তাকে ডেকেছিলো ধূলিমাখা চাঁদ,/মধ্য দুপুর;/বুকের মাঝে হিম সন্ধ্যার/নিথর পুকুর। সেজুঁতির জন্য এ কবিতা লিখেছিলো দীপু। কথা ছিলো - পহেলা বৈশাখে কবিতা ব্লক করা শাড়ী পরে সেজুঁতি ক্যাম্পাসে আসবে। কথা ছিলো - 'উচ্ছ্বাস' নামের সংগঠনের ব্যানারে উৎসবে মাতবে একদল তরুণ প্রাণ।
এ আয়োজনের পরিকল্পনায় মিটিং ডাকে - আপাত: রাজনীতির বাইরে সিনিয়র-জুনিয়র কিছু ছেলেমেয়ে, এদের কেউ বিতার্কিক, কেউ গায়ক, গীটার বাদক, নীরব কবি এবং সবাই নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। উৎসব আয়োজনে অভিজ্ঞ, সম্প্রতি রাজনীতি ছেড়ে দেয়া, আনিস আসে মিটিংয়ে - উপন্যাসের শুরু এখানে। ক্যাম্পাসে আনিসের প্রবেশ থেকে মিটিং রুমে আসার বিবরণ বেশ দীর্ঘ। ক্যাম্পাসে আনিস হাঁটে, ক্যান্টিন পার হয় - আনিসের মাথার ভেতর বয়ে চলা তড়িৎ চিন্তার সাথে পাঠক জানে ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক হালচাল, কোন্দল আর গুটিচাল। বিক্ষিপ্ত এসব বিবরণে একটু ক্লান্তি আসে, তবে ততক্ষণে পাঠক হয়ে উঠে উচ্ছ্বাস'এর একজন।
এরপর মনে হয় - উপন্যাসের মূল চরিত্র আনিস নয়, দীপু। দীপুর মা মারা গেছে, ভাই বোন নেই, বাবা নিরুদ্দেশ। চাচা-চাচীর সংসারে অনাকাঙ্খিত জীবন, টিউশনি করে চলা এবং উচ্ছ্বাসের জন্য মন-প্রাণ নিবেদনে দীপু পাঠকের আপন হয়ে ওঠে দ্রুত। অথচ কোনো কিছুই দীপু ঠিকমতো করতে পারে না, অস্থিরতায় কিছু ভুলচুক থেকেই যায় এবং নীরবে কান্না ঢাকে। এখানে কাহিনী ক্রমশ: দীপুকে ঘিরে চলতে পারতো, তা না করে আমরা দেখি - আবার আনিসের প্রাধান্য। কারিশমায় আনিস ছাড়িয়ে যায় দীপুকে; গল্পের সুপারম্যান নয়, বরং ঠান্ডা মাথার দূর্দান্ত যৌক্তিক এক মানুষ আনিস - শান্ত অথচ ব্যস্ত হিরো। আনিসের দর্শন আর ভাবনা আসে ঘটনা পরম্পরায়। নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা আর তাৎক্ষনিক বুদ্ধিমত্তার মিশেলে পরপর দু'বার কলেজ প্রিন্সিপাল থেকে উৎসবের অনুমতি আদায় করে নেয় আনিস। অথচ তার চারপাশে তখন পথ আঁটকায় প্রশাসনিক বেড়াজাল, রাজনৈতিক ক্যাকটাস, যেখানে প্রিন্সিপাল-বদরুল-ফয়েজ-তৌহিদ একই রকম। জটিল রাজনৈতিক হিসাবের গরমিল খাতে পড়ে উচ্ছ্বাস উৎসব।
এরপরও আমরা দেখি - বর্ষবরণের আয়োজন চলে। কাহিনী ডালপালা ছড়ায় লতার মতো - প্রিয় ক্যাম্পাসে, নিজস্ব পরিসরে ধীরলয়ে - অহেতূক ঘটনা বৃদ্ধিতে যায়নি। কেবল মোরশেদ চরিত্রটিকে মনে হয়েছে লেখক বড্ডো অযতনে ভুলে গেছেন কিংবা বেশি যতনে শোপিচ করে রেখেছেন। ভারতে পড়ালেখা করা মোরশেদ অ্যাকাডেমিক মানুষ, গ্রাফিক্স ভালো বুঝে, নিজে লিটিলম্যাগ বের করে, সাহায্যপরায়ণ লোক - যে দীপুর সাথে মজা করে চা খায়, কবিতা নিয়ে জ্ঞান দেয় - অথচ উপন্যাসের মূল স্রোতের বাইরে থেকে যায় শেষ পর্যন্ত। মোরশেদ কি তবে জনবিচ্ছিন্ন তাত্ত্বিক গুরুদের ছায়া চরিত্র!
