একুশের সাড়া জাগানো সেই ছবিটির গল্প

অরূপ এর ছবি
লিখেছেন অরূপ (তারিখ: শনি, ০২/০২/২০০৮ - ১:৫৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শহীদ রফিক উদ্দীন (আলোকচিত্রী: আমানুল হক)১৯৫২ সালে আমানুল হক ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আর্টিস্ট কাম ফোটোগ্রাফার। একটা ভাঙ্গা বক্স ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে বেড়ান আর ছবি তোলেন। বিয়ে থা করেননি (এখনও চিরকুম...শহীদ রফিক উদ্দীন (আলোকচিত্রী: আমানুল হক)১৯৫২ সালে আমানুল হক ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আর্টিস্ট কাম ফোটোগ্রাফার। একটা ভাঙ্গা বক্স ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে বেড়ান আর ছবি তোলেন। বিয়ে থা করেননি (এখনও চিরকুমার), তাই পাখির মতো জীবন।

কিন্তু ফেব্রুয়ারীর ২১ তারিখ সব কিছু বেশ খানিকটা বদলে গেল। গুলি হল মিছিলে। ঝড়ে গেল অনেকগুলো প্রাণ।

এই ঘটনার কথা শুনে মেডিক্যাল কলেজে ছুটে গেলেন কাজী মোহম্মদ ইদ্রীস। কাজী ইদ্রীস তৎকালীন সরকারী প্রচার বিভাগের সহকারী পরিচালক ছিলেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক হিসেবেও খ্যাতি ছিল তার। কাজী ইদ্রীসকে দেখে ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী (ডঃ) হালিমা খাতুন এগিয়ে আসেন। গোপনে জানান নিহত একজনের লাশ রক্ষিত আছে হাসপাতালের পেছনে, চাইলে সেলাশ দেখাতে পারেন তিনি।

কাজী ইদ্রীস রাজী হয়ে যান, ভীষন উত্তেজনা ভর করে তাকে। হালিমার কাছে জানতে চান ছবি তোলা যাবে কিনা। হালিমা সম্মতি দেন, কিন্তু সবকিছু সারতে হবে মিনিট খানেকের মধ্যে। ইদ্রীস সাহেবের সাথে আমানুল হকের আগে পরিচয় ছিল। খুঁজতে গিয়ে তাকেই পেয়ে গেলেন কম্পাউন্ডের ধারেপাশে। আমানুল তার ফুলহাতা হাওয়াই শার্টের ভেতরে ক্যামেরা লুকিয়ে ঘোরঘুরি করছিলেন।

ঠিক হল দুজনে এক সাথে যাবেন না ছবি তোলার সময়। করিডর থেকে হালিমার সংকেত পেলেই আমানুল হালিমাকে অনুসরন করে যাবেন লাশের কাছে। ইতোমধ্যে ক্যামেরার সেটিং ঠিক করে ফিরে আসে আমানুল আর কাজী ইদ্রীসও দূর থেকে হালিমাকে পরিচয় করিয়ে দেন তার সাথে।

সংকেত পাওয়ার পরপরই আমানুল সন্তর্পনে এগিয়ে যান হালিমার কাছে। গোপনে তোলা হয় রক্তস্নাত লাশের ছবিটি। নিশ্চিত করা হয় ছবিটি যেন ঠিকমতো আসে। ছবির সেই লাশটি ছিল শহীদ রফিক উদ্দীনের।

ছবিটির তিনটি কপি করা হয়। একটি নেন এ.এস.এম মোহসিন (স্পোর্টস ফেডারেশন), আরেকটি নেন মাজেদ খান (ইসলামের ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। শেষ কপিটি পাঠিয়ে দেওয়া হয় দৈনিক আজাদে প্রকাশের জন্য।

দৈনিক আজাদে ছবিটি ছাপার জন্য হাফটোন ব্লক তৈরি করা হলেও মওলানা আকরম খাঁ (আজাদের স্বত্ত্বাধিকারী) বা সদরুল আনাম খান সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন গভীর রাতে।

কিন্তু গোপনে আরেকটি ব্লক তৈরি করা হয়েছিল। আর সেই ব্লকটি ব্যবহার করেই ছাত্ররা লিফলেট ছাপায়। দুর্ভাগ্যবশতঃ পুলিশ সেই লিফলেটগুলো বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করে।

