ফ্রেজার সাহেবে পুরো নাম লুইস জেমস ফ্রেজার। ঊনিশ শতকের শেষদিকে অস্ট্রেলিয়ায় চলছে গোল্ডরাশ, ভাগ্য পরীক্ষা করতে ফ্রেজার সাহেবও রওনা দিলেন অস্ট্রেলিয়া। বেচারা সেখানে সুবিধা করতে পারলেন না, শেষে হাজির হলেন মালায়াতে। বিপুল উৎসাহ নিয়ে আবার সোনার সন্ধানে নামলেন, কিন্তু সোনা পেলেন না।
সোনা না পেলেও এবার খুব হতাশ হতে হল না, কারন সোনা খুঁজতে গিয়ে পেয়ে গেছেন টিনের খনি! দেরী না করে চীনে মজুর আনিয়ে নিয়ে টিনের ব্যবসা শুরু করে দিলেন। মালায়ার জঙ্গলে শ্রমিক-মজুর ধরে রাখা সহজ নয়, তাই বুদ্ধি করে আফিম আর জুয়ার আড্ডা খুলে দিলেন যেন লোকজনের বিনোদনের ঘাটতি না হয়। এভাবে চলছিল ভালোই। তারপর একদিন ১৯১০ সালের দিকে ভদ্রলোক লাপাত্তা হয়ে গেলেন।
ফ্রেজারের ব্যবসা মন্দ ছিল না। তার অন্তর্ধানে ব্রিটিশরাজ চিন্তিত হয়ে গেলেন। শেষে ঠিক হল সিঙ্গাপুরের বিশপ সি. জে. ফার্গুসন ডেভি যাবেন ফ্রেজারের খোঁজে, মালায়ার জঙ্গলে!
বিশপ ডেভি অনেক দৌড়ঝাপ দিয়েও ফ্রেজারের কোন হদিস পেলেন না। দেখলেন মাইনিং ক্যাম্প ফাঁকা পড়ে আছে। কি আর করা, অনুসন্ধানের হাল ছেড়ে দিলেন। কিন্তু ফিরবার আগে নতুন ধান্দা এলো বিশপের মাথায়। মালায়ার গরম আর আর্দ্র আবহাওয়াতে তখন বিলেতী সাহেবরা হাঁসফাস করছিলেন। বিশপ দেখলেন ফ্রেজারের ক্যাম্পের পরিবেশ ভীষন মনোরম, সারাটা সময়জুড়ে হালকা শীত, বইতে থাকে মিষ্টি বাতাস, আর ফায়ার প্লেসের পাশে বসে চমৎকার চায়ে চুমুক দিয়ে গল্প করা যায়। তাই ফিরে গিয়েই রিপোর্টে লিখলেন এখানে একটা হিল স্টেশন তৈরি করা হোক, যেখানে গিয়ে দরকার মতো জিরিয়ে নেবেন বিলেতী সাহেবরা।
বিশপের কথায় কাজ হল। ১৯১৯-এ শুরু হয় রাস্তা তৈরির কাজ। তিন বছর পর খুলে দেওয়া হয় নতুন হিল স্টেশন, নাম দেওয়া হয় ফ্রেজার'স হিল।
সারাদিনই ধান্দায় থাকি পাখির ছবি তুলব। কিন্তু পাখি পাব কই? খুঁজতে গিয়ে পেলাম ফ্রেজার'স হিলের নাম। দাবী করা হয় এখানে ২৭০ প্রজাতির পাখি আছে। বার্ডওয়াচারদের তীর্থ বললে ভুল হবে না। হিসেব করে দেখলাম যেতে ঘন্টা দুই লাগবে। বেলা দুটো বাজে। ফ্রীজে বাসি খাবার ছিল, কোনমতে তা দিয়েই লাঞ্চ করে লটবহর নিয়ে ছুটলাম গাড়ি দিকে। রাতে (Oct 2, 2008) একটা দাওয়াত ছিল ঈদের। কি আর করা, পাখির জন্য না হয় একদিন পোলাও মিসই না হয় হল। তাড়াহুড়োর আরেকটা কারন হল বউ নাই। এসব জায়গায় বউ ছাড়া যাওয়াই ভালো। কাজটা বোরিং, হুদাই মেয়েটাকে যন্ত্রনার মধ্যে ফেলা ঠিক না।
