গেমটা প্রায় শেষ করে এনেছে হারামী।
এ তো আর এ্যাংরি বার্ডস বা পকেট ট্যাঙ্কস নয়, যে ফেসবুকের ফাঁকে ফাঁকে দু-চার মিনিট খেলে মিনিটের মজা লুটে নেব। এ হচ্ছে মিশন গেম। অনেকগুলো স্টেজ, অনেক অনেক শত্রু। সবগুলোকে শেষ করতে পারলে তবেই না বিজয় মুকুট ঘরে এসে ধরা দেবে।
পাঁচ স্টেজের গেম। প্রথম স্টেজে হারামীর বাপকে মেরে ফেলা হয়েছিলো। সে কুড়ি বছর আগের কথা। কে বা কারা যেন রাতের অন্ধকারে হারামীর বাপকে মেরে গুম করে ফেলে। হারামীর মা এতো দিন তার কাছ থেকে এই সত্য লুকিয়ে রেখেছিলেন। বলতেন, তোর বাপ এ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। হারামী আঠারোতে পা দেয়া মাত্রই তিনি ছেলের কাছে সত্য খোলাসা করেন। যথারীতি সিনেমার নায়কদের মত হারামী তার বাপের খুনীদের খুঁজতে বেরোয়। পথে অনেক বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে বাপের হত্যাকারীদের খুঁজে পায় সে। একে একে সবকটাকে লাশ বানিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয় সে। এইখানেই সে জানতে পারে, মাস্টার বাস্টার্ড নামে একজন আছে, যে কিনা তার বাপের খুনের সব প্ল্যান-প্রোগ্রাম করেছিলো। ঐ ব্যাটাই রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
শুরু হয় হারামীর দ্বিতীয় স্টেজ। এই স্টেজের নাম 'রাইজ অফ দ্যা ইভিল'। এইখানে এসে হারামীর পাওয়ার কিছুটা কমিয়ে দেয়া হয়। আর মাস্টার বাস্টার্ড-দের পাওয়ার বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দেয়া হয়। ফলশ্রুতিতে হারামী এই স্টেজে বেশ ধুঁকতে থাকে। তার প্রিয় ঘোড়া 'মিশন' এক পর্যায়ে মারা পড়ে। অস্ত্র ও খাদ্য সঙ্কটে পড়ে হারামী।
এক গরিব ক্ষকের বাড়িতে আশ্রয় নেয় সে। ক্ষক বুড়ো মানুষ। হারামীর বাপের বাল্যবন্ধু টাইপ। হারামীকে দেখে সে অশ্রুজল সংবরণ করতে পারে না। তাদের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হয়ঃ
তুই তোর মায়ের চোখ পেয়েছিস।
সবাই তাই বলে।
আর বাপের সাহস।
সবাই এটাও বলে।
তাদের কথাবার্তা এর বেশি এগোয় না। নিজ গাইয়ের দুধ দিয়ে হারামীকে আপ্যায়ন করে সেই ক্ষক। এর মধ্যেই মাস্টার বাস্টার্ডরা হারামীকে আক্রমণ করে। হারামী কোনমতে পালিয়ে বাঁচে। মারা পড়ে গরিব ক্ষক। হারামীর বাপের বাল্যবন্ধু। তার ভিটেমাটি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। বাড়িতে তার অসুস্থ বউ ও তরুণী কন্যা ছিল। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, পরবর্তী স্টেজগুলোতে তা আর জানা যায় না।
ত্তীয় স্টেজে হারামী এক বন্ধুর দেখা পায়। বন্ধুটি বিশালদেহী। নরখাদক হিসেবে তার কিছুটা দুর্নাম আছে। আশেপাশের সবাইকে সে গিলে গিলে এই মোটা হয়েছে। 'গডফাদার' এর টি-শার্ট পরা তার গায়ে।
মদিরার গেলাসে চুমুক দিতে দিতে সে ইংরেজি কপচায়ঃ
