নিয়মতান্ত্রিক উত্সাহ কি সৃষ্টিশীলতায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়?

শাহ্ আসাদুজ্জামান এর ছবি
লিখেছেন শাহ্ আসাদুজ্জামান [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ০৩/০২/২০০৯ - ১১:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার লেখাটাকে কেউ যদি ভাল্লাগলো বলেন, তাহলে মনটা গলে যায়। সেই আনন্দে পরদিনই আবার আরেকটা নতুন লেখা লিখি। আমার তিন বছরের শিশুটা যখন তার খেলনা গুলো দিয়ে অভিনব কোন কাণ্ড ঘটিয়ে বসে, আমি তখন "বাহ ! চমত্কার!" না বলে পারি না। সেও তার সৃষ্টির সম্মতির আশায় আমার অন্ততঃ একটু হাসি দেখবার জন্য পাগল হয়ে আমাকে ডাকে।

কিন্তু এখানেই একটা ধাঁধা আছে। সৃষ্টির স্বতঃস্ফুর্ত আনন্দে আনন্দিত হয়ে সে যে সেটার সম্মতি চায়, এটুকু পর্যন্ত বোধহয় স্বাভাবিক। কিন্তু যখনই ঐ স্বতঃস্ফুর্ত আনন্দের চেয়ে তার সম্মতিপ্রাপ্তির আনন্দটা প্রধান হয়ে ওঠে, তখনই ঘটে বিপত্তি। ধীরে ধীরে সে তার সৃষ্টিশীলতা হারিয়ে সম্মতিলাভের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এটা ঘটে, যখন আমার "বাহ! চমত্কার" একটি নিয়মতান্ত্রিকতায় পরিণত হয়, আমি তার সৃষ্টির প্রকৃত রসাস্বাদন না করে, সৃষ্টির প্রয়োজনীয় সমালোচনা না করে কেবল "বাহ্ চমত্কার" বলেই তৃপ্ত হই।

এটা শুধু শিশুমনে না, বয়স্ক মনেও অহরহ ঘটে। স্কুল পাঠে নব-উপলব্ধি বা সৃষ্টির আনন্দের চাইতে ফার্স্ট হবার প্রতি মোহটাও একই সূত্রে গাঁথা -- সেটাও ঘটে সেরা নম্বর ধারীকে আমরা প্রতিনিয়তঃ প্রশংসা করি বলেই। একটা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র আমরা স্বততঃ সক্রিয় রাখি বলেই।

এই প্রতিযোগিতাই সৃষ্টিশীলতার একটা বড় অন্তরায় হয়ে দাড়ায়। কবি কবিতা লেখেন শব্দের মালা গাঁথতে তার নেশার আনন্দে, মুগ্ধ হন সেই মালার পূর্ণযৌবনা দেহবল্লরীতে। কেউ তার কবিতা পড়ল, কেউ দুএকবার চমতকার! বলল, সেটার একটা মোহ থাকাটা স্বাভাবিক বটে, তবে সেটা সবসময়েই তাঁর সৃষ্টিনেশার তুলনায় নস্যি। কিন্তু, যদি ঐ চমত্কার বলাটা একটা স্বততঃ পালনীয় একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়, এবং তার উপর সেই প্রশংসার সংখ্যা গুণে তাকে অর্থের মত একটা ক্ষমতা দেয়া হয় যা প্রকারান্তরে সৃষ্টিকে পণ্যেই পরিণত করে, তাহলেই বোধ করি সেটা সৃষ্টির প্রগতিতে একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

ধারণাটা ঠিক আমার নিজের নয়। আম্রিকার এক স্কুল শিক্ষক এবং শিশুমনস্তাত্বিক আলফি কোহন মনে হয় পশ্চিমে এই ধারণার সবচে পরিচিত বক্তা।

এইবার কইনচাইন দেহি -- সচলে শুনছি বাঘা বাঘা লেখকেরা অতিথি থেইকা পুরা সচল হয়াই আবার অচল হয়া যান। এমুন্ডা হয় কেন্?


মন্তব্য

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

বাঘা লেখক নই; আছিও প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে, তাই অতিথিকাল কাটাতে হয় নাই। তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমিও ভেগে যাই। হাসি

সময়ের অভাবে যেমন লেখার আকার ছোট হচ্ছে, তেমনি মন্তব্যের আকারও ছোট হচ্ছে। জগতেরই নিয়ম। একটানে অনেক গুলো লেখা পড়ে যাই, তাই "ভাল্লাগ্লো"র বাইরে লেখা হয় কম।