ভাঙ্গা, জংলী রাস্তা পার হয়ে সাড়ে ছটার দিকে যেখানটায় পৌছালাম তাকে বলা হয় "দ্য গ্যাপ"। গ্যাপ থেকে সাতকিলো উপরে উঠলেই ফ্রেজার'স হিল। মুস্কিল হল রাস্তাটা এক লেনের। তাই নিয়ম করা হয়েছে সময়ের বেজোড় ঘন্টায় গাড়ি শুধু উপরে উঠবে আর জোড় ঘন্টায় নামবে। তখন বাজে সাড়ে ছটা, বুঝলাম সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বসে থাকতে হবে গ্যাপে।
উপরে উঠে মহা ঝামেলায় পড়লাম। হোটেল ঠিক না করেই এসেছি। একটা ভালো হোটেল দেখে ঢুকলাম, বলে দুশো সত্তর রিঙ্গিত! মহাবিপদ! আরেকটায় কোন ঘর খালি নাই। শেষে পথ হারিয়ে যখন ঘুরছি তখন জেলিয়া হাইল্যান্ড রিসোর্ট চোখে পড়ল। ঢুকে দেখি জনমানুষের চিহ্ন নাই। বেশ কবার বেল-এ বাড়ি দিতে একজন হাজির হলেন।
"১৮০, পাবলিক হলিডে রেট", যুবক বলে
"ইউ সি, ফার্স্ট টাইম হিয়ার, সাতু (একজন) ওরাং (মানুষ), উইল টেক বুরুং (পাখি) ফোটো, গিভ সাম ডিসকাউন্ট লাহ!.."
"১৫০"
"নো ১১০, চার্জ মি উইকএন্ড রেট.."
"ওকে.. কাম সি দ্য রুম"
আমি মহাখুশি, রুম বিশাল। তিনটা বেশ, ফাংশনাল কমোড, আর কি চাই। পাখির কথা বলতেই সে বললো হোটেলের বারান্দাতেই প্রচুর পাখি আসে, কষ্ট করত হবে না (কথা সত্য)।
পাখি দেখতে হয় ভোরে, বিকেলে আর বৃষ্টির পর যখন পোকামাকড় বের হয়। তাই আমার প্ল্যান ভোর ছটায় ওঠা। যারা আমাকে চেনেন তারা ঠিক বিশ্বাস করবেন না যে আমি ছটায় উঠতে পারি। রাতে ফুড কোর্টে খেতে গেলাম, নাসি গোরিং ইউএসএ। ভাজা ভাতের সাথে কেন ইউএসএ যোগ করা হয়েছে জানি না, তবে এতে আমিষের পরিমান ভালোই থাকে। ডিনার শেষে দোকানীর সাথে কথা হল পাখি দেখা নিয়ে। ভদ্রলোক বললেন টেলিকম লুপে ঢুঁ মারতে, সাথে একটা ম্যাপও দিলেন।
ঘরে ফিরেই লেপমুড়ি দিয়ে শুলাম। হুমায়ূন আহমেদের মধ্যাহ্ন পড়তে বসলাম, সাথে এক মাগ সস্তা কফি। আহা...
আলো ফোটে সাড়ে ছটায়। তাই বের হতে হতে সাতটা বেজে গেল। পাখির বিষয়টা সত্য, কাকলি শুনেই বলা যায় এটা পাখির স্বর্গ।
আমার সাথে এবার ৩০০মিলিমিটারের জুম, ইমেজ স্ট্যাবিলাইজার আছে বলে হাতেই তোলা যায়। আইএসও ৮০০তে দিয়ে শুরু হলো ফোটোশিকার।
হোটেল মিনিট দশেক ছবি তুলে গাড়ি ছুটালাম টেলিকম লুপের দিকে। গাড়ি ওদ্দুর নেওয়া গেল না, ক্লক টাওয়ারে পার্ক করে পায়ে হাটা দিলাম।
টেলিকম লুপে এমনি এমনি পাখি জটলা করে না। এই জায়গাটা ঘনজংলা। তাই পাখিরা খানিকটা সস্তিতে থাকে। আমার উচিত ছিল ট্রেইল ধরে হাটা। কিন্তু সাহসে কুলায়নি পাহাড়ী লাল জোঁকের ভয়ে। জিনিসটা মোটেএ সুবিধার না।
হাটছিলাম রাস্তা ধরে। আধাঘন্টা পর প্রথম একটা গাছ পাওয়া গেল যেখানে আলো আর পাখি দুটোই প্রচুর। পর্যাপ্ত আলো ছাড়া পাখির ছবি তোলা অসম্ভব!
