ত:নগর বাসের ম্যানেজার হই,এটাই আমার নিয়তি,আমার বাবা লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লিখতেন,তার খুব ইচ্ছা ছিল একটা বই বের হবে ,শেষে ভেবেছিলেন তার ছেলে বোধহয় একসময় মস্ত লিখিয়ে হবে,নিশ্চয়ই তার ছেলের একটা বই এসে মাত করে দেবে পুরোটা দেশ,অথচ আমি এখন দিনরাত শুধু বাসের সিরিয়াল লিখে চলি,তার চেয়ে বেশি আর কিছুই করতে পারি না।

দ্বিতীয় পর্ব:
আমি বিয়ে করলাম।বিথী,এক শ্যামলা শান্তিময় মেয়ে।এই একতলা টিনছাওয়া বাড়িতে ,কলতলা আর উঠোন নিয়ে আবার আমরা শান্তিতে শুরু করলাম সংসার।
ইদানিং খুব সাধ হয় একটা ফুটফুটে ছোট্ট শিশুর,আমার বুকে এসে হামলে পড়বে ছুটির দিনের কোন অলস দুপুরে,রাত জেগে কেঁদে কেঁদে ঘুম হারাম করে দেবে ্ওর মায়ের,বিথী কপট রাগ করে দুমদুম কিল দেবার অভিনয় করবে সেই দেবশিশুর পিঠে।আমার চোখের সামনে বড়ো হবে,স্কুলে যাবে,কলেজে পড়বে,একদিন হয়তো সে সত্যি সত্যিই একজন বড়ো উকিল -তার দাদার ইচ্ছে অনুযায়ী,কিংবা ডাক্তার -বিথী যেমন চায়,কিংবা বিদেশে যাবে পড়তে -আমার মা যেমন চেয়েছিলেন,কিংবা হয়তো সে কেউকেটা অফিসার বনবে যেমন চেয়েছিল আমার ছোটভাইটি।
আমি টের পাই ,আমাদের সবগুলো স্বপ্ন পূরনের ভারটি সেই অনাগত শিশুটির কাধে চাপিয়ে দিয়ে আমি ভারমুক্ত হতে চাইছি,একটি স্বপ্নের ভারে কুজো শিশুর জন্ম দেবার জন্য আমি আর বিথী আসলে উতলা হয়ে উঠছি।

তৃতীয় পর্ব:
কাজ শেষে আমি থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসি ।একটু পা টেনে টেনে হাটি,কোমরের নিচের অংশটুকু সাড় পায় না মনে হয়,তবু আমি বুক চিতিয়ে হাটতে পারি।ডাক্তারের করুন মুখটি ভেবে এখন আমার হাসি পায়।সে এই অপারেশনটি করতে চায় নি,কিন্তু তার কোন উপায় ছিল না,সরকারী এই হাসপাতালে এই অপারেশনটি করতে সে বাধ্য,এই বোধ হয়তো তাকে বহুদিন অসাড় করে রাখবে আমার কোমরের মতোই।

তার যা হবার হোক,আমি আজ খুশি।আজ আমার জন্মদান ক্ষমতা বন্ধ করে এসেছি চিরতরে।অবশেষে স্বপ্নের চক্রটি থামিয়ে দিতে পেরেছি।আমার প্রজন্মের শেষে আর কোন শিশু আসবে না,আর কোন অনাগত শিশুকে বইতে হবে না পূর্বপ্রজন্মের স্বপ্নের শব।


মন্তব্য

??? এর ছবি

আরিফ জেবতিক-এর এই পোস্টটা অবোধ্য ইংরেজিতে দেখাইতেছে কেন?

আরিফ জেবতিক এর ছবি

কী আর করব ভাই,সবই কপাল।

ভাস্কর এর ছবি

হুদাই তাইলে মা.মু.র যন্ত্রে ফালাইয়া পড়লাম!

-----------------------------------------------------
বরফখচিত দেশ ক্যান এতোদূরে থাকো!


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

আরিফ জেবতিক এর ছবি

পড়ছেন?হাচা??
এতো লম্বা লেখা পড়লেন কেমনে?আমি তো পারলাম না!!

ভাস্কর এর ছবি

সন্দেহ করতেছেন মনে লয়?

-----------------------------------------------------
বরফখচিত দেশ ক্যান এতোদূরে থাকো!


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

আরিফ জেবতিক এর ছবি

আরে নাহ্।আসলে হঠাৎ লিইখ্যা এমনিতেই ডরাই গেসি,তার মাঝে আপনে পড়ছেন কইয়া ডর বাড়াইয়া দিলেন।
স্টিকি পোস্টের ভিড়ে তো নিজের লেখা নিজেই খুইজা পাইসি বহুত কষ্টে।

নজমুল আলবাব এর ছবি

কি লিখলা? মাথা দেখি ঝিম ঝিম করে...

!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

আরিফ জেবতিক এর ছবি

পানি খাও।
কী লিখছি বুঝতে না পাইরা,আমিও কয়েক গ্লাস জল পান করিলাম।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

বাঃ! @ আরিফ জেবতিক।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আরিফ জেবতিক এর ছবি

বস্,এইটা হইলো ধুনফুন কমেন্ট।লেখা পইড়া থাকলে কেমন লিখছি,কিভাবে লিখলে ভালো হইতো,সেইগুলান কইয়া যান।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আরিফ, আপনার লেখার চরিত্রটি উকিল হয়নি, তাতে কী? আপনাকে তো উকিলই মনে হচ্ছে। লিখলেন আপনি, আর আসামী এখন আমি, পাঠক! হায় রে কপাল!

আমি তো অন্তত পড়েছি বলে আওয়াজ দিলাম। কেউ কেউ দেখি তা-ও দেয় না। শুধু শুধু পড়ে চলে যায়, ভালোমন্দ কিছুই বলে না। তাদের ধরার ব্যবস্থা আছে?

বাঃ বলে মন্তব্য করলে কি কিছু বোঝা যায় না?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আরিফ জেবতিক এর ছবি

যে ফাকি দিয়া যাইতে পারে,তার ব্যাপারে উকিল দারোগার কি ই বা করার থাকে।যে ধরা পড়ে তাহাকেই জরিমানা গুনিতে হয়।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

তাইলে ধরা খাওয়া আসামী আমিই হইলাম! কপালের ফের। চোখ টিপি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আরিফ জেবতিক এর ছবি

বস্,একটু বিস্তারিত কমেন্ট করলে শিখতে পাই।এইটাই হইলো মুল কথা।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

যাক, তাহলে আসামী খালাস। এবারে মাস্টারি! কোনটা ভালো কে জানে! তথাস্তু। এরপর থেকে মনে থাকবে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

হিমু এর ছবি

ধৃষ্টতা মাফ করেন, আরেকটু বিস্তৃতি নিয়ে লিখলে কেমন হতো?

আরিফ জেবতিক এর ছবি

আপনার শরীফ মন্তব্যের জন্য শুকরিয়া।@হিমু।

আপনি ঠিকই ধরিয়াছেন জনাব।ইহা একটি খসড়া,ইহাকে বড়ো করিবার বাসনা রহিয়াছে।পাছে থিম ভুলিয়া যাই,তাই একটানে একটা খাড়া করিলাম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।