একাত্তরের গল্প - ০১ (বোধ - দর্পন কবীর)

এম. এম. আর. জালাল এর ছবি
লিখেছেন এম. এম. আর. জালাল (তারিখ: রবি, ১৬/০৯/২০০৭ - ৯:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বোধ




দর্পণ কবীর

রেদোয়ান আহমেদ লক্ষ্য করলেন তার পাশে বসা লোকটি এক পা তুলে ভ্রুক্ষেপহীনভাবে বসে আছে। গ্রামের লোকেরা সাধারণত শহরের লোক দেখলে একটু সমীহ প্রকাশ করে। কিন্তু এই লোকটি কেমন যেন উদ্ধত। লোকটি দিনমজুর হবে। গায়ে শতছিন্ন মলিন পোষাক। পড়নের লুঙ্গিটি খুবই নোংরা। গা থেকে কেমন উটকো গন্ধ আসছে। এমন একটি লোক রেদোয়ান আহমদেকে দেখে একটুও কাঁপলো না বা সমীহ প্রকাশ করে টুল থেকে পা নামালো না। এমনকী, ধুপ ধুরস্খ পোষাক পরিহিত রেদোয়ান আহমেদ যে লোকটির পাশে বসলো, তাতে লোকটির ভাবলেশের পরিবর্তন হলো না। সে কেমন নির্বিকার ভাব করে রইলো। ঘটনাটি তুচ্ছ হলেও ভাবিয়ে তুললো রেদোয়ান আহমেদকে। তিনি জানেন কেমন করে মানুষকে চমকে দেয়া যায় কিংবা মুগ্ধ করা যায়। তিনি এ কাজটি দীর্ঘদিন যাবত করে আসছেন। রাজনীতিতে চমক দেখাতে হয়। সাধারণ লোকদের মন্ত্রমুগ্ধও করতে হয়। রাজনীতিবিদ হিসাবে রোদোয়ান আহমেদ এই কৌশল বেশ ভালোই রপ্ত করেছেন। কৌশলটি প্রয়োগও করে যাচ্ছেন। কিন্তু আজ গ্রামের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসে এই লোকটির আচরণ দেখে তিনি নিজেই কেমন চমকে গেলেন। তিনি হাল ছাড়ার পাত্র নন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তিনি লোকটির সঙ্গে ভাব জমানোর গলায় বললেন,

‘এই গ্রামটি খুউব সুন্দর! গ্রামের মানুষগুলোও সুন্দর, তাইনা?’

এর কোন জবাব দিল না লোকটি। সে রেদোয়ান আহমেদের দিকে শুকনো মুখে তাকালো। রেদোয়ান আহমেদ বিরক্ত হলেন। কিন্তু মুখে এর প্রকাশ নেই। রাজনীতিবিদ হওয়ায় এই ‘গুণ’টি আয়ত্ত্ব করেছেন। রাজনীতিবিদদের সবার সাথেই হাসি মুখে কথা বলতে হয়। যে যা চায়, সবই করে দেবার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। খুবই কদর্য শ্রেণীর লোকের সাথে হাত মিলিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে হয়। তিনি এ সব কাজে অভস্ত। লোকটির দিকে তাকিয়ে তিনি হেসে বললেন,

‘আপনাকে আমার খুব চেনা চেনা লাগছে! আপনার নামটা যেন কি?’

এবার যেন কাজ হলো। লোকটি ফিক করে হাসলো। হাসতে গিয়ে মুখ থেকে থু থু ছিটকে বেরুলো। চায়ের দোকানদার মফিজ মিয়া রেদোয়ান আহমেদের উদ্দেশ্যে বললো,

‘স্যার, ও হচ্ছে আন্দু চোরা! ওকে আপনে করে কথা বলতাছেন ক্যান!’

আন্দু চোরা মিটিমিটি হেসে মফিজ মিয়ার কথাকে সমর্থন জানালো। রেদোয়ান আহমেদ দু’ চোখ কপালে তুলে বললো,

‘নাম আন্দু চোরা কেন?’

এবার কথা বললো আন্দু।

‘জ্বে, আমার পেশা চুরি করা। তাই..’

