শহুরে পাখি মানুষ

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি
লিখেছেন আনোয়ার সাদাত শিমুল (তারিখ: বিষ্যুদ, ১২/০৬/২০০৮ - ২:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সেবার ঘরে ফেরার কথা ছিলো না।
কেবল গন্তব্যহীন যাত্রা – ক্রমাগত নিজেদের ছাড়িয়ে শহরের বাইরে।
সেদিন বৃষ্টি ছিলো এবং রোদ – কখনো মেঘলা আকাশ।

আমরা এসব দেখে দেখেই শহরের বাইরে যাই। মনের রোদ আর দমকা হাওয়া সঙ্গী হয় মাধবীর ঘ্রাণে। ভর দুপুরে একটা কোকিল ডেকে যায় আষাঢ়ের মাঝামাঝি। অথবা কোকিল ছিলো না, অন্য কোনো পাখি হবে হয়তো। না বুঝে আমরা কোকিল ধরে নিই, আর মুগ্ধ হই। অচেনা মেঠো পথে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, ছায়া নিরিবিলি – ঢিল মেরে বৃত্তাকার ঢেউ দেখা, তারপর পা ডুবিয়ে বসে থাকা ছেলে মানুষী।
ঝরে পড়া অচেনা ফুল বিনিময়ে বিশুদ্ধ মুগ্ধতার মুহুর্ত। নীরবতা।
আরো পরে, রোদ আরো কমলে সেই প্রথমবার হাত ধরা, প্রবল সাহসে। বুকের পুকুরের ঢেউ ক্রমশঃ পায়ে নেমে খানিক ছলাৎছল। তখন কোকিলের ডাক থেমে গেছে, কাছে বসা অপয়া এক শালিক পানিতে ঠোঁট ডুবিয়ে আবার উড়াল দেয়, সাথে তীব্র শীষ কাটা আওয়াজ। আমরা চোখাচোখি।

কালিদাসের কাল পেরিয়ে জীবনানন্দ – থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার।

সে জনারণ্যে আচমকা আইসক্রীম ভ্যানের আওয়াজে একদল খালি গা শিশু দৌড়ায়। আইসক্রীমের মোহ নয়, হয়তো ওদের দৌড়াতে ভালো লাগে। বণিক বেচারা কী করে বিলাবে সম্বল? বণিকের বাতাসে আমরা লোভী হই। বলি – আগামীর কথা, ঠিক এরকম – পথে দেখা গ্রাম, টিনের ঘর – ঝমঝম বৃষ্টি, খানিক স্বাস্থ্যবতী বউ, ঝোল মাখা ভাত। কেবল ভালোবাসাবাসি। এসব স্বপন বয়ানে আবার শহরে ফেরা – বিশাল ট্রাকে রাঁধুনি গুড়া মসলা - বিলবোর্ডে ফেয়ার এন্ড লাভলী – ক্রমশঃ বাণিজ্য ঘিরে রাখে, শাহ সিমেন্ট জন্ম সৃষ্টির লক্ষ্যে – ইটের পরে ইটে তুমি আর আমি, পাশে শাইনপুকুর অথবা কপোতাক্ষ প্রকল্প। ক্যাসেট প্লেয়ারে হেমন্ত বদলে গানস এন্ড রোজেস। চরম বৈপরীত্যে অবসাদ ক্লান্তি।

'আমরা তাহলে ঘরে ফিরে যাচ্ছি।'
'হ্যাঁ।'

ততক্ষণে লেনদেন হয়ে গেছে। কোমল পানীয় ডাক দেয় – ইটস ইয়্যুর লাইফ – কালার ইট। সাথে বার্জার – স্পর্শে জীবনের রঙ বদল। ট্রাফিকের হলুদ-লাল বাতির অপেক্ষা। বলি- 'পাখিটি কী কোকিল ছিল, নাকি শারষ?' এ শহরে পাখি কই? মানুষগুলো সব পাখি হয়ে গেছে – কাক, শালিক, বক। সময়ের রঙ। জীবনের পলেস্তারা।

তাহলে বণিকেরা জিতে গেলো? দালানের ভীড়ে অদেখা সূর্যাস্ত-সময়।
তারপর অনেকদিন অচেনা শহরে…
কর্পোরেট আমেজে ব্যস্ত মুঠোফোন – খানিক চেনা মুখ।
ভালোবাসাহীন মহীনের ঘোড়াগুলি – বেহালা চৌরাস্তায়, নিঃসঙ্গ সাথী - লোপামুদ্রা।
মাধবী লুকিয়ে আছে কোথাও। আমারই ফেরা এ শহরে কাঁচ ঘেরা কোনো ঘরে।


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

@ তারেক রহিমঃ
খসড়া লেখা আর পূর্ণ হয় না। সম্পাদকের টেবিলেও ছাড় পায় না। এভাবেই থাকে...