প্ল্যান ছিল বারোটা থেকে বারোটা চল্লিশের মধ্যে ঘরফিরতি রওনা দেব। তাই সাড়ে এগারোটার দিকে হোটেলে ফিরে এলাম। এসে দেখে নানারকম হামিং বার্ড (পরে জেনেছি এরা হামিং বার্ড না, প্রজাতিভেদে এদের সানবার্ড বা স্পাইডার হান্টার বলে ডাকা হয়) ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে। ক্যামেরা নিয়ে আবার দৌড়!
বারোটা বিশের দিকে অভিযান শেষ হল, আমিও ফিরতি রওনা দিলাম।
ফ্রেজার'স হিলে লোকজন খুব কম যায়। কারন এখানে না আছে নাইটলাইফ না আছে বিনোদন। এসব কারনে পাখিরাও টিকে আছে। মালেশিয়ানরা যেভাবে টুরিস্ট এনে দেশ ভাসিয়ে দিচ্ছে তাতে শঙ্কা হয়। হাতে বেশী সময় নেই, ভাবছি আবার কবে এই জংলায় আসা যায়..
চেস্টনাট ক্যাপড লাফিং থ্রাশ (Garrulax mitratus)
ফায়ার টাফটেড বারবেট (Megalaima haemacephala)
সিলভার ইয়ার্ড মেসিয়া (Leiothrix argentauris)
পুরুষ গ্রে চিনড মিনিভেট (Pericrocotus solaris)
স্ত্রী গ্রে চিনড মিনিভেট (Pericrocotus solaris)
স্ত্রী লিটল পাইড ফ্লাইক্যাচার (Ficedula westermanni)
লিটল গ্রিন পিজিয়ন (Treron olax)
মাউন্টেইন বুলবুল (Hypsipetes mcclellandii)
গোল্ডেন ব্যবলার (Stachyridopsis chrysaea)
হোয়াইট থ্রোটেড ফ্যানটেইল (Rhipidura albicollis)
বায়ে ছোট র্যাকেট টেইলড ড্রোঙ্গো (Dicrurus remifer), ডানে ব্লু নাটহ্যাচ (Sitta azurea)
প্যাসিফিক সোয়ালো (Hirundo tahitica)
স্ট্রিক্ড স্পাইডারহান্টার (Arachnothera magna)
মন্তব্য
সুন্দর সব ছবি
শেষ কয়েকটাতে পাখীগুলোকে কেমন
ফুল আর ফুলগুলোকে কেমন পাখির মতো লাগছিল
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
ছবিগুলা দেখে গেলাম। বর্ণনা পরে পড়ব। ড়্যাকেট টেইলড ড্রোংগো মনে হয় বামে আর ডানেরটা নাটহাচ (আপনি উল্টা করে লিখেছেন)। আপনার ফ্লিকারের লিংকটা দিলে আরেকটু ডিটেলস দেখতাম...
আমি যতটা জানি তাতে ড়্যাকেটটেইলড -কেই ভীমরাজ বলে। বাংলাদেশে (মানে ঢাকায়) আমি কখনো ভীমরাজ দেখিনি।
ক্লিক করে বড় হয় সেটা জানি, আমি দেখতে চাইছিলাম ছবির এক্সপোজার।
পাখী আমার একলা পাখী
একলা ফোকলা দুজন পাখী
অজ্ঞাতবাস
অজ্ঞাতবাস
আমার আবার পাখী পর্যবেক্ষনের প্রতি আগ্রহ নেই, কিন্তু পাখী দর্শনে আপত্তি নেই... ছবিগুলো দেখে ভালো লেগেছে; ভ্রমনকাহিনীটাও আকর্ষনীয় ছিল..
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
দুর্দান্ত লাগলো।
ওয়াইল্ড লাইফে চরমভাবে মেতেছি মাস ছয়েক হলো। অজস্র ডাউনলোডিত ফিল্ম বসে আছে প্রদর্শিত হবার আশায়।
আপনার খাওনদাওনের গপ্পো শুনি না বহুতদিন।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
আইস্যা গেছে এসএলআর অরুপ । ছবির জন্য বিপ্লব দিলাম।
--------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
দারুণ!
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
ভালো লাগল ছবিগুলো!
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
নতুন মন্তব্য করুন