‘তুমি চোর!’

‘জ্বে। ছিঁচকে চোর।’

‘কী চুরি করো?’

‘এই ধরেন, ঘটি-বাটি, হাড়ি-পাতিল। হাতের কাছে যা পাই, তাই চুরি করি।’

আন্দুর এই জবাবে অবাক হলেন রেদোয়ান আহমেদ। কেউ চুরি করার কথা এমনভাবে স্বীকার করে বলে তার জানা নেই। তিনি কৌতুহলী হলেন। বললেন,

‘তা কেমন যাচ্ছে দিনকাল?’

যেন এ কথাটিতে একতাল চাপা বেদনা ফুস করে ভেসে ওঠলো আন্দুর মনের পুকুরে। পুকুরে ঢেউ ওঠলো। ও বললো,

‘তা গাঁয়ে কি চোরদের ভালো থাকার দিন আছে? এই গাঁয়ে পড়ে থেকে না খেয়ে মরছি। যদি শহরে যেতে পারতাম!’

আন্দুর বুক চিরে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। রেদোয়ান আহমেদ বললেন,

‘শহরে আবার চোরদের জন্য কি এমন সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে?’

‘স্যার শুনেছি, শহরেই চোরদের বড় রমরমা আবস্খা! ঐখানে চোরেরা স্যুাট-কোট পড়ে দামী দামী গাড়িতে ঘুইরা বেড়ায়। থাকে বড় বড় দালানে! তেনারা অবশ্য শিক্ষিত চোর।’

আন্দুর কথা শুনে রেদোয়ান আহমেদের ভিড়মী খাবার যোগাড়। অজপাড়া গাঁয়ের এই ছিঁচকে চোর বলছে কী! তিনি আন্দুর ও কথায় সায় দিলেন না। মফিজ মিয়াকে চায়ের দাম দিতে দিতে তিনি বললেন,

‘তুমি চোর হলে কেন?’

‘স্যার, সাধে কি আর চোর অইছি। ৫ বছর বয়সে বাপটা মইরা গেল মুক্তিযুদ্ধের সময়। মা-ও মরলো সেই শোকে। পেটের দায়ে চুরি বিদ্যাটাই শিখলাম।’

আন্দুর কথা শুনে মনটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো রেদোয়ান আহমেদের। তিনি বললেন,

‘তোমার বাবা কি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন?’

‘জ্বি, স্যার।’

একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অভাবের তাড়নায় হয়েছে ছিঁচকে চোর! ব্যাপারটা বিব্রত করে দিল তাকে। তিনি গলা নরোম করে বললেন,

‘আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাই তোমার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।’

এ কথা শুনেই আন্দু হঠাৎ লাফিয়ে পড়লো রেদোয়ান আহমেদের পায়ের সামনে। তার পা ছুঁয়ে সালাম করলো দ্রুত। তিনি অবাক কণ্ঠে বললেন,

‘তুমি সালাম করলে কেন?’

‘স্যার, আমি মুক্তিযোদ্ধা দেখলেই সালাম করি। আপনারা হলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় লোক। আপনাদের সালাম করলে পূন্য হয়।’

আন্দুর কথা শুনে মনটা বরফ গলা নদী হয়ে গেল। অথচ এই ছেলেটির পেশা হচ্ছে চুরি করা। আশ্চার্য!

রেদোয়ান আহমেদ বললেন,

‘সংসারে তোমার কি আর কেউ নেই?’

‘স্যার, বউ আছে আর আছে পাঁচ বছরের একটা মাইয়া। মাইয়াটার আসুখ। ও ঘরে অসুখে কাতরাইতাছে! কিন্তু বাপ হইয়া কিছুই করতে পারতাছি না। চোর বইলা কেউ সাহায্যও করে না।’