তারেক এর ছবি

আপনি খেয়াল করেছিলেন অনুরোধটা? শুধু খেয়াল করাই নয়, রাখলেন ও। কী বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাই শিমুল ভাই। এত চমৎকার খসড়াই সই হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হু... বণিকেরা আজকাল অনুভূতি কিনে নিচ্ছে... আপনার এই অনুভূতিগুলো খুব ভালো হয়েছে... কোম্পানিগুলো এরই তালাশে আছে...
এটাকেই একটু ছেঁটেছুটে বলে দেবে- আমরা ছাড়া আর কেইবা পারে এমন করে অনুভূতি প্রকাশ করতে? অনুভূতি প্রকাশে অমুক ফোন... এখন মাত্র ০.৫৯ পয়সা মিনিটে জীবনের সকল অনুভূতি প্রকাশ করুন।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

রানা মেহের এর ছবি

লেখাকে তিন।
নজরুল ইসলামের মন্তব্যে পাঁচ
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আমাদের হযবরল' এর লেখা একটা লাইন আমার মাথায় গেঁথে গেছে-
'এখন টিকিট কেটে জ্যোছনা দেখার কাল'

এই লেখা পড়ে ঐ লাইনটা আবার হ্যামারিং করলো ।

-------------------------------------
বালক জেনেছে কতোটা পথ গেলে ফেরার পথ নেই,
-ছিলো না কোন কালে;

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- এক পাখি হয়ে মানুষের আপাতঃ ঘরে ফেরার গান। গান শেষে মানুষ আবারো পাখি হয়ে উড়াল দেয় অন্য কোনো নীড়ের লক্ষ্যে, অন্য কোনো শহরে। এবার মানুষটি অন্য পাখি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাখিটি তার পূর্বস্বর ভুলে যায়, ডাকাডাকি করে সম্পূর্ণ নূতন এক সুরে। নূতন জায়গায়, নূতন শহরে, নূতন পাখি মানুষটি!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

সৌরভ এর ছবি

ফিরবো বললে ফেরা যায় নাকি,
পেরিয়েছো দেশ কাল জানোনা কি
এ সময়।
এখনো সামনে পথ হাঁটা বাকি
চাইলেও দিতে পারবে না ফাঁকি নিশ্চয়।

মহীনের ঘোড়াগুলি:: ঘরে ফেরার গান
-
একেবারে ফেরা হবে কি কখনো আমাদের?
আপনাকে আপাতত একটা বড়সড় মাইনাস, কয়েকদিন ভার্চুয়াল জগতে পাওয়া যাবে না বলে।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

সবই কি চলে যাবে বণিকদের দখলে?

মন-খারাপ-করা লেখা।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

কি খেয়ে লিখলেন?
ব্যপক কাব্যিকতার ছোঁয়া। অসাধারণ!
লেখাটার প্রতি এতো আঁকড়ে ছিলাম যে, বক্তব্যের যন্ত্রণা অতোটা গায়ে লাগে নাই। ফলে মন খারাপ করা লেখা হয়েও মন খারাপ হলো না।

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

কনফুসিয়াস এর ছবি

এই একটা আজব, তাই না?
এক ঘরে ফিরতে গেলে অন্য ঘরকে ছেড়ে যেতে হয়!

-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

তীরন্দাজ এর ছবি

তাহলে বণিকেরা জিতে গেলো? দালানের ভীড়ে অদেখা সূর্যাস্ত-সময়।
তারপর অনেকদিন অচেনা শহরে…
কর্পোরেট আমেজে ব্যস্ত মুঠোফোন – খানিক চেনা মুখ।
ভালোবাসাহীন মহীনের ঘোড়াগুলি – বেহালা চৌরাস্তায়, নিঃসঙ্গ সাথী - লোপামুদ্রা।
মাধবী লুকিয়ে আছে কোথাও। আমারই ফেরা এ শহরে কাঁচ ঘেরা কোনো ঘরে।

অদ্ভুত সুন্দর....!

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

মাধবী লুকিয়ে আছে কোথাও।
বিষন্ন ভালো লাগা...

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

খুব ভালো লাগলো। পড়তে পড়তে গ্রাম, পুকুরের পাড়, আইসক্রীমওয়ালা, শালিক, ছেলেপুলেদের দৌড়ানো, ট্রাফিক সিগন্যাল, এই নগর সভ্যতা সব দেখে এলাম। আপনার জন্য পাঁচ তারা, অকপটে।

তারেক এর ছবি

এরকম অনুভব করি। কিন্তু এত চমৎকার করে গুছিয়ে আনতে পারি না আর লেখায় হাসি

ছোটে রোদ্দুর সবুজের ফাঁকে ফাঁকে হরিণের মত
সোনালী বাদামী মেশা সারাদিন ধরে
খেলতে ডাকছে তাকে জংলা গন্ধে
হারিয়ে যাওয়ার নেশা।

যাপনের নিষ্প্রাণ কোলাহল আমাদের। শহুরে কর্পোরেট জীবনের ব্যস্ত বিভ্রম নিরন্তরমুছে ফেলে আত্মার গান। আমাদের সন্ধ্যা হয় মৃত, সকাল বন্ধ্যা সময়ের ছবি।
ধন্যি আমাদের ক্ষণিক পাখি-কাল। এক লহমার জন্যও যদি তা মুছে দিতে পারে গ্লানি... তবুও দিনশেষে তো সেই পুরনো চৌহদ্দি। ইট-পাথরের জেলহাজত। মন এবং শরীরের।

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

শেখ জলিল এর ছবি

লেখাটির টানেই লগইন করলাম। অদ্ভূত ভালোলাগা ভর করলো মনে। ক্যাটগরীতে 'অগল্প' ঠিকই আছে। আমার কাছে পরিপূর্ণ কবিতা মনে হয়েছে লেখাটিকে। শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

পরিবর্তনশীল এর ছবি

খুবই ভালো লাগল।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

সবাকেই ধন্যবাদ।

ঝরাপাতা এর ছবি

শিমুলীয়।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।