আই উইল মেইক ইউ এ্যান অফার ইউ ক্যানট রিফিউজ।
প্রসীড।
বন্ধু তাকে অস্ত্রশস্ত্র ও জনবল দিয়ে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়। বিনিময়ে চায় নিঃশর্ত আনুগত্য।
হারামী তাতে রাজি হয় না। সে বাজুকা দিয়ে ঐ শত্রুকে খতম করার চেষ্টা করে। তাতে অবশ্য বিশেষ লাভ হয় না। শত্রু ভয়ানক শক্তিশালী। বাজুকার আঘাতে তার কোন ক্ষতি হবার নয়।
হারামী আবার পালায়। তার শত্রুসংখ্যা বেড়ে এখন দুইয়ে দাঁড়াল। মাস্টার বাস্টার্ড আর বাজুকা ইস্কেপার।
স্টেজের শেষদিকে এসে শহরে আগুন জ্বলে ওঠে। হারামীর উপর দায়িত্ব পড়ে আগুন থেকে জনমানুষকে বাঁচানোর। একজনকে বাঁচালে পাঁচটি করে পয়েন্ট পাওয়া যাবে। একশো পয়েন্ট পেলেই নেক্সট রাউন্ডে যেতে পারবে সে।
হারামী এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। স্পাইডারম্যানের মত গ্রেট পাওয়ার ও গ্রেট রেসপনসিবিলিটি নিয়ে সে বিশটা মানুষকে আগুনের হাত থেকে বাঁচালো। আরো অনেক মানুষ তখনো আগুনের মধ্যে ছিল। তাদেরকে বাঁচালে সে বোনাস পয়েন্ট পেত। কিন্তু, হারামীর হাতে সময় নেই। এমনিতেই গেম ওভার করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গেম ওভার করতে না পারলে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। এর মধ্যে হারামীর আম্রিকান ফেসবুক ফ্রেণ্ডরা সবাই গেম ওভার করে নতুন গেম স্টার্ট করেছে। এই শালা ইহুদী-নাসারাগুলো সব জায়গাতেই ফাস্ট।
এদিকে হারামীর মা হারামীকে ডাকছে।
বাবা, লাঞ্চ করবি না?
আ'ম বিজি মম।
বার্গারটায় একটা কামড় দিয়ে যা অন্তত।
হারামী বার্গারে কামড় দিয়ে আসে। সঙ্গে তার প্রিয় আইটেম 'টিরামিসু'। কিংস কনফেকশনারী থেকে আসে এই মেনু। হারামীর খুব পছন্দের।
ঐদিকে ভার্চুয়াল মানুষগুলো সদলে চিৎকার চেঁচামেচি করে চলেছে। হারামী শেষ পিজার টুকরোটা পেটে নামিয়েই খেলতে বসে। হারামীর মা পাশে বসে বসে তার খেলা দেখেন। এককালে তিনিও দিনরাত এই খেলা নিয়ে মেতে থাকতেন। সবাই বলে, মানুষ মারার মধ্যে এক ধরনের পাশবিক আনন্দ আছে। হারামীর মা জানেন, কথাটা ভুল। আসলে মানুষ মারার মধ্যে এক ধরনের ঐশ্বরিক আনন্দ আছে। যতোক্ষণ গেইম অন, নিজেকে ঈশ্বর ঈশ্বর মনে হয়। দোজ ফাকিং গোল্ডেন ডেইজ, একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে প্রৌঢ়ার মুখ দিয়ে।
এইবার হারামীর পকেটে বেশ অস্ত্রশস্ত্র এসেছে। চাইনিজ কুড়াল থেকে শুরু করে আম্রিকান মেশিনগান। লাইফ স্ট্রেংথ-ও অত্যন্ত ব্রাইট দেখাচ্ছে। এইবার সবগুলাকে পিটিয়ে তক্তা বানানো যাবে। হারামীকে তিনটে 'চাল্লি'ও দেয়া হয়েছে এবার। এরা শহরময় মাস্টার বাস্টার্ড আর বাজুকা ইস্কেপারকে খুঁজে বেড়াবে। হারামী এদের গতিবিধি কনট্রোল করবে শুধু।
যা করার এই স্টেজেই করতে হবে। ফাইনাল স্টেজটা নাকি খুব কঠিন। অতএব, ধর তক্তা, মারো পেরেক।