দিনের ক্যাম্পাসে উচ্ছ্বাস কর্মীদের ছোটাছুটি, দীপু-সেজুঁতির খানিক কাছে আসা আর মাঝরাতে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে সৃষ্টির আনন্দে কাজ করে কিছু চিত্রশিল্পী - শাহআলম, আপেল, সেতু, দীপুসহ অন্যরা। সে রাতে হুমকির আচঁড় কাটতে চায় তওহীদ - ধর্মের নষ্ট ব্যবহারে বিষন্ন হয় মান্না, কষ্ট পায় দীপু এবং পাঠক। ঘোলাটে সময়টা তখন রাতে আরেকটু স্পষ্ট হয়।
এ আঁধার আর কাটে না। বুক পকেটে ধুলিমাখা চাঁদের কবিতা ডাক নিয়ে সেজুঁতির খোঁজে ক্যাম্পাসে যাওয়া দীপু সেজুঁতিকে পায় না, বাক-বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে ফয়েজদের সাথে। পড়ন্ত বিকেল, সন্ধ্যা শেষে রাত আসে, দীপু ঘরে ফিরতে চায় অথচ ফিরতে পারে না। পরদিন চারপাশে নীরবতা আর ঘনিয়ে আসা একরাশ অন্ধকারে একাকী দাড়িয়ে থাকে আনিস।
উপন্যাসের পরিশিষ্টে জানা যায় - সিলেট এমসি কলেজের সত্য ঘটনা অবলম্বনে এ কাহিনী লেখা। বোধ করি - সে জন্যই লেখক পুরো আখ্যানে সময়কে নয়, ঘটনাকে ধরতে চেয়েছেন। এবং গতিময় গদ্যে একটি ছিমছাপ উপন্যাস পাঠককে উপহার দিয়েছেন।
টুকটাক কিছু বানান বিভ্রাট দ্রুত গতির এ গল্পে এড়ানো যায় সহজেই, তবে একই মলাটে উপন্যাসের নামে ডেকেছিল/ডেকেছিলো - ধূলিমাখা/ধুলিমাখা একটু চোখে লাগে।
এক সময়কার রাজনীতি সংশ্লিষ্ট মানুষ, সৌখিন (!) সাংবাদিক, জনপ্রিয় ব্লগার আরিফ জেবতিক তাঁর নিজস্ব ধাঁচে আগামীতে আরও বড় আখ্যান নিয়ে হাজির হবেন আমাদের সামনে এমনটিই আশা করছি। তবে "তাকে ডেকেছিল ধূলিমাখা চাঁদ" পড়ার পরে পাঠকের প্রত্যাশাটি দাবী হয়ে যায়!
মন্তব্য
শাহ আলমের করা পোস্টার
সত্য ঘটনা নিয়ে প্রায় সত্যের মতো করে লেখা আরিফের উপন্যাসটা আমার কাছে অনেকটা স্মৃতির
ঘটনার সাথে না থাকলেও ঘটনার সাথে যে মানুষগুলো তার প্রায় সবাই পরিচিত
আর যে ঘটনাগুলো সেগুলোরও প্রায় সবটার একটু দূরের দর্শক
তবে উপন্যাসটায় আরিফের সাংবাদিকতার প্রভাব মাঝে মাঝে ডিস্টার্ব করেছে
০২
এই ঘটনারই একজন শিল্পী শাহ আলম। একেবারে বাস্তব একজন শিল্পী। কিন্তু এখন আর নেই
শাহ আলমকে নিয়ে আমার লেখা বোকাসূত্র
ধন্যবাদ, লীলেন ভাই। বোকাসূত্র পড়ে আসলাম আপনার ব্লগে।
আগে অন্য ব্লগে পড়েছিলাম আলবাব ভাইয়ের এই লেখা।
বেশ লাগলো রিভিউ পড়তে।
উপন্যাসটা পড়ার খোঁচা টের পাচ্ছি এবার ...
@ লীলেন
অসাধারণ কার্টুন তো! শাহ আলম তো বস পাবলিক!
___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
বইটা পড়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
শিমুলের রিভিউ বরাবরই গঠনমূলক, বিশ্লেষনধর্মী।
...শাহ আলম-এর সুন্দর কার্টুনটির জন্য মাহবুব লীলেন-কে ধন্যবাদ।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
অত চুলচেরা হিসেব করে পড়তে জানি না আমি।
তবে উপন্যাসটা ভালো লেগেছে।
আমিও যেন ওখানে কোথাও ছিলাম।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
বইটা পড়া হয় নাই।শিমুল ভাইয়ের দারুণ রিভিউ এর পর পড়তে ইচ্ছা হচ্ছে।লন্ডনে এই বই পাওয়া যাবে কি না এটাই দেখার বিষয়।
শিমুল ভাই,কোন প্রকাশনী থেকে বইটা বের হয়েছিলো??
--------------------------------------------------------
শেষ কথা যা হোলো না...বুঝে নিও নিছক কল্পনা...
---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন
লন্ডনে পাওয়া গেলে তো ভালোই হতো। অনেক বাংলা পাঠক আছেন সেখানে।
বইয়ের প্রকাশক - জাগৃতি ।
----------------------------------------
শমন,শেকল,ডানা
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
Validation error, please try again. If this error persists, please contact the site administrator. -- এইটা কি ম্যাসেজ দেখায়?
চমৎকার হয়েছে পাঠ প্রতিক্রিয়া
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
রিভিউটাই এত ভালো লাগল।.।.।.
উপন্যাসটা পড়লে নিশ্চয়ই মাথাই খারাপ হয়ে যাবে
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
আহা কতো অল্প কথায় কি দারুন রিভিউ। দারুন...
---------------------------------
এসো খেলি নতুন এক খেলা
দু'দলের হেরে যাবার প্রতিযোগিতা...
কবে যে পড়তে পারবো?
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
- হুমম। পড়তে হবে। সচল সংকলনের জার্মান-শিপমেন্টের সঙ্গে বাকি বইগুলোও পাবার আকাংখা প্রকাশ করছি।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
সবাইকে ধন্যবাদ।
বইটার জন্য ওয়েট করছি। দেখি পড়ে...
ধন্যবাদ, সুহৃদ রাশেদ ।
আগের পোস্ট এবং এই পোস্ট সবগুলো পড়ে, অতিথির ঘর পূরণ করে, কমেন্ট করার জন্য আপনার প্রতি সবিনয় কৃতজ্ঞতা । এবং আপনাকে অতিশয় জাঝা
নতুন মন্তব্য করুন