আন্দুর কথায় রেদোয়ান আহমেদ বুঝতে পারলেন , কিছুক্ষণ আগে তার পাশে আন্দু পা তুলে বসেছিলো অন্যমনস্কতার কারণে, দু:শ্চিন্তার অতলে ডুবে। তার মন থেকে জমে থাকা রাগের পালক খসে পড়লো। তার মনটা নদী থেকে সমুদ্র হয়ে যেতে থাকে। তিনি পকেট থেকে পাঁচ শ টাকার কতগুলো নোট বের করে বাড়িয়ে দিলেন আন্দুর দিকে। বললেন,

‘এই টাকাগুলো রাখো। তোমার মেয়ের চিকিৎসায় খরচ করো।’

হঠাৎ কি বজ্রপাত হলো? আন্দু হতভম্ব। বিস্ময়ের ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেল ওকে। এই দৃশ্যে মফিজ মিয়ার চোখও ছানাবড়া। ওরা হতবিহবল চোখে তাকিয়ে রইলো রেদোয়ান আহমেদের দিকে। ওদের স্পন্দন যেন থমকে গেছে। এ ধরনের দৃশ্য দেখে রোদোয়ান আহমেদ অভ্যস্ত। তিনি বহু স্খানে বহুজনকে এভাবেই হত বিহবল করে দিয়েছেন। অর্থের অদ্ভূত এক শক্তি! অভাবী ও দরিদ্র মানুষের সামনে এই শক্তিকে নানাভাবে কাজে লাগানো যায়। থ হয়ে থাকা আন্দুর হাতে তিনি টাকাগুলো গুঁজে দিলেন। এরপর তিনি এগিয়ে গেলেন নিজের গাড়ির দিকে। তিনি জানেন বিস্ময়ের ঘোর কাটুক বা না কাটুক, আন্দু গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে তার পিছু পিছু আসবে। তিনি এ দৃশ্যটি কল্পনা করতে করতে এগিয়ে গেলেন গাড়ির দিকে। পেছনে তাকালেন না একবারও।

জনসভা হবে মঙ্গলের গাঁয়ের ঈদগাঁ ময়দানে। রেদোয়ান আহমেদ এই জনসভায় প্রধান অতিথির ভাষণ দেবেন। তিনি মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে সঙ্গে নিয়ে জনসভার দিকে যাচ্ছিলেন। জনসভার স্খলের ৬ মাইল আগে তাদের গাড়িটির একটি চাকা পাংচার হয়ে গেল। গ্রামের নির্জন পথে থেমে গেল গাড়ি। ড্রাইভার গাড়ির চাকা বদল করার কাজে নামতেই তিনি গাড়ি থেকে নেমেছিলেন। একটু দূরেই দেখতে পেলেন মফিজ মিয়ার চায়ের দোকান। তিনি সুযোগ পেলেই গ্রামের মানুষদের সঙ্গে মেশেন। তাই তিনি মফিজ মিয়ার চায়ের দোকানে বসে চা পান করলেন। তিনি গাড়ির সামনে আসতেই ড্রাইভার রহিম বললো,

‘স্যার, চাকা বদলাইছি। গাড়িতে উঠেন।’

রেদোয়ান আহমেদ গাড়িতে উঠার আগে পেছনে তাকালেন। দেখলেন আন্দু ঠিক-ই তার পেছনে এসেছে। নিজের ধারনার প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় হলো। তিনি আন্দুর উদ্দেশ্যে বললেন,

‘কী ব্যাপার, পিছু আসছো কেন?’

‘স্যার, আপনারে আরেকবার সালাম করতে চাই। আপনে তো ফেরেস্তা!’

রেদোয়ান আহমেদ জানেন আন্দু এ ধরনের কথা বলবেন। গাঁয়ের একজন সাধারণ লোকের হাতে কয়েক হাজার টাকা তুলে দিলে এমন-ই হয়। তারা এতোই বিস্মত হয় যে, দাতাকে মনে করেন দেবতা। আন্দু রেদোয়ান আহমেদকে সালাম করার সময় গাড়িতে বসে থাকা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে দেখতে পেল। সে ভীষণ আঁতকে ওঠে বললো,

‘স্যার, আপনার গাড়িতে রাজাকার সাঈদী!’

‘হিস্স্! চুপ করো, শুনতে পাবে!’