অনেক পরে সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রচ্ছদে ছবিটি পুনঃপ্রকাশিত হয়। ইন্টারনেটে হয়তো এই প্রথম প্রকাশিত হচ্ছে ছবিটি।

পুনশ্চঃ আমানুল হক সম্পর্কে আমার মেজমামা। চীরকুমার এক্সেন্ট্রিক এই শিল্পীর ভান্ডারে অসাধারন সব ছবি জমা আছে। নানা জটিলতায় হয়তো সেগুলো আর কোনদিনই ঠিকমতো প্রকাশিত হবে না। তার বড় শখ ছিল "আমার দেশ চিত্রমালা" নামে বাংলাদেশের ওপর একটা ছবির বই বের করার। সেই বইয়ের ভাগ্য অনিশ্চিত হলেও "একুশের তমসুক" নামে ভাষা আন্দোলনের ওপর তার একটা বই শেষ পর্যন্ত বেরিয়েছে ২০০৪-এ। আগ্রহীরা "সাহিত্য প্রকাশ"-এ খোঁজ করতে পারেন..


মন্তব্য

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

দুর্দান্ত পোস্ট। ছবিটা আগে দেখেছিলাম, কাহিনী জানা ছিলো না।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ছবিটা আগে দেখিনি। কাহিনী জেনে শিহরিত। ধন্যবাদ।

সুজন চৌধুরী এর ছবি

অসাধারন পোস্ট।
আমানুল হক আমার খুব প্রিয় ফটোগ্রাফার। উনি সত্যজিৎ রায়ের সাথে পথের পাচালীতে কাজ করেছিলেন,সত্যজিৎ রায়ের কোন লেখায় পড়েছিলাম তিনি আমানুল হককে কার্তিয়ের ব্রেসোর সাথে তুলনা করেছেন।
আচ্ছা আসাদুল হক কী ওনারই ভাই?

____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

সুজন চৌধুরী এর ছবি

১মত: আমানুল হক আমার বাবার বন্ধু।
২য়ত: আমি ১টা বই পড়েছিলাম সিনেমায় নজরুলের গান বিষয় সেটা লিখছিলেন আসাদুল হক। এই বিষয় বাবার সাথে কথা বলতে গিয়ে জেনেছিলাম উনি আমানুল হকের ভাই ( বাবা ১টু কনফিউজড ছিলো)।বইটা খুবি ভালো লেগেছিলো পড়ে।
খুবি ভাগ্যবান পরিবার।
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

(বিপ্লব)
শৈশব থেকে জানি ফটোগ্রাফার আমানুল হকের নাম।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

অতিথি লেখক এর ছবি

দুর্দান্ত পোস্ট। জানতাম না কিছুই এসবের।

-নির্বাসিত

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

অরূপের লেখা পড়ে মনে হলো যে, সে সন্দেহ করছে আমানুল হককে আলোকচিত্রশিল্পী হিসেবে অনেকে নাও চিনতে পারে।
বাংলাদেশে এখন কি অবস্থা এরকমই!

আমানুল হকের আমার দেশ চিত্রমালা বের হয়নি কথাটা শুনে অবাক হলাম। আগে বিচিত্রার বিশেষ সংখ্যাগুলোর প্রচ্ছদ করা হতো আমানুল হকের তোলা অসম্ভব সুন্দর সব ছবি দিয়ে। পালতোলা নৌকা সবুজ ধানক্ষেতের এক রঙিন ছবি এখনও চোখে ভাসছে। প্রচ্ছদের সেসব ছবির নীচে একথা স্পষ্ট লেখা থাকতো যে আমানুল হকের 'আমার দেশ চিত্রমালা' থেকে। স্মৃতি মোটেও প্রতারণা করছে না। আমি একশোভাগ নিশ্চিত। কিন্তু বইটা আদপে বেরই হয়নি, পরিকল্পনা পর্যায়েই রয়ে গেছে এ বিশ্বাস হচ্ছে না।
একবার প্রকাশনার কাজে নিউমার্কেট থেকে তিনটার মত বাংলাদেশের ছবির বই কিনেছিলাম। আনোয়ার হোসেনের একটা বই ছিল মনে আছে। এরকম বই যে কম বিক্রি হয় তা নয়। নানা কারণেই এসব বইয়ের দরকার পড়ে।