আরেকটা কারণ হল অস্থিরতা। এটাও কালেরই ফল। গভীর কোন চিন্তায় যাওয়ার মত স্থিতি কমই পাই। কথাচ্ছলে মন্তব্য করে যাওয়া হয় প্রচুর, তাই।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- "বাহ! চমৎকার" তো অনেক বড় শব্দ। "হ" শব্দটাকে তাহলে কেমনে দেখবেন আপনি?
এই 'হ' শব্দটার মধ্যেই কিন্তু তাবৎ দুনিয়ার বিন্দু বিসর্গ লুকিয়ে আছে, আমার এমনটাই বিশ্বাস। অতএব, লিখে যান। গোলাগুলি, পাঁঞ্চাল আলহামদু, শুভকামান, চুলকাচুলকি, হাহাপগে- যে যা খুশি মন্তব্যের ঘরে বলে যাক।
আর হ্যাঁ, শেষে এসে লাখ টাকার একটা কোয়েচ্চন করেছেন দেখি। আসলেই পাবলিক মেহমান থেকে মেজবান হয়ে গেলেই এমনে কাটাপাতলা দেয় ক্যান বুঝিনা! চিন্তিত
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

শাহ্ আসাদুজ্জামান এর ছবি

@ইশতিয়াক : লেখাটা আপনিই যখন প্রথম গায়ে মাখলেন, তখন বুঝলাম আপনিই "ভাল্লাগ্লো" শব্দটা সবচে বেশী ব্যবহার করেন।

তারপর ধূসর ও যখন একই ধাচের একটা মন্তব্য করলেন, তখন বুঝলাম, আমার প্রকাশভঙ্গীতে আসলেই দুর্বলতা আছে। আসল কথাটা লেখার তলেই পড়ে গেছে, ভুমিকা আর উপসংহারের দুটো বাক্যই বুঝি শেষমেষ হয়ে গেছে লেখার ভারকেন্দ্র!

এটা ঠিক, ধূসর যেটাকে লাখ টাকার প্রশ্ন বল্লেন, সেই প্রশ্নের একটা উত্তর খুঁজতে গিয়েই এই বিষয়ের অবতারণা। তবে তা বলতে গিয়ে যে "নিয়মতান্ত্রিক প্রশংসা" বা "প্রশংসা লাভের প্রতিযোগিতা"র কথা বললাম, সেটার উপস্থিতি কিন্তু সমাজে ব্যাপক। সচলের উদাহরনটা সচলায়তনের প্রাসঙ্গিকতা থেকেই উল্লেখ করেছি যদিও, ওটাই লেখাটার মূল উদ্দেশ্য বোধ হয় ছিলনা।

যেমন ধরুন আমাদের বুয়েটের বেশ পরিচিত এবং জনপ্রিয় একজন শিক্ষক ডঃ কায়কোবাদ, যিনি প্রায়শই পত্র-পত্রিকাতে লিখেন। যখন মাধ্যমিক-উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষাগুলোতে নম্বরের ইদুর-দৌড় তুলে দিয়ে গ্রেডিং ব্যবস্থা চালু করা হল, তখন কায়কোবাদ স্যারকে দেখেছি বেশকয়েক জায়গায় প্রতিযোগিতার পক্ষে তাঁর শাণিত কলম চালাতে। এ ঘটনা এটাই বলে যে "প্রতিযোগিতা সৃষ্টিশীলতার অন্তরায়" এই ধারণাটা আমাদের সমাজে এখনো যথেষ্ট বিস্তৃত নয়।

আর সচলের উদাহরণে যদি ফিরে আসি, আমি কিন্তু "ভাল্লাগ্লো" / "হ" / "গোলাগুলি" / "শুভকামান" এসবের বিপক্ষে বলিনি, আলফিও বোধ হয় তা বলেন না। এগুলো বরং লেখককে তার লেখার এবং চিন্তার বিকাশ ঘটাতেই সাহায্য করে।

যেটা বলছিলাম, তা হল প্রশংসা যখন নৈমিত্তিক হয়, তাকে যখন অর্থের মত গণনা করা হয় এবং সেই গণনার ফল যখন কোন প্রাপ্তির নিয়ামক হিসাবে ব্যবহৃত হয়, তখনই তা
সৃষ্টিশীলতার পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়।

শিশু যখন তার সৃষ্টিশীল কাজের স্বীকৃতি লাভে উন্মুখ হয়, তখন তাকে বাহবা দেয়া অযৌক্তিক নয়। কিন্তু বাহবা যদি এমন পর্যায়ে পৌছে, যখন শিশু তার বন্ধুকে ডেকে গর্ব করে বলে দ্যাখ, আজকে আমি ১০টা বাহবা পেয়েছি (কিম্বা ১০ টা স্টার পেয়েছি), তখনই সেটা সৃষ্টিশীলতার পরিপন্থী হয়।

যাহোক, সচলের লাখ টাকার প্রশ্নটার পুরো উত্তর বোধ করি এই তত্ত্বটা দিতে পারে না। তবুও একটু ভাবনার উদ্রেক করতে চাইলাম আরকি! মূল বিষয়টা নিয়ে কেউ কোন মন্তব্য দিলে ভাবনাটার আরেকটু বিকাশ হয় বৈকি!

off-topic: @ইশতিয়াক - বানান মাস কোথায় গেল?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।