রেদোয়ান আহমেদ ডান হাতের আাঙ্গুল দু’ ঠোঁটের সামনে সটান তুলে সাবধানী গলায় বললেন। আন্দু তার হুঁশিয়ারী তোয়াক্কা না করে বললো,

‘আপনি না মুক্তিযোদ্ধা! রাজাকার সঙ্গে লইয়া কই যান?’

‘চুপ করো! ওসব তুমি বুঝবা না। রাজনীতি করলে অনেক কিছুই করতে হয়। মানতে হয়।’

রেদোয়ান আহমেদ গলা নামিয়ে বলেন।

‘স্যার, এটা কেমন রাজনীতি? আপনাদের চেতনা বলতে কিছু নাই? এই জন্যই কি দেশ স্বাধীন করছেন!’

আন্দুর প্রশ্নগুলো বুলেটের মত বুকে বিঁধলো। রেদোয়ান আহমেদ আবারো দু’ ঠোঁটের সামনে আঙ্গুল তুলে ও চোখ বড় করে ইশারায় আন্দুকে চুপ করতে বললেন। কিন্তু আন্দু তার হুঁশিয়ারী ইঙ্গিতকে উপেক্ষা করে বললো,

‘স্যার, আপনারে দেবতা ভাইবা সালাম করতে আইছিলাম। কিন্তু অহন আপনার প্রতি ঘেন্না ধইরা গেল। রাজনীতির জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধা হইয়া রাজাকার লইয়া ঘুরতাছেন, এইটা দেইখ্যা আমার লজ্জায় মইরা যাইতে ইচ্ছা করতাছে!’

‘এই চুপ!’

‘ওয়াক থু!’ বলে আন্দু এক দলা থু থু ছুঁড়ে দেয়। এই থু থু কি রেদোয়ান আহমেদের প্রতি? কথাটি ভাবতেই তার গা গুলিয়ে গেল। আন্দু টাকাগুলো রেদোয়ান আহমেদের সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

‘যারা রাজাকার লইয়া ঘুরে, তার টাকা আমি নেই না! এই লন আপনার টাকা।’

রেদোয়ান আহমেদ হতভম্ব। আন্দু টাকাগুলো রেদোয়ান আহমেদের সামনে ছুঁড়ে দিয়ে হন হন করে চলে গেল। যাবার সময় সে আরেকবার ‘ওয়াক থু!’ বলে থু থু ফেললো। রেদোয়ান আহমেদের শরীর ও মন একসাথে কেঁপে উঠলো। ভেতরে কেমন একটা ভাঙন হচ্ছে। তার ভেতরে অন্য একটা মানুষ যেন জেগে ওঠছে। সব কিছু ঘটছে খুব দ্রুত। এ সময় গাড়ির জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী বললেন,

‘গাড়িতে উঠুন। জনসভার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে!’

সাঈদীর কথায় পা বাড়াতে গিয়ে থমকে গেলেন রেদোয়ান আহমেদ। তার পা যেন অনড় পাথর হয়ে গেছে। একটুও নড়ছে না। রাজাকার সাঈদীকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে যাবেন কিনা-এই প্রশ্নে তিনি এই প্রথম ফিন্সজ হয়ে গেলেন। মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াল দিনগুলোর স্মৃতি ছোবল মারতে লাগলো তার বোধে।

লেখকের ইমেইল: darpankabir @ ইয়াহু ডট কম

(লেখাটি www.nybangla.com প্রথম প্রকাশিত হয়)


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

গল্পের জিস্টটুকু ভালো কিন্তু গল্প হিসেবে ততটা ভালো লাগেনি। প্রথম থেকে লেখক যে আগ্রহটাকে ধরে রেখেছিলেন সেটা মাঝপথে হারিয়ে যায়। পরিপূর্ণতা পায় না।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অমিত আহমেদ এর ছবি

ভাল লেগেছে।
তবে লেখকের লেখায় বাংলাদেশের এক জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।


একটা ঝলসে যাওয়া বিকেল বেলা, একটা লালচে সাগরের জলে
যায় ভেসে যায় স্বপ্ন বোঝাই, নৌকা আমার কাগজের...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।