অরূপ, এই বই যদি প্রকাশ না হয়ে থাকে, তবে এটা একটা পাপ হবে। এরকম পাপ করে জাতি এগুতে পারে না। এখনই কিছু একটা করা দরকার। এখন দেশে অনেক প্রকাশক, অনেক পয়সা। উদ্যোগ নিলে এখন মনে পাপস্খলন করা যাবে দ্রুত।
-----------------------------------------------
Those who write clearly have readers, those who write obscurely have commentators.--Albert Camus

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

সুজন চৌধুরী এর ছবি

বিগ সির সাথে ১মত।
তবে এটাও সত্য যে খুব বেশি লোক ওনাকে চেনে না।
(এটা ২ বাংলার ক্ষেত্রেই সত্য)।
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব ভাল করে চিনি সেটা বলবোনা...তবে শ্রদ্ধেয় এই ফটোগ্রাফার সম্পর্কে কোন একটা প্রবন্ধ পড়েছিলাম।খুব সম্ভবত ভোরের কাগজে।আর বিচিত্রার স্বর্ণসময়ে আমি নেহায়েতই পিচ্চি।তাই সেই সূত্র ধরে চেনার কোন পথ আমার খোলা ছিলোনা... মাঝে মাঝে মনে হয় বয়স এত কম ক্যান?? কিসুই তো জানলাম না... মন খারাপ

আমানুল হক কিংবা তার ছবির উপরে নেটে কোন কিছু পাওয়া যাবে?? যদি থাকে প্লীজ দয়া করে লিংক জানাবেন।

কনফুসিয়াস এর ছবি

চলুক
-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

দারুন লাগলো।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

নিঘাত তিথি এর ছবি

শ্রদ্ধা
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

অমিত এর ছবি

সচলের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া কি সম্ভব ?

এম. এম. আর. জালাল এর ছবি

"একুশের তমসুক" থেকে একটি পাতা আমানুল হককে নিয়ে

====
এম. এম. আর. জালাল
"ফিরে দেখুন একাত্তর ঘুরে দাঁড়াক বাংলাদেশ।"


এম. এম. আর. জালাল
"ফিরে দেখুন একাত্তর ঘুরে দাঁড়াক বাংলাদেশ।"

নজমুল আলবাব এর ছবি

নেটে ছিলামনা এই পোস্ট যেদিন দেয়া হয়। আজ পুরনো লেখা পড়ার সময় পেলাম। অসাধারণ। ধন্যবাদ অরূপ।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

অসাধারণ পোস্ট। সচলে ঢুকতে পেরে আমি অনেক কারণেই গর্বিত। এটা তেমন একটা কারণ বলা বাহুল্য।

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

পুরনো লেখা ঘাঁটতে গিয়ে লেখাটা পেলাম। ভালো লাগলো।
বাবা দৈনিক বাংলায় কাজ করতেন, সেই সুবাদে একেবারে ছোটবেলা থেকেই বিচিত্রার সাথে পরিচিত। আমানুল হক-এর ছবিও তখন থেকেই দেখা। অবশ্য তখন ফটোগ্রাফি বুঝতাম না। এখন মনে আসছে হালকা হালকা। আর এই ছবিটার গল্প শুনেছিলাম ডঃ হালিমা খাতুনের কাছেই। একটা টিভি অনুষ্ঠানে তার দীর্ঘ সাক্ষাতকার নিতে গিয়ে।
এটাই সত্যি যে আমানুল হক-কে এখনকার অনেক ফটোগ্রাফারও চেনেন না। দুঃখ কি আর শুধু শুধু হয়?
বই যদি প্রকাশ নাও হয়... ছবিগুলো যেন অন্তত থাকে।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

বিপ্লব রহমান এর ছবি

অরূপদা, (বিপ্লব) ।

ছবিটি আগে কোথাও দেখেছিলাম, তবে এই নেপথ্য কাহিনী জানা ছিলো না। ক্যামেরা যোদ্ধা আমানুল হকের আলোকচিত্র বইয়ে প্রকাশ হোক আর না হোক, অনুরোধ করবো, তার তোলা কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র এই ব্লগে প্রকাশ করার। ধন্যবাদ।


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।