হারামীর চাল্লিরা শহরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্কুল-কলেজ-বাজার, নাইট ক্লাব, রেস্তোরা, হাসপাতাল---সব চষে বেড়াচ্ছে। সামনে যাকে পাচ্ছে, তারই ধড় উড়িয়ে দিচ্ছে। দুই ধরণের মানুষ আছে এইখানে। আম জনতা আর আঙুর জনতা। আম জনতার গায়ে কিছু লেখা থাকে না। এদের মেরে খুব বেশি পয়েন্ট পাওয়া যায় না। একজনে এক পয়েন্ট। তবে, একসাথে অনেকগুলোকে পুড়িয়ে মারলে বা বোমা বিস্ফোরণে মারলে মোটামুটি কেল্লা ফতে। এক ঢিলে শ'খানেক পয়েন্ট পাওয়া যায় তখন। আঙুর জনতা কিঞ্চিৎ স্পেশাল। এদের একজনকে মারলে পাঁচ পয়েন্ট। এদের জামার গায়ে আবার 'আপেল' আঁকা থাকে। আঙুর জনতার গায়ের জামায় কেন 'আপেল' আঁকা থাকবে---বিষয়টা নিয়ে খানিকক্ষণ ভেবেছে হারামী। কোন কূলকিনারা করতে পারেনি।
তবে, আঙুর জনতাকে মারাটা একটু টাফ। প্রথমত, এদের খুঁজে পাওয়াটা কঠিন। যেহেতু এরা দল বেঁধে থাকে না। দ্বিতীয়ত, এদের একজনকে মারতে গেলে অন্যরা হৈহৈ করে তেড়ে আসে। আমজনতাকে মেরে সেই তুলনায় আরাম আছে। একটাকে মারলে অন্যগুলো ফিরেও তাকায় না। কতগুলো হতচ্ছাড়া দাঁত কেলিয়ে হাসতে থাকে। কতগুলো আবার টকাস টকাস করে একে অন্যকে চুমু খায়। চুমু খাবার ব্যাপারটা সম্ভবত গেইমের টিআরপি বাড়ানোর জন্য। আজকাল তো পাঠ্যবই-ও সেক্স ছাড়া বিক্রি হয় না, গেইম তো কোন ছাড়।
এইমাত্র একটাকে মেরে আরো একটা পয়েন্ট কামিয়েছে হারামীর চ্যালারা। এক হাজার এক পয়েন্ট হলেই নেক্সট রাউন্ড ক্লিয়ার। এই সময়...শালার এই সময়টাতেই কারেন্ট চলে গেল। 'ফাক', হারামীর মুখ দিয়ে আপনাআপনি বেরিয়ে গেলো। এতো কষ্ট করে এতো এতো ক্যারেক্টার মেরে...এইডা কিসু হইলো?
এখন আবার গেম রিলোড দিতে হবে।
অবশ্য ফোর্থ স্টেজটা খেলে আরাম আছে। ভার্চুয়াল ক্যারেক্টারগুলোর লাইফ স্ট্রেংথ খুবই কম। অস্ত্রশস্ত্রও নাই বললেই চলে। মাস্টার কিলার আর বাজুকা ইস্কেপারকে মোকাবেলা করার আগে এদেরকে মেরে ভালোই একটা ওয়ার্ম-আপ হয়ে যাবে।
হারামী এই সুযোগে বাইরে তার বন্ধুদের সাথে খেলতে যায়। হারামীর মা তাকে পেছন থেকে ডাক দেন,
বাবা কারেন্ট আসলে গেমটা আমি ওভার করি?
কিন্তু আমি তো গেমটা প্রায় শেষ করে এ্নেছিলাম। এখন আবার তুমি বসবা?
অনেকদিন খেলি না রে। তুই না হয় আবার খেলিস।
আচ্ছা, ঠিকাসে। নিতান্ত অনিচ্ছায় রাজি হয় সে।
হারামীর মা গভীর আগ্রহে ইলেকট্রিসিটি আসার জন্য অপেক্ষা করছে। মানুষের নেশায় তার চোখ দুটো চকচক করছে।
মন্তব্য
প্রথমতঃ নামকরণটা ভালো লাগেনি। কনসেপ্ট ভালো। হয়তো ধরতে পেরেছি মূল ধারাটা। আমার ভালোই লেগেছে
ডাকঘর | ছবিঘর
ধন্যবাদ, দাদা
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
#দারুন লিখেছেন। শুভেচ্ছা আপনাকে
আশরাফুল কবীর
ধন্যবাদ
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
নতুন মন্তব্য করুন